Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

উৎসবে খুশিতে নাচে মন

বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশে পুজো-আচ্চার কমতি নেই। তার মধ্যে আমাদিগের তথা বঙ্গসন্তানদের সবচেয়ে ‘বড়ো’ পুজো দুর্গা পুজো। তা এই মা-দুগ্গা নেমে আসেন মর্তে বা এই মনতাজের শহর মুম্বইতে সদলবল, সপরিবার। বাহন সিংহমশাই, অসুর-মহিষাসুর এবং সন্তান-সন্ততি সমভিব্যবহারে। সামান্য তফাতে থেকে পতিদেবতা স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেবও হাজির থাকেন ‘ফোটো’ বা ‘ছবি’ হয়ে। লিখছেন মিলন মুখোপাধ্যায়।এ তো গেল যাঁদের দর্শন পাওয়া যায় তাঁদের কথা। যাঁদের দর্শন পাবার আশায় আমরা সারা বচ্ছর প্রতীক্ষা করি। যেমন সিনেমার হিরো-হিরোইন বা অন্যান্য ভূমিকায় যাঁরা অবতীর্ণ হন তাঁদের দেখার আশায় আমরা লাইন দিয়ে টিকিট কাটি। অথবা শুটিং দেখার লোভে স্টুডিওর সেটে উঁকি-ঝুঁকি মারি অমুক হিরো, তমুক হিরোইনদের বদন দর্শন করে নিজেদের ধন্য মনে করি।

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

এ তো গেল যাঁদের দর্শন পাওয়া যায় তাঁদের কথা। যাঁদের দর্শন পাবার আশায় আমরা সারা বচ্ছর প্রতীক্ষা করি। যেমন সিনেমার হিরো-হিরোইন বা অন্যান্য ভূমিকায় যাঁরা অবতীর্ণ হন তাঁদের দেখার আশায় আমরা লাইন দিয়ে টিকিট কাটি। অথবা শুটিং দেখার লোভে স্টুডিওর সেটে উঁকি-ঝুঁকি মারি অমুক হিরো, তমুক হিরোইনদের বদন দর্শন করে নিজেদের ধন্য মনে করি। পুজোর পাঁচ-ছ’দিন মা দুগ্গা-শিবঠাকুর-কার্তিক-গণেশ-অসুর-সিংহমশাইরাই হলেন গিয়ে আমাদের নায়ক-নায়িকা-ভিলেন-ঘোড়া ইত্যাদি। অথচ কী আজব কাণ্ড দেখুন! আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করি, ‘‘তপনবাবু কোথায়? তপন দাশ—?’’
পথেঘাটে যত্রতত্র নয়। ষষ্ঠি পুজোর দিন নতুন পল্লির প্রতিমার কাছেপিঠে। অবাক হয়ে আপনি পাল্টা জানতে চাইবেন, ‘কে? কোন তপন দাশ?’’
হায়! যে মানুষটি তাঁর জুড়িদার বসন্ত দাশকে নিয়ে সেই দু’হাজার কিলোমিটার দূর থেকে আসেন প্রতি বচ্ছর, তাঁর নামটুকুও আমরা জানি না। দশ-বারো কিলো ওজনের বাদ্যযন্ত্র ঘাড়ে বয়ে আনেন বছরের পর বছর। অথচ, এই শিল্পীর বাজনার তালে তালে পুজোর পাঁচটি দিনই আমাদের বাঙালি হৃদয় নেচে ওঠে। এই শিল্পীও তো মা-দুর্গার সঙ্গি। আজকের নয়, সেই আদ্যিকালের সময় থেকে। কী আশ্চর্য সাদামাঠা মানুষ এঁরা। যেমন, গত বছর ষষ্ঠির দিন ব্যক্তিগত কারণে যেতে পারিনি ‘নতুন পল্লির’ প্যান্ডেলে। সপ্তমীর সকালে পৌঁছতেই তপন ও বসন্তবাবু দেখি বাজনায় ব্যস্ত। আমায় দেখেই এক গাল হেসে, মাথা নোয়ালেন। অর্থাৎ স্বাগতম। ঢাকের কাঠি থামেনি। ওরই মধ্যে জানতে চাইলেন, ইশারায়, ‘‘গতকাল কোথায় ছিলেন—দেখিনি তো—’’!
ওঁদের যে কোনও একজনের ঢাক কাঁধে নিয়ে না বাজালে, মনে হয় পুজোই হল না আমার। মনে পড়ে, এক বার কাণ্ড হয়েছিল। সারা বছর তো বাজাই না, হঠাৎ নাগাড়ে বাজালে যা হয়—তিনটি আঙুলে গিয়েছিল ফোস্কা পড়ে। পরের বছর ঢাক কাঁধে তোলবার সঙ্গে সঙ্গে তপনবাবু বলেছিলেন, ‘‘আঙুলে একটি পট্টি বেঁধে নিলে, ফোস্কা পড়বে না।—’’ সেই থেকে বছরে চার-পাঁচ দিন অধমের আঙুলে ব্যান্ডএইড জড়ানো থাকে।
তেমনই ধরুন আপনার-আমার হাতে পুষ্পাঞ্জলির সময় যিনি ফুল দিয়ে দেন, সেই পুরোহিত মহাশয় পাঁচ দিনব্যাপী এই প্রকাণ্ড কাণ্ডের সেই হোতাকে চিনি আমরা ক’জন? নৈবাটি অঞ্চলের ভাটপাড়া থেকে আসেন কৃষ্ণকান্ত ভট্টাচার্যমশাই। পুজোর ক’দিন তো বলতে গেলে প্রায় সারাক্ষণই প্রতিমার সঙ্গে একই মঞ্চে বিরাজমান। মাতৃরূপিনী দুর্গার এই নিকটতম সন্তান যেন তাঁরই এই চলমান প্রতিভূর সঙ্গে কী আমরা দুদণ্ড কথা বলে জেনেছি, ‘‘কেমন আছেন ঠাকুরমশাই? সব কুশল-মঙ্গল তো?!’’

রাত শেষ হয় না। গাছের শাখা-প্রশাখায় বসে ঘুম চোখ মেলে পাতার আড়াল থেকে পাখ-পাখালির ইতি-উতি দেখে আকাশ ফর্সা হল কিনা ‘ডাকবো কি ডাকবো না’র সেই সময় দুগ্গা মায়ের পাকশালায় ফলপ্রসাদ কাটাকুটি, ফুল গোছানো পুজোর তাবৎ জোগাড়যন্ত্রের কাজে লেগে যান একনিষ্ঠ মহিলারা। শেলি বন্দ্যোপাধ্যায়, শম্পা ভট্টাচার্য, মহুয়া-স্নিগ্ধা-বুলু। মায়ের ভোগের ব্যস্থাও তো করতে হয়! কত জন খবর রাখে, বলুন?

তারপরেই তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় সেই বৃষোৎসর্গের মতো মহাভোজের আয়োজন। অন্তত পুজোর কটি দিন যেন মায়ের কাছে এসে অভুক্ত ফিরে না যান কোনও ভক্ত। জুহু কোলিয়াওয়াড়ার গোবিন্দ মহারাজ তাঁর ডজনখানেক চ্যালা-চামুণ্ডা নিয়ে তারই তোড়জোড়ে লেগে যান সকাল থেকে। চাল-ডাল-সবজি ইত্যাদি। লেগে যায় ছ’সাতশো কিলো চাট্টিখানি কথা নয়। কারণ, নিমন্ত্রিত-রবাহুত-অনাহুত কেউই তো অবাঞ্ছিত নন। কয়েক হাজার দর্শনার্থীর, ক্ষুধার্তের ক্ষুন্নিবৃত্তির আয়োজনের পুরোধায় থাকেন সদা-সপ্রতিভ শংকর মৈত্র ও কৌশিক সাহা।

আবার দেখুন, কুষ্ঠিয়ার কামারখালি গ্রামের কুণ্ডুমশাই দিকে দিকে আনন্দ-বিতরণের আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কারণ, এঁদের বাজেট বা পুঁজি যে ‘নতুন পল্লি’ বা তাবড় তাবড় পুজোর মতো তিরিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ লক্ষ টাকা নয়। আহা, তাই বলে কী, মালাড অ়ঞ্চলের ভক্তরা বঞ্চিত হবেন? না। সুতরাং এ বছরের সেক্রেটারি উঠে-পড়ে লেগেছেন।

আনন্দবাবু জানালেন, ‘‘মালাড পশ্চিমে আমাদের ‘উদয়ন’ ক্লাবের একান্ন বছর পূর্ণ হল। দুর্গাপুজোও চলে আসছে আজ আটচল্লিশ বছর ধরে।

পুরোহিত সমীর মুখুজ্জের তত্ত্বাবধানে পাঁচদিনের পুজোর বাজেট লাখ দশেক। সন্ধ্যারতির পর যথারীতি মালাডবাসীর বিনোদনের ব্যবস্থা। ক্লাবের কবিমহলের নাটিকা, রমণীদের ‘চিত্রাঙ্গদা’, সুব্রত ভট্টাচার্য রচিত ও অধীর মজুমদার পরিচালিত ‘সাস-বহু’ টাইপের হাসির নাটক ‘কলহকীর্তন’। বিজয়ার দিন বিনোদন ও ঢালাও ভুঁড়িভোজনের ব্যবস্থা। বীরভূমের বোলপুর থেকে শ্রীশ্রীমহাপ্রভু বাউল ও লোকগীতি সম্প্রদায়ের অমিত দাস বৈরাগীর একতারা-ডুগডুগি-সমেৎ ঘুরে ঘুরে নৃত্যগীত। এবং তৎসঙ্গে পাতপেড়ে ভরপেট লুচি-আলুর দম-রসগোল্লা। তবে, এত বছরের পুজো এ বার ঠাঁইনাড়া বয়ে নতুন, অস্থায়ী আস্তানায় খুঁটি গাড়ছে। অশোকবাবু বললেন, ‘‘যেহেতু ‘বাজাজ হল’ ভেঙে একেবারে নতুন ইমারত তৈরি হচ্ছে, তাই এ বারের পুজো হচ্ছে গজানন ট্রাস্টের মাঠে।

‘উদয়নের’ মতোই গতি হতে চলেছে ‘প্রগতি’র। আন্ধেরির সবচেয়ে জাঁকজমক ভরা পুজো অধমের ‘লোখান্ডওয়ালা’ (যেটিকে অলিখিত ভাবে পাবলিক উল্লেখ করেন ‘অভিজিতের পুজো বলে!) হলেও তার বয়েস এখনও কচি। বারো পেরিয়ে তেরোয় পা কিন্তু সবচেয়ে পুরনো আন্ধেরীর ‘প্রগতি’ ক্লাবের পুজো এ বার বাহান্ন বছরে পা দিল। এই পুজোর আয়োজনও এ বার ঠাঁইনাড়া হয়ে অন্য কোথা অন্য কোনওখানের দশা। এত বছরের থান ছিল ‘ফিদাই বাগ অ্যাকাডেমিতে’। সেখানে এ বার ‘মল’ (বাংলা নয়, ইংরাজি!) তৈরির তোড়জোড় লেগে গেছে। ফলে স্থানগুলি।

এই প্রাচীন বারোয়ারি পুজোর প্রবীণ সহ-সভাপতি অরুণবিকাশ দত্তমশাই ছিয়াত্তরে বেশ শক্ত আছেন। চট্টগ্রামের উত্তরভূষি গ্রাম থেকে মুম্বইতে এসে একটা জীবন কাটিয়ে দিলেন। নরেশ বাঁড়ুজ্জেমশাইয়ের সম্পাদনায় ‘প্রগতি’র ঠাকুর গড়তে বর্ধমানের পূর্বস্থলীর তথা ‘চুপি’ গ্রাম থেকে নিমাই পালের বংশধর অমিত পাল চলে আসেন এ শহরে। পরেশ ও সুনীল দাশ আসেন দমদম নাগেরবাজার এবং মুকুন্দপুর থেকে ঢাক-ঢোল কাঁধে করে। ফাংশান-নাটক (‘শ্রীমান নাবালক’ পরিচালনা সত্য চক্রবর্তী) ইত্যাদি নিয়ে ‘প্রগতি’ প্রায় চার-পাঁচ লক্ষ ভক্তকে খিচুড়ি-লাবড়া-মিষ্টি খাইয়ে তৃপ্ত করার বাসনায় খরচ করেন কমবেশি কুড়ি লক্ষ টাকা। এর থেকেই জমিয়ে ভারত সেবাশ্রম সংঘের ক্যানসার ওয়ার্ডের জন্যে একটি ঘর বাবদ অর্থদান করেন।

ঠাকুর কমপ্লেক্স কান্দিবালি বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনে ২০০৫ ও ২০০৬-এ পুজো করেছেন পুরোহিত ভট্টাচার্যমশাই। ভারি প্রাণবন্ত এই শঙ্করবাবু। এর সঙ্গে গপ্পো-আড্ডার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া যাবে মনতাজে পরের কোনও সময়ে।

এ ব্রাহ্মণ ‘কমপ্লেক্সে’র পুজোটি ছেড়ে পাশের পাড়ার পুজোয় মগ্ন হয়েছেন। জিজ্ঞেস করলুম, ‘‘তা, যাঁদের পুজো গত বছর থেকে শুরু করেছেন, তাঁদের ক্লাবের নামটি কী?’’

‘‘ঠাকুর ভিলেজ বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন। এঁদের কয়েক জন কর্তাব্যক্তি পাশের ওই কমপ্লেক্সের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন। তাঁরা কী কারণে কে জানে আলাদা হয়ে সরে এসেছেন। এসে নতুন সংগঠন ‘ঠাকুর ভিলেজ’ নাম দিয়ে শুরু করেছেন নতুন বারোয়ারি পুজো।—’’

হবেই! এক বাঙালি একলা। দুই বাঙালি গপ্পো আড্ডা। তিন বাঙালি একত্র হওয়া মানেই দুগ্গাপুজো লাগিয়ে দেওয়া। চার বাঙালি একত্র হলেই দুটি পুজো লেগে যাবে। ‘‘তা আপনি ওদের পুরোনো বড়ো পুজো ছেড়ে নতুনদের দলে ভিড়লেন কেন? দক্ষিণে বেশি? একটু খোঁচাই দিলুম। হেসে বললেন,

‘‘না-না! তা নয়। আসল অই ‘টাকু ভিলেজই’ আমার যজমান বেশি। ওদেরই উদ্যোগে, বলতে গেলে এই নতুন পুজো।’’

এই শহরের আদি বারোয়ারি দুর্গা পুজো কটির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শিবাজি পার্কে ‘বেঙ্গল ক্লাবে’র পুজো। এই ৭০/৭৫ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যময় ‘বেঙ্গল ক্লাব ও পুজো’র শুদ্ধতা অমলিন হোক—এই প্রার্থনা।....

কারণ, পশ্চিম ঘেঁষা মুম্বইতে বসে মনে পড়ে কাশবনের ঢেউ দেখেছিলুম সেই ‘পথের পাঁচালি’তে অপু-দুর্গার সঙ্গে। শিউলির সুগন্ধও প্রায় ভুলতে বসেছি। শুধু এখনও, এই পাঁচটি দিন মন-প্রাণ-নাচিয়ে দেয়, মাতিয়ে দেয় ঝলকে ঝলকে বয়ে আসা শরতের বাতাসে ঢাকের মাতাল বাজনা—

...ঢ্যাং কুরকুর নাকুড়-নাকুড়

অলঙ্করণ: প্রতিবেদক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE