Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ঘুটঘুটানন্দ ধরলেন নহবতের পোঁ

প্রথম জীবনে ছিলেন ভাল খেলোয়াড়। আবৃত্তির ঝোঁক আর সুকণ্ঠ তাঁকে ঠাঁই করে দিল অভিনয়ে। পেশাদার রঙ্গমঞ্চে গড়লেন রেকর্ড। সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখছেন সোমেশ ভট্টাচার্যনাম শ্রীমান সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্রীমান পৃথ্বীরাজের বাবা হয়ে উঠতে তখনও তাঁর ঢের দেরি। বরং ফুটবল আর ব্যাডমিন্টনের নেশাই প্রবল।

‘চৌরঙ্গী’ নাটকে ন্যাটাহরি

‘চৌরঙ্গী’ নাটকে ন্যাটাহরি

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০১
Share: Save:

রমানাথপুর ফ্রি কিক পেয়েছে। শট নিতে আসছেন শৈলেন মান্না।

তিনকাঠির নীচে যিনি দাঁড়িয়ে তাঁর বাড়ি রমানাথপুরের পাশেই, মশাটে। দু’জনেই খেলছেন যে যার গ্রামের হয়ে। শৈলেন ছুটে এসে ধাঁ করে শট নিলেন। কিপারের হাত মুচড়ে গোলার মতো বল ঢুকল গোলে। কব্জিটা বোধহয় ভেঙেই গিয়েছে। কিন্তু ছেলে গোঁয়ার, মাঠ ছাড়তে নারাজ। ফুলে ওঠা হাত নিয়েই খেলে গেলেন ম্যাচ।

নাম শ্রীমান সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্রীমান পৃথ্বীরাজের বাবা হয়ে উঠতে তখনও তাঁর ঢের দেরি। বরং ফুটবল আর ব্যাডমিন্টনের নেশাই প্রবল।

খেলা ফুটবল খেলা-র রেকর্ডিংয়ে সুরকার ও মান্না দে-র সঙ্গে

গাঁয়ের বাড়ি হুগলি জেলায় হলেও সত্যর জন্ম কিন্তু কলকাতায়, ১৯২৫ সালে। রানী ভবানী স্কুলে পড়ার সময় থেকেই স্কুলটিমের বাঁধা গোলকিপার। খেপও খেলে বেড়ান। স্কুলশেষে সিটি কলেজে। মা চারুশীলা আগেই মারা গিয়েছিলেন। আইকম পাশ দিতে না দিতেই মারা গেলেন বাবা বনমালী বন্দ্যোপাধ্যায়। ভাগ্য ভাল, টিটাগড় পেপার মিলে কেরানির চাকরি জুটল। শ্রাদ্ধশান্তি সেরে নেড়া মাথায় অফিস গেলেন। বত্রিশ টাকা মাসমাইনে, তার বিশ টাকা যায় এক আত্মীয়ের করা ধার শোধে।

অফিসের হয়েই জুটে গেল প্রথম ডিভিশনে খেলার সুযোগ। উল্টো দিকে সাত্তার, মেওয়ালাল‍! ভবানীপুর ক্লাবের হয়ে খেললেন সেকেন্ড ডিভিশনে। শোভাবাজার ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপে দারুণ লড়ে হারলেন নামী খেলোয়াড় মনোজ গুহের কাছে।

ইতিমধ্যে জীবন অন্য দিকে বাঁক নিতে শুরু করেছে। তাঁর খেলা যে ঘাসের মাঠে নয়, অন্য কোথাও তা ক্রমশ টের পেতে শুরু করেছেন সত্য। ছোট থেকেই ঝোঁক ছিল আবৃত্তির। উত্তরপাড়ায় নিখিল ভারত আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় যাওয়া তো ছিলই। নিজেও লিখতে শুরু করেছিলেন। স্বকণ্ঠে তাঁর ‘চোর’ বা ‘ডাস্টবিন’ আবৃত্তি ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছিল।

আর আহিরিটোলার অ্যামেচার ক্লাবে মকশো চলছিল নাটকের। এক বার পাড়ায় নাটক হচ্ছে। প্রধান অতিথি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। মহালয়ার বাইরে তাঁর বড় পরিচয়, তিনি বেতার নাটকের অন্যতম পুরোধা। নাটকের শেষে তিনি সত্যকে ডেকে বললেন, ‘‘তোমার কণ্ঠস্বরটি তো বেশ ভাল। রেডিয়োয় অডিশন দিচ্ছ না কেন?’’ কাঁচুমাচু হয়ে সত্য জানালেন, এক বার নয়, নাম পাল্টে পাল্টে দশ বার অডিশন দিয়েছেন, প্রতি বারই ফেল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বললেন, ‘‘কাল এক বার রেডিয়ো স্টেশনে এসে আমার সঙ্গে দেখা কোরো।’’

তখনকার রেডিয়ো স্টেশন ছিল গার্স্টিন প্লেসে। সকাল হতেই সত্য ছুটলেন সেখানে। অডিশন হল এবং জুটে গেল রেডিয়ো নাটকে অভিনয়ের সুযোগ। সেই যে শুরু হল, টানা করে গিয়েছেন পাঁচশোরও উপর রেডিয়ো নাটক। তার বেশির ভাগ আর শোনার উপায় নেই। তবে কে ভুলতে পারে রেকর্ডবন্দি ‘আলিবাবা’ শ্রুতিনাটকে আলিবাবার কণ্ঠ— ‘চিচিং ফাঁক!’

কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা। প্রথম বড় মঞ্চে ওঠার সুযোগ এল ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের ‘শহিদের ডাক’ নাটকে। সলিল চৌধুরী তাতে গান গাইতেন আর সত্য করতেন ভাষ্যপাঠ। সত্যর খুব সাধ, শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গে অভিনয় করবেন। মণি শ্রীমানী তখন শ্রীরঙ্গমে তাঁর সঙ্গে নাটক করেন। সেই সূত্রে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতেও অভিনয় করা হয়ে গিয়েছে। সত্য তাঁকে ধরে পড়লেন। কিন্তু বহু ঘোরাঘুরি করেও শিশিরবাবু পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেন না।

মাদার টেরিজার সঙ্গে

উত্তরপাড়ায় নৃত্যগোপাল স্মৃতি মন্দিরে আবৃত্তি করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তখন মিনার্ভা থিয়েটারে ‘ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ’ নাটক করছেন তাঁরা। গুরুদাস সাজেন ঠাকুর, মহেন্দ্র গুপ্ত মথুর আর মলিনা দেবী রাসমণি। সত্য চাইলে হৃদয়ের পার্টটা করতে পারেন। চাইলে মানে? এ তো হাতে চাঁদ পাওয়া!

শুরু হল নতুন জীবন। কিন্তু সে নাটক বেশি দিন চলল না। কিছু দিন পরে ফের এল সুযোগ— বিশ্বরূপায় ‘জাগো’। তার পর রঙমহলে ‘শেষ লগ্ন’। পরিচালক বীরেন্দ্রকৃষ্ণই। সত্যর বয়স তখনও তিরিশ ছোঁয়নি, অথচ যে চরিত্রটি করতে হবে তার বয়স পঁচাত্তর। গোড়ায় হোঁচট। তার পর যখন পার্ট প্রায় হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, মরিয়া হয়ে এমন অভিনয় করলেন যে হইহই পড়ে গেল। এর পর ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এ ঘড়িবাবু, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’-এ হাজারী ঠাকুর। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় হাজারীর ভূমিকায় কমেডি-ঘেঁষা অভিনয় করে খুব নাম করেছিলেন ধীরাজ ভট্টাচার্য। সত্য চরিত্রটি করে নিলেন সিরিয়াস ধাঁচের। দু’জনের বিপরীতেই পদ্ম ঝিয়ের ভূমিকায় সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। সে নাটক চলেছিল ছ’শো রজনী!

মজার ব্যাপার, সিনেমায় সাবিত্রীর প্রথম নায়ক কিন্তু সত্যই। স্বাধীনতার পরের বছর হেমেন গুপ্তর ‘ভুলি নাই’ ছবিতে তাঁর প্রথম মুখ দেখানো। বছর তিনেক বাদে ফের সুযোগ। ‘বরযাত্রী’ ছবিতে চার বাঁড়ুজ্জে— কালী, ভানু, সত্য, হারাধন আর অনুপকুমার মিলে হইহই কাণ্ড। গড়িয়া তখন প্রায় ধু-ধু। এক দিন শুটিংয়ের ফাঁকে অনুপ এসে সত্যকে বললেন, ‘রিকশা চালাতে জানিস?’ সত্য বললেন, ‘ততটা জানি না।’ অনুপকুমার বললেন, ‘আমি খুব ভাল জানি।’ কাছেই একটা রিকশা দাঁড়িয়ে ছিল। সত্যকে তাতে বসিয়ে দিলেন প্যাডেলে চাপ। দিব্যি চলছিল। হঠাৎ চাকার নীচে পড়ল পাথর আর রিকশা উল্টে দু’জনেই সোজা নর্দমায়! রক্তারক্তি কাণ্ড!

মামা-ভাগ্নে স্কেচে সত্য ও তরুণকুমার

তবে ভাগ্যের চাকা ঘুরছিল। পরের বছরই মিলে গেল একেবারে নায়কের রোল। ‘পাশের বাড়ী’ ছবিতে সত্য ক্যাবলা নায়ক, বিপরীতে সাবিত্রী। আগের বছর ‘সহযাত্রী’ ছবিতে সাবিত্রী মুখ দেখিয়েছেন, নায়িকা এই প্রথম।

আর সেই বছরেই হঠাৎ় স্বপ্নপূরণ হয়ে গেল সত্যর। নানা থিয়েটারের শিল্পীদের নিয়ে ‘কম্বিনেশন নাইট’ হত তখন। তেমনই এক রাতে শরৎচন্দ্রের ‘বিজয়া’ নাটকে রাসবিহারীর চরিত্রে শিশির ভাদুড়ী আর বিলাসের চরিত্রে সত্য। হল কী, শিশিরবাবুর অভিনয় দেখে সত্য নিজের পার্ট বলতেই ভুলে গেলেন। কাণ্ড দেখে একটা সংলাপ বলে শিশিরবাবু মঞ্চ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। পরে সত্য যখন ক্ষমা চাইতে গেলে, শিশিরবাবু বললেন, ‘জীবনে কখনও কম্বাইনড নাটক কোরো না, এতে তোমার ক্ষতি হবে।’’

ইতিমধ্যে নিজেও নাটক লিখতে শুরু করেছেন সত্য। এক বার এক আত্মীয়কে দাহ করতে গিয়েছেন কাশী মিত্র ঘাটে। সে কালে তো ঘরে ঘরে ক্যামেরা, হাতে হাতে স্মার্টফোন ছিল না। শ্মশানে কিছু ফোটোগ্রাফার ঘুরঘুর করতেন। শেষ ছবি তুলে দিতেন। এঁদের নিয়েই সত্য লিখলেন ‘শেষ থেকে শুরু’। সত্যজিৎ রায় সেই নাটক দেখতে এসে মুগ্ধ। ‘‘সত্যজিৎবাবু হলে বসে নাটক দেখে হাসছেন— এই দৃশ্যটা এখনও চোখ বন্ধ করলেই ছবির মতো আমার সামনে ভেসে ওঠে,’’ বলেছেন সত্য। এ-ই তাঁর প্রথম লেখা নয়, কিন্তু এই নাটকই তাঁকে প্রথম জনপ্রিয়তা এনে দেয়। পরে তা থেকে ছবিও হয়।

‘শেষ থেকে শুরু’ ছবির মহরতে

মঞ্চে খ্যাতি যত বাড়ে, সিনেমার ডাকও আসে বেশি। তপন সিংহ কাজ দিলেন ‘টনসিল’ ছবিতে। নরেশ মিত্র ডাকলেন ‘উল্কা’য়। ঠিক তার আগে রঙমহল ছেড়ে মিনার্ভায় এসে সত্য বড় বাজি ধরেছিলেন। নিজেরই লেখা ‘এরাও মানুষ’ নাটকে প্রতিবন্ধী দাশুর চরিত্র। সত্যের নিজের বিচারে, তাঁর করা অন্যতম সেরা কাজ। এমনই জীবন্ত সেই অভিনয় যে সত্যিই তিনি প্রতিবন্ধী কি না, তা পরীক্ষা করতে ডাক্তারদের বোর্ড বসানো হল। এই অভিনয়ই পরে তাঁকে এনে দিল ‘উল্কা’ ছবিতে প্রতিবন্ধী চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ।

তবে বড় ঘটনাটা ঘটল যখন ‘কাপুরুষ মহাপুরুষ’ ছবিতে অভিনয় করতে ডাকলেন সত্যজিৎ। সত্যর কথায়, ‘‘আমার লাঠি নিয়ে একটা অ্যাকশন ছিল। শুটিংয়ের আগে আমি ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, লাঠিটা ঘোরাতে গিয়ে আমার মাথায় খটাস করে লেগে যাবে, এ রকম করব কি? সত্যজিৎবাবু বললেন, করে দেখাও। আমি করলাম। উনি খুব খুশি হয়ে বলেছিলেন, হ্যাঁ ঠিক আছে, করো।’’

তার পরের বছরেই ‘নায়ক’। সেখানে সত্য এক বাবাজি। রাজধানী এক্সপ্রেসে আপার বাঙ্কে বসে উল্টো দিকের বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্তাকে জিগ্যেস করবেন— আপনি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড উইল ওয়ার্কার্স-এর নাম শুনেছেন? এত ডব্লিউ-এর ছড়াছড়ি দেখে সত্য জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আমি যদি শুধু ডব্লু ডব্লু ডব্লু ডব্লু বলি, তা হলে কেমন হয়?’’ সত্যজিৎ রাজি। ছবির মুক্তির পরে অনেকেই খুব একচোট হেসেছিলেন সংলাপ শুনে। সত্যজিৎ কিন্তু বলতে ভোলেননি যে, ওটা সত্যর মাথা থেকে বেরিয়েছে!

পরের বছর তরুণ মজুমদারের কাছ থেকেও ডাক এল। ছবি ‘বালিকা বধূ’। তার পরে ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘সংসার সীমান্তে’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘খেলার পুতুল’, ‘ভালবাসা ভালবাসা’, ‘পরশমণি’— বার বারই ডাক পড়েছে সত্যর। তরুণ বলেছেন, ‘‘আসলে যে কোনও চরিত্র দিলেই উনি অসম্ভব মসৃণ ভাবে তা উতরে দিতে পারতেন।’’ কথাটা মনে রাখার মতো। কেননা কমেডি করলেও কমেডিয়ানের একরঙা ছাপ সত্য পড়তে দেননি গায়ে। একই সঙ্গে কমেডি এবং সিরিয়াস রোলে অভিনয় করে গিয়েছেন দাপটে। ছোট-বড় বিচার করেননি। ‘‘ছোট দৃশ্যকেও উনি এমন উচ্চতায় নিয়ে যেতেন যে, হল থেকে বেরিয়ে ওঁর নাম করতেই হবে,’’ বলছেন চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী।

‘নহবত’-এর চারশো রজনী উদ্‌যাপন

ঠিক সেই কারণেই তো বিশ্বরূপায় ‘চৌরঙ্গী’ নাটকে তাঁর করা ‘ন্যাটাহরি’ প্রবীণদের স্মৃতিতে আজও অক্ষয়। ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’, ‘আসামী হাজির’— এক-এক নাটকে এক-এক পরত! এক দিকে মৃণাল সেন তাঁকে নিচ্ছেন ‘কোরাস’-এ। আবার ‘মঞ্জরী অপেরা’ থেকে ‘দেবী চৌধুরানী’ হয়ে ‘হীরে মানিক’, তিনি সমান স্বচ্ছন্দ। টেনিদা-কাহিনি ‘চারমূর্তি’-তে ঘুটঘুটানন্দ তিনিই— ‘ঘচাং ফু খাব তোকে!’ মজা আর শয়তানির আশ্চর্য মিশেল। টানা অভিনয় করে গিয়েছেন শ’দুয়েক ছবিতে! ’৯২ সালে ‘সিটি অব জয়’ ছবিতেও ছিলেন ছোট ভূমিকায়। শেষ লগ্নে এক মরমী চরিত্রে তাঁকে ব্যবহার করলেন রাজা সেন, জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী ‘দামু’ ছবিতে। একটা বৃত্তই সম্পূর্ণ হল যেন।

কিন্তু সত্য বাঁড়ুজ্জের জীবনবৃত্তান্ত অসম্পূর্ণই থেকে যাবে একটি মানুষ আর একটি নাটকের কথা না বললে। মানুষটির নাম তরুণকুমার, নাটকটি ‘নহবত’। সত্য যখন ছবিতে কল্কে পেতে স্টুডিয়ো থেকে স্টুডিয়োয় ছুটে বেড়াচ্ছেন, সঙ্গী ছিলেন আরও এক তরুণ। খাদ্যরসিক দু’জনেই, আলাপ জমেছে টিফিনের সময়ে। পরে বাংলা তাঁকে উত্তমকুমার নামে চিনবে, তখন তিনি চাকরি করেন পোর্ট কমিশনার্সে। সেই সূত্রেই বাড়িতে আসা-যাওয়া আর উত্তমের ছোটভাই তরুণের সঙ্গে বন্ধুত্ব। অন্তত তিরিশটা বছর তাঁরা একে অপরের সঙ্গে জুড়ে ছিলেন ওতপ্রোত। কল্পতরু নাট্যগোষ্ঠী তো ছিলই, ‘মামা-ভাগ্নে’ নামে জনপ্রিয় একটা স্কেচও করতেন দু’জনে।

মিনার্ভায় ‘এরাও মানুষ’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার বেশ কিছু দিন পরে এক বার রঙমহলের মালিকেরা এসে হাজির সত্যর কাছে। কী? না, লাখ পাঁচেক টাকা দেনা হয়ে গিয়েছে। এমন একটা নাটক ফাঁদতে হবে, যা রাতের পর রাত হইহই করে চলবে। সত্য তখন সবে নিজের গ্রুপের জন্য একটা নাটক লিখেছেন। কিছু দিন আগে বালিগঞ্জে এক বিয়েবাড়িতে একটি মেয়েকে দেখেছিলেন। চার-পাঁচ দিন আগেই তার স্বামী মারা গিয়েছে, কিন্তু তাকে কিছু জানানো হয়নি। সকলের সঙ্গে সে-ও দিব্যি হইহই করছে। সেই ঘটনার ছায়ায় লেখা নাটক— ‘নহবত’। ওই মেয়েটির আদলেই কেন্দ্রীয় চরিত্র কেয়া।

গ্রুপের নাটক করতে জামশেদপুরে গিয়ে সত্যর আলাপ হয়েছিল একটি মেয়ের সঙ্গে। নাম আরতি ভট্টাচার্য। অভিনয় করতে চায়। হঠাৎই এক দিন সে কলকাতায় এসে হাজির। বাজিয়ে দেখে তাকেই কেয়ার রোলটা দিলেন সত্য। রঙমহলে পর্দা উঠল। এবং রাতারাতি নাটক হিট! পাঁচ লাখ টাকার দেনা শোধ তো হয়েই গেল, জনপ্রিয়তার চোটে আরতি সিনেমায় সুযোগও পেয়ে গেলেন।

‘নহবত’ দেখতে এলেন সস্ত্রীক সলিল চৌধুরী

পরে ‘নহবত’ সরে যায় তপন থিয়েটারে। আরতির বদলে কেয়ার ভূমিকায় আসেন রত্না ঘোষাল। তরুণ তো ছিলেনই, এ বার এলেন বিকাশ রায় আর প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ও। সেটা ১৯৭৬ সাল। সত্যজিতের ‘জন অরণ্য’ মুক্তি পেয়েছে, তার নায়ক হিসেবে প্রদীপ তখন চেনামুখ। ‘নহবত’ নাটকে তরুণ প্রেমিকের পার্ট করার জন্য ছেলে খুঁজছিলেন সত্য। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় খবর দিলেন প্রদীপকে। জুটে গেল রোল। সপ্তাহে তিনটে শো। বৃহস্পতি আর শনি একটা করে, রবিবার ডাবল শো।

প্রদীপ তার আগে গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় করেছেন। ‘নহবত’ নাটকেই তাঁর পেশাদার রঙ্গমঞ্চে হাতেখড়ি। মঞ্চে সত্যর দাপট দেখে তিনি অবাক, ‘‘ওহ, সে যে কী অভিনয়! এই হয়তো বেশ চড়া, আবার তার পরেই এত নিচু পর্দায় চলে আসছেন! দর্শক একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত!’’

শুধু তপন থিয়েটারেই ‘নহবত’ চলল ষোলোশো রজনী! তার বাইরে কল-শো তো ছিলই। দিনের পর দিন একই অভিনয়ে একঘেয়েমি আসেই। তা কাটাতে মঞ্চে দুষ্টুমি করাটা তাই সত্যর স্বভাব হয়ে গিয়েছিল। সংলাপ পাল্টে অন্যদের ভড়কা দেওয়া তো ছিলই, ঠাট্টা-ইয়ার্কিও চলত। নদিয়ার বেথুয়াডহরিতে কল-শো হচ্ছে, প্রদীপ উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে। ‘‘সত্যদা সংলাপ বলতে বলতে সরে এসে টুক করে একটা গালি দিয়ে আবার গলা চড়িয়ে সংলাপে ফিরে গেলেন। দর্শক কিছু টেরও পেল না,’’ বলতে গিয়ে এখনও হেসে ফেলেন প্রদীপ।

১৯৮১ সালে টানা তিন মাসের জন্য আমেরিকা সফরে গেল ‘নহবত’। নিয়মিত বেতন দেওয়া হবে না বলে প্রদীপ যাননি। দেশে ফেরার পরেও টুকটাক কল-শো হত। তখন প্রদীপের জায়গায় অভিনয় করতেন চিরঞ্জিৎ। ‘নহবত’ শেষ হয়ে ‘নাগপাশ’ সবে শুরু হয়েছে। যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ায় ইতি টেনে চিরঞ্জিৎ দূরদর্শনে খবর পড়ছিলেন। কয়েকটা ছবিতে অভিনয় করাও হয়ে গিয়েছে। যাদবপুরে তাঁরই বিভাগের শিক্ষক সমীর রক্ষিতের উপন্যাস ‘হত্যাকারী’ বেরোয় ‘দেশ’ পত্রিকায়। নাট্যরূপ দেন সুভাষ বসু। সেই ‘নাগপাশ’-এ চিরঞ্জিৎকে নামালেন সত্য। ‘‘উনিই আমার নাটকের গুরু। বড় অভিনেতা তো বটেই, কিন্তু শিক্ষক হিসেবে উনি ছিলেন সেরাদের এক জন,’’ বলছেন চিরঞ্জিৎ। সেই নাটকও চলল সাড়ে সাতশো রজনী!

সরযূবালা ও কিশোরকুমার

স্টুডিয়ো আর মঞ্চই যখন ঘরবাড়ি হয়ে ওঠে, বসতবাড়ি আর নাগাল পায় না। গড়পার রোডে সত্যজিতের পৈতৃক ভিটে যেখানে, সেখান থেকে কোনাকুনি রাস্তা পেরোলেই সত্যর বসত। সরু সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছোট্ট স্টাডি, মেঝেয় ফরাস। সেখানে বসেই যত চিন্তা, লেখালেখি তাঁর। গুছিয়ে সংসার করার সময় কই? দুই ছেলেমেয়ে রুমা আর সুদীপকে সামলে রাখেন স্ত্রী সবিতাই। আর সত্যর এক দূর সম্পর্কের ভাই ছিলেন প্রাক্তন সেনা। অকৃতদার, কড়া ধাতের মানুষ। তিনিই কার্যত সংসারের হাল ধরে রাখতেন।

সেই স্টাডি়তে বসেই সুদীপ বলেন, ‘‘কালেভদ্রে এক দিন বাবা বাড়িতে থাকতেন। পড়াশোনার খোঁজ নিতেন। আমাদের একটা বড় আয়না ছিল। এক দিন সকালে সেটার সামনে দাড়ি কামাতে কামাতে বাবা বললেন, ‘খাতা নিয়ে আয় দেখি, ট্রান্সলেশন কর— সে কাঁদিতে কাঁদিতে আসিল।’ শুনে তো আমারই কেঁদে ফেলার জোগাড়! তখন সিক্স-সেভেনে পড়ি। বললাম, ‘হি কেম ক্রাইং ক্রাইং।’ এ বার বাবার কাঁদার পালা!’’

তবে শাসন নয়, বরং বুঝিয়ে ভুল শুধরে দেওয়াটাই ছিল তাঁর স্বভাব। আর সুযোগ পেলেই হইহই। সকলকে নিয়ে পিকনিক, ক্যারম পেটানো, ছেলেকে নিয়ে ঘুড়ি ওড়ানো। এক বার তো বিশ্বকর্মা পুজোয় ঘুড়ি ওড়াবেন বলে অসুস্থতার ছুতো করে অফিস কেটে চলে এলেন! ‘‘আমায় আর আমার আট-দশটা বন্ধুকে নিয়ে দুটো ট্যাক্সি ডেকে চলে গেলেন গড়ের মাঠে। সঙ্গে ফুটবল। বাবা-কাকা গোলে। খেলা শেষে সবাই মিলে ফুচকা!’’

সত্য ক্রমে পরিচিত থেকে বিখ্যাত হয়ে উঠছিলেন, যদিও টাকার জোগান তেমন ছিল না। ‘নহবত’-এর আগে তো নয়ই। সুদীপের মনে পড়ে, ‘‘আমার স্কুলজীবনের শেষ দিকে বাবা একটা সেকেন্ড হ্যান্ড হিন্দুস্তান ফোরটিন গাড়ি কেনেন।’’ ১৯৭৫ সালে পয়লা বৈশাখ তপন থিয়েটারে নতুন করে ‘নহবত’ শুরু হয়। কিন্তু অঘটন ঘটল কালীপুজোয়। ডাবল শো করে বাড়ি ফিরবেন সত্য, বাজি পোড়ানো হবে। হঠাৎই বাথরুমে পড়ে গেলেন সবিতা, সেরিব্রাল অ্যাটাক! মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করানো হল। বাঁচানো গেল না। ‘‘বিডন স্ট্রিট দিয়ে যখন সব কালী প্রতিমা বিসর্জনে যাচ্ছে, তারই মধ্য দিয়ে শ্মশানে গেল মায়ের দেহ। আমাদের সংসারটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল,’’ বলছেন সুদীপ।

আমেরিকা সফরের পরে আবার নতুন ভূত চাপল সত্য আর তরুণের মাথায়। হলিউডের চাইনিজ থিয়েটারে গিয়ে সোফিয়া লোরেন থেকে বার্ট ল্যাঙ্কাস্টারের মতো তারকাদের হাত-পায়ের ছাপ সিমেন্টে বাঁধানো দেখে সত্য সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়েছিলেন। দুঃখ করছিলেন, ‘‘শিল্পীদের সম্মান এরা কী ভাবে দেয়! আর আমরা?’’ আগের বছরই উত্তম মারা গিয়েছেন। দুই বন্ধু ঠিক করে ফেললেন, তাঁর নামে মঞ্চ গড়বেন। ‘শিশির নাট্য নিকেতন’ করবে বলে মনোহরপুকুর রোডে লিজে জমি নিয়েছিল শৌভনিক নাট্য সংস্থা। অর্থাভাবে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সেই জায়গাই সাব-লিজে নিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে মোটা টাকা ধার করে ১৯৮৬ সালে উত্তম মঞ্চ গড়া শুরু হল।

ফুটবল টিমের মধ্যমণি

হাতে তখন কাজ নেই। অগত্যা যাত্রায় নামলেন সত্য এবং তরুণ। নট্ট কোম্পানি দিয়ে শুরু। পরে সত্য নিজে লিখেছেন, নির্দেশনাও দিয়েছেন— ‘মাটির ঘরে মেম বৌ’, ‘মাকে প্রণাম বাবাকে সেলাম’... সাত বছর বাদে কাজ শেষ হল, ’৯৩ সালে খুলল উত্তম মঞ্চ। কিন্তু তখন পেশাদার থিয়েটারের পালে আর হাওয়া নেই। শ্যামবাজারের থিয়েটার একের পর এক বন্ধ হচ্ছে। উত্তম মঞ্চও মার খেতে লাগল। ফের ‘নহবত’ করে, রবি ঘোষকে এনেও লোক টানা গেল না। মঞ্চ বন্ধ হল। ব্যাঙ্কে দেনা জমল। শুরু হল প্রোমোটারদের উঁকিঝুঁকি।

এরই মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়লেন সত্য। পেট জুড়ে অস্থিরতা, রক্তবমি। হাসপাতালে ভর্তি রইলেন এক মাস। ১৯৯৭ সালের ২৮ জুলাই রাতে যবনিকা পড়ল। ছ’বছর পরে মারা গেলেন তরুণকুমারও। ২০১১ সালে উত্তম মঞ্চ নিজেদের হাতে নিয়ে কলকাতা পুরসভা যে তাকে রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করেছে, তা আর তাঁদের দেখা হল না।

নাটকের জীবন শুধু নয়, নাটকীয় জীবন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্য খেলা ছাড়েননি। তিনি যে জাত খেলোয়াড়! দিনভর ব্যস্ততা, চাপ, ডামাডোল। তবু রাতের পর রাত জেগে দেখেছেন বিশ্বকাপ। পি কে ব্যানার্জি আর চুনী গোস্বামীর বড় ভক্ত তো ছিলেনই। পরে মারাদোনারও খুব ভক্ত হয়ে যান।

’৮০-র ১৬ অগস্ট ছিল ইডেনের সেই কালো দিন। ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের খেলায় দু’দলের সমর্থকদের মারপিটে মারা গেলেন ষোলো জন। সুপর্ণকান্তি ঘোষের সুরে মান্না দে রেকর্ড করলেন তাঁর সেই বিখ্যাত গান— ‘খেলা ফুটবল খেলা, খোকা দেখতে গেল সেই সকালবেলা... তোমরা আমার একটা কথাই রেখো, খেলার মাঠে কারও খোকা আর না হারায় দেখো।’

ষোলোটি নামের তালিকায় সত্যিই কাঁকুড়গাছির একটি ছেলে ছিল, যার নাম খোকা। গীতিকারের নাম সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়।

ইডেনে আর ফুটবল হয় না। কিন্তু মাঠ আছে নানা কিসিমের, মারপিটও আছে।

কথাগুলো তাই থেকেই গেল!

ঋণ: আনন্দবাজার আর্কাইভস, নন্দন গ্রন্থাগার, সাতরঙ (রবি বসু), বর্তমান ও আজকাল পত্রিকা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Satya Bandyopadhyay Actor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE