Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

ভীম নাগের সন্দেশ ছিল ‘বাংলার বাঘ’-এর প্রিয় মিষ্টি

সে কালের অনেক বাঙালির মতো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত না থাকলেও আধুনিক ভারতের নির্মাণ কালে তাঁর প্রয়াস, চিন্তাধারা ও অবদান কোনও অংশে কম ছিল না। শিক্ষার আলোয় তিনি চেয়েছিলেন সমাজের অন্ধকার আচ্ছন্ন দিকগুলি সংস্কার করতে। আর শিক্ষার মাধ্যমেই তিনি এক সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন যার ভিত্তিতেই পরবর্তী কালে ভারতবর্ষ গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হয়েছিল।

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

সে কালের অনেক বাঙালির মতো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত না থাকলেও আধুনিক ভারতের নির্মাণ কালে তাঁর প্রয়াস, চিন্তাধারা ও অবদান কোনও অংশে কম ছিল না। শিক্ষার আলোয় তিনি চেয়েছিলেন সমাজের অন্ধকার আচ্ছন্ন দিকগুলি সংস্কার করতে। আর শিক্ষার মাধ্যমেই তিনি এক সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন যার ভিত্তিতেই পরবর্তী কালে ভারতবর্ষ গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। একাধারে আইনজীবী, জুরি কিংবা বিচারক, অন্য দিকে এক শিক্ষাবিদ। আর এমনই সব কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে উঠেছিলেন ‘বাংলার বাঘ’। স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।

আশুতোষের জন্ম ১৮৬৪-র ২৯ জুন। তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত। তাঁর বাবা গঙ্গাপ্রসাদ, মা জগত্তারিণী দেবী। গঙ্গাপ্রসাদ পেশায় ছিলেন ডাক্তার। তিনি ভবানীপুর অঞ্চলে প্র্যাক্টিস শুরু করেছিলেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর পসার জমে ওঠে।

খুব ছোট বয়স থেকেই আশুতোষের প্রখর স্মৃতি শক্তির পরিচয় পেয়েছিলেন গঙ্গাপ্রসাদ। শোনা যায় স্কুলের ছাত্রাবস্থাতেই আশুতোষ মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট মুখস্থ বলতে পারতেন। ভবানীপুর চক্রবেড়িয়া স্কুলে আশুতোষের পড়াশুনা শুরু হয়েছিল। তবে দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় সাময়িক ভাবে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে ১২ বছর বয়সে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন ভবানীপুরের সাউথ সাবার্বন স্কুলে। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও লেখক শিবনাথ শাস্ত্রী। পরে ১৮৮৯ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এর পরে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে তাঁর সহপাঠী ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। কলেজে সহপাঠীদের চেয়ে সব বিষয়ে এগিয়ে ছিলেন আশুতোষ। সেই সময় থেকে বোঝা গিয়েছিল তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা।

১৮৮৪-তে তিনি বি.এ পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন সেই সঙ্গে ‘ঈশান ও ভিজিয়ানাগ্রাম’ বৃত্তি আর হরিশচন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেই বছরই তিনি লন্ডন সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। এর পরে অঙ্কে এম.এ পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। পরের বছর প্রেমচাঁদ বৃত্তি এবং পদার্থবিদ্যা নিয়ে দ্বিতীয় বার এম.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। বিশেষ উল্লেখযোগ্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনিই প্রথম ছাত্র, যিনি দু’টি বিষয়ে এম.এ পাশ করেছিলেন। মূলত পদার্থবিদ্যা ও অঙ্কে তাঁর আগ্রহ থাকলেও ইতিহাস, ইংরেজি সাহিত্য ও দর্শনের প্রতিও তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল।

১৮৮৭ থেকে ১৮৯১ পর্যন্ত তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ পরীক্ষায় অঙ্কের পরীক্ষক হিসেবে কাজ করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি পরীক্ষকের কাজ করেছিলেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই আইনের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। ১৮৮৫ সালে তিনি আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন এবং পরে বি.এল ডিগ্রি পেয়েছিলেন। আইন বিষয়ে গভীর জ্ঞানের জন্য তিনি স্বর্ণ পদক পেয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে থাকাকালীন তিনি বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ লিখেছিলেন।

২৫ বছর বয়সে তিনি গাণিতিক গবেষণার জগতে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পরে ‘জিওমেট্রিক্যাল কনিকস’ নামক শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। ১৮৮৫-এ তিনি ‘রয়্যাল অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল সোসাইটি অফ লন্ডন’ এবং ‘রয়্যাল সোসাইটি অফ এডিনবরা’-র ফেলো নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ ছাড়াও তিনি ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’-র সদস্য হয়েছিলেন।

ছাত্র থাকাকালীন কিংবা পরর্বতী সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ব্যাপারে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মতামত গৃহীত হয়েছিল। এমনকী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রেও তাঁর মূল্যবান মতামত গ্রহণ করা হয়েছিল।

১৮৮৬-তে তাঁর বিবাহ হয়েছিল যোগমায়া দেবীর সঙ্গে। তাঁর সন্তানদের মধ্যে অন্যতম শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।

১৮৮৮ সালে আশুতোষ কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে সিনিয়র হিসেবে পেয়েছিলেন প্রখ্যাত আইনবিদ রাসবিহারী ঘোষকে। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি অপ্রত্যাশিত সফলতা লাভ করেছিলেন। ১৯০৪ থেকে মৃত্যুর কয়েক মাস আগে পর্যন্ত দীর্ঘ ১৯ বছর তিনি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯২০তে অল্প সময়ের জন্য তিনি প্রধান বিচারপতির দায়িত্বও পালন করেছিলেন।

আশুতোষ ছিলেন বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন এক বিরল ব্যক্তিত্বের মানুষ। অন্যের প্রতিভা চেনার অদ্ভূত এক ক্ষমতা ছিল তাঁর। ব্যক্তিগত জীবনে গোঁড়া ব্রাহ্মণ এই মানুষটির কোনও প্রকার জটিলতা পছন্দ ছিল না। তিনি ছিলেন নিরামিষাশী। চা, এমনকী পানও খেতেন না। তবে সন্দেশ ছিল তাঁর প্রিয় মিষ্টি। বিশেষ করে ভীম নাগের সন্দেশ তাঁর নামের সঙ্গে যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। শোনা যায় যে বেশির ভাগ দিনই তিনি ভীম নাগের দোকান থেকে সন্দেশ কিনতেন।

তাঁর পছন্দ অপছন্দ নিয়েও শোনা যায় নানা কাহিনি। নরম বিছানা তিনি পছন্দ করতেন না। এক বার কোনও এক অভিজাত ধনী পরিবারে নিমন্ত্রিত হয়ে রাতে কিছুতেই ঘুমোতে পারছিলেন না। পরে মাটিতে নিজেই বিছানা করে ঘুমিয়েছিলেন তিনি। নিয়ম মেনে জীবনযাপন করতেন তিনি। রোজ ভোর চারটের সময় ঘুম থেকে উঠতেন। কিছু ক্ষণ কাজ করার পরে বেরিয়ে পড়তেন ময়দানে প্রাতর্ভ্রমণে। সেই সময় বহু বিখ্যাত ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর দেখাসাক্ষাৎ হত।

আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে সকলেরই ছিল অবারিত দ্বার। প্রতি দিন সকাল থেকেই বহু মানুষ তাঁর কাছে ভিড় করতেন। একটা ঘটনা সে যুগে অনেকেই দেখেছেন। স্নানের সময় হয়ে গেলে বাড়ির পরিচারক বাটিতে তেল নিয়ে তাঁকে মাখাতেন। আশুতোষ তেল মাখতে মাখতেই অভ্যাগতদের সঙ্গে কথা বলতেন। এমনকী, কোনও সাহেব এলেও একই ভাবে দেখা করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু প্রকৃতির মানুষ। কেউ অসুবিধায় পড়েছেন শুনলে তিনি সহানুভূতির সঙ্গে যথা সম্ভব তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেন। তিনি ছিলেন নিয়তীবাদী এবং গভীর ভাবে ঈশ্বর বিশ্বাসী।

তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে শোনা যায় নানা কাহিনি। সেই সময় রেলে যাতায়াতের সময় প্রায়ই দেশের মানুষকে শ্বেতাঙ্গদের খারাপ ব্যবহারের শিকার হতে হত। এক বার কোনও একটি সরকারি কাজে আশুতোষ আলিগড় যাচ্ছিলেন। ট্রেনের কামরায় তাঁর সঙ্গী ছিলেন এক মিলিটারি অফিসার। আশুতোষ যখন তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলেন সেই ফাঁকে সাহেব তাঁর নাগরা জোড়া জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছিলেন। পরে সাহেব যখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন আশুতোষ তাঁর কোট খানি একই ভাবে জানলার বাইরে ফেলে দিয়েছিলেন। সাহেবের যখন ঘুম ভাঙল তিনি কোটটি দেখতে না পেয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। আশুতোষ তখন তাঁকে জানিয়ে দিলেন যে তাঁর কোটটা নাগরা খুঁজতে গিয়েছে।

১৯২৪-এর ২৫ মে পটনায় তাঁর জীবনাবসান হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE