Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বড় ম্যাচের টিকিট যখন ৬০ পয়সা, ১ টাকা ১০

এই তখন ঘেরামাঠের প্রবেশমূল্য। ছিল ডে’জ স্লিপ, মাউন্টেড পুলিশের লাঠি, কাঠের গ্যালারি, র‌্যাম্পার্ট। ময়দানে হারিয়ে যাওয়া সেই আগুনে দিনগুলোর গল্প খুঁজলেন রতন চক্রবর্তী ইস্টবেঙ্গল ঠিক কত গোলে জিতছে, জানার জন্য হীরালাল সাহার হাতের দিকে তাকালেই চলত। গোল হলেই তাঁর আঙুলের ফাঁকে একটা একটা করে নতুন সিগারেট জ্বলে উঠত। চারটের বেশি গোল হলে বাঁ হাতের ফাঁকেও দেখা যেত আগুন দেওয়া চারমিনার। ষাট বা সত্তরের দশকে শিয়ালদহের ওই কট্টর লাল-হলুদ সমর্থক ছিলেন যে কোনও ম্যাচের চলমান স্কোর বোর্ড। মোহনবাগানের গ্যালারিতে থাকতেন মণ্ডলবাবু। গোল হলেই তিনি খুলে ফেলতেন তাঁর বিশাল ছাতা।

শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

ইস্টবেঙ্গল ঠিক কত গোলে জিতছে, জানার জন্য হীরালাল সাহার হাতের দিকে তাকালেই চলত।

গোল হলেই তাঁর আঙুলের ফাঁকে একটা একটা করে নতুন সিগারেট জ্বলে উঠত।

চারটের বেশি গোল হলে বাঁ হাতের ফাঁকেও দেখা যেত আগুন দেওয়া চারমিনার।

ষাট বা সত্তরের দশকে শিয়ালদহের ওই কট্টর লাল-হলুদ সমর্থক ছিলেন যে কোনও ম্যাচের চলমান স্কোর বোর্ড।

মোহনবাগানের গ্যালারিতে থাকতেন মণ্ডলবাবু। গোল হলেই তিনি খুলে ফেলতেন তাঁর বিশাল ছাতা। মাথার উপর ছাতা তুলে বনবন করে ঘোরাতেন। ঘুরিয়েই যেতেন। সবুজ-মেরুন গ্যালারিতে তিনিই ছিলেন পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের জীবন্ত-আনন্দ।

কেউ তাঁর আসল নামের খোঁজ করেনি কখনও। সবাই ডাকত ছাতা ঘোরানো মণ্ডল।

হীরালাল বা মণ্ডলবাবুরা এখন আর মাঠে আসেন না।

প্রথম জন প্রয়াত। অন্য জনের খোঁজ নেই। তাঁর সঙ্গে নিয়মিত আড্ডায় বসা গ্যালারি-বন্ধুদের সবার কাছেই ওঁরা লা-পাতা।

ময়দানের তিন প্রধানের গ্যালারির বন্ধুত্ব এক সময় যা ছিল, এখন তার পুরোটাই প্রায় ভ্যানিশ! বছর বছর ধরে এক দল যেত, অন্য দল আসত। অনেকটা ‘কফিহাউসের সেই আড্ডাটা’র মতোই।

এক দশক ঘুরে আরেক দশক। বদলে যেত আড্ডার মুখ। আড্ডা কিন্তু থামত না। এটাই ছিল পরম্পরা। আড্ডা-সদস্যদের নিয়ে পাঁচ-দশ বা পনেরো জনে হয়ে যেত এক-একটা পরিবার।

শুধু ফুটবল নয়, হকি, ক্রিকেট— আড্ডায় বাদ থাকত না কিছুই। তার মাঝেই চলত পিকনিক। ‘শত্রু’ক্লাবের বংশোদ্ধার। এ দল-ও দল খেলোয়াড় নেওয়ানেয়ির গোপন খবর চালাচালি। আবার এই আ়ড্ডাই কখনও বা হয়ে যেত বিয়ের পাত্র-পাত্রী দেখাশোনার মঞ্চও!

ইস্টবেঙ্গলের কর্মসমিতির এক সদস্য দেবু বসু যেমন। উনি তাঁর মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর গ্যালারি-দোসর বীরু গুহর ছেলের সঙ্গে।

মৃত্যু কখনও কখনও সেই আড্ডায় থাবা বসাত। কখনও শরীর বা সময়ের অকুলানও তাতে ছেদ ফেলেছে। টুকরো কাগজ আর বাদামের খোলার মতোই পড়ে থেকেছে অসংখ্য ছবি। এখনও প্রবীণ যাঁরা মাঠে আসেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপে বসলে ধুলো ঝেড়ে বের করে আনেন সেই মেদুরতার দিনগুলি। সে দিনের মণিমুক্তো। ভেসে যাওয়া আদরের নৌকো-য় সওয়ার হয়ে তাঁরা ভেসে যান স্মৃতির নদীতে। আধুনিকতার প্রাচুর্য, বৈভব চাপা পড়ে মুহূর্তে। কী যেন এক নৈসর্গিক অনুভবে আচ্ছন্ন হয়ে যান তাঁরা।

ইডেন থেকে ফুটবল সরে গিয়েছে অনেক দিন। কিন্তু ময়দানের ঘাসের নীচে এখনও যে কত শত গল্প গুটিসুটি মারে একা একা!

কত স্মৃতি! কত স্মৃতি!

ব্রিটিশদের তৈরি গ্যালারিতে বসতে হবে বলে কিংবদন্তি মোহনবাগানি গোষ্ঠ পাল না কি নিজের ক্লাবের খেলাই দেখতেন না।

ম্যাচের সময় তিনি বসে থাকতেন ক্লাব তাঁবুর দাওয়ায় রাখা কাঠের বেঞ্চিতে। কখনও কখনও আবার মাঠেই আসতেন না।

ম্যাচের দিন গ্যালারিতে বসতেন না এক সময়ের বাগান সচিব ধীরেন দে। তিনি বসে থাকতেন গঙ্গাপারের কোনও নৌকোয়। কখনও দূরে রাখা নিজের গাড়িতে। শুনতেন না রেডিয়োর ধারাভাষ্যও।

যুগটা মোবাইলের নয়। তাই বাগানের সবর্কালের সফলতম সচিব নিজের ড্রাইভার তেওয়ারিকে বারবার পাঠাতেন সামান্য দূরে, খেলার ফল জানতে। কখনও আবার মাঠের শব্দব্রহ্ম শুনেই বুঝে নিতেন গোল হয়েছে।

ইস্টবেঙ্গলের প্রয়াত সচিব পল্টু দাশ গ্যালারিতে থাকতেন ম্যাচের সময়। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে নির্দিষ্ট আসন ছিল তাঁর। তবে ম্যাচ চলাকালীন কখনও বেঞ্চিতে বসতেন না তিনি। খেলা শুরুর কয়েক মিনিট আগে মাঠে ঢুকতেন। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন ম্যাচের সময়। তুকতাক নয়। এটাই ছিল ওঁর দস্তুর।

বঙ্গজীবনের অঙ্গের মতোই ইস্টবেঙ্গল শব্দটা যাঁর জীবনের ধারাপাত, সেই স্বপন বল আবার ম্যাচের সময় দু’টো বেঞ্চি একসঙ্গে করে তার জোড়া অংশটায় বসতেন। দীর্ঘদিন ক্লাবের ম্যানেজার পদ সামলানো স্বপনের কথায়, ‘‘এ ছিল আমার তুকতাক।’’ এ ভাবে বসলে তাঁর টিম নাকি কখনওই হারত না।

পঞ্চাশ, ষাট বা সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মেয়েদের মাঠে আসার চল তেমন ছিল না।

একমাত্র বনেদি সেনবাড়ি, শোভাবাজার রাজবাড়ির মহিলারা কখনও সখনও আসতেন। প্রাক্তন বামনেতা, স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়েকেও দেখা যেত মাঝেমধ্যে।

মহিলা-সমর্থকদের ভিতর চোখে পড়ার মতো ব্যতিক্রমও ছিল। স্বামী অলোক ঘোষের হাত ধরে মাঠে আসতেন শিক্ষিকা মঞ্জুদেবী। সেই ’৬০ সাল থেকে এখনও নিয়মিত ময়দানে আসেন তিনি। প্রতি দিন তাঁকে দেখা যায় বাগান-তাঁবুর সেই বিখ্যাত লনে।

সে কালের নামী অভিনেত্রী-প্রেমিকা তপতী ঘোষকে যেমন নিজের কালো রঙের রোভার গাড়িতে বসিয়ে মাঠে আনতেন সমর (বদ্রু) বন্দ্যোপাধ্যায়।

পুরীতে আলাপ। ‘উল্কা’ নাটক দেখে ভালবাসা। এর পর তপতীদেবীর সঙ্গে ‘সাহেব’ বদ্রুর বিয়েও হয়।

সংসার করেছেন চুটিয়ে। তার আগে বদ্রুর প্রেম ছিল আর এক অভিনেত্রীরই সঙ্গে। তিনি মীনাক্ষী গোস্বামী। সে-প্রেম অবশ্য টেকেনি।

খেলোয়াড়-অভিনেত্রীর প্রেম-ভাঙার গল্প ময়দানে আরও আছে। নামী অভিনেত্রী অনুভা গুপ্তা। বাগানের মিডিও অনিল দে-র সঙ্গে এক কালে চুটিয়ে প্রেম করতেন। খেলার সময় প্রায় প্রতিদিন গ্যালারিতে এসে বসতেন তারকা অভিনেত্রী। শেষ পর্যন্ত বিয়েটা আর হয়নি।

বয়েসে দশ বছরের ছোট রবি ঘোষের সঙ্গে ঘর বাঁধেন অনুভা। আর অনিল সংসার পাতেন অন্য খানে।

নব্বই দশকে দুই প্রধানে খেলা দুঁদে সুদর্শন এক স্ট্রাইকারের বাইকে প্রায়ই ঘুরতে দেখা যেত এক নামী অভিনেত্রীকে। সেই অভিনেত্রী আবার এখনকার এক রাজনীতিকও। ময়দান চত্বরে সন্ধ্যায় তখন তাঁদের অভিসার ছিল রীতিমতো মশালাদার খবর।

আরও দু’জনের কথা মনে পড়ছে। বাগানের এক নামী স্ট্রাইকার। বর্তমানে পক্ককেশ কর্তাবিশেষ। আর এক প্রাক্তন নামী ডিফেন্ডার।

দু’জনের সঙ্গেই বেশ কয়েকজন টলিউড-অভিনেত্রীর ঘনিষ্ঠতা ছিল। সে ঘটনা সবারই জানা। আড়ালে-আবডালে দু’জনেই তা আজও স্বীকার করেন। শুধু নাম উল্লেখের অনুমতি মিলল না।

ঘেরা মাঠের চেহারাটাই ছিল অন্য ধাঁচের। সার সার কাঠের গ্যালারি। জাল আর কাঠের খুঁটির বেড়া। গ্যালারির সেই কাঠ বদলে এখন টিউবিউলার। লোহার পাইপের উপর সিমেন্টের বেঞ্চি।

এক সময় প্রিয় দলের হারের পর ক্ষোভ জানানোর অস্ত্র ছিল ওই বেঞ্চির কাঠগুলো। ভাঙা কাঠ মিসাইল হয়ে ছুটে যেত কোচ-ফুটবলারদের দিকে। মাথা বাঁচাতে ত্রিপলের তৈরি তাঁবুটাই ছিল ওঁদের একমাত্র সম্বল। কখনওসখনও আস্ত বেঞ্চি এসে পড়ত তার ছাদে। প্রাণভয়ে যার নীচে লুকিয়ে পড়তেন ক্লাবের কর্তারা, ফুটবলাররা। এক-এক দিন অনেকেই বাড়ি ফিরতেন পুলিশের গাড়িতে।

বাগানের ক্যান্টিনের চিকেন স্টু এক সময় ছিল মেম্বার্সদের হট-আইটেম। এখন যা বেঁচে আছে নিভু-নিভু হয়ে। অনেকটা পাড়ায় পাড়ায় পোস্টাপিসের ধুলোমলিন পোস্ট বক্সের মতোই।

পুরনো লোকজনকে উস্কে দিলেই ঠোঁট-উল্টানো জবাব শুনবেন, ‘‘সে-স্বাদ আর কই ভাই, যার লোভে এক কালে উপচে পড়ত ভিড়, আজকের কাজুর ক্যান্টিনে!’’

হাইকোর্টের দুঁদে বিচারপতি থেকে অভিনেতা, বনেদি বাড়ির কর্তাবাবু থেকে উত্তর কলকাতার রকে আড্ডা দেওয়া কেরানি— সবার কাছেই তখন মোহনবাগানের খেলা দেখতে গিয়ে এক বাটি স্টু না-খাওয়া মানে জীবনটা মাঠে মরে যেতে দেওয়া!

স্টু-টা তাও পাওয়া যায় এখন। কিন্তু এক কালে ইস্টবেঙ্গল মাঠের ক্যান্টিনের বিখ্যাত সেই মাংসের ঘুঘনি আর ডিমের পোচ? — মাথা খুঁড়লেও পাবেন না।

নেই সেই বাঁশ আর টিনের তৈরি ক্যান্টিন। বদলে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝাঁ চকচকে কাফেটেরিয়া। মিয়োনো বাতির ঝুলপড়া ক্যান্টিনের বদলে ফটফটে আলো। সুদৃশ্য টেবিল।

পাশে মহমেডান মাঠের গল্পও সেই ‘হারানেরই’। বড় বড় পেঁয়াজি, টোস্ট, রং চটা কাপে চা।—কোথায় গিয়েছে হারিয়ে!

ক্যান্টিনই বন্ধ থাকে প্রায় দিন। শাকালুওয়ালা, স্যাকারিন দেওয়া লেবু চা বা চিনেবাদামওয়ালার দেখা মেলে কালেভদ্রে। পাবেন না গ্যালারিতে কাচের বয়ামে করে আনা কোনও দাদুর আচার, কী লাল-সবুজ-হলুদ লজেন্স বিক্রি করা দিদিকেও।

ক্রমশ লুপ্তপ্রায় প্রাণীর মতোই দিনে দিনে তাঁরাও হয়ে পড়ছেন মিউজিয়াম-পিস।

ফেসবুক, টুইটার আর ওয়াটস অ্যাপ যুগের লাল-হলুদ, সবুজ-মেরুন বা সাদা-কালো সমর্থকদের বেশির ভাগেরই এই ছবিগুলো অচেনা, অদেখা। ক্লাবকে ঘিরে তাদের আবেগের অনেকটাই যেন টিভির সামনে, ফেসবুকের চাপানউতোর নয়তো ফ্যানস্ ক্লাবের অনুষ্ঠানে-অনুষ্ঠানে বন্দি!

ইংরেজ আমলে তৈরি নিয়মে ময়দানের মালিক এখনও সেনাবাহিনী। ময়দানের তিন ঘেরা মাঠের একটা দিকে ওরা কোনও কাঠামো তৈরি করতে দেয় না। তারকাঁটার বেড়া দিয়ে ঘেরা থাকে এক দিকের গোলপোস্টের পিছনের ওই জায়গাটা। যাকে বলে র‌্যাম্পার্ট।

ঘেরা মাঠের বাইরে ওই একটা জায়গা থেকেই দেখা যায় প্রায় পুরোটা মাঠ। ঝাঁ ঝাঁ রোদে পুড়ে, কখনও বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে দুপুর একটা-দেড়টা থেকে দাঁড়িয়েও যখন টিকিট মিলত না, ভাঙা-হৃদয়ের দর্শকদের ঢল নামত তখন ওই র‌্যাম্পার্টেই।

কাতারে কাতারে লোক। গিজ গিজে সার সার মাথা। সেই মাথার আড়াল সরিয়ে ফাঁক খুঁজে খেলা দেখা অত সহজ না। তখন ভরসা ছিল একটু পিছনের ঢালু জমি, নয়তো সার দেওয়া সাইকেল কী বাইকের সারির সিটগুলো।

আর ছিল গাড়ির ব্যাটারির খোল। কার্ডবোর্ডে তৈরি টেলিস্কোপ। পাওয়া যেত ভাড়ায়। দু’য়ে মিলে আট আনা। খোলের ওপর চেপে, চোখে টেলিস্কোপ রেখে দুধের স্বাদ তখন ঘোলে।

ময়দানে এখন আর ফুটবল নেই। তাই র‌্যাম্পার্ট আজ থেকেও নেই।

ছিল ডে’জ স্লিপ। এক দিনের খেলা দেখার গেট পাস।

টিকিট নয়। বিনি পয়সায় সই আর সরকারি সিলমোহর ছাপ্পা দেওয়া চিলতে কাগজের টুকরো। বেশির ভাগই এগুলো পেতেন ফুটবলার বা কোনও ক্লাবকর্তার ভাগ্যবান আত্মীয়, নয়তো বন্ধু-স্যাঙাত।

একটা ডে’জ স্লিপ মানে, ময়াল সাপের মতো পেল্লাই লাইনে দাঁড়ানো নেই, ধাক্কাধাক্কি, গুঁতোগুঁতি, হুজ্জুতি নেই। রোদ-বৃষ্টির ঝামেলা নেই। কলার তুলে বড়জোর মিনিট পনেরো আগে হেলতে-দুলতে মাঠে ঢোকা। আর সত্তর মিনিটের তাজা শো-এর আঁচ পোওয়ানো। এই ডেজ স্লিপেরও ঠাঁই এখন জাদুঘরে।

চালু ছিল ‘আই স্লিপ’ও।

পেয়ারের ভক্ত কিংবা পাড়ার চেনা মুখকে মাঠে ঢোকানোর আরেক তরিকা। তারকা ফুটবলার বা কর্তারা গেটে দাঁড়ানো মাঠ কমিটির সদস্যদের চোখের ইশারায় অনুরোধ করতেন, ‘‘আমার পরিচিত, মাঠে ঢুকিয়ে দিন।’’

ওই ইশারাটুকুই ছাড়পত্র।

টিকিটের দাম এক সময় ছিল সাত আনা আর তেরো আনা। পরে হল ষাট পয়সা আর এক টাকা দশ। মেম্বার্স কার্ড, ডেজ স্লিপ, আই স্লিপ, সেনা-গ্যালারি বাদ দিলে বাকিরা বসতেন ওই ষাট, কী এক টাকা দশেই। ষাট হলে মাঠের আড়াআড়ি। আর এক টাকা দশে গোল পোস্টের পিছনে, কী একটু ত্যারছা ভাবে।

গ্যালারির উত্তেজনা ঠেকাতে তৈরি পুলিশ

ওই দু’টো গ্যালারি ছিল যে কোনও ম্যাচের উত্তেজনা আর বিষাদের প্রধান মুখ। মাঠে চোখা চোখা শব্দবাণ থেকে ইট-পাটকেলের বৃষ্টি শুরু হত ওই সব দিক থেকেই।

আবার ফুলের মালা কিংবা চিংড়ি নয়তো ইলিশ নিয়ে ফেন্সিং টপকে মাঠে ঢোকার দুঃসাহসিক দায়িত্বটাও নিতেন ওঁরাই। মশাল আর কার্ডবোর্ডের পালতোলা নৌকার ‘রেপ্লিকা’ নিয়ে মাঠে আসার প্রথম পাঠও ওখানেই তৈরি।

পূর্ববাংলা ছেড়ে আসা রোখাসোকা, ডাকাবুকোদের ভিড়ে ঠাসা ইস্টবেঙ্গল গ্যালারি। শয়ে শয়ে রাগী আগুনে মুখের ভিড়। তুলনায় বাগানের গ্যালারি শান্ত। অন্তত সদস্য আসন তো বটেই।

হাওড়ার এক বনেদি বাড়ির সদস্য একবার অশ্লীল গালাগালি দিয়েছিলেন বলে তাঁর কার্ড কেড়ে নিয়েছিলেন ‘মোহনবাগানি’ কিংবদন্তি উমাপতি কুমার।

উল্টো দিকে ইস্টবেঙ্গলি কর্তারা সব সময় যেন যুদ্ধং দেহি!

মনে পড়ে, সত্তর দশকে মোহন-ইস্ট ম্যাচ। মোহনবাগান হেরেছে। ইস্টবেঙ্গলে তখন উঠতি কর্তা অভিন্নহৃদয় দুই বন্ধু— পল্টু দাস আর জীবন চক্রবর্তী।

উত্তেজনায় ফেটে পড়তে পড়তে জীবন সে বার ম্যাচ শেষে মোহনবাগানি গোলকিপার তরুণ বসুর মুখের ওপর জোড়া ইলিশ নাচিয়ে ছিলেন।

তরুণ বসু তখনও অবধি টুপি পরে খেলতেন। অনেকটা রাজার যেমন মুকুট থাকে, তেমন ওটাই ছিল তার ‘ট্রে়ড মার্ক’। ওই ঘটনার পর তরুণ চিরদিনের জন্য সেই ‘মুকুট’ ত্যাগ করেন। খেলতে গিয়ে আর কোনও দিনই টুপি চড়াননি মাথায়।

বাগান সদস্যদের গনগনে মেজাজ তৈরি হল অনেক পরে। টুটু বসু-অঞ্জন মিত্রদের জমানায়। বিশেষ করে চিমা ওকোরিকে এনে মোহনবাগানে বিদেশি খেলানোর রেওয়াজ চালু করার পরে সেটা আরও বাড়ে। বাগানের সেই চিরাচরিত গ্যালারির গাম্ভীর্য আর কুলীনতায় টান পড়ল এর পরই।

মেম্বার্স গ্যালারির পিছনেই প্রেস বক্স। রেডিয়োতে সরাসরি ধারাভাষ্যর ব্যবস্থা হলে ওখানে বসেই দিতে হত। তার পরিণাম এক-এক সময় যে কী ভীতিপ্রদ ছিল!

ক্লাব নিয়ে একটু বেচাল কিছু বলে ফেললেই সে দিনের মতো ভাষ্যকারের হয়ে গেল!

বলা বাহুল্য, এই ঝাঁঝটাও ছিল ইস্টবেঙ্গল মাঠেই বেশি। লালহলুদ মাঠের সঙ্গেই এরিয়ান ক্লাবের তাঁবু। গ্যালারিও লাগোয়া। সমালোচনার ‘স’ শেষ হবার জো ছিল না, কান ঝাঁঝিয়ে দেওয়া অশ্লীল শব্দে ঠিকরে উঠত প্রেসবক্স।

এমনকী আগের ম্যাচে রিপোর্টে হয়তো কড়া সমালোচনা করেছেন কোনও রিপোর্টার, পরের ম্যাচে তাঁকে দেখা মানেও দাউ দাউ চিতা।

ইস্টবেঙ্গল গ্যালারি মানেই, পায়ে পায়ে এমনই কড়া ট্যাকেল। সে ধারাভাষ্যকারই হন, কী সাংবাদিক।

ধীরেন দে পরবর্তী জমানায় যেটা এল বাগান মাঠেও।

এই তো বছর কয়েক আগের গল্প। একরোখা, অন্ধ ভক্তরা সুব্রত ভট্টাচার্যের মতো ‘ঘরের ছেলে’-কে হেনস্তা করতে ছাড়ল না। নিজের মাঠেই ‘আক্রান্ত’ হলেন সুব্রত। সেই সুব্রত, যিনি কিনা ক্লাবকে এনে দিয়েছেন জোড়া আই লিগ-সহ ৬৮ টা ট্রফি। মীর মহম্মদ ওমরের জমানায় মহামেডান মাঠে দু-এক জন ফুটবলার চড় থাপ্পড় খেলেও অন্য দুই প্রধানে কিন্তু সুব্রতর ঘটনা ছাড়া এমনটা কমই ঘটেছে।

টিম হেরে গেলে পুরো টিমকে মাঠে ঘেরাও করে রাখা হয়েছে, এমন ঘটনা ইস্টবেঙ্গল-ইতিহাসে আকছার। এই তো সে দিন, ট্রেভর মর্গ্যান জমানাতে যেমন। এরিয়ান ম্যাচে হেরে যাওয়ার পর দলবল সমেত তাঁবুতে আটকা পড়েছিলেন ব্রিটিশ কোচ।

এক বারের কথা মনে পড়ে।

হারা ম্যাচের পর বাগান গ্যালারি থেকে সমর্থকদের ছোড়া ইটের ঘায়ে একটা চোখই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল ফুটবলার মহম্মদ লতিফের। স্কুটার পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রদ্যোত বর্মনের।

ইস্ট-মোহনের গ্যালারিকে সমান তালে টেক্কা দিতে পারে মহামেডানও।

টিম লিগে হয়তো আট নম্বরে, তবু গ্যালারিতে ভিড় উপচানো। এমনই আবেগ। এতই টান। সাদা-কালোর ঘরে ক্ষোভ যত বেশি, ভালবাসার পাল্লাও ততটাই ভারী।

এক-এক সময় সেই অতি-উৎসাহ, অতি-আবেগ যে কী আকার নিত!

গোল করলে নিজের সোনার হার ফুটবলারকে পরিয়ে দিয়েছেন এমন সমর্থক সাদা-কালোতে মুঠো মুঠো। সেই সঙ্গে হারের পর প্রেসবক্সে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার একমাত্র রেকর্ডও আছে ওদেরই।

এক বারের ঘটনা।

অভিনেতা সলমন খান মাঠে এলেন। শুধু তাঁকে ছোঁবেন বলে ইলেকট্রিকের বিপজ্জনক তার তোয়াক্কা না করে গ্যালারি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন জনা তিনেক দর্শক। বড়সড় দুর্ঘটনা হয়নি, শুধু কপাল জোরে। নিরাপত্তার অভাবে ভয়ে সলমন ফিরে গিয়েছিলেন মাঠে না ঢুকে।

অন্য এক বার। সে দিন সেই ‘কপাল’ আর সাথ দিল না।

টিম জিতল। গ্যালারিতে শুরু হল তুমুল নাচ। কাঠের তক্তা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল মাটিতে। মৃত্যু হল মেটিয়াবুরুজের এক সমর্থকের।

সত্তর বা আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বড় দলের গ্যালারিতে একটা অদ্ভুত জিনিস পাওয়া যেত। চার বা আট পাতার ট্যাবলয়েড। খেলার পত্রিকা।

পুরো হট কেক। ‘অলিম্পিক’, ‘গড়ের মাঠ’, ‘খেলার মাঠ’—সাদা-কালো ব্লকের ধোঁয়াশা কালো কিংবা নীলচে ছবি। অনেকটা এখনকার ভোটার কার্ডের মতো দেখতে। লেটার প্রেসের হরফ। ক্রীড়াসূচি থেকে ফুটবলারদের হাঁড়ির খবরে ঠাসা। গ্যালারিতে তার পঞ্চাশ-ষাট-একশো কপি আসা মাত্র নিমেষে হাওয়া।

নালায় পড়ে যাওয়া মাউন্টেড পুলিশের ঘোড়া

একই ফুটবলারের একই ছবি বছরভর ছাপা হয়েছে। খবরের মাথামুণ্ডু নেই। তাও সেই ট্যাবলয়েডের যে কী ক্রেজ ছিল!

এখন আর তার খোঁজ মেলে কই!

খোঁজ নেই টিকিট প্রত্যাশীর দীর্ঘ লম্বা লাইনের পাশে মাউন্টেড পুলিশের রোমহর্ষক দাপাদাপিরও।

শুধু ডার্বি বলে নয়, রোজকার খেলার মাঠে টিকিট লাইনে এক সময় মাউন্টেড পুলিশের দৌড়াদৌড়ি ছিল বাঁধা গল্প। অবশ্যই বড় ম্যাচে তাদের দাপট বেশি।

ডার্বি দেখতে লোক এখন কম আসে এমন নয়। টিকিট ইচ্ছে করে কম না ছাড়লে যুবভারতীতে আশি-নব্বই হাজারের ভিড় হেসেখেলে। কিন্তু টিকিট বিক্রির বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে। তার সঙ্গে সঙ্গেই ভোক্কাট্টা হয়ে গিয়েছে ষাট- সত্তর-আশির দশকের ঘোড়সওয়ারের চেনাচেনা মুখের সারি।

ডার্বি তখন মাঝেমধ্যে ইডেনে হত। টিকিট বিক্রি হত দুই প্রধানের মাঠ থেকে। দু’দিন আগে থেকে লম্বা লাইন। লাইনে জায়গা রাখতে এমনও হত— সকালে বাবা, বিকেলে কাকা, রাতে ছেলে। পরের দিন আবার একই রুটিন।

রাতে বাড়ি থেকে আসত খাবার। তাতেও যে সবাই টিকিট পেতেন, তা নয়।

ঠিক যে দিন টিকিট দেওয়ার কথা, সে দিন সকালেই শুরু হত বিকট ঝামেলা। অনেকটাই তা এক দল ঝানু মাথার সমর্থকের আগে ভাগে ভেবে নেওয়া স্ট্র্যাটেজি।

সে কেমন?

লাইন পাহারার দায়িত্বে মাউন্টেড পুলিশ। এক দল যুবক ছিল যাদের কাজই হত মাউন্টেড পুলিশের ঘোড়াটাকে উত্ত্যক্ত করে তোলা। তাতে নৃশংস সব কাণ্ডও ঘটেছে এক-এক সময়। মায় ঘোড়ার পশ্চাদ্দেশে সিগারেটের ছ্যাঁকা পর্যন্ত। আর খুব কমের ওপর দিয়ে গেলে ঘোড়ার লেজ মুড়িয়ে ঝাঁকানি।

ব্যস, খেল্ শুরু।

ঘোড়ার এলোপাথাড়ি দৌড়াদৌড়ি। তার পিঠে চড়া পুলিশের বাঁই বাঁই লাঠি। মুহূর্তে লাইন ছারখার।

নিট ফল?

প্রায়ই দু’রাত জেগে থাকা টিকিট প্রত্যাশীরা চলে যেতেন সবার পিছনে। আর সামনে? তক্কে তক্কে থাকা সমর্থকদের আশি ভাগ।

পর পর রাত জেগে ক্লান্ত শরীরে কাউন্টার খোলার মুখেই ছিটকে যাওয়াদের অনেকেই তখন প্রায় স্বজন-হারানো শোকে আছাড়িপিছাড়ি।

কেউ আবার অপ্রত্যাশিত ভাবে টিকিট পেয়ে মাঠেই গড়াগড়ি।

এই ভাঙাভাঙির খেলাটা যে শুধুই ডার্বি ম্যাচে হত, তাও নয়।

সে কালে বড় ম্যাচ ছাড়াও তিন বড় দলের বড় গাঁট ছিল এরিয়ান, খিদিরপুর, ইস্টার্নরেল, রেলওয়ে এফসি-র মতো টিম। স্বভাবতই কমবেশি উত্তেজনা থাকত এই ম্যাচগুলোর দিনেও।

সত্তর দশকের এমন একটি ম্যাচের কথা মনে পড়ে।

লিগে উয়াড়ির উত্তম চক্রবর্তীর গোলে ইস্টবেঙ্গল হেরে গেল। পরের বছর ইস্টবেঙ্গল-উয়াড়ি ম্যাচে খেলা দেখতে যে পরিমাণ লোক লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন, তার ক’শতাংশ যে মাঠে ঢুকতে পেরেছিলেন, কে জানে! রীতিমতো ‘বড় ম্যাচ’-এর উত্তেজনা সে বার। লাইন ছত্রখান। লাঠি। কাঁদানে গ্যাস। রক্তারক্তি কাণ্ড। ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে কাঁটা ঝোপের মধ্যেও দৌড়াদৌড়ি।

ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই মাউন্টেড পুলিশ বাহিনী এখন কার্যত শো-পিস।

মাঠের বাইরে লাইন থেকেই তৈরি হওয়া এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধটা অনেকটা সলতে পাকানোর মতো ছিল। মাঠের ভেতরটা তো বারুদে ঠাসা। সলতের একটাও যদি হিলহিলে হয়ে দপ্ করে উঠত, মাঠটা হয়ে যেত ভিসুভিয়াস!

এও ছিল যেন রোজের গপ্পো।

এই মারকাটারি লড়ালড়ির পাশাপাশি, বাঙাল-ঘটি লড়াই-এ কিছু অদ্ভুতুড়ে স্বাদ ছিল ময়দানের রোজনামচা।

তারই একটি যেমন।

একশো পঁচিশ বছর পেরোনো মোহনবাগানের ঘরের দুই ছেলে চুনী গোস্বামী এবং সুব্রত ভট্টাচার্যের পূর্বপুরুষ ছিলেন বাঙাল।

চুনীর আদি বাড়ি ময়মনসিংহে আর সুব্রত মানে বাবলুর যশোর।

বাবলুকে তেমন কটাক্ষ শুনতে না হলেও চুনী ডার্বি ম্যাচে গোল করতে না পারলেই গ্যালারিতে একটা আওয়াজ ছিল পাক্কা— ‘‘ও বাঙাল, বাঙালদের গোল করে না ইচ্ছে করেই।’’

দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফরোয়ার্ড সবুজ-মেরুন জনতার বিশ্বাসী হতে চেয়ে চুনী যে কাণ্ডটি ঘটিয়েছিলেন, তা সেই সময়ের ময়দানি উত্তাপকে হাড়ে হাড়ে চিনিয়ে দেয়। ‘অপবাদ’ থেকে বাঁচতে চুনী গোস্বামী বিয়ে করেছিলেন ঘটির বাড়ির মেয়েকে! ঘটনাটি বলতে গিয়ে এখনও বেশ মজা পান কিংবদন্তি ফুটবলার।

চুনীকে বাগান সমর্থকরা ডাকতেন ‘বড়বাবু’। লম্বা ছিলেন বলে সুব্রতর নাম হয়ে গিয়েছিল ‘লগা’। পরে তাঁকে কেউ কেউ ডাকতেন ‘উত্তমকুমার’ বলে। এই নামগুলোর জন্মদাতাও ওই গ্যালারিই। এমন নামাবলির সংখ্যাও অগুনতি। ইস্টবেঙ্গলের সোনালি যুগের স্টপার অশোকলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডাকা হত হেডমাস্টার। গৌতম সরকারকে ছোট বেকেনবাউয়ার, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যকে আয়রন ম্যান, কে বি শর্মাকে কালীবাবু, কৃষ্ণকায় কান্ননকে ‘কেলে কান্নন’।

দর্শক আসনে ফুটন্ত আম-আদমির ভিড়টার পাশে ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বলে একটা দিকও ছিল।

ঘেরা মাঠের সে-কাহিনিও কম রংদার নয়!

সুকল্যাণ ঘোষ দস্তিদারের ঘুষিতে আহত রেফারি বিশ্বনাথ দত্ত

টিভির সম্প্রচার তখন আজকের মতো নয়। ময়দানি ফুটবলের স্বর্ণযুগের একটা বড় সময়ে তো টিভিই আসেনি। তাই বিকেল হলেই মাঠে চলে আসতেন হাইকোর্টের নামী বিচারপতি থেকে দুঁদে ব্যারিস্টার। অহীন্দ্র চৌধুরী থেকে উত্তমকুমার। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য থেকে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় হয়ে অনুপকুমার, সন্তোষ দত্তরা। কলকাতায় থাকলে কোনও কোনও সময় শচীনকর্তা।

এই গুণী মহলেও ঘেরামাঠের যে কী প্রবল টান!

একটি ঘটনা বলি।

মহালয়ার রিহার্সাল করাচ্ছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। এ সময়ে তিনি খুব কড়া। খেলা দেখতে যাব বললে, ছুটি মিলবে না। তাই ডাহা মিথ্যে বলে ডার্বি দেখতে গিয়ে মহা বিপদে পড়েছিলেন প্রবাদপ্রতিম দুই শিল্পী— মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় আর শ্যামল মিত্র। তাঁদের বাড়ি গিয়ে আসল খবরটা ধরে ফেলেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ।

মাঠে নিয়মিত দেখা যেত তরুণকুমারকেও। বাগানের এক প্রবীণ সদস্যের কাছে শুনেছি, অমিতাভ বচ্চন না কি একবার মোহনবাগানের খেলা দেখতে আসতে চেয়েছিলেন বাগানের মাঠে। কলকাতায় শুটিং করার ফাঁকে।

মাঠের শৃঙ্খলা নষ্ট হবে বলে সচিব ধীরেন দে অনুমতি দেননি। তাই বিগ-বি-র সে-ইচ্ছে অধরাই থেকে যায়।

বিপণন এবং আধুনিকতার ঠেলায়, টোটাল প্যাকেজের যুগে ময়দানের তিন ঘেরা মাঠেই এখন পরিবর্তনের দমকা হাওয়া। সেখানে ইতিহাস কখনও ফিসফিস কথা কয়। কখনও বা চোরা অভিমানে অন্ধকারে মুখ লুকোয়!

১৯১১-র ২৯ জুলাই যে বেঞ্চিতে বসে শিবদাস-বিজয়দাসরা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক আইএফএ শিল্ড জিতেছিলেন, সে-আসন এখন সংরক্ষিত। বাগানের লনে ডান দিকে শোভা পায় সেই ঐতিহাসিক স্বাক্ষর!

এমন আরও কত কিছু খুঁজলে পাওয়া যায় এখনও। যেমন পাওয়া যায় এক কালের বহু-আলোচিত সেই ফ্ল্যাগ পোস্ট। ম্যাচ শেষ হওয়ার দশ মিনিট আগে যেখানে লটকে থাকা ক্লাব পতাকাকে নিয়ম করে নামিয়ে নেওয়াটা এক সময় ছিল গেরস্থ বাড়ির ‘সন্ধে দেখানো’ পুজোর মতো। শাঁখের আওয়াজটুকুই যা ছিল না।

আজ সেই স্মৃতির পোস্টে পতাকা ওঠে না, নামেও না। ঘুঘু এসে ডানা ঝাপটায়, কাকে ঠোকরায়। বিকেলে বা সন্ধ্যায় আজকাল ময়দানে পা রাখলে যে কোনও পুরনো ফুটবল-দরদির মনটা হু হু করবেই। লেসলি ক্লডিয়াস আর গোষ্ঠ পালের নামাঙ্কিত সরণির উপর শুধুই চাপ চাপ অন্ধকার। রেড রোডের পাশের এক প্রধানের গেটে রক্ষী দরজা এঁটে ঝিমোয়। ইডেনের দিকে মুখ করে হাঁটতে হাঁটতে পিছনে তাকালে তিন ঘেরা মাঠকে মনে হয় কোনও এক হরপ্পা-মহেঞ্জোদরো। চাপা পড়া প্রাচীন সভ্যতা।

আচমকা ঝাপটা লাগে বুকে— ‘আধুনিকতা’ কি সত্যিই এতটা ভীষণ বস্তু, যা শেষ করে দিতে পারে যে কোনও ঐতিহ্য, আবেগ, পরম্পরাও!

ছবি: নিখিল ভট্টাচার্য, সুনীল দাস, তপন দাস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE