Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

সে কি এল, নাকি...

ভরা শীত কালেও এখন আফশোস শোনা যায়! ভাল করে ঠান্ডা পড়ছে না! কিন্তু, আমাদের শৈশব বা কৈশোরে এমনটা হত না। দুর্গাপুজোর সময় থেকেই বাতাসে হিমের পরশ... আর কালীপুজো-ভাইফোঁটা পার হলেই শীতের পোশাকের সঙ্গে বিছানার নীচে থেকে বেরিয়ে আসত লেপ-কম্বল।

রূপা মণ্ডল
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০২
Share: Save:

ভরা শীত কালেও এখন আফশোস শোনা যায়! ভাল করে ঠান্ডা পড়ছে না! কিন্তু, আমাদের শৈশব বা কৈশোরে এমনটা হত না। দুর্গাপুজোর সময় থেকেই বাতাসে হিমের পরশ... আর কালীপুজো-ভাইফোঁটা পার হলেই শীতের পোশাকের সঙ্গে বিছানার নীচে থেকে বেরিয়ে আসত লেপ-কম্বল। ছাদের উপর মাদুর পেতে সে সব রোদে দেওয়া হত। এমনকী, দামি শাড়ি, শাল, কোট ইত্যাদিও রোদে না দিয়ে ব্যবহার করা হত না। বাজারের ব্যাগে ফুলকপি, বাঁধাকপি, পালং শাক, সিম প্রভৃতি শীতকালীন সব্জির সঙ্গে উঁকি মারত কয়েকটি করে কমলালেবু। এই সময় আনাজের দাম কমে যেত। তাই শীতের আনাজ মানেই ব্যাগ ঠাসা সব্জি। শেষপাতে টোম্যাটোর চাটনি হত রোজ। দুপুরে খাওয়ার শেষে একটা কমলালেবু হাতে নিয়ে ছাদে চলে যেতাম। মাথায় ভিজে চুল রোদে শুকোতে শুকোতে আয়েস করে কমলালেবু খাওয়া— সে যেন এক আলাদা আবেগ মাখা দিন ছিল।

আমাদের শৈশব ও কৈশোরে পুজোর ছুটির পরেই স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে যেত। তাই, অফুরন্ত সময় হাতে। ছাদে রোদ পোহানোর সঙ্গে গল্পের বই পড়া আর এক ধরনের বিলাসিতা ছিল। আশপাশের বাড়ির ছাদে বিভিন্ন বয়সী জেঠিমা, পিসিমা, কাকিমাদেরও চুল শুকোতে দেখা যেত। এ ছাদ থেকে চেঁচিয়ে অন্যকে জিজ্ঞেস করা, ‘কিগো আজ কি রান্না করলে?’ এখন ফ্ল্যাটবাড়ির সৌজন্যে সে চিত্র উধাও। কেউ আর তার বেশি উঁচু বাড়ির সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠতে চায় না, বা পারেও না। এখন এক চিলতে বারান্দায় কয়েক মিনিটের জন্য কাউকে হয়তো দাঁড়াতে দেখা যায়। কিন্তু প্রতিবেশীর সঙ্গে চোখাচোখি হলেই মুখ ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। নেই সময়, আন্তরিকতা, আবেগ! সব বড় মেকি হয়ে গেছে!

কলকাতার মফস্‌সলে বেড়ে ওঠা আমার স্মৃতিতে শীত মানে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা, বাইরে কুয়াশার চাদর, একটু একটু করে রোদের আঁচ বাড়া, কুয়াশার ঝাপসা পর্দা ভেদ করে আস্তে আস্তে প্রকৃতির দৃষ্টিগোচর হওয়া, লেপ-কম্বল-চাদর-কাঁথা মুড়ি দিয়ে দুপুরে শুয়ে শুয়ে রেডিও শোনা বা ছাদে বসে রোদ পোহানো, সন্ধেবেলায় খেলা শেষে বাড়ি ফিরে ঠাকুরমার সঙ্গে চাদর ভাগাভাগি করে গল্প শোনা— জানি না, এ যুগে ক’জনের এমন সৌভাগ্য এখনও হয়!

দুপুর হলেই বিভিন্ন ফেরিওয়ালাদের ডাক শোনা যেত— ‘চাই, বাসন চাই, বাসন...’ কিংবা ‘জয়নগরের মোয়া, নলেন পাটালিগুড়’। শব্দগুলো দূর থেকে কাছে এসে আবার দূরে মিলিয়ে যেত। রোগা, লম্বা যে ছেলেটি আমাদের পাড়ায় নলেন গুড়ের মোয়া আর পাটালি বিক্রি করতে আসত, তাকে প্রতি বছরই শীতকালে দেখতাম। খেলার ছলে তার ডাক ও হাঁটার ভঙ্গি নকল করতাম!

নলেন গুড় মানেই পায়েস আর পিঠেপুলি। খড় দিয়ে বিনুনি বেঁধে তাতে গাঁদাফুল গুঁজে তৈরি হত বাউনি। পৌষ সংক্রান্তির সন্ধ্যায় কনকনে ঠান্ডায় সেই বাউনি বাঁধতে বাঁধতে রান্নাঘর থেকে ছ্যাঁকছোঁক শব্দে পিঠে তৈরির আওয়াজ শুনতাম। বাউনি বাঁধা হয়ে গেলে ঠাকুরমা সেই গরম পিঠেতে ঝোলা নলেন গুড় মাখিয়ে খেতে দিতেন। রাতে খাওয়া সেরে শুতে যাওয়ার সময় দেখতাম ঠাকুরমা অনেকগুলো বাড়তি পিঠে দুধে ফুটিয়ে তুলে রেখে দিচ্ছেন পরের দিনের জন্য।

শীত মানেই হরেক পার্বণ— পৌষ সংক্রান্তি, গঙ্গাসাগর, মাঘ মাসে লক্ষ্মীপুজো, নবান্ন, সরস্বতীপুজো, স্কুল ও ক্লাবের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, মাঘমেলা, বইমেলা, আরও হরেক মেলার ছড়াছড়ি। শীতকাল মানেই বেড়াতে যাওয়ার সময়— কাছে, দূরে, যেখানেই হোক না কেন। শৈশবে বাবা-মার সঙ্গে ভোর ভোর বেরিয়ে বেলঘরিয়া রথতলা থেকে ২৩০ নম্বর বাসে চলে যেতাম চিড়িয়াখানা। একসঙ্গে এত পশু-পাখি দেখার আনন্দই আলাদা, তার উপরে ছিল বিজলীগ্রিলের কাটলেট, পপকর্ন খাওয়ার লোভ।

শীতের অন্য আনন্দ ছিল বড়দিনের কেক খাওয়া এবং তার সঙ্গে চড়ুইভাতি। এখন এই কলকাতার বুকে কোথাও কোনও সবুজ প্রান্তর চোখেই পড়ে না, যে ক’টা মাঠ এখনও বেঁচেবর্তে আছে সেগুলো কোনও না কোনও ক্লাবের দখলে। তাই মাঠ পরিষ্কার করে মাটির উনুন বানিয়ে চড়ুইভাতির মজা এখন আর মেলে না। এখন কোনও কোনও প্রতিষ্ঠানের মাঠ ভাড়া পাওয়া যায়, তার ক্ষুদ্র অংশে অতীব সন্তর্পণে চড়ুইভাতি করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়।

ছোটবেলায় খেলার মাঠের অভাব এতটা বোধহয় অনুভব করিনি। সারা শীতকালটা ছিল ব্যাডমিন্টন খেলার সময়। আর ছেলেরা ক্রিকেট খেলত। দুপুরবেলায় পাড়ায় পাড়ায় ক্রিকেট ম্যাচ হত। তখন ক্রিকেটটা শীতকালেরই খেলা ছিল। ইন্ডিয়া টিমে ছিলেন গাওস্কর, কপিলদেব, আজাহারউদ্দিনেরা। কাকিমা, পিসিমা, দিদিমারা শীতকালে সোয়েটার বুনতেন। বিভিন্ন ঘরের ডিজাইনের সঙ্গে ইন্ডিয়া টিমের খেলোয়ারদের পোশাকের মতো নীল বর্ডার দেওয়া ভি-গলা হাতকাটা সাদা সোয়েটারের খুব চল ছিল।

শীতকালে ছাদের রোদ সরে গেলে সবাই মাঠে কিংবা গঙ্গার তীরে সোপানগুলিতে গিয়ে বসে অস্তগত সূর্যের নরম আঁচ নিতে চায়। স্রোতস্বিনী গঙ্গার কিনারে বসে জলে ভেসে চলা নৌকা, ওপারে জি টি রোড ধরে হু হু করে চলা গাড়ি, কলকারখানার চিমনি বেয়ে ওঠা কুণ্ডলী পাকানো কালো ধোঁয়া, টুপ করে ডুবে যাওয়া লাল বলের মতো সূর্য, আর আকাশে রেখে যাওয়া তার আবিরের রেখা— কলকাতা আসলে কলকাতাই।

আড়িয়াদহের মেয়ে। একটি বেসরকারি সংস্থানে কাজ করেন। অবসর সময় কাটে ছবি এঁকে এবং লেখালেখি করে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE