Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

আসরে বাংলা গানেই বাঙালির মান রেখেছিলেন

নিজের গান রেকর্ড করতে আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর কণ্ঠস্বরের সামান্যই ধরা আছে সে কালের অনুন্নত রেকর্ডিংয়ে। তবু তা শুনলে বোঝা যায় অঘোরনাথ চক্রবর্তীর কণ্ঠ-মাহাত্ম্য। লিখছেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্যনিজের গান রেকর্ড করতে আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর কণ্ঠস্বরের সামান্যই ধরা আছে সে কালের অনুন্নত রেকর্ডিংয়ে। তবু তা শুনলে বোঝা যায় অঘোরনাথ চক্রবর্তীর কণ্ঠ-মাহাত্ম্য। লিখছেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

বসন্তের এক সকালে সোনারপুর স্টেশনে পৌঁছে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক পকেটঘড়িটা বের করে দেখলেন, ট্রেন আসতে তখনও বেশ কিছুটা সময় বাকি। প্ল্যাটফর্মে দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষারত কয়েক জন যাত্রী। একটা ফাঁকা বেঞ্চ দেখে তাতে আরাম করে বসলেন তিনি। বসন্তের স্নিগ্ধ সতেজ হাওয়ায় চোখ বন্ধ করে আপন মনে গুনগুনিয়ে ভৈরবীতে গান ধরলেন, ‘বিফল জনম বিফল জীবন, জীবনের জীবনে না হেরে...’

এমনটা কিছু ক্ষণ চলার পরে দূর থেকে ট্রেনের আওয়াজ শোনা গেল। যথাসময়ে প্ল্যাটফর্মে ট্রেন এসে দাঁড়াল। তবু গানে মগ্ন সেই গায়কের কানে তার আওয়াজ পৌঁছল না। আশ্চর্য এক সুরে মগ্ন হয়ে তিনি গেয়েই চলেছেন। ইতিমধ্যেই স্টেশনের কিছু যাত্রী শিল্পীর কাছে এসে ভিড় করেছিলেন। ট্রেনের জানালা দিয়ে কিছু যাত্রী মুখ বাড়িয়ে সেই সুরের মাদকতায় ডুব দিয়েছেন। ট্রেনের গার্ড, ড্রাইভার এবং কয়েক জন যাত্রী সেই সুরের আকর্ষণে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়েছিলেন।

প্ল্যাটফর্মে এত মানুষের উপস্থিতিতে হঠাৎই ঘোর ভাঙল সেই শিল্পীর। আশপাশে এত ভিড় দেখে কিছুটা বিস্মিত, কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে তিনি গান থামিয়ে দ্রুত ওঠার উপক্রম করতেই শ্রোতারা বাধা দিয়ে বললেন, ‘‘আহা, বন্ধ করলেন কেন? গান চলুক না!’’ এর উত্তরে সেই ভদ্রলোক বললেন, ‘‘না না, ট্রেন এসে গিয়েছে যে! দেরি হয়ে যাবে পৌঁছতে।’’ এ বার ভিড়ের মধ্যে কয়েক জন বললেন, ‘‘এক দিন না হয় একটু দেরিই হবে। তবে এমন গান তো রোজ শোনা যাবে না।’ অগত্যা গান চলতে লাগল।

ইতিমধ্যে স্টেশন মাস্টারও সেখানে হাজির হয়েছেন গান শুনতে। যাঁকে ঘিরে এই কাণ্ড, দেরি হয়ে যাচ্ছে ভেবে তিনি মনে মনে বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলেন। তবে স্টেশন মাস্টার ও ট্রেনের চালক যখন তাঁকে আশ্বাস দিলেন— গানের জন্য যেটুকু দেরি হবে, ট্রেনের গতি বাড়িয়ে সেই সময়টুকু তাঁরা পূরণ করে নেবেন, তখন আশ্বস্ত হয়ে তিনি গান শেষ করেছিলেন।

অঘোরনাথের রেকর্ড

সে দিনের সেই আত্মভোলা শিল্পী অঘোরনাথ চক্রবর্তী। বাংলা ধ্রুপদী সঙ্গীতের এক কিংবদন্তি। তাঁর কণ্ঠস্বরের খুব সামান্য নমুনাই ধরা আছে সে কালের অনুন্নত রেকর্ডিং পদ্ধতিতে। তবু সেগুলি শুনলে বোঝা যায় তাঁর কণ্ঠমাধুর্য। আর হয়তো সেই কারণেই মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও তাঁর গানের খোঁজ করেন সঙ্গীত রসিকেরা।

১৮৫৪ সালে অঘোরবাবুর জন্ম দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার রাজপুরে। অল্প বয়স থেকেই কর্মসূত্রে তাঁকে কলকাতার বেলেঘাটায় যাতায়াত করতে হত। সেখানে নন্দীবাবুদের গোলায় তিনি চাল বেচাকেনার মধ্যস্থতার কাজ করতেন। আর সেই সঙ্গে চলত সঙ্গীতচর্চা।

অঘোরবাবু সঙ্গীতের তালিম পেয়েছিলেন উস্তাদ আলিবক্সের কাছে। ধ্রুপদ শিখেছিলেন উস্তাদ মুরাদ আলি এবং দৌলত খাঁর কাছে। এ ছাড়া প্রবাদপ্রতিম শ্রীজান বাঈয়ের কাছেও টপ্পা শিখেছিলেন। ভোলানাথ দাসের কাছে ভজন এবং গীতও শিখেছিলেন তিনি। অঘোরবাবু আসর মাতাতেন ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, ভজন গেয়ে। সে কালের বেশির ভাগ ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পীরা আলাপের উপরে জোর দিতেন। কিন্তু অঘোরবাবু ছিলেন এর ঠিক বিপরীত। তিনি কখনও আলাপের উপর জোর দিতেন না। বরং মনে করতেন আলাপ যেন সময় নষ্ট।

১৯০২ থেকে এ দেশে গ্রামোফোন কোম্পানি রেকর্ডের ব্যবসা শুরু করে। সে কালের বহু রাজা-মহারাজা তাঁদের সভার গায়ক-গায়িকাদের গান রেকর্ড করার ব্যাপারে খুবই উৎসাহী ছিলেন। সে জন্যই সে কালের বিখ্যাত কিছু শিল্পীর গান রেকর্ডে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু অঘোরবাবু গান রেকর্ড করতে একেবারেই আগ্রহী ছিলেন না। বরং তিনি মনে করতেন রেকর্ডে কণ্ঠস্বর ঠিক ভাবে ধরা না পড়ায় তা বিকৃত হয়ে যেত। এ কথা ঠিক, সে কালের বহু বিখ্যাত শিল্পীর গান রেকর্ড করা হলেও রেকর্ডিং যন্ত্রের স্পিড ঠিক না থাকায় কণ্ঠের সঠিক গুণমান ধরা পড়েনি।

পাথুরিয়াঘাটার মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর সে কালের অন্যতম সঙ্গীতরসিক। তাঁর সভাগায়কদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত সব শিল্পী। তাঁদের মধ্যে ছিলেন অঘোরবাবুও। যতীন্দ্রমোহন ভাল মতোই জানতেন অঘোরবাবুর গান রেকর্ড করার এই আপত্তির কথা। তবু তিনি চেয়েছিলেন অঘোরবাবুর কণ্ঠস্বর রেকর্ডে ধরে রাখতে এবং তাঁর গান বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে। এর জন্য তিনি এক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন।

যতীন্দ্রমোহন জানতেন যে, অঘোরবাবু কিছুতেই স্টুডিয়োয় গিয়ে গান রেকর্ড করতে রাজি হবেন না। তাই স্টুডিয়োয় নয়, তাঁরই প্রাসাদে গান রেকর্ড করার ব্যবস্থা করেছিলেন। তবে সে কালে ব্যাপারটা একেবারেই সহজ ছিল না! এক দিন পাথুরিয়াঘাটার প্রাসাদে তিনি গানের আসর বসিয়েছিলেন। অঘোরবাবুকে কিছু না জানিয়ে গ্রামোফোন কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে রের্কডিংয়ের যন্ত্রপাতি বাড়িতে আনিয়েছিলেন। গান রেকর্ড করতে উপস্থিত ছিলেন উইলিয়াম সিনক্লার ডারবি ও ম্যাক্স হাম্পে।

পর্দার আড়ালে রাখা ছিল রেকর্ডিংয়ের যন্ত্রপাতি। যতীন্দ্রমোহনের অনুরোধে একটি বিশেষ দিকে তাকিয়ে অঘোরবাবুকে গান গাইতে বলা হয়। আর তিনি গান শুরু করা মাত্রই অভিজ্ঞ সাহেব রেকর্ডিস্ট তাঁর গান রেকর্ড করতে শুরু করেন। এই ভাবে মাত্র পাঁচটি গান রেকর্ড করা সম্ভব হয়েছিল— সেগুলি হল, ‘আনন্দবন গিরিজা’ (ভজন), ‘বিফল জনম বিফল জীবন’ (ভৈরবী), ‘নজর দিলবাহার’ (টপ্পা), ‘গোবিন্দ মুখারবিন্দে’ (ভজন) এবং ‘লপ লপটানে’ (ধামার)। এ জন্যই রেকর্ডগুলির উপর শিল্পীর নামের পাশাপাশি লেখা থাকত ‘ফ্রম দ্য হাউসহোল্ড অব হিজ হাইনেস মহারাজা যতীন্দ্রমোহন টেগোর’। গানগুলির সঙ্গে কেবল মাত্র তানপুরা বাজিয়ে গাওয়া হয়েছিল। তাই শুনলে মনে হয়, খালি গলায় গাওয়া হয়েছে।

শোনা যায়, আসরে গান গাওয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন ভীষণ খুঁতখুঁতে। আসরে মন মতো পরিবেশ না পেলে তিনি গান না গেয়েও উঠে আসতেন। অথচ তিনি নিজের গানের প্রচারের ব্যাপারে ছিলেন ভীষণ উদাসীন। পছন্দ করতেন সহজ সরল জীবনযাত্রা। সে কালে বহু আসরে অঘোরবাবুর গানের সঙ্গে সারেঙ্গিতে সঙ্গত করতেন আরও এক প্রবাদপ্রতিম রমজান খান।

যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর

এক আসরে সে কালের অন্য এক প্রখ্যাত শিল্পী লালচাঁদ বড়াল তাঁর গানের সঙ্গে পাখোয়াজে সঙ্গত করতে চেয়েছিলেন। সে সময়ে অবশ্য লালচাঁদ সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তা বা প্রতিষ্ঠা পাননি। কিন্তু অঘোরবাবু তাতে সম্মত হননি। ‘‘আর এক দিন হবে,’’ এমনটা বলে বেশ কয়েক বার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এতে লালচাঁদ ভীষণ অপমানিত বোধ করায় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আর কখনও পাখোয়াজ ছোঁবেন না। পরে অবশ্য সঙ্গীতের তালিম সম্পূর্ণ করে তিনি সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে আর এক কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন।

ইতিহাসের পাতায় উল্লেখ মেলে কাশীতে অঘোরবাবুর একটি অনুষ্ঠানের কথা। সেই আসরে উপস্থিত ছিলেন সে যুগের প্রখ্যাত অবাঙালি সব সঙ্গীতশিল্পীরা। তাঁদের মধ্যে একমাত্র অঘোরবাবুই ছিলেন বাঙালি। আর ছিলেন কিছু বাঙালি শ্রোতা। হঠাৎই শোনা গেল অবাঙালি শিল্পীরা বাঙালিদের গান নিয়ে হাসিঠাট্টা করছেন। তাঁদের ধারণা, কালোয়াতি গান গাওয়া বাঙালিদের কাজ নয়! তাঁদের মধ্যেই কেউ কেউ বাঙালিদের খাদ্যাভ্যাসকে টেনে এনে বললেন, ‘‘বাঙালিদের শরীরে ধ্রুপদী সঙ্গীত গাওয়ার তাকত কোথায়? চিংড়ি মাছ খেয়ে কি গান হয়?’’ এ সব শুনে অঘোরবাবু কোনও প্রতিবাদ করলেন না। চুপচাপ শুনে গেলেন। তবে মনে মনে ঠিক করলেন, গান গেয়ে এর যোগ্য জবাব দেবেন। যথাসময়ে শুরু হল আসর। দু’-এক জন শিল্পীর গানের পরে অঘোরবাবুর গান শুরু হল। বেশির ভাগ অবাঙালি শ্রোতা আছেন জেনেও তিনি ধরলেন একটি বাংলা গান। ‘বিফল জনম, বিফল জীবন...’ সচরাচর তিনি আসরে ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল গাইতেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তিনি তা করলেন না। প্রাণপণ দরদ দিয়ে টপ্পার আঙ্গিকে গানটি গাইলেন। যদিও তিনি জানতেন, অবাঙালি শ্রোতারা গানের কথার অর্থ বুঝবেন না। তবুও তিনি এমনটাই করলেন। গান যখন শেষ হল, তখন কারও মুখে আর কোনও কথা নেই। সকলেই সেই সুরের মূর্ছনায় যেন আপ্লুত, মোহিত এবং তৃপ্ত। শোনা যায়, সেই আসরে সে দিন অঘোরবাবুর গানের পরে আর কেউ গান গাওয়ার সাহস করেননি। এই ছিলেন অঘোরবাবু, যিনি গানের মধ্য দিয়েই সেই আসরে নীরব প্রতিবাদ করে বাঙালির মান রেখেছিলেন।

জীবনের শেষ ১০ বছর তিনি কাশীতে কাটিয়েছিলেন। ১৯১৫ সালে তাঁর জীবনাবসান হয়। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে গোপালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অমরনাথ ভট্টাচার্য, নিকুঞ্জবিহারী দত্ত, পুলিনবিহারী মিত্র প্রমুখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁরাই ধরে রেখেছিলেন তাঁর
সুরের ঐতিহ্য।

ঋণ: সঙ্গীতের আসরে: দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE