Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ফাউন্টেন পেন

দাও ফিরে সে অরণ্য! দাও ফিরে সেই ফাউন্টেন পেন। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য রসলেখক হিমানীশ গোস্বামী তাঁর শেষজীবনে এক ‘আজব অভিধান’ রচনায় ব্যস্ত ছিলেন। অভিধানের এক সেরা এন্ট্রি ছিল ইংরেজি ‘সোলার কুকার’-এর বাংলা। করেছিলেন ‘রবি ঠাকুর’। ইংরেজি ‘ফাউন্টেন পেন’-এর বাংলা ঝরনা কলম তেমন আজগুবি কিছু নয়। বস্তুত একেবারেই ইংরেজি অনুকরণে গড়া।

শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

রসলেখক হিমানীশ গোস্বামী তাঁর শেষজীবনে এক ‘আজব অভিধান’ রচনায় ব্যস্ত ছিলেন।

অভিধানের এক সেরা এন্ট্রি ছিল ইংরেজি ‘সোলার কুকার’-এর বাংলা। করেছিলেন ‘রবি ঠাকুর’।

ইংরেজি ‘ফাউন্টেন পেন’-এর বাংলা ঝরনা কলম তেমন আজগুবি কিছু নয়। বস্তুত একেবারেই ইংরেজি অনুকরণে গড়া।

তবে ঠিক কবে থেকে প্রতিশব্দটা ব্যবহারে এল বলা মুশকিল। ফাউন্টেন পেন কথাটার অবশ্য একটা প্রথম ঐতিহাসিক প্রয়োগ পাওয়া গেছে।

মার্কিন ঐতিহাসিক হেস্টর ডর্সি রিচার্ডসন (১৮৬২-১৯৩৩) ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় চার্লসের শাসনকালের (১৬৪৯-১৬৮৫) একটি তথ্যপুটে উল্লেখ পাচ্ছেন ‘১৫ শিলিং দামের তিনটি ফাউন্টেন পেন’-এর।

অষ্টাদশ শতকের গোড়ার থেকেই ফাউন্টেন পেন কথাটা ভাল রকম চালু হয়ে গেছে।

দ্বিতীয় চার্লসের শাসনকালে ফাউন্টেন পেন শব্দটার প্রথম উল্লেখ তথ্যে এলেও বিশ্রুত ডায়েরিলেখক স্যামুয়েল পেপিজ কিন্তু ১৬৬৩-তেও লেখার যন্ত্রটির উল্লেখ করছেন ‘মসি বহন করার’ ধাতব কলম বলে।

অর্থাৎ ব্যবহারে আসার পরও বহু দিন অবধি ঝরনা কলমকে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছিল ফাউন্টেন পেন নামে চলার জন্য।

তো সেটা কত দিনের অপেক্ষা?

বলা যেতে পারে, বেশ লম্বা ঐতিহাসিক দিন গোনা।

সে ইতিহাসে যাব (পড়ুন বক্স-এ), তার আগে আমাদের বড় বড় কয়েকজন লিখিয়ের লেখনী-সংসর্গে একটু ঝাঁকি মারলেই বা মন্দ কী?

বুদ্ধদেবের বোতল-কালি

টাকাপয়সার টান মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কোনও দিনই কলমের বিলাস করতে দেয়নি। এক বার উপহার পেয়েছিলেন কিছুটা শৌখিন সোয়ান কলম। তা দিয়ে অঢেল লিখেছেন। লিখতে লিখতে এক সময় কলমের নিব জিপ সব বেরিয়ে এলে, সুতো দিয়ে সে নিব-জিপ এঁটেই চালিয়ে দিতেন।

তারাশঙ্করবাবুর আবার অদ্ভুত ধারা কলম নিয়ে। একটি কলম দিয়ে শুধু একটিই উপন্যাস লিখতেন। তারপর সেটি আর ব্যবহার করতেন না। সযত্নে তুলে রাখতেন।

পছন্দ ছিল বেশ মোটা নিবের শক্ত, দামি কলম। খুব চেপে লিখতেন বলে নিব ভোঁতা হয়ে যেত। আঙুলে কড়া পড়ত।

প্রতিদিন ভোরে স্নান সেরে লেখার আসনে বসে সাদা কাগজে নীল সুলেখা কালিতে প্রথমে ইষ্টদেবী মা কালীর নাম এক হাজার বার লিখতেন।

সে-লেখা এত ক্ষুদ্র হরফে যে আতস কাচ ছাড়া পড়া অসম্ভব। প্রিয় কলম বলতে ছিল শেফার্স। তবে ‘গণদেবতা’ লিখেছিলেন পার্কার-এ।

কলম নিয়ে যাকে বলে একেবারে ‘অবসেস্‌ড’ ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। অবশ্যই ফাউন্টেন পেন।

একবার আমেরিকা থেকে চিঠি লিখে মেয়েকে ধমকে ছিলেন, ‘‘তোর সাহস হয় কী করে আমায় ডট পেনে চিঠি লেখার!’’

ওঁর প্রিয় ঝরনা কলম শেফার্স। যদিও পার্কার, ওয়াটারম্যান, মঁব্লঁ-ও ছিল সংগ্রহে।

কলমের মতো কালি নিয়েও বাতিক ছিল। সাদা কাগজে কালো কালির ইম্প্রেশন চাই-ই তাঁর।

শিবনারায়ণ রায় একবার অস্ট্রেলিয়া থেকে স্কচের সাইজের দু’বোতল কালো কালি এনে দিয়েছিলেন তাঁকে। যে জন্য অবশ্য এয়ারপোর্টে সিকিউরিটি চেকআপে খুব ঝামেলা পোহাতে হয় ওঁকে। বারবার বোঝাতে হয়েছিল, এ সুরা নয়, কলমের কালি মাত্র।

ওই বোতল-কালি নিয়ে খুব কৃপণ ছিলেন বুদ্ধদেব, পাছে ফুরিয়ে যায়।

বুদ্ধদেব-জায়া প্রতিভা বসুর আবার কোনও মাথাব্যথাই ছিল না কলম নিয়ে। হাতের কাছে যা পেতেন, তাই সই। আবার কী!

আশাপূর্ণাও অনেকটা তাই। বিশেষ কোনও কলমের মোহ ছিল না। বিছানায় উপুড় হয়ে প্যাডে লিখতেন কুইঙ্ক কালিতে।

রাত কত হইল, উত্তর মেলে না

তা কলমের এত সব গল্পকথা নতুন করে মনে পড়ার কী কারণ হল?

কারণ একটাই।

চারপাশ দেখেশুনে তো মনে হচ্ছেই, ঝরনার জলের মতো ঝরনা কলমও বুঝি ঝরে পড়তে চলেছে আমাদের জীবন থেকে।

কিছু দিন আগে চিঠি লেখার ইতি গোছের একটা লেখার সময় বারবার চোখ যাচ্ছিল হাতের কলমটার দিকে।

বিষয় চিঠি বলেই ঘটা করে বার করেছিলাম প্রায় স্বেচ্ছা অবসরে চলে যাওয়া শেফার্স ফাউন্টেন পেনটা। আর খেয়াল করলাম কলমটা আমার মন জানে। তাতে আরেকটা ভাবনাও উঁকি দিচ্ছিল: আমি ওকে দিয়ে লিখি? না ও আমাকে দিয়ে লেখায়?

লেখা শেষ হতে করুণ ভাবনাটা এল। আর কত দিন, প্রিয় শেফার্স? কথটা প্রায় ঋত্বিকের ‘সুবর্ণরেখা’র বিজন ভট্টাচার্যের সেই মর্মান্তিক সংলাপের মতো শোনাল—‘‘রাত কত হইল? উত্তর মেলে না।’’

ঝরনা কলমের রাত কত হয়েছে সত্যিই জানি না!

লেখাপড়ার সঙ্গে যুক্ত কাউকেই তো আজ ফাউন্টেন পেন নিয়ে ঘুরতে দেখি না। কিছু লেখার ব্যাপার হলেই দেখি আইফোন, আইপ্যাড কী সব বার করে। রোলেক্স, ওমেগা-পরা লোক যেমন নেই-কথায় আস্তিন তুলে সময় দেখে আর ঘড়ি দেখায়, তেমন দামি মোবাইলওলারাও সামনে লোক পেলে গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ পাঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে কিন্তু পার্কার ফিফটি-ওয়ান, শেফার্স, ক্রস বা ওয়াটারম্যানের মালিককে এত কিছু করতেই হত না।

শার্ট, কোর্ট বা পাঞ্জাবির পকেটে থেকেই মহার্ঘ কলমরা সাপের মাথার মণির মতো জ্বল জ্বল করত।

সে-পেন ধার করে লিখতে চাওয়ার মতো সাহস হত না কারও, কারণ অ্যালসেশিয়ান বা বুলডগের মতো সেই কলমরা হত একপ্রভু অনুগত।

মালিকের লেখার চলনের সঙ্গে সে একাত্ম, অন্য কারও আঙুলের চাপে তার রেখাপাত অসাড় হত।

সংস্কৃতে তো সতর্কবাণী আছে— বই, কলম আর বউ কখনও ধার দিয়ো না। তারা ফেরত আসে না। আর এলেও আসে নষ্ট, ভ্রষ্ট, তছনছ হয়ে।

ফাউন্টেন পেনের আয়ু কত, এই দুশ্চিন্তা খুব কম দিনের নয়। সত্তর দশকের প্রথম দিক থেকেই ডট পেনের বাড়বাড়ন্ত দেখতে শুরু করেছি আমরা। যারা ইস্কুল কলেজ, ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় ঝরনা কলমের সঙ্গে সঙ্গে কালির শিশি নিয়েও হলে হাজির হতাম।

ডট পেনে পরীক্ষা দেওয়া ছিল নিষিদ্ধ, কারণ তখনকার ডট পেনে লিখলে পাতার উল্টো পিঠে গোদা গোদা ছাপ ফুটে উঠত।

পরীক্ষার খাতা আর ব্যাঙ্কের চেকবইয়ে বল পয়েন্ট পেন কবে থেকে গ্রাহ্য হল সেটা সাল-তারিখ দিয়ে বলতে পারছি না।

তবে সে দিন থেকে জগৎটাই যে ভালরকম বদলে বা উল্টে গেছে, তা না মেনে উপায় নেই।

ডেস্কটপে সমাচ্ছন্ন পেপারলেস বা পৃষ্ঠাহীন অফিসকাছারির নীলনকশা যে বল পয়েন্ট পেনের টিপে আঁকা হচ্ছে তা আমরা কতটা সে সময় আঁচ করতে পেরেছিলাম, বলতে পারব না।

কারণ তখনও আমরা ঘোর বিশ্বাসী যে, ঝরনা কলম ছাড়া প্রেমপত্র লেখা যায় না। আর বুক পকেটে একটা ফাউন্টেন পেন গোঁজা না থাকলে সমাজে শিক্ষিত বলে পাস হওয়া অসম্ভব।

খোকা, এ কলম থেকে তোমার আর রেহাই নেই

পঞ্চাশের দশকে শিক্ষিত মহলে স্টাইলে উঠেছিল গাবদা ডরিক পেন।

গাবদা বলে বেশি-বেশি কালি ধরত এবং গ্রাম্ভারি চেহারার জন্য তাতে বেশ একটা আশুবাবু-আশুবাবু ভাব ছিল।

আশুবাবু ভাব মানে স্যার আশুতোষের চেহারার মধ্যে যেমন শ্রদ্ধা, সমীহ জাগানো একটা ব্যাপার ছিল, সেই সঙ্গে একটু ভয়ডর জাগানোরও, সেই রকম কিছু হয়তো।

আমার ক্লাসের বন্ধুর পকেটে চকচকে ডরিক দেখে অঙ্কের মাস্টার হালদার স্যার একবার বলেছিলেন, ‘‘একটা সিঁড়িভাঙা অঙ্ক নামাতে পারিস না, আর পকেটে ডরিক নিয়ে ঘুরিস। কী সব দিনকাল!’’

আশুবাবুর তুলনায় গেলাম বটে, তবে লেখার টেবিলে ডরিক হাতে যাঁর ছবিটা মনে গেঁথে আছে, সেটা রবীন্দ্রনাথের। ছবিতে তো কলমের ক্লিপের লেখাটা পড়া যাচ্ছে না, তবে বাল্য-কৈশোরে এত ডরিক দেখেছি যে ছবিটাকে অন্য কিছু ভাবতেও পারছি না।

এক জনপ্রিয় সাহিত্যিক হালে লিখেছেন যে কবির প্রিয় লেখনীর ব্র্যান্ড নাকি ছিল মঁব্লঁ। হতে পারে।

মর্যাদায় মঁব্লঁ-র একটা অভ্রংলিহ কেতা ছিল। কলমটার নাম শোনা অবধিই ঠিক ছিল সাধারণ বাঙালির, যাদের জীবন জুড়ে ছিল একটাই কলম, জাপানি পাইলট।

চার টাকা দামের কলমটা ছিল অনেকটা সেকালের ল্যান্ডমাস্টার, অ্যাম্বাসাডর গাড়ির মতো। গাড়ি দুটো যেমন ছিল তেল ভরো-আর-চালাও টাইপ, কলমটাও ছিল কালি-ভরো-আর-লিখে যাও মার্কা।

নাইন-টেনের ছেলেরা ক্লাসের পরীক্ষা দিয়ে এসে পাড়ার রকে হেক্কারি করত।— ‘‘আজ দেড় কলম নামিয়েছি।’’

তাতে যে পরীক্ষা পাসের গ্যারান্টি ছিল, তা নয়।

পাইলট পেনের সব চেয়ে আলোচ্য দিক ছিল তার নিব। কোনও ক্রমে তাকে মুচড়োয় বা ভাঙে কার সাধ্যি!

আমার প্রথম পাইলট কেনার অভিজ্ঞতা অদ্ভুত। পূরবী সিনেমার অদূরে এক দোকানে আমায় পাইলট কেনাতে নিয়ে গেলেন প্রাইভেট টিউটর। দোকানদার কলমের নাম শোনার আগেই এক বাক্স পাইলট বার করে ক্যাপ খুলে খুলে খান কয়েক পেন ছুড়তে লাগলেন কাউন্টারের এক ধারে রাখা কাঠের ব্লকে।

দেখেশুনে আমার প্রাণ তো শুকিয়ে ফুস্। এই পেন দিয়ে খুনোখুনি হবে, না লেখালেখি?

ও মা, ওই কলমেরই একটা কেনার পর কালি ভরে যেই ধরিয়ে দেওয়া হল হাতে, সে কী অনুভূতি! তর তর করে কত কী’ই যে লেখা হয়ে যাচ্ছে আপন গতিতে।

এত কাল উডপেন্সিলে লিখে এসে হঠাৎ করে ঝরনা বাগিয়ে যেন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেলাম। থুড়ি। গ্র্যাজুয়েট হয়ে গেলাম।

দোকানদার কলম প্যাক করে দিতে দিতে বলেছিলেন মনে আছে, ‘‘খোকা, এ কলম থেকে তোমার আর রেহাই নেই। জীবনভর এই দিয়েই লিখতে হবে। এর নাম পাইলট।’’

কথাটা খুব মিথ্যে নয়।

ঝরনা কলমের স্বর্ণযুগে বাপ-ঠাকুর্দার ব্যবহৃত কলমে নাতিপুতিকেও লিখতে দেখা যেত।

নেশার ঘোরে কলমের নাম

আমার বড়দির সঙ্গে লোরেটোর এক ধনী মুসলিম পরিবারের মেয়ে পড়ত, নাম মেহরুন। সে রোজ স্কুলে ওর ঠাকুর্দার ব্যবহার করা ওয়াটারম্যান নিয়ে আসত, যা কেনা হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালে।

সেই কলম একবার চেয়ে নিয়ে একটা সই করে স্কুলের আইরিশ প্রিন্সিপাল মাদার কেভিন বলেছিলেন, ‘‘এত ভাল কলমে আমি কখনও লিখিনি।’’

দামি কলম থেকেই যে দামি লেখা বেরোয় তাও নয়। দামি কাগজের ওপর নজর ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। কিন্তু দামি কলমের বাতিক দেখিনি।

‘দেশ’ পত্রিকায় যোগ দেবার পর পত্রিকার দামি লেটারহেডে পাতার পর পাতা গল্প-উপন্যাস লিখতেন, কিন্তু কলম বলতে সেই থ্রো-অ্যাওয়ে ডটপেন। আর আনন্দবাজারে থাকতে তো সেই নিউজপ্রিন্ট আর ডটপেন। আর কী না কী লেখা বেরিয়েছে তাতে!

অথচ এই সুনীলদার স্মৃতির অতলে কোথাও না কোথাও তলিয়ে ছিল কলম। যৌবন কালে একবার মদের আসরের ঝামেলায় ওঁর হাতের সায়মা ঘড়িটা খোয়া যায়।

থানায় সেটা রিপোর্ট করতে গেলে জিজ্ঞেস করা হল ঘড়ির ব্র্যান্ড কী! তাতে তখনও নেশায় চুর সুনীল কেবলই বলে চললেন, শেফার্স পাইলট পার্কার... আরও কত কী!

যেখানে কথা হচ্ছিল, সেখানে সন্তোষকুমার ঘোষও ছিলেন। হেসে বলেছিলেন, ‘‘এই না হলে বড় লেখক! অবচেতনেও কলম খোঁজে!’’

আর তেমনই একজন ছিলেন বিজনেস স্ট্যাডার্ড পত্রিকার (তখনও আনন্দবাজার গ্রুপের কাগজ) দুর্দান্ত প্রুফ রিডার, ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবিতে প্রসন্নমূর্তি গোপীজীবন বন্দ্যোপাধ্যায়। জীবনে একটাই সাধ ছিল তাঁর— ক্রস ফাউন্টেন পেন।

বিদেশ যাচ্ছি শুনে একটা ক্রস এনে দেবার আবদার করেছিলেন। ক্রসের জায়গায় এনেছিলাম প্রায় সমান কেতার একটা ফাবার কাস্টেল।

তাতে কী সুন্দর বলেছিলেন গোপীবাবু, ‘‘না ওটা আপনিই ব্যবহার করুন। বরং বাইরে থেকে আনা কোনও ভাল বই দিন আমাকে।’’

যখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কেন?’’ বললেন, ‘‘আমি ক্রাইস্টের মতো সারা জীবন ক্রস বহন করে আসছি। অপিসের কাজে যেটুকু যা বলপেন ধরি, বাকি সময় ক্রুশবিদ্ধ।’’

আবারও প্রশ্ন করতে চাইছি নিজেকে: তা হলে আইপ্যাড, ল্যাপটপের জমানা মানে ঝরনা কলমের প্রজন্মের শেষ?

তা হলে আরও কতগুলো শেষের প্রশ্ন উঠে আসে। আড়াই শ’বছর আগে উপন্যাসের উত্থানে প্রশ্ন জেগেছিল, তা হলে কবিতার দিন কি শেষ?

পৌনে দু’শ বছর আগে ফটোগ্রাফি আবিষ্কারের পর আশঙ্কা জাগল, তা হলে কি চিত্রাঙ্কনের দিন ফুরোলো?

বছর কুড়ি-পঁচিশ আগে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা চাঞ্চল্যকর বই লিখলেন ‘এন্ড অব হিস্ট্রি’। অর্থাৎ ইতিহাসের ইতি।

আর বছর পঁচিশ-তিরিশ ধরে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তাঁর থিওরি অফ এভরিথিংগ-এর সন্ধানে আছেন, যে-মীমাংসায় পৌঁছলে বিজ্ঞানের আর এগোনোর জায়গা থাকবে না।

কলমের ছোঁয়ায় বিন্দু, রেখাপ্রবাহ নির্মাণ করার জায়গায় আঙুলে টিপে টিপে শব্দ উৎপন্ন করা যদি প্রগতি হয়, তা’হলে বেচারি ঝরনা কলমবিলাসীদের আর কী গতি?

সত্যজিৎ রবিশঙ্কর সমরেশ

শেক্সপিয়র ফাউন্টেন পেন পাননি, কিন্তু তাঁর আর কী এসে গেছে? পালকের কলম দোয়াতে চুবিয়ে চুবিয়েই লিখেছেন, আর তাতেও সমসাময়িকদের মধ্যে খ্যাতি ছড়িয়েছিল অতি দ্রুততায় পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যাওয়ার।

তাঁর প্রথম ফোলিও এডিশন প্রকাশ করার সময় বন্ধুদ্বয় জন হেমিংস ও হেনরি কন্ডেল ভূমিকায় লিখেছেন: ‘‘ওঁর মন ও হাত সমান তালে চলত, আর যা ভাবনায় আসত তা এত অবলীলায় প্রকাশ পেত যে ওঁর পৃষ্ঠায় সামন্যই কাটাছেঁড়া পাওয়া যায়।’’

ঝরনা কলম পেলে শেক্সপিয়র যে কী খেলা দেখাতেন, তা ভেবে কাজ নেই। তবে ফাউন্টেন পেন পেয়েও গত শতাব্দীর ইংরেজ মহাকবি এবং শেক্সপিয়রের এক জবরদস্ত সমালোচক ও উপাসক টিএস ইলিয়ট কিন্তু দিব্যি কবিতা লিখে গেছেন টাইপরাইটার মেশিনে!

যা প্রথম জেনে একেবারে হতচকিত হয়ে গেছিলাম। লাইন-স্পেস লিভার সরিয়ে সরিয়ে রেমিংটন টাইপরাইটারে কী করে, ওঁর সব আশ্চর্য পঙ‌্ক্তি পাতায় ফুটেছে তা ভেবে আজও আশ্চর্য হই।

তা হলে ‘সাগিনা মাহাতো’-য় দিলীপকুমারের সেই সংলাপ আউড়াতে হয়, ‘‘এই তো জীবন, কালীদা।’’

আজ দেশ-দুনিয়াময় কম্পিউটারেই তো কবিতা ফোটানো হচ্ছে। কম্পিউটার ছাড়া তো তেরো আনা লেখক-কবিই এখন অচল। ঝরনা কলমের জন্য হা-পিত্যেশ করার লোক কই?

বরং কালি-কলমে লেখা মানুষজনকে যখন-তখন খোঁটার মুখে পড়তে হয়, ‘‘সে কী? এখনও কলম চালিয়ে যাচ্ছেন? সাত দিন তো লাগে কম্পোজ শিখতে!’’

আসলে সাত-দশ দিনের ব্যাপার নয়। ব্যাপারটা দুটো মস্ত যুগের।

যেমন বাঙালির ধুতি-শার্টের যুগ আর প্যান্ট-শার্টের যুগ।

যেমন বাঙালির কলমে প্রেমপত্র লেখার যুগ আর মোবাইলে তিন সেন্টেন্সে প্রপোজ করার যুগ।

যেমন চৌরঙ্গির পেন হসপিটালে কলমের সাম্রাজ্যে বাঁশ বনে ডোম কানা দশার যুগ আর কম্পিউটারে অ্যামাজন ডট কম বাজিয়ে আইফোনের সম্ভারে দিওয়ানা হওয়ার যুগ।

সত্যজিৎ রায় যেমন এক দিন বললেন, ‘‘আমি এখনও রেকর্ডের যুগ পেরোইনি। গানবাজনা শুনতে ওই রেকর্ডই ভরসা আমার।’’

বলতে নেই, একবার কানে হেডফোন চাপিয়ে জোর ভল্যুমে ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল শুনতে গিয়ে ওঁর কানের ইক্যুইলিব্রিয়ামের সমস্যা হয়ে গেল।

এই সত্যজিৎবাবু জীবনের শেষ দিন অবধি দামি কাগজে রকমারি সেরা ফাউন্টেন পেনে লিখে গেলেন, ইংরেজি লেখার জন্য টাইপরাইটার সামিল করলেও বাংলায় একটি শব্দ লিখতে হলেও হাতে উঠে আসত ঝরনা কলম।

ঝরনা কলমেরই বিখ্যাত কালি ‘কুইঙ্ক’-এর বিজ্ঞাপনের জন্য উনি দু’জন লেখকের প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন ওঁর বিজ্ঞাপনী চাকরির জীবনে।

লেখকদের একজন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্যজন রাজশেখর বসু। এমনই বিধিলিপি যে চলচ্চিত্রকার জীবনে এই দু’জনেরই কাহিনি নিয়ে ছবি করলেন সত্যজিৎ।

রাগরাগিণীর ব্যাপারে বিশুদ্ধবাদী রবিশঙ্করেরও দেখেছি ঘড়ি ও কলমের ব্যাপারে উন্নত সাবেকিয়ানা।

ঘড়ি ওঁকে বরাবর একটাই পরতে দেখেছি— পাতেক ফিলিপ।

কলম কখনও কারঁ দাশ, কখনও পার্কার ফিফটি ওয়ান অথবা পার্কার ডুয়োফোল্ড।

লেখালেখির সময় ভুলেও কখনও অন্য কলম বাড়ালে উনি মিষ্টি হেসে বুকপকেটে থেকে নিজের কলমই বার করে নিতেন।

ওঁর প্রিয়তম সুগন্ধি কৃশ্চন দিওর-এর ‘ও সোভাজ’ এবং ‘আর্ডেন স্যান্ডালউড ফর মেন’ (এই সুগন্ধি আর্ডেন সংস্থা বানানো বন্ধ করতে উনি কাঁদতে বাকি রেখেছিলেন) ছাড়া ওই কলমগুলো আর ঘড়ি ওঁর নিত্যকার সঙ্গী ছিল। ফলাও করে লেখা ওঁর ওই ‘রবিশঙ্কর’ সইটা ঝরনা কলম ছাড়া আর কী করে পাতার উপর ঝরে পড়বে?

আর দেখেছি সমরেশ বসুকে।

ফুলস্ক্যাপ কাগজে অতি সূক্ষ্ম হরফে এবং অতি চমৎকার হস্তাক্ষরে পাতার পর পাতা লিখে যাচ্ছেন। সে সময় ‘শাম্ব’ লিখছিলেন। দেখলাম, প্রতি পৃষ্ঠায় প্রায় চল্লিশ লাইন করে লিখে যাচ্ছেন, যাতে শব্দ সংখ্যা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ৬০০-৬৫০। অথচ মুক্তোর মতো ভাসছে লেখাগুলো।

কোনও এক বন্ধু তাঁকে উপহার দিয়েছিল একটি শেফার্স কলম। সেই কলমটির প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ মুগ্ধতা।

বহুদিন ওই কলমেই লিখেছেন সমরেশ। তবে পাশাপাশি পার্কারও ছিল পছন্দের।

শুধু যে ঝরনা কলমে লিখেছেন তাই নয়, বল পেনেও লিখেছেন বহু লেখা।

রবিঠাকুর ও স্টিল নিব

রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’র ফ্যাক্সিমিলি এডিশন পড়ার বড় আকর্ষণ কবির কলমকারি।

সাপুড়ের বাঁশির মতো এক ঘোর লাগানো টান ওই ক্যালিগ্রাফির। সরল অথচ রাজকীয়।

পুরুষালি হস্তাক্ষরের মধ্যে কোথায় যেন একটা নারীর ছোঁয়া। রেখার প্রবাহের সঙ্গে যেন ঝরনার জলের ঝরে পড়া।

রবীন্দ্রনাথ প্রথম কবে ঝরনা কলম হাতে নিয়েছিলেন জানি না, তবে ওঁর হস্তলিপির মধ্যে একটা ঝরনার গুঞ্জন আছে।

রবীন্দ্রনাথ ও ঝরনা কলমের প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে আসে। তা হল কবির জন্মের মাত্র ক’বছর আগে ইংলন্ডের বার্মিংহামে স্টিলের নিবের ব্যাপক শিল্প গড়ে ওঠে।

পৃথিবীর অর্ধেক স্টিল নিবই তখন তৈরি হচ্ছে সেখানে, ফলত ফাউন্টেন পেন সহসা সাধারণ মানুষের কেনার মধ্যে চলে এল। তার আগে ইরিডিয়াম টিপ-এর সোনার নিব কলম কেনাটা সবার সামর্থ্যে আসত না। স্টিলের নিব আসাতে ঝরনা কলমের ঝরা শুরু হল দেশে দেশে। নগরে নগরে, পল্লিতে পল্পিতে।

ইতিহাস বলছে কলমের এই বহুল প্রসারে দেশে দেশে শিক্ষারও বংশবৃদ্ধি ঘটে গেল। এই যুগসন্ধিক্ষণেই বড় হচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

বাঙালি সরস্বতী পুজোয় দেবীর পদতলে রাখবেই বই ও কলম। শিশুর অন্নপ্রাশনে অবধারিত ছিল কলম। কিশোরের পৈতেতে অবশ্য উপহার ছিল ঝরনা কলম।

আর ভদ্র, বিবেকী যুবা বিয়েতে পাওয়া দুটি জিনিসেরই কদর করত। একটা রিস্ট ওয়াচ ও একটা ফাউন্টেন পেন।

ব্র্যাডম্যান, বিয়র্ন বর্গ, কেনেডি

এত ভয়ভীতি আশঙ্কার পর কিছু রুপোলি রেখার গল্পও শোনাই।

ধরা যাক, একটা আধুনিক প্রেমের গান। ‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি’। প্যাডে টাইপ করে দেখুন— স্বাদে আসছে না।

এ বার ঝরনা কলমে ঝরান।

কী, একটা আবেশ আসছে?

কিংবা টাইপ করুন, ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’!

ফের সেই সমস্যা তো?

এ বার পাড়ার কাগজ-কলমের দোকানে ফাউন্টেন পেনের খোঁজ নিন।

দুটো উত্তর পাবেন।

এক, ‘‘কলমে আর কে লেখে?’’ আর দুই, ‘‘ও সব তো বড়লোকদের ব্যাপার।’’

দুটো উত্তরই সত্যি, দ্বিতীয়টা একটু বেশি সত্যি।

যদি ফ্যাশনে আসতে চান তো স্লিং ব্যাগে লেটেস্ট আইপ্যাড নিয়ে ঘুরুন।

যদি স্টাইল সেট করবেন তো মঁব্লঁ নিন।

কারও বিয়েতে একটা আইফোন দেবার কথা ভাবতে পারেন? পারেন না তো?

কারণ যাদের আইফোন দেওয়া যায়, তাদের সবারই আইফোন আছে। ভেবে নিন, তা হলে একটা শেফার্স, ডুপঁ, ফাবার কাস্টেল, মন্তেভের্দে, স্টিপিউলা বা রটরিং।

খুব অবাক এবং খুশি হবে প্রাপক বা প্রাপিকা।

যাদের ধারণা বড় বড় চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্যই দামি ফাউন্টেন পেনের ব্যবহার, তারা খেয়াল রাখেন না যে, একেকটা কলম একেকটা মানুষের সৌরভ বিস্তার করে। তাদের শরীরে অঙ্গ হয়।

যেমন বলা হয় ক্রিকেট ব্যাট ছিল ব্র্যাডম্যানের হাতের সম্প্রসারণ, টেনিস র‌্যাকেট বিয়র্ন বর্গের। তেমনি আরেকটি মানুষের সঙ্গে ঝরনা কলম জুড়ে আছে। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ও মঁব্লঁ।

কেনেডির মৃত্যু নভেম্বরে। আর প্রতি নভেম্বরের প্রথম শুক্রবারে পালিত হয় বিশ্ব ঝরনা কলম দিবস।

সহায়তা: সিদ্ধার্থ সিংহ, স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনোদ ঘোষাল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Fountain pen special story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE