Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

শ্রীরামকৃষ্ণ.com

‘লাইক’ বাড়ছে তো বাড়ছেই। পরমহংসদেব যেন জেন ওয়াই-এরও কাছে চলে আসছেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর আবির্ভাব। লিখছেন শংকর‘লাইক’ বাড়ছে তো বাড়ছেই। পরমহংসদেব যেন জেন ওয়াই-এরও কাছে চলে আসছেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর আবির্ভাব। লিখছেন শংকর

চিত্রণ: শেখর রায়

চিত্রণ: শেখর রায়

শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

সেই কোন আদ্যিকাল, ১৮৮৬ সালের অগস্টের মধ্যরাত।

গলায় ক্যানসার এবং পেটে হাঁড়ি হাঁড়ি খিচুড়ির খিদে নিয়ে ডজনখানেক শিষ্য পরিবৃত হয়ে আমাদের ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ নিঃশব্দে ভবসংসার ত্যাগ করে চলে গেলেন।

কত লোক এই সংসারে আসেন। হম্বিতম্বি করেন। লোকে মাথায় তুলে নাচানাচি করে। তারপর মানুষ তাঁদের ভুলে যায়।

কিন্তু আমাদের ঠাকুর বিস্ময় ঘটালেন।

প্রথমে স্বদেশে এবং পরে প্রিয় এক ত্যাগী সন্তানের মাধ্যমে মহাসমুদ্রের ও পারে বিস্ময় ঘটিয়ে নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি করলেন।

কেমন করে এবং কেন এই অঘটন সম্ভব হল?

সংখ্যাহীন মানুষ, রাজার প্রাসাদ থেকে হতদরিদ্রের পর্ণকুটিরে পর্যন্ত যে ভাবে তাঁকে দেবতা মনে করে পূজার বেদিতে বসালেন, সে এক পরম বিস্ময়।

গলায় ফিতে ঝুলিয়ে যে সব পরিমাণ বিশেষজ্ঞ এই বিপুল বিস্মৃতির হিসেব নিকেশ করেন, তাঁরা জাজমেন্ট দিয়েছেন, ঠাকুরের ‘ফ্রি সাইজ’— সাত টাকা মাইনের মন্দির-পুরোহিতের দুঃসাহসিক ঘোষণা— ঈশ্বরে সবার অধিকার, কারও বঞ্চিত হবার প্রয়োজন নেই, সব সন্তানের জন্য জন্মদাতার দান সেই বন্ধনহীন ফ্রি-সাইজ আবরণ যা ধনী-দরিদ্র, নিষ্ঠুর-প্রায়ান্ধ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত এবং স্বার্থপর-যুক্তিপ্রেমী সবাইকে নিতান্ত সহজে স্বর্গলোকের সন্ধান দিতে পারে।

মার্কেটিং মাস্টারদের বিস্ময়, যে-মানুষটি কামার্ত না হয়েও নিজ বস্ত্রখণ্ড থেকে বন্ধনমুক্ত হয়ে উলঙ্গ হয়ে পড়তেন, সব দীনতা-নীচতা ছেড়ে জননী ও সন্তানদের জয়ধ্বনি দিতেন, তিনি মহাশক্তিবলে এই ফ্রি-সাইজ থিয়োরিকে সমাজের এক কঠিন সময়ে বিশ্বজনের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুললেন?

বড়লোকের মাসমাইনের পুরোহিত থেকে নিজেই কী ভাবে সবার অতি আদরের ঠাকুর হয়ে উঠলেন?

মানুষের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা আরও দু’একবার যে ঘটেনি এমন নয়, কিন্তু কলিযুগের কঠিনতম সময়ে আবার কেন এই রামকৃষ্ণলীলা?

এই রহস্য সন্ধানে ও উদ্ঘাটনে পুরোহিতের জীবনকাল থেকে দীর্ঘসময় ধরে কত সহস্র গ্রন্থ লেখা হয়েছে। দু’খানি অমৃতকথা সংখ্যাহীন ভাষায় প্রচারিত হয়েছে।

মৃত্যুহীন লেখকদের একজন গৃহীভক্ত। আর একজন পুরোহিত মশায়ের ত্যাগী সন্তান।

এই দু’জনেরই অপরিপূর্ণতা—কথামৃত ও লীলাপ্রসঙ্গ দুটিই অসম্পূর্ণ। দু’জনেই ভয় দেখিয়েছিলেন যথাসময়ে ঠাকুরের মহামিলন পর্বের শেষ পরিচ্ছেদটি সুললিত ভাষায় লিখে ফেলবেন। সময়ও পেয়েছিলেন যথেষ্ট, কিন্তু বোধ হয় এঁরা ইতি টানতে সাহস পাননি।

কারণ, ফ্রি-সাইজ মন্ত্রের উদ্গাতা ব্রাহ্মণের বাণী যে মৃত্যুহীন— এখনও প্রতিদিন কোথাও না কোথাও তাঁর বেঁচে থাকার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। প্রিয়ভক্তরা তো বলেই দিয়েছেন, অন্তত আরও পনেরো’শ বছর ধরে বিশ্ব সংসারের সব মানুষের জন্য তাঁর বারবার বেঁচে ওঠা।

মার্কেটিং-এর মহারাজারা বিপণনের এই বিশ্ববিজয়ী সাফল্যকে অঘটন বলে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত হন। তাঁরা খুঁজে চলেছেন, মৃত্যুর পরেও কোন্ শক্তিবলে তিনি সংখ্যাহীন সাহায্যপ্রার্থীর হৃদয়ে এমন ভাবে বেঁচে আছেন?

‘ফ্রি-সাইজ’ কথাটি জামাকাপড়ের দোকানে বহু ব্যবহৃত, কিন্তু ভুক্তভোগীরা জানেন, এ কালের কোনও বস্ত্রখণ্ডই নারীপুরুষের ফ্রি-সাইজ নয়। কিন্তু কখনও কখনও তো অসম্ভব সম্ভব হয়। যেমন, আমাদের ঠাকুর— ক্ষুদ্র, বৃহৎ, মধ্যম, নীচ, উত্তম, সংসারী, বৈরাগী, মাতাল, সংযমী, কামুক ও ব্রহ্মচারী সবাই তাঁর জালে ধরা পড়ে যান, ঠাকুরের উপদেশ শুনে তাঁরা মুক্তির সন্ধান পাচ্ছেন।

বলরাম বসুর বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ-তনয়রা

অদ্ভুত এই মানুষটির সর্বরোগহর প্রেসক্রিপশন!

গরিবকে তিনি বলেন, কোনও ভয় নেই, মা তোমাকে কোলে তুলে নেবেন। ধনীকে বলেন, ভাল কাজে সঞ্চিত অর্থ ব্যয় কোরো; ভুলে যেও না টাকা মাটি, মাটি টাকা। তরুণ সাধককে বলেন, জপে-তপে মন না দিলে মাকে পাবে কী করে? মাতালকে বলেন, কুছ পরোয়া নেই, প্রাণ চাইলে যত খুশি ড্রিংক করো, কিন্তু পা যেন না টলে। নিষিদ্ধপল্লির যাত্রীদের কাছে পরামর্শ, এমন জায়গায় যাবে না, যেখানে নিজের মাকে নিয়ে যাওয়া চলে না। কারও জন্য উপদেশ কথায় কথায় উপবাস, আবার কারও জন্য পেটপুরে খাওয়া! নিজের প্রিয়তম শিষ্যটিকে কাছে টানবার জন্য পেটপুরে রসগোল্লা খাওয়ানোর প্রলোভন; শিষ্যটিও তেমন, পছন্দ না হলে কান মলে দেওয়ার ভীতি প্রদর্শন।

কামিনী-কাঞ্চনে টান নেই, কিন্তু পয়সার মাহাত্ম্য তিনি বোঝেন। অর্থই যে গেরস্থের রক্ত তা মোক্ষম বোঝেন। ভক্তজনের ভিড় বাড়াবার জন্য নিজের সভায় এক পয়সা প্যালা নেই।

এই ঠাকুরের পারচেজিং পলিসিটিও ভুবনবিদিত, জিনিস কিনতে হলে অন্তত তিনটি দোকান থেকে দাম ও কোয়ালিটি যাচাই করতে হবে এবং যেহেতু কলিযুগের কনজিউমার ইজ দ্য কিং, সে হেতু কেনার পরে ফাউ চাইতে হবে— বাই ওয়ান গেট ওয়ান মন্ত্রের উদ্গাতা।

কনজিউমারকে রক্ষে করবার জন্য সেই বিখ্যাত গল্পের প্রচার, লোভী বিক্রেতাকে ছোট করবার জন্যে গল্প—‘কেশব, কেশব?’— ‘গোপাল গোপাল। ‘হরি হরি?’— হরহর।

কথামৃত ও লীলাপ্রসঙ্গ। এঁদের এক জন লেখক ইস্কুলের শিক্ষক। আরেক জন তাঁর আদরের সন্ন্যাসী সন্তান।

এক জন কয়েক বছর ধরে উইক-এন্ডে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে এসে অমৃতবার্তার সংকলক।

আরেকজন গুরুর অন্তিম পর্বে তাঁর সেবা ও শুশ্রূষায় দিবারাত্র ব্যয় করে দুর্লভ সব বাণীর সংগ্রাহক।

এর বাইরেও বহু সংসারী ও বহু ত্যাগী বহু বছর ধরে তাঁর বিস্ময় বাণীর উল্লেখ করেছেন।

তবু আজও যা নজরে পড়ে যায়, এত জেনেও আমরা কত কম জানি আমাদের এই ঠাকুর সম্বন্ধে।

আমরা জানি না, তাঁর দৈহিক উচ্চতা কত ছিল? পরবর্তী কালের সাহেব-ভক্তরা ছাড়বার পাত্র নন, তাঁরা প্রয়াত গুরুর ফটোগ্রাফ এবং পরিধান বস্ত্র আঁকড়ে ধরে অঙ্ক কষতে শুরু করেছেন, এবং প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনি বিশালদেহী প্রিয় শিষ্য বিবেকানন্দ থেকে লম্বা ছিলেন।

তাঁর দেহের রং সম্বন্ধে স্ত্রী সারদামণি হলুদ সোনার ডিম উল্লেখ করেছেন, কিন্তু অপরে তাঁর রঙের অত প্রশংসা করেননি।

অনেকে বলছেন, রোগাটে, আবার স্ত্রী বলছেন, যখন পিঁড়িতে বসতেন, সমস্ত আসনটি ভরে যেত।

আবার ক্যানসারজর্জরিত শরীরের মৃত্যুপরবর্তী প্রায়-নিষিদ্ধ ছবিটি মনে করিয়ে দেয়, অবিনশ্বর আত্মার সাময়িক আশ্রয় এই দেহটি সত্যই ব্যাধিমন্দিরম।

মৃত্যুকালে তেমন ভাল ব্যবহার পাননি। দক্ষিণেশ্বরের মালিকরা মৃত্যুপথযাত্রী ক্যানসার রোগীর মন্দিরে ফিরে আসায় উৎসাহ দেখাননি; পরে স্ত্রীর উইডো পেনশনে বাধা দিয়েছেন; সব ভক্ত কাশীপুরের খরচপাতি দিতে হাতটান করেছেন। বাকি ভাড়া আদায়ের জন্য কাশীপুর উদ্যানবা়টির দারোয়ান সদ্য স্বামীহারা স্ত্রীকে গেটে আটকে দিয়েছেন।

এমনকী চিতাভস্ম নিয়েও টানাটানি। শ্রীরামচন্দ্র দত্ত এই দেহাবশেষ ভস্মাদি একটি তাম্রকলসে পূর্ণ করে কাশীপুর বাগানে ঠাকুর যে-ঘরে বাস করতেন, সেই ঘরে যত্ন-সহকারে রেখে দিলেন। তাঁর ইচ্ছা কলসিটি কাঁকুড়গাছির বাগানে সমাহিত করবেন।

কিন্তু ত্যাগী ভক্তদের অন্য মত, তাঁদের দু’জন গোপনে কাশীপুরের ওই ঘরের স্কাইলাইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে কলসি থেকে বেশ কিছু ভস্ম কৌটায় পূর্ণ করলেন এবং সেই প্যাকেট বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়িতে নিঃশব্দে রেখে এলেন।

এই প্রচেষ্টার নেতৃত্বে যে সন্ন্যাসী তিনিই রামকৃষ্ণ নামটিকে নিজের সন্ন্যাস নাম করার জন্য অনুমতি পেয়েছিলেন।

স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ ছিলেন আর এক রামকৃষ্ণ-তনয় সারদানন্দের খুড়তুতো ভাই। এঁর পিতৃদেব শ্রীশ্রী ঠাকুরের হাত থেকে নিজের ছেলেটিকে ছাড়িয়ে আনতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন।

তিনি এক বার পুত্রকে ফিরিয়ে আনবার জন্য বিখ্যাত বরাহনগর মঠে এসে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন।

সমস্ত অনুরোধ ব্যর্থ হলে ধৈর্যচ্যুত পুরোহিত পিতা শ্রীরামকৃষ্ণের অযথা নিন্দাবাদ আরম্ভ করলেন।

পুত্র এ বার অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে ‘তবে রে শালা’ বলে পিতাকে প্রহার করতে উদ্যত হলেন। পুত্রের গুরুভক্তি দর্শনে তান্ত্রিক পিতা সাতিশয় মুগ্ধ। তিনি আর কখনও ছেলেকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেননি। মাঝে মাঝে যোগাযোগ রেখেছেন, এমনকী নিজের ধারদেনার কথাও জানিয়েছেন।

রামকৃষ্ণানন্দের শ্রীরামকৃষ্ণ সেবা আজও মুগ্ধ ভক্তজনের আলোচ্যবিষয়। শ্রীশ্রীঠাকুরের জীবিতাবস্থায় যে ভাবে সেবা হত, ঠিক সেই ভাবেই মরণোত্তর সেবা, বরাহনগরে। রামকৃষ্ণানন্দ নিত্য দাঁতনকাঠিটি পর্যন্ত থেঁতো করে দিতেন। এমনকী দাঁত খুঁটবার জন্য খড়কে কাঠিও দিতেন। জলপান দেবার সময় ভেজানো ছোলাগুলোর প্রত্যেকটির মুখও কেটে দিতেন।

গ্রীষ্ণকালে মধ্যরাত্রে হয়তো নিজের গরম বোধ হওয়ায় নিদ্রাভঙ্গ হল, তখনি শ্রীশ্রীঠাকুরেরও গরম বোধ হচ্ছে মনে করে রামকৃষ্ণানন্দ ঠাকুরঘরের জানলা দরজা খুলে দিতেন এবং ঠাকুরকে হাওয়া করতে লাগতেন। স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ জপ ধ্যান অপেক্ষাও এই সেবার দিকে অধিকতর জোর দিতেন।

সেবক রামকৃষ্ণানন্দ তাঁর গুরুর স্মৃতিবিজড়িত যে সব জিনিস বরাহনগরে নিয়ে গিয়ে খাটের ওপর সাজিয়ে রেখেছিলেন, তার মধ্যে ছিল ঠাকুরের ছবি, তাঁর ভস্মাবশেষ, তাঁর পাদুকাদ্বয় ও স্মৃতিবিজড়িত আরও কিছু জিনিসপত্র। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী ১৪টি পান প্রত্যহ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে নিবেদন করা হত। একবার অর্থাভাবে এই পানের সংখ্যা ১৪ থেকে ১০-এ নামিয়ে আনায় বিতর্ক হল। স্বয়ং বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণানন্দের বিপক্ষে যোগ দিলেন, তখন রামকৃষ্ণসেবক চোদ্দো চোদ্দো বলতে বলতে মঠ ত্যাগ করে চলে গেলেন। দুঃখ কমতে অবশ্য ফিরেও এসেছিলেন।

ঠাকুরের দেহাবসানেরও পরে সন্ন্যাসী সন্তানরা এমন ভাবেই তাঁর সেবা করতেন যেন তিনি বেঁচে আছেন।

আরও শুনুন। ব্রাহ্মণের রান্না ছাড়া গুরুজি অন্নগ্রহণ করতে পারতেন না, তাই সেবক শশী, অর্থাৎ স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ নিজেই ভোগ রাঁধতেন। দুপুরে আধঘণ্টা এবং রাত্রে ১৫ মিনিট ধরে ভোগ দেওয়া হত। তিনি প্রতি দিন নিয়মিত সময়ে ঘড়ি ধরে ঠাকুরের ঘর মুছতেন, এমন ভাবে সেবা যেন মানুষটি বেঁচে রয়েছেন।

এক দিন শশী দুপুরের খাওয়ার পরে বিশ্রাম করছেন— বেলা প্রায় দুটো হবে। এমন সময় হঠাৎ মনে হল, গরম গরম নিমকি-কচুরি ঠাকুরকে খাওয়াতে হবে। অমনি উঠে পড়ে স্টোভ জ্বালিয়ে স্বহস্তে নিমকি, কচুরি ইত্যাদি তৈরি করলেন।

ভক্তদের ঠাকুরভক্তি তুলনাহীন।

স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ

রামকৃষ্ণ জীবিতকালে দুপুর বারোটার মধ্যে অন্নগ্রহণ করতেন— মধ্যাহ্ন অতীত হলে ‘রাক্ষসী বেলায়’ তিনি কখনও খেতেন না। তাই আজও বেলা বারোটার মধ্যে মধ্যাহ্নভোজন আবশ্যিক। বৃহস্পতিবারের বারবেলার বা অশ্লেষা-মঘা এ সব গুরুমহারাজ খুব মানতেন, তাই শশী মহারাজের মতন শিষ্যরা ওই সময়ে চিঠিপত্র লেখা, হাটবাজার করা বা নতুন কোনও কাজ করতেন না।

আরও একটি আনুগত্যের কথা স্বামী সচ্চিদানন্দ উল্লেখ করেছেন। জিভ পরিষ্কার না করলে ঠাকুর কারও হাতে জলগ্রহণ করতেন না, তাই শশী বারবার সবাইকে সাবধান করে দিতেন যেন এ বিষয়ে ভুল না হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ যা উপদেশ দিয়েছেন শাস্ত্রীয় শ্লোকে তার সমর্থন না জুটলেও সন্ন্যাসী শিষ্যরা তা মেনে চলতেন।

শশী মহারাজ প্রায়ই বলতেন, ঠাকুর বলে দিয়েছেন, জলের যেমন নির্দিষ্ট কোনও আকার নেই— যে পাত্রে তাকে রাখা যায় তারই আকার সে ধারণ করে।

শশী মহারাজ বিশ্বাস করতেন, মরদৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়ার পরেও শ্রীরামকৃষ্ণের অধিকাংশ সাক্ষাৎ-শিষ্যই তাঁর দর্শন লাভ করেছেন।

রামকৃষ্ণানন্দের চিঠি থেকে জেনেছি: ‘‘শ্রীগুরুমহারাজ কখনও দুটি শব্দ ব্যবহার করতে পারতেন না: গুরু ও কর্তা। যদি কেউ তাঁকে গুরু বা কর্তা বলে ডাকত, তিনি তখনই বলতেন যে ‘ঈশ্বরই এক মাত্র গুরু ও কর্তা।’ গুরু মহারাজ আরও বলতেন, ‘যাবৎ বাঁচি, তাবৎ শিখি’।’’

আরও সব অমৃত বাণী।

তিনি বলতেন— ‘‘যদি কেউ গোমাংস খায় এবং সেই সঙ্গে তার মন ভগবানে নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে সে প্রকৃত নিরামিষাশী ও সন্ন্যাসী।’’

সকল মানুষের প্রতি তাঁর প্রথম উপদেশ, ‘‘হে মানুষ, জগতে সহ্যশক্তি সর্বোত্তম গুণ। যে সহ্য করে সে বাঁচে, যে সহ্য করে না, সে শেষ হয়ে যায়।’’

তাঁর আরও একটি প্রিয় কথা, ‘‘মায়ার চেয়ে বন্ধন বড় নয়, যোগের চেয়ে শক্তি বড় নয়, জ্ঞানের চেয়ে বন্ধু বড় নয়, অহংকারের চেয়ে শত্রু বড় নয়।’’

আরও ব্যাখ্যা: ‘‘অহংই হল কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, অহংকার আর জিঘাংসার মূল।’’

স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ আজীবন তাঁর প্রত্যেক চিঠির ওপরে প্রথমে লিখতেন— ‘শ্রীগুরুপাদপদ্মভরসা’, মাদ্রাজ থেকে এক চিঠিতে আমেরিকায় প্রিয় স্বামী পরমানন্দকে ঠাকুরের একটা কথা তিনি বলেছিলেন, ‘‘সর্বদা পরবশ্যম দুঃখম, সর্বং আত্মবাসং সুখম্। অন্যের উপর নির্ভর করলে দুঃখ পাবে, স্বনির্ভরতাই আসল সুখ। এক সময়ে শ্রীগুরুমহারাজের সব কাপড় ছিঁড়ে যায়। একটি মাত্র ছিল। মথুরবাবুকে বললে একশো জোড়া কাপড় সহজেই পেয়ে যেতেন। কিন্তু তা না করে একটি কাপড় দু’টুকরো করে পরতে লাগলেন। কারুর কা‌ছ থেকে কিছু চাওয়ার অর্থ নিজেকে ছোট করা।’’

বহু বিতর্কিত নারীপ্রসঙ্গ।

রামকৃষ্ণানন্দ আমেরিকায় করুণ সন্ন্যাসীকে লিখছেন, ‘‘এই সংসারে নিজের জননী ব্যতীত কেউ আপনজন নয়। তুমি যদি সকল নারীকে নিজের মা বলে মনে করো, তা হলে তোমার মধ্যে কামের উদ্রেক হবে না। শ্রীগুরুমহারাজের এই অমূল্য উপদেশ কখনও ভুলবে না যে, নারীকে ঘৃণা করে, তার মধ্যেও কামনার রেশ আছে। … সকল নারীকে যে নিজের মা রূপে শ্রদ্ধা ও ভালবাসতে শিখেছে সে কখনও কামের বশবর্তী হয় না।’’

শ্রীরামকৃষ্ণবাণীর সারাংশটি শশী মহারাজ তাঁর দীর্ঘজীবনে নানা ভাবে পুনঃপ্রচার করেছেন।

তিনি কখনও বলছেন, ‘‘তাঁর দর্শন পাওয়ার একমাত্র পথ একাগ্র পরাভক্তি।’’ কখনও বলছেন, ‘‘ভগবানকে পূজ্য করবার জন্যে তোমাকে ভগবান হতে হবে। তুমি পাপী— এই ভাবটি দূরে নিক্ষেপ করো। মানুষকে পাপী বলাই পাপ।’’

ঠাকুরের আরও কয়েকটি বাণী সাক্ষাৎ-শিষ্যের মুখে মুখে ফিরেছে, ‘‘কামিনীকাঞ্চনে সদাসক্ত পুরুষ কখনই কামিনীকাঞ্চনাশক্তি পরিত্যাগ করে সচ্চিদানন্দ পরব্রহ্মে মনকে নিবিষ্ট করতে পারে না।’’

অধ্যয়নকেও এক হাত নেওয়া হচ্ছে। ‘‘শকুনি অতি ঊর্ধ্বে ওড়ে, কিন্তু তার দৃষ্টি থাকে গোভাগাড়ে, বইপড়া পণ্ডিতেরা অতি উঁচু উঁচু জ্ঞানের কথা বলে বটে, কিন্তু তাদের মন থাকে অসার চাল-কলা, ধন-মান ও বিদায়ের উপর।’’

আরও দার্শনিক ভিটামিন মিশ্রিত রয়েছে ঠাকুরের বাণীতে। ‘‘মেঘেতে যেমন সূর্যকে ঢেকে রাখে, মায়াতে তেমন ঈশ্বরকে ঢেকে রেখেছে, মেঘ সরে গেলেই যেমন সূর্যকে দেখা যায়, মায়া দূর হলে তেমনি ঈশ্বরকে দেখা যায়।’’

তার পর সেই দুরন্ত সত্য যা এত দিন কেবল পদার্থবিদ্যার সাধকরাই বুঝেছেন— ‘‘হাজার বছরের অন্ধকার ঘরে পিদ্দিম জ্বাললে তখনই আলো হয়। তেমনি হাজার জন্মের সঞ্চিত পাপ শ্রীহরির একবার কটাক্ষে দূর হয়ে যায়।’’

শুধু ফিজিক্স কেমিস্ট্রি নয়, আলু-পটলেরও ভগবান আছে। তাই ফ্রি-সাইজ রামকৃষ্ণ কোনও রকম ভণিতা না করেই বলছেন, ‘‘আলু-পটল সিদ্ধ না হলে শক্ত থাকে, কিন্তু সুসিদ্ধ হলে নরম হয়ে যায়।’’

প্রিয় শিষ্য রামকৃষ্ণানন্দ খুঁজে খুঁজে গুরুর ফ্রি-সাইজ বাণীগুলো সংগ্রহ করে সারাজীবন ধরে তরুণদের গছিয়েছেন।

যেমন মার্কিন মুলুকে এক্সপোর্ট করা স্বামী পরমানন্দকে বলছেন— ‘‘সেই একমাত্র শ্রীহরির নাম গুণকীর্তন করতে পারে যে তৃণের চেয়ে নমনীয়, বৃক্ষের চেয়ে সহ্যগুণী, আর মানকে যে তুচ্ছ জ্ঞান করে।’’

নিন্দা ও স্তুতিতে মৌন হয়ে শ্রীগুরুমহারাজের কাজ করে যাওয়াটাই রামকৃষ্ণ-সন্তানের জনপ্রিয় প্রেসক্রিপশন।

সেই সঙ্গে আবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া, ঠাকুর বলেছেন, ‘‘দোষ দেখার পরিবর্তে, যতটা সম্ভব প্রত্যেকের গুণ আমাদের দেখা উচিত।’’

অহংকারকে নির্মূল করার জন্য তিনি মেথরের মতো পায়খানা পরিষ্কার করেছিলেন, তাঁর ফ্রি-সাইজ ঘোষণাটা সোজাসুজি— ‘‘মায়ার চেয়ে বন্ধন বড় নয়, যোগের চেয়ে শক্তি বড় নয়, জ্ঞানের চেয়ে বন্ধু বড় নয়, অহংকারের চেয়ে শত্রু বড় নয়।’’

আগেই উল্লেখিত যেমন, এই অহংই হল ‘‘কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, অহংকার ও জিঘাংসার মূল।’’

দু’একটি অতিপ্রয়োজনীয় ব্যাপারে ঠাকুর সত্যিই ফ্রি-সাইজ— সব মানুষই তা সহজে গ্রহণ করতে পারে। যেমন ধন।

‘‘ধন না থাকিলে জগতে কাহারও সম্মান লাভের সম্ভাবনা নাই। ধনে মূর্খকেও পণ্ডিত করায়। ধনে অসম্ভব সম্ভবপর হয়…শ্রীরামকৃষ্ণ অর্থকে সর্ব অনর্থের মূল জানিয়া তাহার ধাতুময়ী মূর্তির প্রতি এতাদৃশ ঘৃণাপরায়ণ হইয়াছিলেন যে, কোনও ধাতুময় দ্রব্য তিনি স্পর্শ করিতে পারতেন না, তাহা করিলে তাঁহার হস্ত অসাড় হইয়া যাইত। পরমুহূর্তের জন্যও তিনি কিছু সঞ্চয় করিতে পারিতেন না।’’

সংসারের কঠিনতম বিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের সহজতম বাণী তাঁর সন্ন্যাসী সন্তানদের মুগ্ধ করেছিল।

প্রিয় শিষ্য রামকৃষ্ণানন্দ তাঁর ফ্রি-সাইজ পলিসিকে অনেক ভেবে-চিন্তে জীবন সায়াহ্নে ব্যাখ্যা করেছেন, ‘‘এ জগতে বন্ধনই একমাত্র সহায় ও সুখের কারণ। প্রেমবন্ধন আছে বলেই সাংসারিক জীবন এত সুখকর হয়েছে। গৃহনির্মাণ, বস্ত্রবয়নে, পেটিকাদি কারণে বন্ধন অপরিহার্য। গৃহদ্বারে বন্ধন না দিলে চোরের ভয়। কেশ বিন্যাসে বন্ধন আবশ্যক: … ভিক্ষুকও আপনার চীরখণ্ডগুলিকে একত্রবন্ধন করে রাখে, পাছে হারিয়ে ফেলে। অতএব বন্ধন সাংসারিক লোকের পরম সহায়, কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ বন্ধনের কথায় ভয় পেতেন… তিনি বন্ধনকে এত ঘৃণার চোখে দেখতেন যে কোনও দ্রব্যে তিনি বন্ধন দিতে পারতেন না। বস্ত্র পরিধানে বন্ধন আবশ্যক, সুতরাং স্বয়ং পারতেন না বলে অন্যে তাঁকে বস্ত্র পরিয়ে দিত।’’

সবাইকে জড়িয়ে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের এই ফ্রি-সাইজ পলিসির উৎস কোথায়?

তাঁর প্রিয় সন্তান স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ অন্য অনেকের মতন তা খুঁজে বার করেছিলেন। তিনি লিখে গিয়েছেন, ‘‘শ্রীরামকৃষ্ণের ভিতর আমিত্ব ছিল না। তিনি ‘আমি, আমার’ এই দুই কথা উচ্চারণ করতে পারতেন না। যে জায়গায় সচরাচর লোকে ‘আমার শব্দ ব্যবহার করে থাকে, তিনি সেই জায়গায় নিজের বুকে হস্ত স্থাপন করে ‘এখানকার’ শব্দটি ব্যবহার করতেন। যেমন ‘আমার ভাব এরূপ নয়’ বলতে হলে তিনি ‘এখানকার ভাব এরূপ নয়’ বলতেন।’’

সেই কারণেই দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের সাত টাকা মাইনের পুরোহিত আজও ভক্তজনের হৃদয়ে এই ভাবে বেঁচে আছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE