Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

আমার খাবারে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল

যাতে গলাটা খারাপ হয়ে যায়। বিস্ফোরক আরতি মুখোপাধ্যায়। রাগ, অভিমান, হতাশা উগরে দিলেন জীবনে প্রথম বার।ঝটিতি সফরে তিনি কলকাতায়। সানি টাওয়ারে বাড়ির দেখভাল। গানের অনুষ্ঠান। শ্যুটিঙের ঝামেলায় বাদ গেছে সকালের নিয়মমাফিক দু’ ঘণ্টার রেওয়াজ। চা খেতে খেতে বললেন, ‘‘ঝামেলা মেটাতে মেটাতেই জীবনটা কেটে গেল।’’

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

ঝটিতি সফরে তিনি কলকাতায়। সানি টাওয়ারে বাড়ির দেখভাল। গানের অনুষ্ঠান। শ্যুটিঙের ঝামেলায় বাদ গেছে সকালের নিয়মমাফিক দু’ ঘণ্টার রেওয়াজ।

চা খেতে খেতে বললেন, ‘‘ঝামেলা মেটাতে মেটাতেই জীবনটা কেটে গেল।’’

পত্রিকা: যে দিন কেউ আপনার খাবারে ‘বিষ’ মিশিয়ে আপনার গলা নষ্ট করতে চেয়েছিল, সেই ঝামেলাটা কেমন করে কাটিয়ে উঠেছিলেন?

আরতি: সে তো কবেকার কথা! আজ আর এ সব বলে কী হবে!

পত্রিকা: একটু বলুন না!

আরতি: মুম্বইতে স্ট্রাগল করছি তখন। জানেন, আজও জানতে পারিনি, ঠিক কোন খাবারে কে কী মিশিয়ে দিয়েছিল। হঠাৎই এক দিন শরীরে প্রবল অস্বস্তি। পা ফুলে ঢোল। অসম্ভব যন্ত্রণা। ডাক্তারের কাছে গেলাম। পেট থেকে বেরলো সে সব আজগুবি পদার্থ। এও জানা গেল, আমার খাবারের মধ্যে কেউ বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। সেই থেকে পায়ে যে ব্যথা শুরু হল, তা আজও চলছে। একটানা বসে রেওয়াজ করতেও পারি না। এনার্জি কিছুটা হলে কমেছে।

থেকে থেকে শাড়ি সামলাচ্ছিলেন। আর বলছিলেন, ‘‘মুম্বইতে এ দিক ও দিক কোথাও যেতে হলে দিব্যি জিনস চড়িয়ে ঘুরে বেড়াই। কিন্তু কলকাতায় নিজেকে শাড়ি ছাড়া ভাবতে পারি না। এখানকার মেজাজটাই আলাদা।’’

পত্রিকা: আজও কলকাতার প্রতি এত টান! অথচ খ্যাতির মধ্য গগনে দুম করে কলকাতা ছেড়ে মুম্বই চলে গিয়েছিলেন। আফশোস হয় না?

আরতি: ও মা, আফশোস হবে কেন?

পত্রিকা: হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তো অনেক বার বলেছেন, আরতি যে কেন মুম্বই চলে গেল! তখন বাংলায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আর আরতি মুখোপাধ্যায়, এই দুটোই তো নাম...

আরতি: (বেশ উত্তেজিত হয়ে) কী দিয়েছে আপনাদের কলকাতা! কেউ আমার প্রাইভেট অ্যালবাম করার উদ্যোগ নিয়েছে কখনও? কেউ আলাদা করে প্রোমোট করেছে আমায়? শুনুন, আরতি মুখোপাধ্যায়কে কতগুলো ছবির গান, পপুলার গান গাইয়ে ছেড়ে দিয়েছেন আপনারা, ব্যস।

পত্রিকা: কী বলছেন? ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখা-য় কলাবতী রাগের ওই যে বিস্তার সে শুনে তো আজও সকলে মুগ্ধ।

আরতি: সুবর্ণরেখা-র ওই গান শুনেই তারাচাঁদ বারজাটিয়া আমায় বলেছিলেন, ‘‘দিদি আপ কো বম্বে যানাই পড়েগা।’’ উনি ছবির ডিসট্রিবিউটর ছিলেন। উনিই প্রথম মুম্বইতে সওদাগর ছবিতে আমাকে দিয়ে গান গাওয়ান।

পত্রিকা: শুনেছি, সুবর্ণরেখায় আপনাকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন ঋত্বিক ঘটক?

আরতি: ও বাবা! তখন তো আমি খুব ছোট। দেখতেও বোধ হয় খারাপ ছিলাম না। ঋত্বিকদা যেই বললেন, অভিনয় করতে হবে, আমি কেঁদেকেটে একশা। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম, অভিনয় করতে গিয়ে যদি গানটা হারিয়ে যায়! আমি কিছুতেই রাজি হইনি।

পত্রিকা: যখন মুম্বই চলে যান, তখন কলকাতায় আপনার সাজানো সংসার। আপনার প্রথম স্বামী সুবীর হাজরার কথায় আপনার গান তখন অসম্ভব হিট। সংসার-টংসার ফেলে হঠাৎ মুম্বই, অসুবিধে হয়নি?

আরতি: (খানিক ভেবে) আমার স্বামী খুব গুণী মানুষ ছিলেন। শুধু গান লেখা নয়, সত্যজিৎ রায়ের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। ছদ্মবেশী ছবির চিত্রনাট্যও ওঁর লেখা। আমি ওঁর গুণের জন্যই প্রেমে পড়েছিলাম। বিয়েও করেছিলাম। কিন্তু দেখলাম, উনি আমাকে একটুও স্পেস দিতে চাইছেন না। আমি কী শাড়ি পরব, কোন সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কতটা কথা বলব, সেটাও উনি বলে দিতেন। দম বন্ধ হয়ে আসত। গানেও তার ছাপ পড়তে লাগল। কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার এটা অন্যতম কারণ ছিল। সে এক ভয়ঙ্কর সময়। অনেক মনের জোর লেগেছিল, জানেন। সুধীনদা (দাশগুপ্ত) বলেছিলেন, ‘তুই বম্বে চলে যা।’ আর কার না ইচ্ছে করে বলুন তো, লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল, আরডি বর্মনের মতো সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে!

পত্রিকা: রাহুল দেববর্মন নাকি খুব বকাঝকা করতেন আপনাকে?

আরতি: উফ্! সে আর বলতে! আমি ওকে ‘তুমি’ করেই কথা বলতাম। ও ডাকত ‘তুই’। মুম্বইতে যে অঞ্চলে থাকি, পঞ্চমদাও (আরডি বর্মন) সেই অঞ্চলের বাসিন্দা। তখন তো মোবাইল ছিল না। প্রথম দিকে ওর মুখোমুখি হইনি। তারই মধ্যে একটা সময়, উনি টানা কয়েক দিন ধরে আমার বাড়িতে ফোন করছিলেন। আমি বাড়িতে ছিলাম না। বাড়িতে লোক পর্যন্ত পাঠিয়েছিলেন। তারা এসে দেখেছে বাড়ি বন্ধ।

পত্রিকা: আপনি তখন কোথায়?

আরতি: মুম্বইতে থাকা তখন কি চাট্টিখানি কথা! সবে ওই শহরে পা রেখেছি। গান গেয়ে রোজগার করতে হবে, সেই চাপটা নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। এক দিনে তিন-চারটে করে গুজরাতি গান রেকর্ড করছি। একটা গানে হয়তো পাঁচশো টাকা পেতাম বা অনেক সময় কিছু পেতামই না। মুম্বইতে রেকর্ড করে সে দিনই হয়তো ছুটে যাচ্ছি কলকাতায়। এয়ারপোর্ট থেকে নেমে হুড়তেপুড়তে পৌঁছচ্ছি স্টুডিয়োয়। রেকর্ড করছি ‘হংসরাজ’ ছবির মতো হিট গান। কলকাতাতেই বা কতটুকু পারিশ্রমিক পেতাম?

পত্রিকা: রাহুলদেবের সঙ্গে যোগাযোগ কী ভাবে?

আরতি: ওই, ফোনেই। এক দিন আমায় পেয়ে গেলেন। শুরুতেই প্রচণ্ড ধমক। বললেন, ‘তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না। মুম্বইতে লোকে আধ লাইন গান গাওয়ার জন্য সঙ্গীত পরিচালকের বাড়িতে পড়ে থাকে রে। কিছু না পারিস, আমায় মাঝে মাঝে ফোনও তো করতে পারিস। কত গান যে তোর মিস হয়ে গেল!’

পত্রিকা: প্রথম ওঁর কাছে কী গান পেলেন?

আরতি: কিশোরদার সঙ্গে ডুয়েট। রুশওয়াই ছবিতে ‘মেরি তানহাই’।

পত্রিকা: হেমন্ত-মান্না-কিশোর তিনজনের সঙ্গেই চুটিয়ে কাজ করেছেন। কাকে বেশি রোম্যান্টিক লেগেছে?

আরতি: হেমন্তদার মতো কণ্ঠ মান্নাদার ছিল না। হেমন্তদা গানগুলোকে খুব সহজ করে গাইতে পারতেন। ভিতরে ঘা দিত। আর কিশোরদা মানুষটাই তো রোম্যান্টিক। অমন দরাজ গলা, যা গাইতেন, তাই হিট।

পত্রিকা: অনেকেই বলেন, স্টুডিয়োয় কিশোরকুমার অদ্ভুত সব কাণ্ড করতেন।

আরতি: (প্রচণ্ড হেসে) এমন সব অঙ্গভঙ্গি করতেন গান গাইবার সময়, গাইব কী! হেসেই গলা নষ্ট হয়ে যেত এক এক সময়। তবে কিশোরদাও সারাক্ষণ আমায় বলতেন, ‘তুমি অনেক কম গান গাইছ। এই সময় তোমার অনেক বেশি কাজ পাওয়া উচিত। এটা নিয়ে একটু ভাবনাচিন্তা করো।’

পত্রিকা: আরও বেশি গান গাইতে বাধাটা কোথায় ছিল?

আরতি: আসলে মুম্বইতে আমি যা যা গাইছিলাম, প্রত্যেকটাই হিট হচ্ছিল। গীত গাতা চল ছবিতে সারিকার লিপে প্রত্যেকটা গান আমার গাওয়া। এবং হিট। কল্যাণজি-আনন্দজির সুরে গঙ্গা কি সৌগন্ধ-এ রেখার লিপের গান, শঙ্কর-জয়কিষণের সুরে সন্ন্যাসী ছবির গান, গানের কথাটা এই মুহূর্তে মনে পড়েছে না, খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। আর হবে নাই বা কেন। আমি ক্লাসিক্যাল, সেমি ক্লাসিক্যাল, ভজন, টপ্পা সব রকম গান গাইতে পারতাম। ফিল্মে গান গাইতে গেলে এই ভার্সেটেলিটিটা খুব জরুরি। এর পরেও যদি বেশি না ডাক পাই, আমি কী করতে পারি! আমি এমনও দেখেছি, জগজিৎ সিংহর মতো অত বড় একজন গায়ক, সঙ্গীত পরিচালকের বাড়ি গিয়ে বসে আছেন, নিজের গানের রেকর্ড হাতে নিয়ে, শুধু নতুন গান পাওয়ার আশায়।

পত্রিকা: তাই!

আরতি: শুনুন, আমার কথা বলি, এইচএমভি থেকে এক বার বলা হল, হিন্দি রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যালবাম হবে। আমায় কয়েকটা হিন্দি রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করে পাঠাতে হবে। তখন সিডি ছিল না। আমি টেপ-এ রেকর্ড করে দিলাম। এইচএমভি-র মিটিঙে নাকি বলা হয়, ‘হিন্দি রবীন্দ্রসঙ্গীত যদি গাইতেই হয়, তা হলে তা লতা মঙ্গেশকর গাইবেন। আরতি মুখোপাধ্যায় নয়! অথচ দেখুন, লতাজি সেই গান কোনও দিনই গেয়ে উঠতে পারলেন না।

পত্রিকা: কিন্তু আপনি তো হিন্দিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন।

আরতি: সে তো অনেক পরে। এইচএমভি থেকে নয়। সেটাও আশাজির গাওয়ার কথা ছিল। উনি গাইলেন না, তাই আমি সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার তো কোনও ইগো নেই।

পত্রিকা: আচ্ছা, গুলশন কুমার যখন একের পর এক হিট ভজনের ক্যাসেট করছেন, অনুরাধা পাডোয়ালের মতো গায়িকা যেখান থেকে উঠে আসছেন... গুলশন তখন আপনাকে রেকর্ড করার প্রস্তাব দিলে আপনি নাকি ওঁকে ফিরিয়ে দেন?

আরতি: বাজে কথা। কে বলেছে? গুলশন আমার বাড়ি এসেছিলেন। আমার গান রেকর্ডও করা হয়। কিন্তু সেটা বেরয়নি। ঠিকটা না জেনে লোকে কেমন গুজব ছড়াতে থাকে, দেখেছেন?

পত্রিকা: আনন্দ আশ্রম ছবিতে শ্যামল মিত্রের পরিচালনায় আপনি ‘কথা কিছু কিছু’ গানটি গেয়েছিলেন। ছবির হিন্দি ভার্সানে আপনার গলায় গানটা শোনা গেল না কেন?

আরতি: মুম্বইতে আমার প্রচুর গান কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ওই গানটা প্রীতি সগর গেয়েছিলেন। আর মজার কথা, গানটা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল।

পত্রিকা: কিন্তু সঙ্গীত পরিচালক তো সেই শ্যামল মিত্রই ছিলেন!

আরতি: ওপর থেকে যদি চাপ আসে, শ্যামলদাই বা কী করবেন? আমি তো বলছি, কোনও মানুষই খারাপ ছিলেন না তখন। কিন্তু পরিস্থিতি তাঁদের বাধ্য করত। ধরুন, বাপি লাহিড়ীর মতো অত বড় সুরকার। উনিও তখন মুম্বইতে স্ট্রাগল করছেন। ওঁকেও তখন স্টার আর্টিস্টদের দিয়েই গান গাওয়াতে হয়েছে। ইচ্ছে হলেও আমাকে নিতে পারেননি।

পত্রিকা: আচ্ছা!

আরতি: এখানে একটা কথা বলি। গায়িকাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কটা তখন মুম্বইয়ে অসম্ভব রেষারেষির ছিল। গল্পগুজব, আড্ডাটাড্ডা দেওয়ার তো কোনও প্রশ্নই নেই। হার্ডকোর প্রফেশনাল একটা দুনিয়া। কেউ কাউকে জায়গা ছাড়ে না। কলকাতায় চেহারাটা ছিল ঠিক উল্টো। প্রতিমাদি (বন্দ্যোপাধ্যায়), সন্ধ্যাদির (মুখোপাধ্যায়) কাছে কত ভালবাসা পেয়েছি। কেউ কোনও দিন কোনও কটু কথা বলেনি আমায়। অন্য দিকে নির্মলাদি (মিশ্র), বনশ্রীর (সেনগুপ্ত) সঙ্গে দারুণ আড্ডা হত।

পত্রিকা: লতা মঙ্গেশকর বা আশা ভোঁসলে কখনও আপনার গানের প্রশংসা করেছেন?

আরতি: হ্যাঁ করেছেন তো। লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলালের পরিচালনায় পরবরিশ-এ যে গানটা গেয়েছিলাম (বলেই দু’কলি গেয়ে উঠলেন ‘হাম তো মর যায়েঙ্গে, লে লে কে তেরা নাম’)। গেয়েছিলাম চার জনে। আশাজি, অমিতকুমার, শৈলেন্দ্র সিংহ আর আমি। এটা তো আশাজিই আমাকে গাওয়াতে বলেছিলেন। যখন গানটা রেকর্ড করছি, স্টুডিয়োয় পেয়ারিলালজি মজা করে বলেছিলেন, ‘আর্তি, তুমনে আশাজি কো কেয়া গুল খিলায়া।’ আমি তো লজ্জায় লাল। তখন মুম্বইয়ে ওই সব হাসিঠাট্টার সঙ্গে আমি খুব একটা অভ্যস্থ ছিলাম না। লতাজিও কিন্তু ভাল গাইলে ডেকে প্রশংসা করতেন।

পত্রিকা: একটা ঘটনার কথা শুনেছি, এক বার আরডি বর্মন নাকি আপনার বাড়িতে গান নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিলেন। আর আশাজি নীচে ট্যাক্সিতে বসে আরডি-কে তাড়া দিচ্ছিলেন...

আরতি: (বেশ অপ্রস্তুত হয়ে) বিষয়টা দেখুন ওরকম নয়। আশাজির হয়তো সে দিন সত্যি সত্যিই তাড়া ছিল।

পত্রিকা: কখনও মনে হয়েছে টেলিভিশন আসার পরে গানটা যখন একটা দেখার বিষয় হয়ে গেল, রুনা লায়লার মতো আর্টিস্টরা দাঁড়িয়ে নেচে গান গাইতে আরম্ভ করলেন, তখন আপনি তানপুরা বা হারমোনিয়ামে চমৎকার সুর লাগালেও লোকে হয়তো সেটা শুনতে চাইছে না...

আরতি: টেলিভিশনের লোকজন তখন ভেবেছিলেন, নতুন কিছু করা যাক। অমনি লাউড পোশাক পরে নাচতে নাচতে লোকে গাইতে শুরু করল। খুব খারাপ লাগে জানেন, যখন দেখি, এই নাচগানটাকে প্রোমোট করার জন্য লোকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আর আমি পাশাপাশি শেখর সেনের সুরে ভজন রেকর্ড করতে চাইছি। সেটা কেউ প্রোমোট করতে চাইছে না। নেচে নেচে একটা গান গেয়েই লোকে এখন পঞ্চাশ হাজার টাকা পেয়ে যাচ্ছে। আর তাকেই সবাই মাথায় তুলে নাচছে। সুর-ফুরের তো কোনও বালাই নেই। আর সে সময়, মুম্বইয়ের মতো জায়গায় নামী শিল্পীদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে আমার গানকে হিট করাতে হয়েছে। একটা গানে বড়জোর পাঁচশো টাকা জুটেছে। ক্ষোভ হবে না, বলুন তো? বিবিধ ভারতীতে আমার ভজনও বাজছে, আবার ‘ওলে ওলে’ও বাজছে। দুটো কি এক হল? আর একটা কথা বলি, এখনকার শিল্পীদের লাইমলাইটে আসার পথটা অনেক সহজ হয়ে গেছে।

পত্রিকা: এটা কী বলছেন! এখন কি শিল্পীদের লড়াই করতে হয় না?

আরতি: এই মুহূর্তে এক জন লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পী দেখান তো! আছেন এমন কেউ, যাদের সঙ্গে প্রত্যেক মুহূর্তে পাল্লা দিয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে, গান হিট করাতে হবে? অনেক ঝড় পেরোতে হয়েছে আমায়, বুঝলেন। ঈশ্বরের আশীর্বাদ, তাই বেঁচে গিয়েছি।

পত্রিকা: এখন কি কারও গানই ভাল্লাগছে না?

আরতি: তা হতে যাবে কেন! এখনও ভাল গান তৈরি হচ্ছে। রিয়্যালিটি শো থেকেও চমৎকার ট্যালেন্ট বেরচ্ছে। জিৎ গাঙ্গুলি, শান্তনু মৈত্রর কাজ ভাল লাগছে। শ্রেয়াও খুব ভাল গাইছে। অরিজিৎ সিংহ ছেলেটাকেও বেশ লাগছে।

পত্রিকা: আজকে যে রেকর্ডিং-এর সময় পিচ কারেকশন করা হয়, কেমন লাগে? শুনেছি শ্রেয়া ঘোষালও তো এর সুযোগ নেন।

আরতি: শুধু শ্রেয়াকে বলে লাভ নেই। সবাই এটা করেন। তাতে যদি গানটা মনে স্পর্শ করে, আমার আপত্তি নেই। কিন্তু দু’দিন বাদে যদি লোকে গানটাই ভুলে যায়, তা হলে আর এ সবের মানে কি! তবে আমার অবশ্য এ সব কোনও দিন লাগেনি। উস্তাদ সাগিরুদ্দিন খান সাহেবের ছাত্রী ছিলাম। উস্তাদজকে সারেঙ্গি বাজাতে শুনতাম। ওই বাজনাটার মতো চড়া তারে গান গাওয়ার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। পিচ নিয়ে আমায় কোনও দিন ভাবতে হয়নি।

পত্রিকা: একটু অন্য কথায় আসি। শুনেছি আজকের আরতি মুখোপাধ্যায় সংসার সামলাতেই ব্যস্ত।

আরতি: আমি একাই থাকতে চেয়েছিলাম। ডিভোর্সের পর পাঁচ বছর একাই ছিলাম। কিন্তু মা খুব চাইতেন, আমি আবার বিয়ে করি। আমার এখনকার স্বামী গুজরাতি। খুব সম্মান করে আমায়। কলকাতার ওপর রাগ করে যদি বলি, ওখানে আর যাব না। তখন ওই আমায় বলে, ‘আর্তি, তুম উধার যাও। উধার বহুত রেসপেক্ট হ্যায় তুমহারা।’

পত্রিকা: পরজন্মেও কি আরতি মুখোপাধ্যায়ই হতে চান?

আরতি: অবশ্যই। এক সময় যাঁরা বলতেন, আরতি মুখোপাধ্যায় মুম্বইয়ে গিয়ে কল্কে পাচ্ছে না, ও শেষ হয়ে গেছে, তাদের আরও গান শোনাতে চাই। এক জীবনে অত গান গেয়ে উঠতে পারব না। তবে একটা কথা, নিজের স্বভাবে একটু বদল দেখতে চাই।

পত্রিকা: বদল বলতে?

আরতি: আবার যদি জন্মাই, তবে যেন একটু ধূর্ত হয়ে জন্মাতে পারি। সার জীবনে আঘাত শুধু পেয়েই গেলাম। এড়িয়ে যাওয়ার কায়দাটা পরজন্মে শিখে আসব।

ছবি: সুব্রত কুমার মন্ডল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE