Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ভগবানের বিশেষ দর্শন

মুম্বই মনতাজ-এ মিলন মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

তিন-চার দশক আগে, বলতে গেলে সেই মান্ধাতা আমলে, কেদারনাথ যাত্রার কথা বলা শেষ হতেই ভগবান ভক্ত রক্ষেকালীর প্রশ্নবাণ।

‘‘তা’ কেদারবাবার কথা, তেনার মন্দিরটির কথা তো কিছুই বললে না—’’

একটু ভেবে নিয়ে জবাব দিলুম,

মন্দিরের কথা আর কী বলব? যেমনটি হয়। পেছনে সাদা তুষার ঢাকা হিমালয়ের পটভূমিকায় কেদারনাথ মন্দির। তে-কোনা চূড়াওয়ালা পাথরের মন্দির—’’

বলে সেই কবেকার হাতে-আঁকা ছবিটি দেখালুম। হলুদ হয়ে-যাওয়া ড্রইংয়ের খাতাটি ভক্তিভাবে কপালে ঠ্যাকালে রক্ষেকালী। গদগদ কণ্ঠে, চোখ বুজে বললে, ‘‘জয় বাবা কেদারনাথ।’’ পরক্ষণেই শুধোল, ‘‘আর বাবাঠাকুর? বাবাকে কেমন দেখলে?’’

যেমন হয় বলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলুম। কারণ, ভেতরে পুজো-টুজো দিতে বা তথাকথিত স্পেশাল শালগ্রাম শিলা বা শিবের মূর্তি দেখার আগ্রহ তখন শুকিয়ে গিয়েছিল একটিই কারণে।

মন্দিরের ছোট্ট দরজার এক ধারে দর্শনার্থীদের দীর্ঘ লাইন দীর্ঘতর হচ্ছিল। সকলেই দূর-দূরান্ত থেকে অজস্র ধকল সয়ে পুণ্যতীর্থ স্থানে হাজির হয়েছিল। দরজার কাছে পৌঁছতেই যে তিন-চার জন পুরোহিত পাণ্ডা লাইন সামলাচ্ছিলেন তাঁদের কটূ এবং উদ্ধত আচরণ আগে থেকেই লক্ষ করেছিলুম। দরজাটির কাছে পৌঁছে গেছি। পাণ্ডারা এগিয়ে যাবার তাড়া দিচ্ছিল।

জলদি করো আগে বাড়ো—

আমি ভেতরে গিয়ে দর্শন করব। বলতেই হাত বাড়িয়ে দিল,

ভেতরে ঢুকলে পঞ্চাশ, বসে থাকলে একশো রুপেয়া’’

অর্থাৎ আজকের হিসেবে পাঁচশো টাকা। কথা না বাড়িয়ে নিজেই লাইন থেকে সরে গিয়েছিলুম।

এখানে, এই শিরডির সাঁইবাবার মন্দিরের সুদীর্ঘ রেলিং দেওয়া লাইনে সে উপায় নেই। মস্ত হলঘরের মতো ‘প্রতীক্ষালয়ে’র দু’ধারে রেলিং ঘুরে ঘুরে চার-পাঁচটি পাকের পর পৌঁছেছে গর্ভগৃহের ভেতরে। সাঁইবাবার মূর্তির সামনে।

গতকাল বিকেলে বেরিয়ে পড়েছি মুম্বই থেকে। সপরিবার বন্ধুর সঙ্গে তার ইনোভা গাড়িতে চেপে। রক্ষেকালীও যুতে গিয়েছিল ‘পুণ্যিলাভের আশায়। জোড় হাত কপালে ঠেকিয়ে বলেছিল, বেলুড়-দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের থানে মাথা ঠুকে এয়েছি, এ রাজ্যের ‘ঠাকুর’-দর্শন না কল্লে তো পাপের বোঝা বাড়বে।

মহারাষ্ট্রের শিরিডি হল আহমেদ নগর জেলায়। মুম্বই থেকে নিদেন তিনশো কিলোমিটার দূরে। নাসিক ছাড়িয়ে তার পর। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ নাসিক ছাড়িয়ে গাড়ি দাঁড় করানো হল। টেফিন কৌটো থেকে ‘পিকনিকে’র কায়দায় ডিনার সেরে ফের গাড়িতে আরও ঘণ্টা খানেকের পর শিরডির থান। চার তারা হোটেল ‘হৃষিকেশে’ ওঠা গেল রাত বারোটার পর। আধো ঘুম আধো জাগরণে রাত ৪টে অবধি কাটিয়ে গরম জলে স্নান করে হাঁটতে হাঁটতে মন্দির পৌঁছে দেখি প্রতীক্ষালয়ের লাইনে শ’তিন-চার দর্শনার্থী আমাদের আগে পৌঁছে গেছেন। আমরাও যুতে গেলুম।

প্রতীক্ষালয়ের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় ‘ক্লোজ সার্কিট টিভি’তে দেখতে পাচ্ছি সাঁইবাবাকে স্নান করাচ্ছেন সাত জন পুরোহিত। শ্বেত পাথরের মূর্তিকে দুধে জলে ভারি যত্নের সঙ্গে। সমান তাল মন্ত্রপাঠের মতো কোরাস কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে—

‘ওঁ সাই নমো নমহ,
শ্রী সাই নমো নমঃ

জয় জয় সাই নমো নমহ,
সৎগুরু সাই নমো নমঃ।।

অপেক্ষমাণ সকল পুণ্যার্থীই কণ্ঠে মিলিয়ে মন্ত্রোচ্চারণে অংশ নিচ্ছেন। ওয়েটিং রুমের ভেতরে লাইন একটিই। ভারী সুষ্ঠু ব্যবস্থা। সুদীর্ঘ সারিটি হলের প্রধান কপাট ঘুরে এসেছে। স্টেইনলেস স্টিলের রেলিং দিয়ে একই লাইনকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চার-পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এমনই একটাই লাইনের অন্য প্রান্তে সাইবাবার গর্ভগৃহের দুয়ার। সাঁইবাবাকে স্নান করানোর পর তাঁকে লাল বস্ত্রে সজ্জিত করে যখন গর্ভগৃহে দুয়ার খোলা হল, তখন সকাল সাড়ে ছ’টা।

লাইন এগোতে শুরু করল। আমরাও শম্বুক গতিতে এগোচ্ছি। শ’দেড়েক মতো ভক্ত গর্ভগৃহে ঢুকে প্রণাম করে, পুজো দিয়ে দুধ, নতুন চাদর, নারকেল ইত্যাদি মানত পূর্ণ করে প্রণাম শ্রদ্ধা জানিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বেরিয়ে যাবার পথে। যন্ত্রের মতো সমান তালে, ছ’সাত জন পূজারি-পুরোহিত দ্রুত লয়ে এই সব ব্যবস্থায় সহযোগিতা করছেন। হঠাৎ থেমে গেল দীর্ঘ লাইন। প্রায় আধ ঘণ্টা এক পাও এগোলো না। কী ব্যাপার? না ভিআইপি দর্শন। অর্থাৎ কোনও মন্ত্রী বা তথাকথিত কোনও ‘গণ্যিমান্যি’ নাগরিক অথবা ফিল্মের তারকা ভেতরের বিশেষ দরজা দিয়ে ঢুকে ‘স্পেশাল’ পুজো বা আরতি দিচ্ছেন। সুতরাং আমজনতা স্থবির হয়ে, দমবন্ধ করে দাঁড়াও। ‘ভিআইপি’ মশাই প্রাণভরে পুজো আচ্চা সেরে বেরুলে তবে আবার আমাদের নগণ্য জনগণের পালা।

এতক্ষণ বেশ ভাল লাগছিল। ধূপধূনোর গন্ধ ভরা মন্দিরের ভেতরে ঢুকে মন্ত্রোচ্চারণের ধ্বনি মিলেমিশে সকালটি ভারী পবিত্র, সুন্দর লাগছিল। সমস্ত কিছুই মূহূর্তে গেল বিষিয়ে। ঈশ্বর-ভগবান –দেবতা বা তাঁদের অবতার, যাঁরা সাধারণ মানুষের মধ্যেই কালক্রমে অবতার হয়ে উঠেছেন, তাঁদের কাছে আজ কি ভিআইপি, মন্ত্রী বা সিনেমা তারকারা বিশেষ ভক্ত হিসেবে প্রাধান্য পাচ্ছে?

প্রথম পাতায় লেখা ঘটনাটি বছর খানেক আগের। আজকের এই মনতাজে যে সুখের খবরটি পরিবেশন করার জন্যে এইটুকু উপক্রমণিকা দরকার ছিল। সেটি এই রকম।

গত মাসে শিরডির সাঁইবাবা মন্দিরের নবাগত কর্তৃপক্ষ ‘ভিআইপি’ মন্ত্রী বা কোনও তাবড় ‘নক্ষত্র’কে স্পেশাল পুজো ইত্যাদি দেবার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। সুতরাং এখন থেকে পুরো সপ্তাহের পাঁচটি দিনই সকাল দর্শনার্থী একই মূল্যায়নে একই লাইনে দাঁড়াবেন অপেক্ষা করবেন এবং যথারীতি নিয়মে পুজো ‘আরতি’ করবেন। শুধু শনি ও রবিবার যে কোনও ভক্ত যৎসামান্য ‘ফি’ বা ‘চাঁদা’ দিয়ে সাঁইবাবার দর্শন পেতে পারেন অথবা মানতের পুজো দিতে পারেন আলাদা—সুদীর্ঘ লাইনের ভিড় এড়িয়ে। সীমিত সময় বরাদ্দ এর জন্যে। সকাল ন’টা থেকে বারোটার মধ্যে যে কোনও সাধারণ মানুষই অবস্থা ব্যতিরেকে অসাধারণ হয়ে উঠতে পারেন। একশো টাকার দর্শন ও পুজো। পাঁচশো টাকার ডোনেশান দিলে আরতি ও সঙ্গে যুক্ত হবে।

মহারাষ্ট্রের এক প্রধান পীঠস্থান এই শিরডিতে ব্যবস্থার পরিবর্তনের রাজা-উজির তথা সাধারণ বা আমজনতার মধ্যে ফারাক কিঞ্চিৎ ঘটেছে। মন্ত্রী-ভিআইপি তারকারাও যে আদিতে সাধারণ মানুষ এবং মানুষ নন সেটি মেনে নেওয়া হয়েছে ভাল কথা।

তবুও সেই ‘একশো-পাঁচশো’ ওয়ালা আর হত দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিস্তর ফারাক তো রয়েই গেল। স্পেশাল পয়সা ওয়ালা ‘দর্শন’ ও সাধারণ নিঃস্বের ভক্তিতে যে তফাত তা তো ঘুচলো না। হায় সাঁইবাবা। তোমার ধ্যানধারণার বক্তব্য বা তোমার দেখানো পথে আজ, অ্যাতোদিন পরেও যে কেউ হাঁটছে না। না কেউ বলা ঠিক হবে না—কারণ কিছু কিছু মানুষ পৃছিবীতে আছেন যাঁরা এখনও সেই পথ অনুসরণ করবার যথেষ্ট চেষ্টা অন্তত করেন।

জীবৎকালে সাঁইকে ‘ফকির’ হিসেবে কেউ পয়সাকুড়ি দান করতে গেলে আঁতকে উঠতেন। মুখ ভারি করুন হয়ে যেত। সেই করুণ, করুণা-মাখা মুখের সাঁইবাবা সামান্য অপ্রস্তুত গলায় বলতেন, এগুলো আমাকে কী দিচ্ছো ভাই। যদি দিতেই ইচ্ছা করেন। তো দু’মুঠো চাল ডাল দিন খেতে পারবো।’’

তাঁরই নামে মন্দির এখন টাকার ছড়াছড়ি। বাবার মূর্তিটি ছিল পাথরের। পরে ক্রমশ ভক্তদের ভক্তির ঠেলায় এই মানবেশ্বরকে এখন সোনা রূপোয় বাঁধানোর কথা হচ্ছে। জীবিত থাকলে উনি অবশ্যই প্রবল আপত্তি করতেন। জীবনের প্রান্ত সীমায় এসে উনি এক কাণ্ড করেছিলেন, মনে পড়ে। সাঁই ঠাকুরের জ্বর হয়েছে ক’দিন ধরে। শীতের রাতে শরীর গরম রাখার জন্যে আগুন জ্বালানো হয়েছে। সেই চুল্লি ঘিরে বসে আছে নাসিকের গ্রামবাসী। বেশির ভাগই এই ফকির বাবার কাছে আসে বা সঙ্গে থাকে। তাদের সঙ্গে কথা বলছেন, গল্পকথা শোনাচ্ছেন বাবা খালি পায়ে তাঁর অঙ্গবস্ত্র বলতে কৌপিন গোছের একটি খাটো ধুতি বা লুঙ্গি জড়ানো। কথা বলতে বলতে, উত্তেজিত হচ্ছিলেন। তথাকথিত ধর্মাধর্ম নিয়ে কথা। ওঁর বক্তব্যের ছোঁয়া ছিল তখনকার মূল দুটি ধর্মের বিষয়ে। হিন্দুত্ব ও ইসলাম। হিন্দু ও মুসলমান মানুষজন। ফকিরের বক্তব্যের সার কথাই ছিল ‘জাতি’র হেরফের বিশ্বাসের ব্যবধান সৃষ্টি করে গেছে মানুষই। অথচ প্রকৃতি (বা ঈশ্বর আল্লা) কখনওই এহেন ভেদাভেদ সৃষ্টি করেননি। আগুনের চুল্লির চার পাশে বসা গ্রামবাসী বা তাঁর শিষ্যদের ঘিরে ঘিরে চক্রাকারে হাঁটতে লাগলেন উত্তেজনার বলে। মুখে বলছেন, যেন বর্তমান মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে,

ওরে, তোরা কেউ আমার কথায় কান দিলি না কেউ বিশ্বাস করলি না যে আমরা সবাই সমান মানুষ। কোনও ভেদ নেই। মুসলমান কোনও রূপেই হিন্দুর থেকে বা হিন্দুরা মুসলমানদের থেকে আলাদা নয়’’

বলতে বলতে সেই ফকিরবাবা অগ্নিকে সাক্ষ্যি রেখেই যেন নাচতে লাগলেন আগুন মানুষদের ঘিরে ঘুরে ঘুরে বৃত্তাকারে। সামান্য কৌপীন কখন তাঁর অঙ্গ থেকে খসে খসে পড়ে গেছে। তিনি বলছেন,

‘‘দ্যাখ দ্যাখ রে তোরা, হিন্দু-মুসলমান মানুষ আমিও ঠিক তোদের মতোই তোদের মধ্যেও যে বাস করে সে তো সকলের মধ্যেই বসবাস করেন তোরা তাকে যা উচ্ছে নাম দিয়ে ডাকতে পারিস—

ছেলেবেলা থেকেই এই কথার রেশ শুনে এসেছি। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথায়, নানান সময়ে নানা রূপে। তারই নমুনা পেয়েছি, ‘‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেধিছে ঈশ্বর। আবার তাঁরই একান্ত শিষ্য নরেন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের বাণীতেই একই কথার অনুরণন ‘‘রহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজছি ঈশ্বর—’’

আবার ঠাকুরের মতে,

‘‘ভক্তের কোনও জাত নেই। ঈশ্বর প্রেমই তাদের সকলকে একাত্ম করেছে। যুগাবতারগণ যুগে যুগে এসে একই কথা বলে গেছেন সেই বিষ্ণুর অবতার কেষ্টঠাকুর তেকে যিশুখ্রিস্ট, শ্রীরামকৃষ্ণ, সাঁইবাবা—সকলেই। অথচ হায় মানবজাতি। তোদের জীবনবোধ বদলালো কোথায়? আজও সেই মানুষেরাই মন্দিরাদির প্রবেশমূল্য ধার্য করে। ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি অর্পন করতে গেলেও টাকা-পয়সা, আরতি-পূজো করতে গেলেও সেই অর্থবিহীন টাকার ঝনঝনানি। অথচ যুগে যুগে টাকা মাটি মাটি টাকা।

অথবা, এ আমাকে কী দিচ্ছে ভাই? দুমুঠো চাল দিতে পারো’’

এঁদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে কোনও কথা বলা স্রেফ ধৃষ্টতা। তবে, এটুকু বলতে দ্বিধা নেই,

‘‘এ বার তোরা মানুষই!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

milan mukhopadhay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE