Advertisement
১৯ মার্চ ২০২৪

থমকে যাক বয়স

কী ভাবে মিলতে পারে এমন সুস্থ জীবনের হদিশ? নিউরোসার্জন অমিতাভ চন্দের সঙ্গে কথা বললেন সোমা মুখোপাধ্যায়। আশি পেরিয়েও শিরদাঁড়া সোজা রেখে গটগট করে হেঁটে যাচ্ছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। লেখালেখির চাপ সামলেও প্রতি সকালে ডন-বৈঠক দিচ্ছেন ৮০ বছরের শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। আশির কোঠায় পৌঁছেও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় দিনভর শুটিং-এ ব্যস্ত। এ যেন সরাসরি বয়সকে চ্যালেঞ্জ জানানো।

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

আশি পেরিয়েও শিরদাঁড়া সোজা রেখে গটগট করে হেঁটে যাচ্ছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। লেখালেখির চাপ সামলেও প্রতি সকালে ডন-বৈঠক দিচ্ছেন ৮০ বছরের শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। আশির কোঠায় পৌঁছেও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় দিনভর শুটিং-এ ব্যস্ত। এ যেন সরাসরি বয়সকে চ্যালেঞ্জ জানানো।

প্র: চার পাশে ‘ফিট’ লোকজনকে দেখে অনেকেরই তো মনে হয়, ‘ইস, আমি কেন ওদের মতো নই?’

উ: দেখুন, আমাদের গড় আয়ু যেমন বাড়ছে, তেমন অনেক রোগও বাড়ছে। বিশেষ করে মস্তিষ্ক আর শিরদাঁড়ার নানা অসুখে কাবু হচ্ছেন অনেকেই। ফলে মনে মনে হাজার চাইলেও তরতাজা জীবন থেকে কেউ কেউ অনেকটাই দূরে থাকেন। অনেকের তো এমন অবস্থা যে দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো কাজগুলো করতেও সমস্যা হয়।

প্র: এটা কী ভাবে ঠেকানো যায়? ঠেকানোর ব্যাপারটা সবটাই কি নিজের হাতে?

উ: না। সবটা নিজের হাতে নয়। প্রত্যেক রোগের কিছু কারণ থাকে। তার মধ্যে কিছু আমরাই পরিবর্তন করতে পারি। জীবনযাত্রার কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে সেগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। বাকিগুলোর ক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না।

প্র: যেমন?

উ: ব্রেন টিউমার। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রেন টিউমারের আশঙ্কা বাড়ে। এই ব্যাপারটা তো আমাদের হাতে নেই। আসলে আমাদের শরীরে অসংখ্য কোষ আছে। বিভিন্ন ধরনের কোষ বিভাজনের হার বিভিন্ন। ব্রেন বা লিভারে কোষ বিভাজন প্রায় হয়ই না। আবার ত্বকে খুব দ্রুত হয়। কোন কলাতে কোন কোষ কত দ্রুত বাড়বে সেটা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের ক্রোমোজোমের জেনেটিক কোড। অনেক সময় বাইরের কিছু কারণ (ভাইরাল ইনফেকশন) জেনেটিক কোডে পরিবর্তন ঘটায়। আমাদের শরীরে কিছু এনজাইম আছে, যা জেনেটিক কোডের মেরামত চটপট করে ফেলে। কিন্তু কখনও কখনও এই পরিবর্তন এতটাই বেশি যে মেরামত আর সম্ভব হয় না। তা ছাড়া বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেরামতির এনজাইমগুলির কাজের ক্ষমতাও কমে। এর ফলে কোষ বিভাজনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়। তৈরি হয় টিউমার। এ ক্ষেত্রে কোনও ‘মডিফায়েবল ফ্যাক্টর’-এর হদিশ এখনও দেওয়া যায় না। মোবাইল ফোনের ব্যবহার কম করার কথা বলা হচ্ছে ইদানীং। তবে সে ভাবে প্রমাণিত হয়নি।

প্র: রাস্তাঘাটে অনেককেই তো দেখা যায়, ঝুঁকে হাঁটছেন। ঘাড়ে বা কাঁধের ব্যথায় নুয়ে পড়ছেন। এগুলো কেন হয়?

উ: এটা মূলত স্পন্ডিলোসিসের কারণে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ভার বহনকারী হাড়ের জয়েন্টগুলিতে ক্ষয় শুরু হয়। হাঁটু এবং অন্যান্য জয়েন্টে হলে আর্থ্রাইটিস বলি। কিন্তু শিরদাঁড়া অনেকগুলি হাড় দিয়ে তৈরি। সেখানে ক্ষয় হতে পারে। কোনও কোনও জায়গায় হাড় বাড়তে পারে। স্লিপড ডিস্ক হতে পারে। লিগামেন্ট স্থিতিস্থাপকতা হারিয়ে মোটা হয়ে যেতে পারে। এরই সম্মিলিত নাম স্পন্ডিলোসিস।

প্র: স্পন্ডিলোসিস হলে কী হয়?

উ: অনেক কিছু হতে পারে। ঘাড়ে বা কোমরে অসহ্য ব্যথা, ঘাড় ঘোরাতে না পারা, স্নায়ুর ওপরে চাপ পড়ে হাত-পায়ে ব্যথা, ঝিনঝিন করা, অসাড় হয়ে যাওয়া।

প্র: এটা ঠেকানোও কি নিজের হাতে নেই?

উ: অনেকটাই নিজের হাতে। শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়া, ব্যায়াম না করা, শিরদাঁড়ার ওপরে অতিরিক্ত চাপ দেওয়া, যেমন বেশি ভারী জিনিস তোলা, মাথায় অতিরিক্ত ওজন তোলা, ত্রুটিপূর্ণ ভঙ্গিতে বসে দীর্ঘক্ষণ কাজ করা ইত্যাদি হলে স্পন্ডিলোসিস হতে পারে। এখনকার দিনে ওবেসিটি বা স্থূলতা একটা বড় সমস্যা। তার সঙ্গে বসা, দাঁড়ানো বা হাঁটার ত্রুটিপূর্ণ ভঙ্গিমা শিরদাঁড়ার ওপরে চাপ আরও বাড়িয়ে দেয়। সেখানেই বাড়ে স্পন্ডিলোসিসের প্রকোপ। কুলি বা মোটবাহক যাঁরা, অনেক কম বয়সে এঁরা এই রোগের শিকার হন। শরীরের ওজন কমালে শিরদাঁড়ার ওপরে ভার কমানো যায়। সেটা ব্যায়ামে সম্ভব। ব্যায়ামে মাংসপেশি দৃঢ় হয়। তখন মাংসপেশি শিরদাঁড়ার ভার অনেকটা লাঘব করে। তাই ব্যায়াম করতেই হবে।

প্র: স্পন্ডিলোসিসের জন্যই তো অনেকে কলার পরে ঘোরেন, তাই না?

উ: হ্যাঁ। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, টানা বহু দিন কলার পরে থাকা খুব ক্ষতিকর। এতে ঘাড়ের মাসল আরও দুর্বল হয়ে যায়। কয়েক দিন ব্যথা হল, কলার পরলাম, ঠিক আছে। আরেকটা মিথ-ও ভাঙতে চাই। স্পন্ডিলোসিসে কিন্তু মাথা ঘোরে না। অনেকে মাথা ঘুরলেই ধরে নেন, স্পন্ডিলোসিস হয়েছে। মাথা ঘোরার অন্য নানা কারণ থাকে।

প্র: শোনা যায়, শক্ত বিছানায় শোয়া নাকি খুব উপকারী?

উ: একেবারে ভুল ধারণা। অনেকেই মনে করেন, শক্ত বিছানায়, এমন কী পারলে কাঠের ওপরে বা মেঝেয় শুলে বা বালিশ না নিয়ে শুলে শিরদাঁড়া খুব ভাল থাকে। আবার স্পন্ডিলোসিসেও শক্ত বিছানায়, বালিশ ছাড়া শোওয়ার নিদান দেওয়া হয়। আসলে এই ধারণাগুলো ভুল। এগুলো আমাদের শেখা পাশ্চাত্য থেকে। সেখানকার শিক্ষা এই অসুখে firm matress-এ শোওয়া উচিত। Firm শব্দটার এ ক্ষেত্রে বাংলা প্রতিশব্দ তেমন নেই। তাই আমরা সুবিধামতো ‘শক্ত’ বানিয়ে ফেলেছি।

প্র: তা হলে কি নরম বিছানায় শুতে বলছেন?

উ: বাড়াবাড়ি রকমের নরম বা শক্ত কোনওটাই ঠিক নয়। সাধারণ ছোবড়ার গদিই ঠিকঠাক। তাতে ঘাড়, কাঁধের সমস্যা হবে না।

প্র: আর কুঁজো হয়ে হাঁটেন যাঁরা, তাঁদের সমস্যাটা কী?

উ: ওটা মূলত অস্টিওপোরোসিস-এর কারণে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হাড় ফোঁপড়া হয়ে যায়। শিরদাঁড়ায় ফ্র্যাকচার হয়। বেঁকে যায়। আবার মাসল দুর্বল হয়েও কুঁজো হয়ে হাঁটেন অনেকে। আসলে আমাদের পিঠের ব্যায়াম কম হয়। যাঁরা জিম-এ যান, তাঁরাও ট্রাইসেপ-বাইসেপ নিয়েই মূলত ব্যস্ত থাকেন। তাই পিঠ বেচারা অবহেলিত থাকে। সময় এলে সে-ও শোধ তোলে। এ ছাড়া পারকিনসন’স ডিজিজ হলে এমনিই ঝুঁকে পড়েন অনেকে।

প্র: পারকিনসন’স কেন হয়?

উ: আমাদের ব্রেনের নির্দিষ্ট সার্কিটে ক্ষয় হলে এমন ঘটতে পারে। সাধারণভাবে ৬০ বছরের পর এটা হতে পারে। হাত-পা কাঁপা, যে কোনও মুভমেন্টে অসুবিধা, এমন কী সাধারণ হাঁটাচলাতেও সমস্যা হয়।

প্র: এটা ঠেকানো যায় না? এর চিকিৎসাই বা কী?

উ: সে ভাবে ঠেকানোর কোনও পথ এখনও পাওয়া যায়নি। গবেষণা চলছে। তবে একটা কথা বলতে পারি। প্রচুর শাকসব্জি, ফল খান। তাতে যে ফলিক অ্যাসিড থাকে, সেটা পারকিনসনস প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে বলে ইদানীং মনে করা হচ্ছে। ওষুধের মাধ্যমে পারকিনসন’স কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ইদানীং পারকিনসনস’স-এর অস্ত্রোপচারও শুরু হয়েছে। তবে অস্ত্রোপচারে কাঁপুনি বন্ধ হয়। কিন্তু মুভমেন্টের স্বাভাবিকতা পুরোটা ফেরে না। যেমন হাত বাড়িয়ে কিছু ধরব। কিন্তু হাতটা বাড়াতে পারছি না। এগুলো থেকেই যায়।

প্র: আর স্ট্রোক? ইদানীং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তো স্ট্রোকেও প্রায় পঙ্গু দশা দেখছি অনেকেরই।

উ: স্ট্রোক একটা বড় সমস্যা। দু’রকমের স্ট্রোক হয়। মস্তিষ্কের রক্তবাহী নালী বা ধমনীর মধ্যে যখন রক্ত চলাচল ব্যাহত হয় তখন সেই নির্দিষ্ট অংশে মস্তিষ্কের কাজও ব্যাহত হয়। রক্তচলাচল বেশিক্ষণ বন্ধ থাকলে মস্তিষ্কের সেই বিশেষ অংশটি চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। একে বলে ইস্কিমিক স্ট্রোক।এ ছাড়া হেমারেজিক স্ট্রোকও হয়। মস্তিষ্কের মধ্যে যে ছোট ছোট ধমনী বা শিরা থাকে, সেগুলি ছিঁড়ে গেলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। এটা হয় মূলত হাই ব্লাড প্রেশার অর্থাৎ উচ্চ রক্তচাপের জন্য।

প্র: স্ট্রোকের চিকিৎসা কী?

উ: হেমারেজিক হলে অস্ত্রোপচার করে রক্তের ক্লট বার করা হয়। এখন তো ব্রেন না খুলেও অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে। ইস্কিমিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রেও অস্ত্রোপচার হয়। ভবিষ্যতে যাতে আর স্ট্রোক না হয় সে জন্য বাইপাস বা স্টেন্টিং করা হয়। বাইপাসে খরচ পড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকার মতো। আর স্টেন্টিং-এ দু’লাখের মতো। তা ছাড়া স্ট্রোকের রোগীর পুনর্বাসনের জন্যও এখন অনেক ধরনের চিকিৎসা রয়েছে। তাই জীবন থমকে গেল, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। মনের জোরটা বাঁচিয়ে রাখা খুব।

প্র: স্ট্রোক এড়ানোর জন্য কী করা যেতে পারে?

উ: কতগুলো জিনিস স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। যেমন ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, মানসিক চাপ, ধূমপান-মদ্যপান। আর তাই ডায়াবিটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত। নিয়মিত ওষুধ খেলে, ব্যায়াম করলে এটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। আর মানসিক চাপও যতটা কমানো যায়, ততই ভাল। ধ্যান, যোগব্যায়াম করলে মানসিক চাপ খানিকটা কমে। তা ছাড়া ভাল বই পড়া, পরিবার-বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময় কাটানোও একটা উপায়। আর একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে। ধূমপান-মদ্যপান কিন্তু ছাড়তেই হবে।

প্র: ধূমপানের ক্ষতি তো বুঝলাম। কিন্তু সোশ্যাল ড্রিঙ্কিং! সেটাও পুরোপুরি বাদ দিতে বলছেন?

উ: আমরা আসলে ওই ছাড়টা নিতে শিখিনি। অল্প ছাড় দিলেই বেশি হয়ে যায়।

প্র: আপনি বার বার নানা ধরনের শৃঙ্খলার কথা বলছেন। এত শৃঙ্খলা মেনে কি চলা সম্ভব?

উ: ব্যক্তিগত একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার বাবার বয়স এখন ৮৩ বছর। উনি ধূমপান বা মদ্যপান করেননি। যথেষ্ট পরিশ্রম করতেন। ২০০৯ থেকে প্রস্টেট ক্যানসারের রোগী। বছর দুয়েক আগে ওঁর মেরুদণ্ডে টিউমার ধরা পড়ল। হাত-পা, বিশেষত বাঁদিকের হাত-পা একেবারেই অকেজো হয়ে পড়ল। যদিও এই বয়সে অস্ত্রোপচারে বড় রকম ঝুঁকি থাকে, তবু এ ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। আমি নিজেই সেই অস্ত্রোপচার করলাম। ঘণ্টা ছয়েকের অস্ত্রোপচার উনি ভালরকম সহ্য করলেন। এখন উনি সম্পূর্ণ সুস্থ। বাজার করছেন, পার্কে বেড়াচ্ছেন। আসলে এটা বলে একটা জিনিসই বোঝাতে চাইছি, কম বয়স থেকে আপনি জীবনকে সম্মান করুন, বার্ধক্যে জীবন আপনাকে সম্মান করবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE