Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

এই গরমে কষ্টে আছে ওরা

মনতাজ-এ মিলন মুখোপাধ্যায়কম-সে-কম চার। চার দশক। এতগুলো বছর এই বে-শহর মুম্বইতে টিকে আছি। কিছু স্বপ্ন পূরণের আশায়। কিছুটা ‘পৈটিক’ কারণেও। অথচ, অ্যাদ্দিন এমন ধারা হয়নি যে, হাসফাঁস করছি। চল্লিশখানা চোত-বোশেখ সহ্য করেছে এই ‘মহা সয়’ শরীর। এ বার যেন আইঢাই করছে। আসলে বাতাস ‘শুষ্কং কাষ্ঠং’ গোছের বলেই শুষে নিচ্ছে নির্যাস। রস কষ সব। এ শহর সমুদ্দুরের গায়ে বটে, তবে কলকাতা-বঙ্গের মতন কালবোশেখি ঝড়-টড়ের বালাই একেবারেই নেই।

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

কম-সে-কম চার। চার দশক। এতগুলো বছর এই বে-শহর মুম্বইতে টিকে আছি। কিছু স্বপ্ন পূরণের আশায়। কিছুটা ‘পৈটিক’ কারণেও। অথচ, অ্যাদ্দিন এমন ধারা হয়নি যে, হাসফাঁস করছি। চল্লিশখানা চোত-বোশেখ সহ্য করেছে এই ‘মহা সয়’ শরীর। এ বার যেন আইঢাই করছে। আসলে বাতাস ‘শুষ্কং কাষ্ঠং’ গোছের বলেই শুষে নিচ্ছে নির্যাস। রস কষ সব। এ শহর সমুদ্দুরের গায়ে বটে, তবে কলকাতা-বঙ্গের মতন কালবোশেখি ঝড়-টড়ের বালাই একেবারেই নেই। গরমের ভাপে ভাপে ঝলসে যাচ্ছে গায়ের চামড়া। এক বিন্দু ঘাম নেই কোথাও। না পিঠে, না ঘাড়ে-গলায় অথবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অন্যান্য সন্ধিস্থলে। ‘জৈষ্ঠ্যে ঝড়’ শব্দটি বিভিন্ন দেশে-প্রদেশে খাটে আর খাটে বইয়ের পাতায়। অ্যা-হ্যা-হ্যা—বঙ্গসন্তান! সাধ কত! পশ্চিমঘাট পাহাড়ের উপত্যকায় মুম্বই শহরে বসে, কি? না, জৈষ্ঠ্যের ঝড় দেখবেন? কবি নজরুলের জন্মমাস যদিও। কিন্তু তাঁর কপালেও সম্বৎসরের খ্যাতনামা ‘ঝড়ে’র কোনও আভাসই জুটত না এই শহরে থাকলে। ঘরে বসে ফুল স্পিডে বন বন করে পাখা ঘুরিয়েও বাতাস নেই। বাতাস সর্বত্র বিরাজমান। অথচ কুত্রাপি সেই বায়ু বইছে না। দৃষ্টির চার পাশে জানালার বাইরে অ্যাতো ঝোপ-গাছপালা, একটি পাতাও নট নড়ন-চড়ন—নট কিচ্ছু! বৈশাখ আমাদের ঘরে ঢুকেই আঙুল তুলে হুকুম দিয়েছে, ‘‘স্ট্যাচুড!’’

সব পাথর হয়ে গেছে। রবিঠাকুরের শীতের গান, এখানে, তাঁর জন্মমাসে কেমন যেন গ্রীষ্মেও খেটে যায়, ‘‘সইবে না সে, পাতায় ঘাসে চঞ্চলতা তাই তো আপন রং ঘুচালো ঝুমকোলতা—’’!

শয়নঘরের জানালায় আর চড়ুইয়ের দল ঝগড়া বাঁধিয়ে, চেঁচামেচি করে, ভাতঘুম ভাঙিয়ে দেয় না। চার পাশের গাছে গাছে রাত-বিরেতে, দুপুর বেলায় আর কোকিলেরা ডাকাডাকি করে না। জোড়ায় জোড়ায় শালিখরা তো উঠে গেছে কবেই!

না! ‘উঠে গেছে’ বলতে ঠিক ‘অবলুপ্ত’ হয়েছে তা নয়। তবে ক্রেমে ক্রেমে সে দিকেই এগোচ্ছে এই উপগ্রহের পাখপাখালি বা জীব-জন্তুদের ভবিষ্যৎ। গোটা পৃথিবীর বৃহত্তর পরিধির বিস্তারে না গিয়ে মনতাজের পাতায় তুলে ধরা যাক স্রেফ মুম্বইয়ের দুর্দশার অশনি সংকেত। আমরা সাধারণ মানুষরা যেমন হিমশিম খাচ্ছি গরমে, তাবৎ শহরবাসী প্রাণীদের অবস্থাও একই রকম। দু’পেয়েরা তবু ভালই আছি। বলতে গেলে মুক্ত আছি। কয়েদখানার বন্দিদের দশা কল্পনা করুন। চিড়িয়াখানার মধ্যে আটক পাখিদের অবস্থা ভেবে দেখুন। লোখণ্ডওয়ালার গাছ-পাতার ডালে, ছায়ায় যারা ছিল, গরমের উত্তাপ সহ্য না করতে পেরে ডানা মেলে উড়ে গেছে ‘অন্য কোথা’ ‘অন্য কোনখানে’। পাতাবহুল গাছের শীতলতর ছায়ায়। কিন্তু, চিড়িয়াখানায় যে সব পাখি আটক হয়ে আছে, তাদের কষ্ট কল্পনা করুন। ওদেরও তো কষ্ট-ব্যথার বোধ রয়েছে।

কলকাতা চিড়িয়াখানাকে আমরা জানি ‘আলিপুর চিড়িয়াখানা’ বলে। মুম্বইতে সেই ‘বন্দিশালা’র অবস্থান ‘বাইকালা’তে। তবে, এর একটি দশাসই লম্বা চওড়া পোষাকি নামও আছে— উচ্চারণ করতে নিশ্বাস ফুরিয়ে যাবে—বীরমাতা জিজাবাই ভোসলে সরকারি উদ্যান! এখানকার বাসিন্দাদেরও রাখা হয় প্রায় ‘জন্তুজানোয়ার’দের মতোই।

এই গ্রীষ্মে নিদাঘ দুপুরে প্রায় কোনও জলাশয়েই এক ফোঁটা জল নেই। কাদাও গেছে শুকিয়ে। হ্যাঁ, বলতেই পারেন, ‘‘আমরা মানুষরাই পাই না জল প্রয়োজন মতো, তো, সখের জানোয়ারদের জন্যে আবার জল—। আহা-হা, আবদার কত!’’

জলশূন্য ‘উদ্যান’। সবুজ রং প্রায় উধাও। চতুর্দিকে ধুলো-আবর্জনা। জল না থাকলে বা নামমাত্র থাকলে ‘কাদা’ বলা হয়। সারা দিন জলে গা ডুবিয়ে বেশির ভাগ সময় কাটাতে অভ্যস্ত কুমির বা জলহস্তিরা। ভালুক, হাতি— এরাও জলশূন্য জলাশয়ে বা কাদা অসম্ভব নোংরা জলে ডুবে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে এই ‘বাগানে’!

এমন অস্বাস্থ্যকর অবস্থার ফলে এই তো গত গ্রীষ্মের তাপে জলের অপ্রতুলতা এবং নোংরা জল খাওয়া ও ব্যবহার করার কারণেই ছোট্ট আদরে হাতিটি রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেল। নাম শক্তি।

প্রায় পাতকুয়ো সাইজের ছোট ছোট জলাধারে এক একটি প্রাণী ঠিক মতো ডোবেও না। ওরই মধ্যে একই জাতের পশুরা গুঁতোগুঁতি করে সেঁধিয়ে জলে শরীর পুরোপুরি না ডুবলেও, বসতে চায়। হাতি, কুমির, জলহস্তি, ভালুক, শীতল দেশের প্রাণী পেলিক্যান। এমনই অন্তত দেড়শো দু’শো জাতের পশুপাখি আলাদা আলাদা খাঁচায় জীবন টিকিয়ে রাখে। মোটে আড়াই হাজার একর জমিতে প্রায় গাদাগাদি ভিড়। বাসিন্দারা মুক বলেই প্রতিবাদ করতে পারে না। অবশ্যই কষ্ট পায়, ভেতরে ভেতরে কাঁদেও হয়তো। কিন্তু, উচ্চশ্রেণির দু’পেয়ে পশুদের কানে তা পৌঁছয় না। ফলে, ওদের লালন-পালনের ব্যাপারে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। অসুখে ভুগলে চুপচাপ সহ্য করে যেতে হয় ওদের। পেট ভরে যাবার মতন খাবার খাঁচার ভেতর না ছুড়লে অবলাদের আধপেটা খেয়ে থাকতে হয়। নিঃশব্দে মৃত্যু ঘটলে, সেই জাতের প্রাণীদের একটি সংখ্যা শুধু বিয়োগ করে দিলে—খালাস। সরকারি ‘কর্তব্য সুষ্ঠু ভাবে সমাধা হইল’!

দিনে প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার মানুষ এই অস্বাস্থ্যকর উদ্যানে ঢোকে পাঁচ টাকার টিকিট কেটে। ছুটির দিন হলে আরও বেশি। অথচ বাসিন্দাদের রক্ষণাবেক্ষণ, বাগানটির দেখাশোনা ও যত্ন নেবার জন্যে কর্মচারী রাখা হয়েছে সাকুল্যে ৫০-৬০ জন। ঝাড়ুওয়ালারা স্রেফ রাস্তা ঝাট দেয়, মালি ক’টি দয়া করে গাছপালায় জলটল দেয়। গরম কালে জল সরবরাহ কম হওয়ার ফলে গাছে জল দেবার ব্যাপারটিও অবরেসবরে থুতু পরিমাণ ছেটানো হয়ে থাকে। বাগানের বাদবাকি খোলা জায়গায় শুকনো ঘাস জমা হতে থাকে। আবর্জনার পাহাড় জমে ওঠে জায়গায় জায়গায়। দুর্গন্ধে নাকে রুমাল দিয়ে হাঁটতে হয়।

আর, খাঁচাগুলোর দশা আরও করুণ। শ্বাস বন্ধ করে এলাকা না পেরোলে কটুগন্ধে ওষ্ঠাগত প্রাণ। কালেভদ্রেও এই কারাগারগুলোয় জল ছেটানো হয় কিনা সন্দেহ! ভর দুপুরে চড়ুই পাখি সাইজ মশা-মাছি গরাদের ভেতরে-বাইরে ভন ভন করছে। জন্তুদের নাকে মুখে এসে বসছে। শ্রান্ত-ক্লান্ত, অসুস্থ পশুটি কোনও রকমে ল্যাজ নাড়া দিয়ে তাড়াবার চেষ্টা করছে মাঝেমধ্যে।

এই মশামাছির প্রসূতি সদন হল সব ক’টি পাঁকময় পচা ডোবার অকথ্য শ্যাওলা-জমা জলে। জলহস্তিদের আয়ু কমবেশি পঞ্চাশ বছর। ছোট্ট ‘হিপো’ শক্তি ছিল মহা প্রাণবন্ত। প্রায় জলবিহীন কাদার মধ্যেই লাফালাফি করত। ঠিক কি অসুখে মারা গেল, সঠিক কেউ বলতে পারল না।

‘সুপারঠনঠন’, থুড়ি—ইয়ে, মানে সুপারিন্টেন্ডেন্ট, দান্তে কাচুমাচু মুখ করে স্বীকার করেছিলেন, ‘‘মৃত্যুর সঠিক কারণ বলতে পারব না। তবে, বেশ কিছু দিন ধরেই ভুগছিল শক্তি। ওষুধ অবশ্যই খাওয়ানে হয়েছিল।’’

‘‘তা, ওষুধ কি অসুখের জন্যে?’’

জবাবে ঋত্বিক ঘটকের ছবি ‘সুবর্ণরেখা’য় অভিনেতা বিজন ভট্টাচার্যের সংলাপ মনে পড়ে, ‘রাইত কতো হোইলো’, উত্তর নাই’।

পশু চিকিৎসকের বক্তব্য, ‘‘জলাশয়ের জল দিনে অন্তত দু’বার বদল করা দরকার। এখানে জলাভাবের দরুন হয়তো হপ্তায় একবারই পাল্টানো হয়। হিপোরা জলেই সাধারণত দিনের পর দিন বাহ্যি-পেচ্ছাব করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একই জল খেয়েও নেয়। ক্রমাগত লেজ নাড়ার জন্য সেই পরিত্যক্ত নরম বিষ্ঠা ডোবার জলে দ্রুত ছড়িয়ে যায়। বিষাক্ত হয়ে ওঠে জল। শ্যাওলা-জমা কাদাজলে দ্রুত সংক্রমিত হয় নানান রোগ। খুব সম্ভবত জলহস্তিটি সংক্রমিত রোগেই মারা গেছে।’’

পাঁচটি হিপো ছিল। তিনটিকে অন্যত্র পাচার করা হয়েছে। জীবিত। একটি সুরাতে। দুটি কলকাতায়। বেঁচে গেছে। বাকি দু’টির গায়ে শ্যাওলা জমে গেছে। বছর খানেক আগে উনিশ বছরের সিংহি অনিতা গাছে উঠতে গিয়ে পায়ে জখম হয়েছে। তার তো পোকামাকড়, কীটদের আক্রমণে দুর্দশা অন্তহীন। ‘মরিয়া প্রমাণ করিল’—বাঁচিয়া গিয়াছে।

মশামাছি ছাড়াও কীট-পতঙ্গ রোগজীবাণু সারা দিন ছেয়ে থাকে পশুপাখিদের। সমস্ত পরিবেশই এমন নোংরা-দূষিত যে, পোকামাকড় কিলবিল করছে খাঁচাগুলির ভেতরে, কাছেপিঠে। জল-কম দশায় বেশির ভাগ প্রাণীদের গায়েই ঘা হয়েছে। গাছের গুড়িতে বা খাঁচার গরাদে শরীর ঘষে ঘষে চুলকে ঘা করেছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। কীট-মশা-মাছি এমনকী খুদে পাখিরা খুঁটে খুঁটে সে সব আরও ভয়ঙ্কর ক্ষত করে দিয়েছে। বিশেষ করে কাকের দল। হরিণ-বাঘ-বাঁদুর-সিংহ-ভালুক সবাই কমবেশি ভুগছে চর্মরোগে। কয়েক ফুট আগে থেকেই পেলিক্যানদের আস্তানা মালুম দেয়। কী দুর্গন্থ রে বাবা! অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসার জোগাড়। কারণ একই। পচা ডোবার আধা-জলে ততোধিক পচা মাছ। এদের খাদ্য হিসেবে ছুড়ে দেওয়া হয়ে থাকে।

সদ্য যুবতী সিংহি ‘জিমি’ও ভুগছে চর্মরোগে। সারা দিন গা ঘষে, চুলকোয়, চাটে। ঘা হয়েছে নানান জায়গায়। কর্তারা পাঠিয়েছেন ওকে পশু হাসপাতালে—এই ক’ দিন আগে। ওঁদের বক্তব্য, ‘‘দশ বারো দিনেই ওই সামান্য চর্মরোগ থেকে সেরে উঠবে কিশোরী সিংহিটি—আবার লাফালাফি করবে আগের মতোই।’’ লাফালাফি করবে না কচু। ‘চড়তি জওয়ানি’তে ছটফট করবে। কারণ, এই সরকারি চিড়িয়াখানায় পুরুষ সিংহই নেই। সবেধন নীলমণি যে একটি ছিল, দু’ বছর হল সে-ও দেহরক্ষা করে নিষ্কৃতি পেয়েছে। ‘উদ্যান’ নামক এহেন চিড়িয়াখানাকে কী বলে ডাকব, বলতে পারেন? যেখানে, হয়তো কয়েক দশক পরে খাঁচায় খাঁচায় সব পশুপাখির ছবি ঝোলানো থাকবে। ছবির গলায় ঝুলবে গাঁদাফুলের মালা। চিড়িয়াখানার চেয়ে—জেলখানা বা জাদু ঘর বললেই হয়! বীরমাতা জিজাবাই ভোসলে সরকারি ‘মিউজিয়াম’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE