Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বাজারিয়া

মানিকতলায় বাজার বসে। গড়িয়াহাটে মার্কেট। ফর্দ, ঝাঁকামুটে, দোকানির হাঁকডাকের ভিড়ে পায়ে পায়েসাজানো শপিং মল আর পোষাল না। আমি মল ত্যাগ করে সাবেক বাজারেই ফিরে এলাম ফের। মলে বন্দি শাকসব্জি প্যাকেটে প্যাকেটে। ঢেঁড়সের পিছন ফাটিয়ে কচি ঢেঁড়শ বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই। বেগুনের গা-টা একটু টিপে, আম-লেবু-কাচা লঙ্কার গন্ধ শুঁকে, লাউয়ের ত্বকে নখবিলেখন করে যে বাজার, সেটা মল-এ হয় কই? ল্যাজ-ঝটপটানো কই মাছ কই? কিংবা লটপটানো লটে? মলে লটে-ফটের মতো অকুলীন মাছের ঠাঁই নেই।

অলংকরণ: দেবাশীষ দেব

অলংকরণ: দেবাশীষ দেব

স্বপ্নময় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

সাজানো শপিং মল আর পোষাল না।

আমি মল ত্যাগ করে সাবেক বাজারেই ফিরে এলাম ফের।

মলে বন্দি শাকসব্জি প্যাকেটে প্যাকেটে। ঢেঁড়সের পিছন ফাটিয়ে কচি ঢেঁড়শ বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই। বেগুনের গা-টা একটু টিপে, আম-লেবু-কাচা লঙ্কার গন্ধ শুঁকে, লাউয়ের ত্বকে নখবিলেখন করে যে বাজার, সেটা মল-এ হয় কই?

ল্যাজ-ঝটপটানো কই মাছ কই? কিংবা লটপটানো লটে? মলে লটে-ফটের মতো অকুলীন মাছের ঠাঁই নেই। উবু হয়ে বসে আলু-পটল বাছার সিন নেই। বাছতে বাছতে নুরুল-নাড়ু-নারায়ণীদের সঙ্গে টুকটাক গল্পোগাছা— ‘কী গো নাড়ু, বেছে বেছে এমন বুড়ো বুড়ো লাউ কোত্থেকে আনলে?’ কিংবা ‘এমন খেঁকুরে ওল কোন মাটিতে হয় নুরুল?’

নুরুল বলল, ‘ওপর থেকে অমন দেখাচ্ছে, ভাল ডেরেস পরেনি তাই, ভেতরে মাখম দাদা। পুরো মাখম।’

বাজার করার হাজার মজা।

আলু-পটল বাছার মতোই মজাটাও বেছে নিতে হয়। বাজারে ব্যাজার হতে নেই। ঝামেলা একটু আধটু হয়। ওটা ইলিশের কাঁটার মতই সরিয়ে রেখে শাঁসটা নিন।

আমি বাজার-জাতক। বাগবাজারে জন্ম। বাগবাজারের সঙ্গে বাঘের সম্পর্ক নেই। গঙ্গাটা ওখানে বেঁকেছে। ওই বাঁকেই বাজার বসত। তাই বাঁকবাজার। কাছেই দুটো জেলে পাড়া। ঘাটে ইলিশ উঠত। আর প্রচুর তোপসে, গুলে, লাল চিংড়ি…।

শৈশবে ঠাকুরদাদার হাত ধরে বাজারে গিয়ে মাছ চিনেছি। লাউ-কুমড়োর গায়ের রোঁয়া দেখে সে কতটা গাছতাজা বুঝতে শিখেছি।

ছোটবেলার বাজার মানে প্রকৃতি-পাঠ। চিড়িয়াখানা-মিউজিয়াম-বটানিকাল গার্ডেন। কিলবিলানো, জলছেটানো শিঙ্গি-মাগুর-শোলের গামলা হল উন্মুক্ত অ্যাকোরিয়াম। আর মাছ-মাংসওয়ালাদের ছোট চাতালটিই হল ডিসেকশন রুম কিংবা জুলজির ল্যাব। অবলীলায় পেট থেকে বের করে আনছে নাড়িভুঁড়ি, পরে জেনেছি ওটা ইনটেসটাইন-লিভার-প্যাংক্রিয়াস। টুক করে বের করে নিচ্ছে গলব্লাডার। মানে পিত্তি। রুদ্ধশ্বাসে দেখেছি মাছের ফিলে কাটা, শুধু শাঁস উঠে আসছে, আঁশ বাইরে, কাঁটা বাইরে। যা দিয়ে তৈরি হয় ফিশ ফ্রাই।

ফুলকপির একটা ফুলই তো এত বড়? সত্যি? বাঁধাকপির পাতাগুলো ভাঁজে ভাঁজে বুজে থেকে এ ভাবে গোল? পাকা পুঁই বিচির ভিতর কেমন বেগুনি রং ভরা। ঢেঁড়সের মাথায় বসানো বিয়ের টোপর। মুলোর মাথায় রাখা পাতাগুলো যেন মাথায় ঝালর পরা রেড ইন্ডিয়ান।

বাজারের কাছে জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শিক্ষা পেয়েছি।

শৈশবে— বাজার আমায় শিক্ষা দিল নেচার কেমন ভাইরে।

কৈশোরে— ম্যানেজমেন্টের আদিমন্ত্র বাজার থেকে পাইরে।

যৌবনে— বাজার বলে ছলে বলে ভোগ করে নে দুনিয়া।

প্রৌঢ়ত্বে— এই সংসার কানা বেগুন, পৃথিবীটা মায়া।

কৈশোরে বাজার করার আকর্ষণ ছিল আলাদা। পাঁচ টাকা কিলো বড় পার্শের সঙ্গে সাড়ে তিন টাকা কিলো মাঝারি পার্শের সমন্বয় ঘটিয়ে কিংবা এক কিলোর পরিবর্তে ন’শো গ্রাম পেঁয়াজ কিনে হাতখরচার চার আনা-আট আনা বাজার থেকেই ম্যানেজ করা যেত।

আমার কৈশোরে চার আনা মানে চারটে বড় শিঙাড়া। তিন দিনের বাজার-ম্যানেজ জমিয়ে শঙ্খবেলা-দেয়ানেয়া কিংবা রাজদ্রোহী। লাইনে দাঁড়িয়ে পঁয়ষট্টি পয়সা টিকিট।

ন’শো পেঁয়াজ একসঙ্গে না নিয়ে তিন জায়গা থেকে তিনশো করে নিলে লাভ বেশি। যেমন কচুরি খাবার সময় একবারে চারটে না নিয়ে একটা করে নিলে ডালের পরিমাণ বেশি পাওয়া যায়।

এ সব হল মার্কেটিং-এর অ-আ-ক-খ। ম্যানেজমেন্টেরও বটে। পাবলিক রিলেশন কী জিনিস সেটা বাজারের মাছ-মাসিদের কাছ থেকে যা শেখা যায়, লাখ টাকার ম্যানেজমেন্ট স্কুলও সেটা শেখাতে পারে না।

মনে করুন, মাছ-মাসি বলছে, ‘‘তোমার কতা ভেবেই তো এই শোল মাছটা এনিচি। কত জন চাইল, দিলুম নি। এক দিন বড় শোলের খোঁজ করেছিলে কি না…।’’

কর্পোরেটের অনেক আগেই মাছওয়ালারা, শাকওয়ালারা সাইকোলজিকাল প্রাইসিং আয়ত্ত করেছে।

একটা লেবু তিন টাকা, কিন্তু চারটে দশ টাকা। চারটে দরকার নেই। তবুও কিনতে হচ্ছে— কারণ দু’টাকা জেতার মানসিক চাপ।

প্রায় কালো হয়ে যাওয়া পাকা কলা বিক্রির জন্য সেই কবে দেখেছিলাম এক ডজন কলা কিনলে একটা আপেল ফ্রি দিতে। চণ্ডী লাহিড়ী বলেছিলেন, এক মাছ-মাসি নাকি বাটা মাছের সঙ্গে রসুনবাটা ফ্রি দিচ্ছিল, কারণ মাছটা খারাপ হয়ে গেছে, সততার সঙ্গে সেটা বলছে, তাই রসুন বাটাটা ফ্রি।

বাজারে কোনও কিছুর দাম জিজ্ঞাসা করলেন— এই ধরনের ‘শুধু তোমারই জন্য’ মার্কা কথা শুনবেন, ‘একশো টাকা বেচছি, আপনার জন্য নব্বই।’

আহা কী পিরিত!

আপনিও ভজে গেলেন।

বাজারে গিয়ে কত রকম ভাবে ভজা হয়ে যাই আমরা। সব সময়ই আমরা ওজনে বেশি পাই। পাল্লার এক দিকে বাটখারা, অন্য ধারে কেনার জিনিস। ওধারটাই সব সময়ই বেশি ঝুলছে। মাংস কেনার পর এক টুকরো মেটে এমন করে পাল্লায় ছুড়ে দেওয়া, আর পাল্লাটা কিছুটা ঝুঁকে, সাম্যবস্থায় ফিরে আসার আগেই মাংসটা তুলে নেওয়া, যেন অনেকটা বেশি পেয়ে গেলাম। তার ওপর একটু চর্বি ফাউ।

আমারা ভজে গিয়ে ভজা রায়!

এই স্কিল আয়ত্ত করা সহজ নাকি? কোনও রিটেল ম্যানেজমেন্ট স্কুল এই স্কিল শেখাবে?

ছোট বয়েসে বাজারে গেলে ধুঁধুল-ঝিঙের কিংবা পটল-কুঁদরি তফাত শেখার সঙ্গে সঙ্গে বাজারটাও শেখা যায়। শীতের যে বাজার, কত রকমের সব্জি, কত রঙের, সঙ্গে রোদ্দুরটা ফ্রি।

তারাপদ রায়ের একটা কবিতা সামান্য পাল্টে বলা যায়,

সোনালি রোদের সঙ্গে পালং মিশিয়ে ঈশ্বর বলেছেন, ওহে —/

তোমার পাড়ার এলাম আমি,

দেখো হে দেখো হে।

বাজার যতই আগুন থাকুক না কেন, এই বয়েসেও বাজারে গেলে একটা প্রভাতী রিক্রিয়েশনের সঙ্গে সুখ সিক্রেশনও হয় শরীরের ভিতরে। বাজার করলে আনন্দ ফ্রি। জীবনে ফিঙে পাখি ঝিঙে ফুল চাক্ষুস না করলেও বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে আনা ডোরাকাটা ঝিঙেটির স্পর্শসুখের সঙ্গে যমক-উৎপ্রেক্ষা শ্লেষ কিংবা উইট হিউমার পান— আপনারা অনেক কিছুই পান এই বাজার জীবনে। পেয়ে যান। ব্যাজার মুখেও হাসি ফোটে।

লোকটি বলছে, ‘আহা রে পাটালি, বাহারে পাটালি।’— আপনি যদি বাজারু হন, ঠিকই বুঝবেন, কুমড়োর ফালি বিক্রি চলছে।

মৌমাছি-মৌমাছি মধু মধু বলতে বলতে যে কাল্পনিক মৌমাছি তাড়াচ্ছে, সেও হয়তো কুমড়োই বেচছে, আমও হতে পারে।

এক জন কচু বিক্রেতা হাঁকছিল, ‘‘এ কচু খাবেন না, ক্যালোরি বেড়ে যাবে।’’

‘ক্ষীর ক্ষীর রক্ত রক্ত’ বলে যে চিল্লাচ্ছে সে কিন্তু বিসর্জন নাটকের রঘুপতির কিংবা প্রতিশোধ সিনেমার পোসেনজিতের ডায়লগ ঝাড়ছে না, ও বিক্রি করছে নেহাত বিট-গাজর!

স্বভাবকবি সব্জি বিক্রেতাও দেখেছি। যেমন—

‘ঝুড়ি ভরা ভিটামিন

থলের ভিতর ভরে নিন’,

কিংবা

‘শীতে পালং ভাল,

সঙ্গে দিলে রাঙামুলো

মুলো ট্যাংরা দিলে বাদ

শীত হল বরবাদ।

এক লাউ বিক্রেতা ঝুড়ির লাউয়ের গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলছিল, ‘বাপের আদুরে ছেলে।’ এক আম-বিক্রেতা বলেছিল, ‘প্রতিবন্ধী ভাতা পাওয়া খাঁটি ল্যাংড়া, কিন্তু গ্র্যাজুয়েট।’

ফুলকপির ভিতরে পোকা হবে কিনা জিজ্ঞাসা করায় শুনেছিলাম, ‘সে কী? পোকা? এরা তো মিশনারি ইস্কুলে পড়া ফুলু সোনামণিরা।’

‘মাকখন মাকখন… চাকা চাকা মাকখন’ হাঁকছে যে, সে কী বিক্রি করছে বলুন তো? ওল! ‘ওল খেয়ো না, ধরবে গলা’-র যুগ চলে গেছে। ওল এখন দামি খাবার।

টিভি-তে দেখছিলাম, এক পাঁচতারা হোটেলের শেফ ওলের শাহিকারি শেখালেন। ওল নিয়ে তো গান হয়েছে, শোনেননি? ওলে … ওলে…। এক ওল বিক্রেতাকে এক দিন এই গানটা গাইতে শুনেছিলাম, উচ্চারণের প্রয়োজনীয় পরিবর্তনে গানটা শোনাচ্ছিল, ‘ওল লে… ওল লে…।’

শপিং মলে এ মজা মেলে? ওদের ছেলেপুলেরা সাজিয়ে রাখা যন্ত্র যেন!

একটা বাজার অন্য বাজার থেকে আলাদা।

শুনবেন, গড়িয়াহাট বাজারকে লোকেরা বলে গড়িয়াহাট মার্কেট। কিন্তু মানিকতলা ‘বাজার’। চিৎপুরের নতুনবাজার সেই পুরনো কাল ধরে রেখেছে। নিউ মার্কেট আবার অন্যরকম।

বাজার যেমন আলাদা রকমের হয়, আবার একটা বাজারেরও আলাদা আলাদা ভাগ থাকে। মাছের বাজারের এক ধারে কয়েকজন বসে কুলীন প্রকৃতির মাছ নিয়ে। যথা, চিতল, ভেটকি, চিংড়ি, আড় ইত্যাদি। ওদের বাঁধা খদ্দেরদের আঙুলে পাথরের আংটি ও গলায় হার থাকে। এঁরা উচ্চবর্ণের খদ্দের।

কেউ বসে চারাপোনা, বোয়াল, তেলাপিয়া নিয়ে। ওরা মধ্যম। সমুদ্রের মাছ, শঙ্কর মাছ, ভুসো চিংড়ি, মরা তেলাপিয়া— এরা বাজারের নিম্নবর্গ। এদের এলাকাও আলাদা। ওরা বসে বাজারের বাইরে, ছোট কাঁকড়া, একটু নরম হয়ে যাওয়া ভোলা ইত্যাদি নিয়ে। মধ্যবিত্তদের বাড়ির কাজ করে দেয় যারা, রিকশা টানে যারা, ওদের প্রোটিন এরাই জোগায়।

আর কচুর শাক, লতি, থোড়, কলমি, শুষনি-ডুমুরকুড়ুনিদের অবস্থান বাইরেই।

এক রোগাভোগা লোক ব্রাহ্মী, কুলেখাড়া, হেলেঞ্চা এ সব বিক্রি করেন আঁটি বেঁধে। উনি পাতার গুণ শেখান। পাশের এক শাকওয়ালা বলেছিল, লক্ষ্মণ যদি একে পেত, হনুমানের গন্ধমাদন বয়ে আনতে হত না।

বাজারের বিক্রেতারা, বিশেষত মাছওয়ালারা এক একজন ছুপা সাইকোলজিস্ট। দেখেছি, যখন খুব বেশি দামে ইলিশ বিকোয়, সাধ আছে, সাধ্য নেই অবস্থায় দাম শুধোই, মাছওয়ালারা আকাশের কাক দেখতে দেখতে তেরচা ছুড়ে দেয়, ‘বারোশো।’ কিন্তু প্রমোটার বা ঘুষবাবুদের সঙ্গে অন্য ব্যবহার। আবার বাড়িতে ইলিশপ্রেমী কুটুম এসেছে, যে দামই হোক কিনব বলে বাজারে এসে ইলিশের দাম জিজ্ঞেস করেছি, অন্য ব্যবহার।

মাছের বাজারে ঘোরা আমার প্রিয় টাইমপাস। দেখলে হবে? খরচা আছে, জেনেও আমি সুন্দরী কাজরি-পাবদা-পুঁটিরানিদের দিকে তাকিয়ে থাকি। যেন জিম সেরে সবে শবাসনে রয়েছেন! পলিথিনের সুইমিং পুলে সাঁতার কাটা শিঙ্গি-মাগুর-চারাপোনা যেন টলিউডের ঝিঙ্কুমণিরা। দিদিমণি ডাকলেই পাউডার-পমেটম মেখে স্টেজে চলে যাবে।

কত রকমের চিংড়ি! গাড়ির মতোই চিংড়ি বাঙালির স্টেটাস সিম্বল। আমি চেয়ে দেখি, চিংড়িরা বলে আমার পানে চেয়ে চেয়ে খুশি থাকো, নেবার তো মুরোদ নেই। এক সময় চেংড়িরাও এমনই বলেছিল। চিংড়িওয়ালারা জানে অনেক ডোন্ট পরোয়া অলরাইট বাবু আছে, এ সব চিংড়ি চিতল অনায়াসে ঢুকে যাবে ওঁদের ব্যাগে।

বাজার-করিয়েদের মধ্যে একটা বিভাজন তো আছেই। এই যে ডোন্ট পরোয়াবাবুগণ, এঁদের মনে ‘দাম শুনে কাম কী’ ভাব আছে। এঁরা সাধারণ বিক্রেতাদের তুই-তোকারি করেন। খাসা চিংড়ি দেখলে ব্যাগটা ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘পাঁচশো।’ অসময়ের সব্জি নেন। এঁদের হাতের আঙুলে অনেক সময় সিগারেট থাকে। ড্যানচি বাবুদের অন্য রূপ। কলকাতার বাবুরা হাওয়া বদলে পশ্চিমে গেলে বাজারের দাম শুনে ‘ড্যাম চিইইপ’ বলতেন বলে ওঁদের এমন নাম হয়েছিল।

বিচক্ষণ বাজারু আছেন, ওঁদের চোখে ভগবান এক্সরে মেশিনও দিয়ে দিয়েছেন। ঠিক বোঝেন কোন মুলোর ভিতরে শাল হয়েছে, কিংবা কোন বেগুনে গোপনে পোকা। লঙ্কার রূপ দেখেই ভিতরের ঝাঁঝ ও ঝাল বুঝে যান। ওঁদের ব্যাগের হাতলে চামড়ার পট্টি থাকে। সহজে ছেঁড়ে না।

সদাব্যস্ত হাফপ্যান্ট পরা কিছু নব্য যুবা ঝুপঝাপ করে দু’চারটে সব্জি কিনে নেন। ওঁদের বাঁধা সব্জিওয়ালা, মাছওয়ালা আছে। এবং করলা-কাঁকরোলের তফাত বোঝেন না। ওঁরা বাজে বাজারু।

এঁদের বিপরীত হল, যাঁদের প্রচুর সময়। এঁরা সাধারণত রিটায়ার্ড লোক হন। এঁরা আগে বাজারটাকে রেইকি করে ঘুরে ভাল করে বুঝে নেন। কথায় বলে, ‘বাজার করবে ঘুরে, বিয়ে করবে দূরে।’

এঁরা নবীন বাজারুদের উপদেশ দেন, ‘কুমড়ো কেনার সময় দেখে নেবে খোসার উপরের সবুজ পাড়, কিংবা এইগুলো কিন্তু কাগজি লেবু, কড়াইয়ের ডালের সঙ্গে জমে। চিনতে হবে তো?’ মাছওয়ালার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন। —‘এই ডোরা কাটা বজরি ট্যাংরা কোথায় পেলে? ভ্যাদা মাছটা একদম উঠে গেল গো!’

কিছু আছেন সদা সন্ত্রস্ত। ‘ভাল হবে তো?’ ভাব। সর্বক্ষণ ভয়, ঠকে যাচ্ছি। ওঁদের ব্যাজার মুখ বাজার পর্বে কুঁচকেই থাকে।

পত্নীভয়ে ভীত বাজারকারীও দেখা যায়। ওঁরা মোবাইলে স্ত্রীর উপদেশ নিতে নিতে বাজার করেন। হাতে লিস্ট থাকে। ভুলো বাজারিও আছেন— যাঁরা পুঁইশাক কিনলে কুমড়ো নিতে ভুলে যান।

যোগীন্দ্রনাথ সরকার একটা ছড়া লিখেছিলেন, যেখানে বাজার করতে বলা হয়েছিল— ‘দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনিপাতা দই, দুটো পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিম ভরা কই’।

শেষ পর্যন্ত বাজারে গিয়ে মনে হল, ‘দাদখানি বেল, মুসুরির তেল, সরিষার কই, চিনিপাতা চাল, দুটো পাকা ডাল, ডিম ভরা দই’।

সস্তা সন্ধানীরা আছেন, যাঁরা একটু বেলার দিকেই বাজারে যান। তখন দাম ও ভিড় দুটোই কম। কানা বেগুন বেছে কেনেন। ওঁদের থিওরি, কানা বেগুনের ভিতরে যে পোকা থাকবেই, তার কোনও মানে নেই। পোকারা বেগুন ফুটো করে বেরিয়ে যায়। গর্তগুলো একটু সার্জারি করে বাদ দিলেই হল। অনেক সস্তা পড়ে। জ্যান্ত মাছেরা ততক্ষণে মুমূর্ষু অবস্থায়। একজনকে দেখেছিলাম, এক মাছওয়ালার সামনে দাঁড়িয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। ঘণ্টাখানেক পরও তিনি ওখানেই। শুধোলাম, ‘কী দাদা, এখনও আছেন?’ উনি বললেন, ‘কী করব বলুন? জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে দুশো টাকার তফাত। ট্যাংরাগুলো আইসিইউ-তে আছে। একটা করে একস্পায়ার করছে, ওমনি সরিয়ে রাখছি। জ্যান্ত ট্যাংরা পাঁচশো, মৃত তিনশো।’

এঁরাই দক্ষ বাজারু।

দক্ষ বাজারুরা লুঙ্গি পরে বাজারে যান। কিংবা পাজামা। শার্টটা খুব পরিষ্কার থাকা উচিত নয়। বাজারের জিনিসগুলো যতই পছন্দ হোক না কেন, মনের ভাব গোপন রেখে এমন ভাব প্রকাশ করতে হয়, যেন পছন্দ হচ্ছে না।

এঁদের ভিতর অনেকে বাড়িতে বাজারের খাতা রাখেন। আগে এর চল ছিল। আমার বাপ-ঠাকুর্দা রাখতেন। পাঠকদের দীর্ঘশ্বাস ফেলার জন্য বাবার বাজারের খাতা থেকে এক পাতা তুলে দিলাম (একের পাতায় পাবেন)।

সস্তার বাজার আমিও করতে চেয়েছি। কাটোয়ায় অন্য কাজে গিয়ে সস্তায় কাটোয়ার ডাঁটা আনব বলে বাজার চষেও ডাঁটা পাইনি। সাঁত্রাগাছিতে ওলও নয়। শিলিগুড়ি থেকে এক বস্তা সস্তার আনারস কিনেছিলাম। ট্রেন থেকে নামাতে গিয়ে রেল লাইনে পড়ে গেল অর্ধেক। বাকি অর্ধেকের জন্য ট্যাক্সির ভাড়া গুনতে হল।

বাজারুদের বৈচিত্রর কথা বলেছিলাম, কিন্তু বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য তো বাজারেই দেখি।

আমলা বা কেরানি, চোর বা পুলিশ, রণজয়ী জেনারেল, কিংবা হাবিলদার, সিপিএম বা তৃণমূল, সবাই দে়ড়খানা থলি হাতে। জেনারেলের পায়েও চটি। বাজার এক সামাজিক তীর্থ। যেখানে মানুষের মধুর ধাক্কাধাক্কি।

ঘরে ফ্রিজ থাকলেও বাঙালির এক বড় ভাগ নিত্যবাজারে বিশ্বাসী। একটা সময় ছিল, ধনীবাবুদের বাজার সরকার থাকলেও মুটে নিয়ে শখের বাজার করত। পকেটে টাকা নিয়ে ঝাঁকা ভরা বাজার।

একেই রঙ্গ করে বলি— এখন ঝাঁকা ভরা টাকা নিয়ে পকেট ভরা বাজার।

সে যাই হোক, বাজার কখনও একঘেয়ে মনে হয় না। প্রতিটি শো নতুন। নাটকে যেমন। এক নাটকে একই সংলাপ, কিন্তু প্রতি দিন নতুন। বাজারের ভিতরেই তো জীবনে জীবন। বনফুলের হাটেবাজারে উপন্যাসের সদাশিব ডাক্তার হাটেবাজারে ঘুরে বেড়াতেন জীবন দেখতে। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বলতেন, বাজারের ঝুড়িতে ঝুড়িতে গল্প লুকোনো থাকে। বাজার নিয়ে সাপ্তাহিক প্রতিবেদনও লিখতেন।

তারও আগে বাজারদরকে সাহিত্যের পর্যায়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ মিত্র। উনি বাজার সরকার নামে আনন্দবাজার-এ লিখতেন সত্তরের দশকে। তারপর নিখিল সরকার, বিজন কুমার ঘোষ। বাজার প্রতিবেদনের সেই ধারাটি এখনও এ সময়ের কলমে ধরা পড়ে।

এই প্রজন্মের ছেলেপিলেরা জমা জল, ছেঁড়া পাতা মাড়িয়ে বাজার যেতে চায় না। ওরা মল-সুখী। আমিও ক’দিন মলের বাজার করে সাবেক বাজারে ফিরে এলাম। ডিমবেচা মাসি বলল, ‘‘ক’দিন দেখলুম নি যে! শরীল ঠিক ছিল তো?’’

চোখ অপারেশনের পর বাজার গেলাম, শাকওয়ালা বলল, ‘‘হেলেঞ্চা দিচ্ছি, চোখ ভাল থাকে।’’

বাজারে সর্ষেশাকের মাথার উপরে হলুদ ফুলে কী মায়া! চোখে সর্ষে ফুল দেখার মানেটাই পাল্টে যায়।

অন্য দিকে কুমড়ো ফুল নিজেকে উৎসর্গ করে আছে বড়া হবার জন্য। আর পুঁইয়ের ভিতরের দানা ক’টি জীবনরহস্যে ক্রমশ মেজেন্টা হয়ে যাচ্ছে।

যে মোচাটি কলা হতে পারল না, কিংবা যে এঁচোড়টি হল না কাঁঠাল— তাদের অপূর্ণ ইচ্ছের শরীর আমাদের নাইলনের থলের ভেতরে পুরে বাড়ি যেতে যেতে এই সব প্রাকৃতিক শাকতরকারির সঙ্গে নিজেদের তুলনা করার ক্ষণিক দার্শনিকতার সুযোগ তো বাজারটাই দেয়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE