Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

স্ট্রিট ফুড ও মরাঠি পাকশালা

‘বাসনার সেরা রসনায়’। বাঙালি বেজায় খাদ্যরসিক। একটু ঠাট্টা করে বলা যায় বেজায় পেটুক। সে কবজি ডুবিয়ে বিরিয়ানি পোলাও কোর্মা কালিয়াই হোক বা শেষ পাতে মিষ্টি। ‘জিভে জল’ এনে দেওয়ার সুস্বাদু ব্যাঞ্জনের এলাহী সম্ভার রয়েছে আমাদের দেশে। খাদ্য ও রন্ধন নৈপুণ্যের অদ্ভুত ও সুগঠিত একত্রীকরণ হয়েছে এদেশে। কখনও তা প্রামাণিক। কখনও অন্য রাজ্য থেকে প্রভাবিত। কখনও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।

মধুছন্দা মিত্র ঘোষ
শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

‘বাসনার সেরা রসনায়’। বাঙালি বেজায় খাদ্যরসিক। একটু ঠাট্টা করে বলা যায় বেজায় পেটুক। সে কবজি ডুবিয়ে বিরিয়ানি পোলাও কোর্মা কালিয়াই হোক বা শেষ পাতে মিষ্টি। ‘জিভে জল’ এনে দেওয়ার সুস্বাদু ব্যাঞ্জনের এলাহী সম্ভার রয়েছে আমাদের দেশে। খাদ্য ও রন্ধন নৈপুণ্যের অদ্ভুত ও সুগঠিত একত্রীকরণ হয়েছে এদেশে। কখনও তা প্রামাণিক। কখনও অন্য রাজ্য থেকে প্রভাবিত। কখনও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। কোনও কোনও রান্নার পদ আবিষ্কৃত হয়ে গেছে হঠাৎই। বিভিন্ন ঘরানার রন্ধন শৈলির জন্য ভারত খ্যাত। অ়ঞ্চলভেদে ও প্রদেশভেদে রান্নার কায়দা রীতি কুশলতারও তারতম্য হয়। তবে রন্ধন একটি শিল্প।
আপাত পরবাস যাপনের খাতিরে মুম্বই তথা মহারাষ্ট্রকে বিশদে জানার তাগিদ রোধ করি। মরাঠা সম্প্রদায়, তাদের কৃষ্টি সংস্কৃতি, লোকাচার, উৎসব, সাহিত্য, রন্ধনশৈলি ও খাওয়া দাওয়া। এ বারের প্রতিবেদনটিতে শেষোক্ত দুটিকেই ধরার চেষ্টা করি। আরব সাগরের ঢেউ ছলকানো ও পশ্চিমঘাট পাহাড় ঘেরা লোনা বাতাস মাখা মুম্বই মহানগরের নিজস্ব কিন্তু রন্ধনশৈলি, সে রান্নার বৈচিত্র, এখানে ব্যবহৃত বিভিন্ন মশলার সঠিক ব্যবহার, এখানকার স্ট্রিট ফুড খাবার পর রমরমা এ সব নিয়েই লেখা এগোয়। মুম্বইয়ের রান্না, রান্নার আয়োজন সমস্ত সম্বন্ধে জানার আগ্রহ থেকেই প্রতিবেদনটি সাজাতে থাকি। আর এই মরাঠি রানান তথা খাবার নিয়ে লেখা শুরু করতেই দেখি কালি ও কলম আপাত জং ধরা খোলস ভেঙে দিব্য তৎপর।
মুম্বইয়ের ‘স্ট্রিট ফুড কালচার’—বেশ একটা অন্যরকম ব্যাপারস্যাপার আছে। সেখানে যেমন অনেক রকম নিজস্ব মরাঠি ঘরানার খাবার দাবার রয়েছে তেমনই আবার দক্ষিণ ভারতীয় ও কিছু চিনা খাবারও সংযুক্ত হয়েছে। বিশেষত মুম্বই-পুণে এ সব মেট্রোপলিটন শহরগুলিতে প্রায় সকাল শুরু হতে না হতেই শুরু করে বিকেল-সন্ধে পেরিয়ে বেশি রাত পর্যন্ত রমরমিয়ে চলে পথ চলতি এই সব দোকানগুলো। প্রতিটি ভেন্ডার স্টল বা স্ট্রিট ফুডের ভিড় ঠাসা দোকানগুলো অভ্যস্ত দক্ষতায় আপাত মুখরোচক খাবার সমূহ চটজলদি প্লেটে সাজিয়ে ক্ষুদার্থ ভোজনরসিকদের হাতে তুলে দেয়। বাইরের দোকানে এই সমস্ত খাবারদাবার গুলো স্বাদ-বর্ণ-গন্ধে ও দর্শনে না হয় ভাল লাগা থাকলে কতটা স্বাস্থ্যসম্মত সে কথা ভেবে লাভ নেই। মুম্বইবাসীদের যে বড় আদরের এই ‘রাস্তে ওয়ার্চি’ খাবার।

বাঙালির সকালের জলখাবার লুচি আলু খেঁচকি বা আলুর দম বা পাতি দুধ-মুড়ি-কলা নয়। বাঙালির ব্রেকফাস্টও এখন রীতিমতো গ্লোবাল। সেখানে যেমন আছে প্রাদেশিক খাবার ধোকলা, মোমো, ক্লিয়ার স্যুপ, আলুপরটা, ধোসা, ইডলি, দই বড়া সমসা চাট, ভেলপুরি, লিট্টি তেমনই বিদেশিয়ানায় স্যান্ডউইচ, ওমলেট, প্যানকেক, বার্গার, পাস্তা, মাসরুখ সসেজ, কর্নফ্লেক্স, মুসলি, ফ্রেঞ্চফ্রাই, বেবি কর্ন স্যুপ, ক্লাব কিংবা চিজ গ্রিলড স্যান্ড উইচ, পিৎজা ইত্যাদি। আবার বিকেল বা সান্ধ্যকালীন জল খাবার মুড়ি মাখা, তেলেভাজা, সিঙারা, ফুচকা, চিড়ে বাদাম ভাজা, ফিস ফ্রাই, এগ রোল, মোগলাই, চাউমিন ইত্যাদি নানা পদ তো আছেই। খোদ মুম্বইয়েও সকাল থেকে সন্ধে হরেক পথ চলদি খাবারদাবারের এলাহি হাতছানি। সেখানে মহারাষ্ট্রিয়ান খাবার ছাড়াও পরিবেশিত হচ্ছে মেদু বঢ়া, উপমা, মাইসোর মশালা ধোসা, অনিয়ন মশালা উত্তপম, পুরী ভাজি, পুরি ছোলে, ছেনা পোড়া, লিট্টি চোখা, থুপপা, মোমো, ইডলি-সম্বর, মশালা ছাল, শ্রীখণ্ড পুরী, কর্ন আলু টিক্কি, আলু পরোঠা ইত্যাদি।

মরাঠা কুইজিনে ব্যবহৃত যাবতীয় রান্নাবান্নার মূল রসদ হল জোয়ার, বাজরা, গম, ডাল ও চাল ইত্যাদি শস্য। মুম্বইকর ও কোঙ্কন উপকূলে ভাত প্রধান খাদ্য। নগরাঞ্চলে আটা ও ময়দার চাপাটি এবং বাজরার আটায় তৈরি ‘ভাখরি রোটি’ বেশ প্রচলিত। গ্রামীণ এলাকাগুলিতে যেখানে দারিদ্র সীমার নীচে বহু মানুষ বসবাস করেন তাঁরা প্রধানত ‘বাজরি ভাখরি রোটি’ খান শুখা আচার ও কাঁচা লঙ্কা পেঁয়াজ সহ। ছোলার ডালের আটার একটা মরাঠি পদ ‘জুনকা’ বা ‘পিঠালে’ গ্রামীণ এলাকার মানুষজনদের একটা নিত্য খাদ্য। যদিও এই পিঠালে খাবারটি শহুরে মরাঠি পরিবারও খান। মরাঠি ভাষায় আনাজপাতিকে বলা হয় ‘ভাজি’। মরাঠি রান্নায় গোটা মশালার ব্যবহারই বেশি। এরা রান্নায় ব্যবহার করেন পেঁয়াজ, রসুন, আদা, লাল মির্চ, সবুজ লঙ্কা, হিং, ধনে, জিরে, হলুদ ইত্যাদি। তবে শ্রাবণ মাস ভর অনেক গোড়া হিন্দু পরিবার পেঁয়াজ রসুন খান না।

মুম্বইয়ে এসে থেকেই এঁদের মরাঠি খাবারদাবারের প্রতি জানার আগ্রহ ছিল। মহারাষ্ট্রের রন্ধনরীতি আমাদের বাঙালিদের থেকে অনেকটাই আলাদা। মহারাষ্ট্রের মানুষরা সরষে তেল, সর্ষে বাটা খেতে একেবারেই অভ্যস্ত নয়। কিছু রান্নায় এরা সর্ষে দানা বা রাই সাঁতলানো বা ফোড়ন দেওয়া হিসেবে ব্যবহার করে। নিখুঁত মরাঠি স্টাইলে মাচ্ছি ফ্রাই, ভোজনা বা মালভনি মশলা সহযোগে মাচ্ছি কারি, প্রণ কোলিওয়ারা, জিঙ্গা মালওয়ালি, পমফ্রেট কোলহাপুরি, সুরমাই কুন্ডাপুরি তাওয়া ফ্রাই, পমফ্রেট ড্রাই মশালা তাওয়া ফ্রাই, রাওয়াস রাজমুন্দ্রি, রাওয়াস তাওয়া ফ্রাই, ক্র্যাব তাওয়া মশালা এই সবও মরাঠি আমিষভক্ত পরিবারগুলির পছন্দের ব্যাঞ্জন।

মরাঠি গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে মাছ-মাংসের তেমন প্রবেশাধিকার নেই। তবে এটাও ঠিক যে দিনকাল তো পাল্টাচ্ছে। খাওয়াদাওয়ার বাছবিচার তোয়াক্কা করে না আজকের প্রজন্ম। বাড়িতে হয়তো আমিষ পদ খাওয়ার রেওয়াজ নেই, তবে রেস্তোরাঁ বা বাড়ির বাইরে অন্য কোথাও মচ্ছি ফ্রাই বা মাচ্ছি কোস্টাল কারির স্বাদ হামেশা নিয়ে থাকে। মরাঠা ও কোঙ্কণ উপকূলের মানুষজন মূলত ভাতের ভক্ত। মাছের নানা কোঙ্কনি পদ ভাতের সঙ্গে খাওয়াই তাদের পছন্দ। ‘বম্বে ডক’ মহারাষ্ট্রের অন্যতম পরিচিত একটি মাছ। মরাঠিরা এই মাছটিকে ‘বমবিল’ বলে থাকেন। আরবসাগরের লোনা জলে রাওস, বমবিল, সুরমাই, মান্দালি, বাংড়া, হাওয়াই, জিঙ্গা এই সব বিবিধ সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণে। ‘জিঙ্গা’ মানে ‘চিংড়ি’ এ কথা তো মুম্বইবাসী সব বাঙালিরা জানেন। মুম্বইকররা বোনলেস বা কাটা ছাড়া মাছই বেশি পছন্দ করেন। টাটকা বমবিল ফ্রাই হোটেল রেস্তোরাঁয় খাবারের মেন কোর্সের আগে ‘স্টাটার’ হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয়। সাইজ অনুযায়ী ‘সি ফুডস প্লেটার’ এই সব ‘স্টাটার’ হিসাবে দিব্যি চলে।

প্রায় প্রতিটি মরাঠা-কোঙ্কন পরিবারের পাকশালাতে ‘মালভানি মশলা’ নামে নির্ধারিত কিছু মশলার মিশ্রণ মজুত থাকে। ‘কোলিওয়ারা’ নামক আরও এক ধরনের মশলা ব্যবহার করেন এঁরা। মরাঠি পাকশালায় হালকা থেকে মশলাদার বিভিন্ন ভোজনের রকমফের রয়েছে। গ্রামাঞ্চলের লোক তো বটেই, শহর অ়ঞ্চলের বেশির ভাগই জোয়ার ও বাজরার রুটি খায় এ কথা তো আগেই বলেছি। গমের আটা বা ময়দার চল তেমন নেই বললেই চলে। এখানকার লোকে জোয়ার বাজরার রুটিটা খায় বস্তুত এই কারণে যে, কোঙ্কণ উপকূল ও বিদর্ভ অঞ্চলে ধান, জোয়ার, বাজরা শস্যের ফলন খুব। সে জন্য মরাঠি পরিবারের রান্নায় প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ভাত, রুটি, ডাল, সবজি এসবই পরিবেশিত হয়।

মুম্বইকররা খাবারের থালার পাশে বাটিতে স্যুপ জাতীয় এক প্রকার তরল পানীয় ব্যবহার করেন। যেমন, ‘কড়ি’ পরিবেশন করা হয় খিচরির সঙ্গে। নারকেলের দুধ ও কোকম ফলের রস দিয়ে তৈরি ‘সোলকড়ি’ এবং শুধুমাত্র কোকম ফল দিয়ে তৈরি ‘কোকম সার’ বা চাটনি পরিবেশিত হয় অন্যান্য খাবারের থালার সঙ্গে। মুম্বইকররা বাড়িতে ‘টাক’ নামের এক প্রকার পানীয় তৈরি করেন। বিশেষত গরমের দিনে। আমাদের দইয়ের ঘোল জাতীয় পানীয়টি। তবে টাক-এর পদ্ধতি ও স্বাদ একেবারেই আলাদা। ‘ছাস’ নামে আরেকটি পানীয়ও এ দেশে খুব জনপ্রিয় গরমের দিনে। দই জাতীয় ‘শ্রীখণ্ড’ নামে আরও একটি খাদ্যবস্তু মুম্বইয়ে সবাই বেশ পছন্দ করেন। মুম্বইয়ের শপিং মলগুলির ফুড সেকশনে নানান ফ্লেভারের ‘শ্রীখণ্ড’ পাওয়া যায়। আমার প্রতিবেশী সীমা কার্লেকারকে দেখেছি বাড়িতেই শ্রীখণ্ড তৈরি করতে। ঘরে পাতা সাদা দই, মখমল কাপড়ে বেঁধে খানিকটা টং এ সারারাত ঝুলিয়ে রেখে, জল ঝরিয়ে তার পর তার মধ্যে এলাচ গুঁড়ো বা পছন্দসই এসেন্স দিয়ে গুঁড়ো চিনি, ওপরে কিছু ড্রাই ফ্রুটস ছড়িয়ে ফ্রিজে ঠান্ডা করে পরিবেশন করতেও দেখেছি। মরাঠিরা এই শ্রীখণ্ডের ‘চাক্কা’ বা পুর ভরে কচুরিও বানান।

এই প্রতিবেদনটির প্রায় প্রথমার্ধে প্রসঙ্গত লিখেছিলাম য়ে মুম্বইয়ের স্ট্রিট ফুড কালচারের একটা অন্যরকম ব্যাপার স্যাপার আছে। কত যে ভুরি ভুরি নানাবিধ স্ট্রিট ফুডের সন্ধান পাওয়া যায় এই পথ চলতি দোকানগুলোয়। বিক্রিও দেদার। সে মরাঠাদের এক্কেবারে নিজস্ব কিছু ব্যঞ্জন থেকে শুরু করে প্রাদেশিক অন্যান্য ব্যাঞ্জন থেকেও ধার করা খাবারদাবার। যেমন পাওভাজি, মিশাল পাও, বঢ়া পাও, পোহা, সিরা, সাবুদানা বড়া, বটাটা বড়া, থালিপেঠ, সাবুদানা খিচরি, মেথি বঢ়ে, মেদু বঢ়া, ডালেম্বি, পুরেনি মিশাল, নিড়, বম্বে মিক্স, সাবুদানা চিড়া, কিমা পাও, কান্দা ভাজি, পানি পুরি, সেও পুরি, সমোসা বড়া, বেসন পাও ইত্যাদি সমস্তই মরাঠি জলযোগ। মরাঠি আ়ঞ্চলিক এই সব দোকানগুলো সব সময়েই ভিড়ে ঠাসা।

প্রাদেশিকতার মিশেলে এই স্ট্রিট ফুডগুলোয় আরও সংযুক্ত হয় হাল্কা নুডলস, হরিয়ালি কাবাব, বাটার মশলা কর্ন, মকাই দানা রোস্ট, সিজওয়ান, নুডলস, বয়েলড ও ফ্রায়েড মোমো, এগ রোল, স্প্রিং রোল, পনির টিক্কা, চিকেন টিক্কা, লিট্টি চোখা, টাঙ্গগি কাবাব, চাইনিজ ভেল। চিকেন ললিপপ, মহিরাসানা টিক্কা, দহি বড়া, ইডলি, ধোসা, উত্তপম, উপমা ইত্যাদি নানান খাবার। এ ছাড়া আধুনিক প্রজন্ম এখন পিৎজা হাট, ম্যাকডোনাল্ড, কে এফ সি, ফাসো’স ইত্যাদি আউটলেটে পেট ভরানো খাবার ভেজ রাপস কিংবা নন ভেজ রাপস, ক্লাব স্যান্ডউইচ, ইটালিয়ান চিজ স্যান্ডউইচ, ভেজ কিংবা চিকেন বার্গার, স্পাইসি ভেজ পিৎজা, চিজ গার্লিক ব্রেড, ডিলাক্স ভেগ্গি, বারবি কিউ চিকেন, স্পাইসি সালোমি, ইটালিয়ান পিৎজা উইথ ভেজ-নন ভেজ টপিং ইত্যাদি হরেক বিদেশি খাবারের হরেক আয়োজন।

মুম্বাইয়া স্ট্রিট ফুড এ পাওভাজি একটা দুর্দান্ত রেসিপি। ঝাঁ চকচকে এই মহানগরে তথা সমস্ত মহারাষ্ট্রের এক অন্যতম খাবার পাওভাজি। বিশাল লোহার তাওয়ায় চটকানো সবজি ও জমকালো মশলা সহযোগে কষা গ্রেভি সঙ্গে মাখনে সাঁতলানো দুই বা চার পিস পাও। সামান্য আচার, এক টুকরো লেবু, পেঁয়াজ, মশলামাখা কাঁচা লঙ্কা-সহ খোপ কাটা স্টিলের থালায় পরিবেশিত হয়। বেশ উদোর পূর্তি খাবার হলেও পাওভাজি প্রচুর গুরুপাক, প্রচুর মাখন ও মশালাদার। তবে পাওভাজি মুম্বইকদের একান্ত রসনা তৃপ্তির খোরাক। পথের ধারে পর্যটক সমাগম হয় এমন জায়গায়, ধাবাগুলোয় পাওভাজি অন্যতম বিক্রয়লব্ধ ব্যাঞ্জন। অফিসযাত্রী ও কলেজ পড়ুয়াদেরও বেশ প্রিয় খাবার। আবার অন্যদিকে খুব বেশি দামও নয়। পকেট সাশ্রয়ী খাবার এই পাওভাজি।

জুহু বিচের পাওভাজির স্বাদই আলাদা। মুম্বইয়ে বেড়াতে আসা ভিন রাজ্যবাসীর মুম্বইয়ের পাওভাজির স্বাদ নিতেই হবে। এখানেও আবার একটা কৌশলগত ব্যাপার আছে। মহারাষ্ট্রে পাওভাজি বানানো পদ্ধতি মোটামুটি এক হলেও বিভিন্ন কারিগরের উপাদান মিশ্রণ ও রন্ধনের নিজস্বতা বা বলা যেতে পারে নিজস্ব কিছু সিক্রেট থাকে।

আরও আছে বড়াপাও—‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ভেজ বার্গার’। মুম্বইকারদের কাছে অপরিহার্য বড়াপাও হল স্ট্রিট ফুডের শেষকথা। না, এটা কোনও অতিকথন নয়। মুম্বইকররা বড়াপাওয়ের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। এমন কী ম্যারডোনাল্ড এর কাঁচের শো-কেসে নামীদামি সম্ভারকেও হার মানাতে জুরি নেই এই বড়াপাওয়ের।

এ কাটলেট ইন এ বন—পাওয়ের ভেতর কাটলেটটি আর কিছুই নয়, সেদ্ধ আলু, ধনেপাতা কুচি, কাঁচালঙ্কা, চাটমশালা, আদা রসুন পাউডার ইত্যাদি একত্রে মেখে হাতের তালুর সাহায্যে চপের মতো বানিয়ে ব্যসনে ডুবিয়ে ছাঁকা তেলে ভাজা। অর্থাৎ আমাদের দিশি আলুর চপ। এখানে বলে ‘বড়া’, আর ‘পাও’ মানে গোল আকৃতির পাউরুটি। পাওয়ের মধ্যে এই ‘বড়া’ ঢুকিয়ে মাখনে দুই পিঠ সামান্য ভেজে, ওপরে মশলা মাখানো কাঁচালঙ্কা ভাজা সাজিয়ে ভোজনবস্তুটি পরিবেশন করা হয়। আস্ত একখানা বড়া পাওয়ে সুখের কামড় দিতে প্রথমেই যেটা লাগে, সেটা হল বিশাল একখানি হাঁ গাল।

এমনই আছে কিমা পাও। মাংসের কিমা সহযোগে পাও। মূলত মুম্বইতে মুসলিম সম্প্রদায়ের অত্যন্ত পছন্দের এই কিমা পাও। অবশ্য শুধু তাই নয়, ট্যাক্সিচালক, গ্যারেজ কর্মী এঁরাও দ্বৈপ্রাহরিক উদোরপূর্তি করে নেন কিমা পাওয়ে।

সান্ধ্য আহারে চিকেন টিক্কা রোলও বেশ উপাদেয়। একটি পাতলা রুমালি রুটি দিয়ে মোড়া কষা মাংসের কিমা, উপরে চাট্টি ভাজা পেঁয়াজ ছড়ানো।

আরও আছে কান্দা ভাজি, বাংলা তর্জমা করলে বাঙালিদের পেঁয়াজি। বেসনের গোলায় পেঁয়াজ কুচি, ধনেপাতা ও কাঁচালঙ্কা কুচি, সামান্য খাবার সোডা, নুন ভাল করে ফেটিয়ে ডুবো তেলে পাকোড়ার মতো ভেজে তুলে দেওয়া। মুম্বইয়ের সাধারণ লোকেদের বেশ পছন্দের সান্ধ্য ও সস্তা জলখাবার।

দিল্লিতে যাকে বলে ‘গোলগাপ্পা’, উড়িষ্যায় ‘গুপচুপ’ কলকাতায় ‘ফুচকা’—মুম্বইতে ‘পানিপুরি’। পানিচুরির স্টলগুলোতে মহিলাদের মতোই পুরুষদের ভিড়ও চোখে পড়ার মতো। এখানে পানিপুরি পরিবেশিত হয় স্টিলের প্লেটে, সঙ্গে স্টিলের বাটিতে পাতিলেবু, পুদিনা পাতা, চাট মশলা, তেঁতুল মিশ্রিত দ্রবণ। আহা—ভাবতেই জিভ গলে লোনা ধরে পড়বে। একটা ব্যাপার, এখানে পানিপুরিওলারা বেশ হাইজেনিক পদ্ধতিতে পুরো প্রণালীটি সমাধা করেন। প্লাস্টিকের গ্লাভস পরিহিত হাতে, পানিপুরির ভেতর বুড়ো আঙুলের নিপুণ কারসাজিতে মোক্ষম গর্তটি তৈরি করে, তাতে ততোধিক মুখরোচক পুরটি প্রবেশ করিয়ে প্লেটে সাজিয়ে পরিবেশন করেন। খাট্টামিঠা দ্রবণটিও স্টিলের বড় হাতায় তুলে স্টিলের বাটিতে তুলে দেওয়া হয়। বড় রেস্তোরাঁগুলোতে তো মিনারেল ওয়াটারের ব্যবহার চলে পানিপুরির আসলি দ্রবণটিতে। তবে কলকাতার সেই শালপাতার ছোট্ট বাটিতে বিহারী ফুচকাওয়ালার অপরিষ্কার হাত ডুবিয়ে দেওয়া ফুচকার তুলনায় স্বাদেও কিছুটা ফারাক।

মিশাল পাও পুরোপুরি মহারাষ্ট্রিয়ান পদ। সারা বিদর্ভ অঞ্চলেই এই খাবারটির প্রচলন। পুণে শহরে মিশাল পাও বেশি নামকরা হলেও মুম্বইয়ের ‘রাস্তে ওয়ার্চি খায়চ’ হিসাবে মিসাল পাওয়ের কাটতি খুব। এর মশালাদার উপাদানটি স্বাদে ও বর্ণেও লা-জবাব। কল বার করা কড়াইশুটি, আলু, চিঁড়ে, কাঁচা পেঁয়াজ, টমেটো, সেই ভাজা, দই, মাখন ও মিশাল পাও মশলা দিয়ে পাওয়ের সঙ্গে এই পদটি মুম্বইয়ের একটি চূড়ান্ত আহার।

মরাঠি পরিবারে কান্দা পোহা-ও প্রিয় জলখাবারের একটি। ‘কান্দা’ অর্থাৎ পেঁয়াজ ও ‘পোহা’ অর্থাৎ চিঁড়ে, সঙ্গে ভাজা আলুর টুকরো লঙ্কা কুচি, কড়াইশুটি, বাদাম, কিসমিস, গাজর, পেঁয়াজ লেবুর রস—তেলে সরষে ফোড়ন ও কারিপাতা ফোড়ন দিয়ে নাড়াচাড়া করে নামানো। আমাদের বাঙালি চিড়ের পোলাও এঁদের কান্দা পোহা।

বাটাটা বড়া তো মুম্বইকারদের কাছে ‘স্ট্রিট আইকন’ জাতীয় প্রিয় খাবার। আমাদের ওখানকার পাতি আলুর চপ যেমন চ্যাপ্টা আকৃতির, বটাটা বড়া আকৃতিতে গোল। মুম্বই তথা সমগ্র মহারাষ্ট্রের আম জনতার পকেট সাশ্রয়ী পছন্দসই খাবার এটি।

মুম্বইয়ের চৌপট্টি বিচের ভেলপুরির প্রসিদ্ধি সর্বজনগ্রাহ্য। বেলপুরি ‘যখন খুশি খাও’ এমনতর একটি স্ন্যাক্স। কাগজের প্লেটে কাঠের বা প্লাস্টিকের চামচে মুড়ি, সেদ্ধ আলুর টুকরো, পাপড়ি, সেঁউ ভাজা, কাঁচা লঙ্কা-পেঁয়াজি-ধনেপাতা কুচি, আমচুর ভেজানো ছোলা, লাল বাদাম ভাজা, বেলপুরি চাট মশালা, টকমিষ্টি চাটনি ও দই এর মিশ্রণ ভেলপুরি এক অসাধারণ টাইমপাস স্ট্রিট ফুড। ভেলপুরিতে এই মিশ্রণটাই হল আসল রসায়ন।

বম্বে স্যান্ডউইচ ভোজ্য আহারটিও মুম্বইয়ের স্ট্রিট ফুড কালচারের একটি বিশিষ্ট উদ্ভাবন। তিনকোণা করে কাটা পাউরুটিতে পরতে পরতে পুদিনা চাটনি, চাকা করে কাটা পেঁয়াজ, শসা, টমেটো, গাজর সাজিয়ে মাখনে দুই পিঠ ভেজে পরিবেশন করা হয় টমেটো সসের সঙ্গে। মকাই দানা এখানে ছড়ানো অবস্থায় প্রচুর বিক্রি হয়। মহারাষ্ট্রে ভুট্টার ফলন হয় খুব। খুবই মিষ্টি স্বাদের এবং এর প্রতিটি দানাও বেশ বড়। কয়লার আঁচে হাল্কা সেঁকে বিট লবণ পাতিলেবুর রস মাখিয়ে চালু বিক্রি। লাইন দিয়ে অপেক্ষা করতে হয় মকাই রোস্ট পাওয়ার জন্য। তেমনই মকাই বাটার-মশালা রয়েলড এর চাহিদা খুব।

‘স্ট্রিট ফুডের’ মতোই ‘স্টিট ফ্রুট’ ড্রিংস’ এর এ অ়ঞ্চলে চাহিদা প্রচুর। ফলের রসের পার্লার যে রাস্তার দুই ধারে কত তার হিসাব মেলা ভার। মরসুম অনুযায়ী আনারস, কালো আঙুর, আতা, স্ট্রবেরি, মুসাম্বি, কোকম, কমলালেবু, আখ, আম, গাজর ইত্যাদির সরবত বিকোয়। দোকানগুলোয় গরমের দিনে ও শীতের দিনে বিক্রিবাটা প্রচুর। আখের রস, ডাব, নারিয়েল পানি, লস্যি, ছাস এই সবও ঘরোয়া পানীয় স্ট্রিট ড্রিংস হিসাবে গরমের দিনে বিকোয় দেদার। কাগজ বা থার্মোকলের প্লেটে নানান রকম কাটা ফল যেমন, তরমুজ, সফেদা, পাকা পেঁপে, শসা, ফুটি, পেয়ারা, আম ইত্যাদিও পথচলতি মানুষদের খুবই প্রিয় জলযোগ। ফালুদা-কুলফি ও আইসক্রিমের স্টলগুলোর হাতছানি তো সবসময়ে আছেই। সেখানেও কত রকম ককটেল। মহারাষ্ট্রের শৈলশহরগুলোয় চকোলেট, হট চকোলেট ও স্ট্রবেরি মিল্ক সেক, হোম মেড চকোলেট, স্কোয়াস, সিরাপ এর প্রচুর ভিড়ে ঠাসা দোকান ও বিক্রি।

বিবিধ ব্যাঞ্জন এর কথা লিখতে লিখতে কখন যে ডায়েরির পাতাগুলো ভরে উঠল। পাঠক আসুন, বৃষ্টিমায়ায়, ভোজনবিলাসে কাটিয়ে দিই টুকরো কিছু সময়। মুম্বইয়ে এখন উতলধারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE