Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

‘ছায়া’পথের নক্ষত্রলোকে

নাচে-গানে অতুলনীয়। ঘোড়া চালাতেও দড়। আজও তাঁর ছায়া পড়ে কাছের মানুষদের স্মৃতির আরশিতে। শুনলেন চিরশ্রী মজুমদারনাচে-গানে অতুলনীয়। ঘোড়া চালাতেও দড়। আজও তাঁর ছায়া পড়ে কাছের মানুষদের স্মৃতির আরশিতে। শুনলেন চিরশ্রী মজুমদার

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

তিরিশের দশকের শুরু। বুলি ফুটল ভারতীয় চলচ্চিত্রের মুখে। ভাল গল্প, কুশলী পরিচালক ও ধ্রুপদী গানে সাজানো সিনেমায় নামতে অভিনয়, নাচ, গান, বাচনভঙ্গি... কলাবিদ্যায় ষোলো কলা দখল জরুরি ছিল। তবে আঙুরফল সর্বদাই মহা-টোকো! তাই, ‘টাকাপয়সার টানাটানি’, ‘পরিবারটাই সুবিধের নয়’, এ সব নিন্দে করতে করতেই লোকে ধীরাজ ভট্চাজের ‘চাঁদ সদাগর’ বা প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘দেবদাস’ দেখে বেজায় নাকের জলে, চোখের জলে হত।

সবাক চলচ্চিত্রের এমনই এক অবাক সময়ে, এক ধনাঢ্য পরিবার তাঁদের আদরের দুলালীকে নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন। ১৯১৪ সালে হারাধন গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে কনক জন্মেছিল সোনার চামচ মুখে। বাবা বড় অফিসার, পিসির বিয়ে হয়েছে ভাগলপুরের রাজবংশে। সেখানেই যত্নে-বৈভবে ১১ বছর হতেই বিয়ে। মেয়েটি ঘর ও সংসার কী বস্তু, বুঝত না। তবে বয়ঃসন্ধির নিয়ম মেনে চিনত এক স্বপ্নকে। সেটাই খানখান হল, বিয়ের পরই স্বামী যখন জানান, সংসারে তাঁর মন নেই। তাই নতুন বউকে ছেড়ে ওড়িশায় চলে যান শিক্ষকতা করতে।

বাবা কনকবালাকে নিয়ে এলেন কলকাতায়। পাশের বাড়িটিই সংগীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে-র। মনের গুমোট কাটিয়ে দিল ওই দৈবসুরের রোশনদান। ভাগলপুরে থাকতেই দামোদর মিশ্রের কাছে কনকবালার শাস্ত্রীয় সংগীতে হাতেখড়ি। এ বার, মহাসংগীতের মহারথী কৃষ্ণচন্দ্রকে ‘বাবুকাকা’ আর কিশোর মান্না দে-কে ‘মানা’ রূপে পেয়ে তাঁর জীবন ভরে উঠল সরস্বতীর আশীর্বাদে। সঙ্গে সাক্ষাৎ শম্ভু মহারাজের কাছে উচ্চাঙ্গ নৃত্যের তালিম। বড়রা লক্ষ করলেন, চারুবিদ্যার সান্নিধ্যে প্রলেপ পড়ছে ছোট মেয়েটির গহন বিষাদে।

ভাগলপুরের রাজবাড়ির নাতি কুমুদলাল (পরে দাদামণি অশোককুমার) তখন বোম্বাইয়ের রূপনগরে তরুণ তুর্কি। কনকের জন্যও একই ভবিষ্যৎ ভাবলেন দাদারা। রাজপরিবারের বন্ধু উপেন গোস্বামী ফিল্ম কোম্পানির ম্যানেজার। তাঁর তদ্বিরে কিশোরী কনক প্রথম দাঁড়ালেন ক্যামেরার সামনে। ছবির নাম ‘পথের শেষে’। পরিচালক জ্যোতিষ মুখোপাধ্যায়। চরিত্র এক কমবয়সি বৈষ্ণবীর। পারিশ্রমিক সাড়ে সাত টাকা। অভিনয় শেষে জহর গঙ্গোপাধ্যায়, নরেশ মিত্রদের দেখতে দেখতে সাজঘরে এসে তেল ঘষে মেকআপ তুললেন ছায়া দেবী। পরদা ওঠার আগেই কনকের নাম বদলে ‘ছায়া দেবী’ রাখেন অশোককুমারের মামিমা, তাঁর বউদি। ১৯৩৬-এ ‘পথের শেষে’ মুক্তি পেল। সে ছবিতে ছায়ােক দেখে বিস্মিত দুঁদে পরিচালক দেবকীকুমার বসু। ‘সোনার সংসার’-এ নায়িকা হিসেবে প্রথম বার সই করান তাঁকে।

দেবকীবাবুর মাস্টারি মেজাজের স্মৃতি আজও ভাসে স্টুডিয়োর পুরনো বাতাসে। সেই কঠিন শাসনের পালিশেই ধার ও চমক বাড়ল ছায়া দেবীর অভিনয়ে। ছবি মুক্তি পেতে ছায়ার সেই কোহিনুর-আলোয় মন্ত্রমুগ্ধ সকলে। নায়িকা পেলেন সোনার মেডেল ও অজস্র অভিনয় প্রস্তাব। দেবকীবাবু বাংলা ও হিন্দিতে তৈরি করলেন ‘বিদ্যাপতি’। রানি লক্ষ্মীর চরিত্রে পুরো ভারতকে বশ করলেন ছায়া দেবী। তাঁর পারিশ্রমিক লাফিয়ে চড়ল পাহাড়ে। তবু ‘নিউ থিয়েটার্স’ মহলের সুখের জলহাওয়া বেশি দিন সইল না ছায়া দেবীর। পরে বলেছিলেন, ‘ওরা বলত, আমাকে সামলানো শক্ত।’

শ্রেষ্ঠত্বের কারসাজি ওখানেই! আমাদের নৈমিত্তিকের ছানি পড়া চোখে তাকে পরিষ্কার দেখাই যায় না। তেমনই ক’জোড়া চোখ বলেছিল, ‘ছায়া দেবী খ্যাপা। একলা থাকবে, সেটে তানপুরা নিয়ে আসবে। সন্ধের পার্টিতে থাকবে না। কী দেমাক! বড় ঘরের মেয়ে বলে?’

‘হারমোনিয়াম’-এর শ্যুটিংয়ে শমিত ভঞ্জের সঙ্গে

তবু রেকর্ড গড়ে চলেছিল সুশীল মজুমদারের ছবি ‘রিক্তা’। যা পরে হয় রাজকুমার-হেমা-রাখীর হিন্দি ফিল্ম ‘লাল পাত্থর’। ছবির ট্র্যাজিক নায়িকা ছায়া দেবীর অভিনয় ও গায়কি দেখে নির্বাক সিনে-জগৎ। তখনই তিনি হঠাৎ পরদা থেকে উধাও। ঠিকই তো, ভীষণ খেয়ালিই বটে! তাই বুঝি সকলকে চমকে দিয়ে বেতারে নিয়মিত শোনা যেতে লাগল তাঁর খেয়াল! প্রচণ্ড জনপ্রিয় হল ছায়া দেবীর গাওয়া ঠুমরি আর দাদরা। কিন্তু শত সাধাসাধিতেও সিনেমায় প্লেব্যাক করবেন না। বলেন, গান আমার গোপন সুখ। শেষে চল্লিশের শুরুতে সুশীল মজুমদারের কথা ফেলতে না পেরে অভিনয়ে ফিরলেন। ‘অভয়ের বিয়ে’-তে আবার নায়িকা। ভাগ্যিস!

গায়িকা-নায়িকা রূপে, বাংলা থেকে বম্বে, ম-ম করে উঠল তাঁর সুগন্ধ। আমরা সে সব চোখে দেখিনি, তার অনেক গল্প শুনেছি। তপন সিংহ সে সময় কলেজ ও বিশ্ব সিনেমার ছাত্র। তিনি বলেছিলেন, ‘খনা’, ‘মেরা গাঁও’... ভারতে তাঁর মানের সম্পূর্ণ শিল্পী কস্মিনকালেও আসেনি। আন্তর্জাতিক স্তরে বড় জোর দু’-এক জন তাঁর সামনে দাঁড়াতে পারবেন হয়তো!’

দেশে এল স্বাধীনতা। আর টকি-রেনেসাঁ-র পর বাংলা সিনেমায় এল সাদা-কালো স্বর্ণযুগ। আবার কিছু দিনের জন্য অন্তর্হিত ছায়া দেবী। যখন ফিরলেন, তখন তিনি চরিত্রাভিনেত্রী। তখনকার কেন্দ্র চরিত্রের মহানক্ষত্ররা তাঁর ছায়ায় ঢাকা পড়তে লাগলেন। তবু যুগটি তুলনায় মিঠে। সেই মহাতারকারা বিরক্ত হলেনই না, বরং এই অসীম শক্তিশালী অভিনেত্রীকে নাগালে পেয়ে আপ্লুত হলেন। পরদায় এঁর ছেলে বা মেয়ে হওয়াই ভাগ্যের কথা। খোলসটি কঠিন হলেও ছায়া দেবীর নরম হৃদয়ের হদিশ এই তারকাদের অনেকেই পেয়েছিলেন। ছায়া দেবীও গালে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘দেখতুম বাপু উত্তমকে। মেকআপ রুম থেকে বেরিয়েই চরিত্র হয়ে গেল। ড্রাইভার তো একশো পার্সেন্ট ড্রাইভার। সাহেব তো পুরোপুরি সাহেব।’ ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’র স্ক্রিনে যে স্নেহভরা সম্পর্ক ফুটেছে মা-ছেলের, বাস্তব তার থেকে খুব দূর ছিল না।

‘সপ্তপদী’ থেকেই সুচিত্রা হাত ধরে নিজস্ব মেকআপ রুমটিতে টেনে নিয়ে যেতেন তাঁকে। ‘সাত পাকে বাঁধা’য় মেয়ের বাড়িতে, তার শাশুড়িকে অগ্রাহ্য করে, সিঁড়িতে গটগট করে উঠে যে দজ্জাল মা ‘টেলিফোনের লাইনটা কোথা দিয়ে যাবে’, বলে মেয়েকে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছিলেন, সিন ভাঙলে সেই মা-মেয়ের সখ্যও ছিল দেখার বিষয়। এক সময় সিনেমার ভীষণ রকম পাবলিক লাইফে অতিষ্ঠ হয়ে দু’জনেই যখন অন্তরালবাসিনী, তখনও অক্ষুণ্ণ ছিল তাঁদের যাতায়াত, ফোনালাপ। সুচিত্রার মতো ছায়া দেবীকেও অনেকে ‘গ্রেটা গার্বো’ বলতেন। আত্মপ্রচারে, ভিড়ভাট্টায় অনীহা। প্রথম থেকেই অগাধ ব্যক্তিত্ব, যা থেকে জন্মেছিল ওই সাংঘাতিক স্ক্রিন প্রেজেন্স। ভাগ্যবানেরা দেখেছিলেন তাঁর রঙ্গও। বিকাশ রায় হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘এক বার সে ক্রেনের উপর সিনেমাটোগ্রাফারের উঁচু চেয়ারে উঠে বসল। বলল, বড় ইচ্ছে, উপর থেকে সকলকে কেমন লাগে দেখি।’ বোনপো অশোককুমারও তাঁকে ধরেবেঁধে মুম্বই নিয়ে গিয়ে হিন্দি ফিল্ম করিয়েছেন। বলেছিলেন, ‘‘হাটেবাজারে’তে ছায়ার পাশে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে নার্ভাস লাগত। বয়সে ছোট, এ দিকে সম্পর্কে বড়। তার চাইতেও বড় অভিনয়ে। ভীষণ আনপ্রেডিক্টেবল, গড-গিফ্টেড।’ ছায়া দেবী অবশ্য তাঁকে দেখলেই দাঁত কিড়মিড় করতেন, ‘পাগলের ঝাড়!’

ছায়া দেবী আর ছবি বিশ্বাস। এই নিয়েই তো ছায়াছবি। ‘প্রতিশোধ’ সিনেমায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা গিয়েছিল এই দুই হুজুরের। অভিজাত চরিত্রে ছবি বিশ্বাস থাকলেই তাঁর ঘরণী ছায়া দেবী। অভিনেত্রী বলেছেন, ‘ওই টোটালিটি আর কারও মধ্যে দেখিনি।’ অথচ, ছবিবাবু এলেই ছায়া দেবী কপট রাগ দেখাতেন। ‘যে দিকে যাব, শুধু ছবি বিশ্বাস। আর যেন কেউ নেই!’ ছবিবাবুও রহস্য করে মাথায় টোকা মারতেন, ‘সবই কপাল ম্যাডাম। জীবনে কত কী করার ছিল! কিছুই হল না।’ শৈল্পিক অতৃপ্তিতে বড় মিল ছিল দু’জনের। তাঁকে ‘শিল্পী’ বললে ছায়া দেবীও রেগে কাঁই! ‘ইয়ার্কি হচ্ছে? প্রভা দেবীকে স্টেজে দেখেছ? শিশিরবাবুকে ‘সীতা’য়? আমি ও রকম পারি? অ্যাঁ?’

‘‘ভীষণ রেগে যেতেন আর একটি বিষয়ে। ঠিক বারোটায় লাঞ্চ করতেন। সে সময় পার হলে খাবেনই না,’’ বলছেন তাঁর স্নেহধন্যা মাধবী মুখোপাধ্যায়। ‘‘খাওয়াও ভারী মজার। ভাত না, শুধুই মাংস। অপূর্ব রাঁধতেন! আমার জন্য রেঁধে আনলেন ডালপুরি-আলুর দম। স্বাদ এখনও মুখে লেগে। আর সিমলে পাড়ায় তাঁর বাড়িটি। গেলে কী খুশি যে হতেন!’’

‘সুবর্ণলতা’-র লাঞ্চব্রেকে মাধবীকে ছায়া দেবী বলেছিলেন, ‘বিদ্যাপতি’র সেটের গল্প। তখন তো গ্লিসারিনের বালাই নেই। কানন দেবী বললেন, পাঁচ মিনিট দিন। তার পর চোখে জল আনলেন। দেখে ছায়া দেবীও কাঁদার জন্য পাঁচ মিনিট চাইলেন। চাইলেন বটে, কিন্তু কান্না এল না। লঙ্কাবাটা ডলবেন কি না ভাবলেন, কিন্তু তাতে চোখে জল আসবে। তা কান্না নয়।

আসলে চরিত্রে ডুব দিতে হয়। তবে আপনিই আসে হাসি, কান্না। হাসানো, কাঁদানো, রাগানো যায় দর্শককে। একই কায়ায় তৈরি হয় ‘পদিপিসি’, ‘আপনজন’-এর আনন্দময়ী বা ‘সাত পাকে বাঁধা’র মিসেস বসু। মাধবীকে মন্ত্র দিয়েছিলেন ছায়া দেবী। ‘‘অভিনয় করতে গেলে, অনুভব করতে জানতে হয়। যা ছায়াদি পারতেন।’’ কী ভাবে, কিছুটা জানেন মাধবী। ‘‘বিয়ের পর ওইটুকু মেয়েকে স্বামী বলেছিলেন, আমি অন্য এক জনকে ভালবাসি। তোমাকে মানতে পারব না। ছায়াদি কিন্তু আজীবন বিয়ে করেননি।’’ শিল্পে নিখুঁত হতে গেলে জীবনে খুঁত থাকতে হয় বোধহয়!

কত বার নাচিয়েও ছেড়েছেন মিনার বিজলী ছবিঘরকে। ‘ধনরাজ তামাং’য়ে দেশোয়ালি নাচ বা ‘চেনা অচেনা’য় সৌমিত্রের সঙ্গে তাঁর বলডান্স দেখে হুল্লোড় হলে। প্রিয় পরিচালক তপন সিংহের ‘হারমোনিয়াম’ সিনেমায় গান গাইতে নতুন করে তালিম নিলেন। ছবিতে শমিত ভঞ্জ এসেছেন বারবনিতাদের মাসি ছায়া দেবীর খাসমহলে। তাঁর ৫৪ বছরের গলায় অক্লেশে খেলছে খেমটা গানের দুরূহ কলি। ‘আহা, ছল করে জল আনতে আমি যমুনাতে যাই।’ কী ঠমক, দমক আর নিপুণ শরীরী বিভঙ্গ। আহা, মরি মরি! শ্যুটিং শেষ হতেই অভিনন্দন-উল্লাসে ভরে গিয়েছিল সেট। বলেছেন শমিত ভঞ্জ। তখনই বোঝা গিয়েছিল, সিনেমার ইতিহাস রচিত হল আজ!

‘আপনজন’-এর সেটে কে যে রবি, কে যে ছেনো— কিছুতে মনে রাখতে পারতেন না। তাঁর এই ভীষণ নাম গুলিয়ে ফেলার মজারু স্বভাবের সাক্ষী অনেকেই। ও দিকে, ‘ফয়সালা’ ছবির শ্যুটিংয়ে শমিতের ঘোড়সওয়ারি দৃশ্যের আগে, চুপি চুপি এসে তাঁকে খানিক সাবধানতার পাঠও দিয়ে গিয়েছিলেন। ‘আপনি ঘোড়া চালাতেও জানেন!’ শমিত ভঞ্জের হাঁ বন্ধ হচ্ছিল না।

কত রকমের মায়ের চরিত্রে রূপদান করেছিলেন তিনি। অথচ বাস্তব জীবনে মা হওয়ার স্বাদ পেলেন না। অবশ্য কে বলে? ঠিক ‘আপনজন’-এর চিত্রনাট্যের ঢঙেই তো আপনজন পেয়েছিলেন, সেই ষাটের দশকেই। দু’-দুটো মেয়ে। সে সময়ে তারা রুমকি-ঝুমকি নামে জলসা কাঁপাত। কোলেপিঠে বড় করেছিলেন তাদের, ভীষণ ভালবাসতেন বললেও কম বলা হয়। ছবি ছেড়ে দেওয়ার পরের জীবনটা এই পরিবারটিই আগলে রেখেছিল তাঁকে। ওদের কাছে ছায়া দেবী আবার ‘কনক’ হয়ে গেলেন।

‘‘আমরা ওঁকে এক্কেবারে কনক বলেই তো ডাকতাম। আমার জীবন শুরুই ওঁর সঙ্গে,’’ বলছিলেন দেবশ্রী রায়। ‘‘হিরণ্ময় সেনের ‘পাগল ঠাকুর’ করলাম, আমার বয়স ১১ মাস। উনি স্তোত্র বলছেন, টলতে টলতে নাচছি। আমি বালক গদাধর, উনি আমার মা। তখন থেকেই যাতায়াত ১০ নম্বর মদন ঘোষ লেনে। ওঁর বাড়িতে। ‘কুহেলি’তে আমি রাণু, উনি মানদাদি। এমনই টান! এর পর ওঁদের গঙ্গোপাধ্যায়-মুখোপাধ্যায় পরিবারে দিদির বিয়ে হতে, সত্যিই আত্মীয়তায় জুড়ে গেলাম। আমার মাকে, রামুকে (রাম মুখোপাধ্যায়) চোখে হারাতেন। সকালেই চলে যেতাম, দুপুরে ওঁর হাতে খেতাম। জ্বালাতাম, ইচ্ছে করে চটিয়ে দিতাম। খেপে যেতেন। হিহি করতাম। তখন বটুয়া থেকে পয়সা বের করে শিঙাড়া আনাতেন। এটা-ওটা তুলে বলতাম, ‘নিয়ে যাই?’ ‘হ্যাঁ, নিলেই হল!’ রামুর জন্য সোয়েটার বুনতে বুনতে বলতেন। যাওয়ার আগে ফোন করতাম। কী নিয়ে যাব? উত্তর, কালাকাঁদ। কালীপ্রতিষ্ঠা করলেন, পুজো হত। সব নিজে হাতে করতেন। এক বার মহারাষ্ট্রে গেলেন, সাংবাদিকরা ছেঁকে ধরলেন। বললেন, বেশ করেছি এসেছি। আপনার কী!’’

দেবশ্রী ব্যস্ত নায়িকা। তাই তাঁর দিদি তনুশ্রী ভট্টাচার্য, ঝুমকির সঙ্গেই বেশি সময় কেটেছে ছায়া দেবীর। তনুশ্রী বললেন, ‘‘মনটা ছিল মস্ত আকাশ। তাই মেজাজ ছিল দেখার মতো। একদিন খাটের তলা থেকে অ্যাওয়ার্ডগুলো বের করলেন। বললেন, বেচে দেব। কেউ ইন্টারভিউ নিতে এল। তাকে তাড়া করে পাড়াছাড়া করে এলেন। কিংবা সোজা আমাকেই দেখিয়ে দিলেন, এ বলবে। আশির মাঝামাঝি ওঁর অভিনয় জীবনের ৫০ বছর হল। কী হইচই! উনি একেবারে ক্যাঁক করে উঠলেন। ওরা কোত্থেকে জানল, পঞ্চাশ হল না একশো? দূর হ!

‘‘গোঁজ হয়ে বলতেন, যা! আর যাব না তোর বাড়ি। তার পর কাকে ধরে খুটখুট করে হাজির। আর আমি না গেলে কী মুখঝামটা! ফোন করে বলতেন, অ্যাই ঝুমা, খুব শরীর খারাপ, শিগগির আয়। গিয়ে দেখি খইনি ডলছেন। বললেন, মিথ্যে না বললে আসবি? একবার কে রটিয়েছে, উনি আর নেই। নীচে প্রেস, লোকারণ্য। আমি বললাম, এ বাবা! উনি উপরে ঘুমোচ্ছেন। জানতে পারলে তো কুরুক্ষেত্র!’’

দেবশ্রী হেসে কুটিপাটি, ‘‘এক বার ফোন। শিগগির আয়। সূর্য বেইমানি করেছে। আর্ট ডিরেক্টর সূর্য চট্টোপাধ্যায় ওঁকে খুব ভালবাসেন। তিনি আবার? তাও গিয়েছি। তা কনক বললেন, ওদের বাড়িতে বিয়ে ছিল। গেলুম। মেনুতে যা যা লেখা ছিল, সবই খাওয়াল। কিন্তু জানিস, আমাকে চাটনি আর পাঁপড় দেয়নি!

‘‘পুরীতে কনকের শ্যুট। রোদে অনেকটা হেঁটে চেঞ্জ করতে ফিরতে হচ্ছে। একটা বুদ্ধি করল। পরদিন কী কী সিন, কী কী চেঞ্জ সব বুঝে নিল। পরদিন যখন এসেছে, সব্বাই জিজ্ঞেস করছে, ছায়াদি, আপনাকে মোটা দেখাচ্ছে যেন। সে তো পরতে পরতে সব জামাই পরে এসেছে! আমাকে বলল, দূর! কে হাঁটে! ওখানেই চেঞ্জ করে শট দেব। বাকিদের বলল, পুরীর জলহাওয়া ভাল। খেয়েদেয়ে মোটা হয়েছি।’’

প্রায় ষাট বছরের অভিনয় জীবন তাঁর। শেষ ছবিটি দেবশ্রীরই সঙ্গে। ১৯৯৩-এ। রাম মুখোপাধ্যায়ের ‘তোমার রক্তে আমার সোহাগ’। ‘‘বলল, রামুর জন্য করছি। দাঁড়াতে পারছে না, তবু বরযাত্রীতে নাচবে। ছবির আউটডোর পড়ল হলদিয়াতে। সকাল হতেই বিখ্যাত বটুয়াটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। চানাচুরের প্যাকেট নিয়ে ফিরল। আমার রামু খাবে।’’

তনুশ্রীর গলা ধরে আসে, ‘‘২০০১-এ অ্যাটাকটা হল। ফোনে খবর এল। ভেবেছি কনকই এ বার লোককে দিয়ে ফোন করাচ্ছে। দেবশ্রী তখন ‘শিল্পান্তর’ ছবির শ্যুটিংয়ে পুরুলিয়ায়। তাঁর কনক শ্যামবাজারের এক নার্সিংহোমে ভর্তি। শ্যুটিংয়ে দেবশ্রীর মুখে র‌্যাশ বেরোল, কলকাতায় ফিরলেন দু’দিনের জন্য। আসার কথাই নয়। কিন্তু একজনের যে ডাক এসেছিল তখনই।’’ দেবশ্রীরও গলা বুজে আসে, ‘‘ভগবানই আনিয়ে দিয়েছিলেন।’’ মুখে শেষ গঙ্গাজল দিয়েছিলেন দু’বোনই।

ছায়া দেবীর ইচ্ছেয় তাঁর ভাইঝির সঙ্গেই চতুর্থীর কাজে বসেছিলেন তনুশ্রী। তখন প্রয়াণ নিয়ে কত লেখালেখি! কিন্তু কেউ দেবশ্রীকেই কিছু জিজ্ঞেস করেনি! এখন এ জন্য খারাপ লাগে। তখন শুধু কনকের স্মৃতি জড়ো করছিলেন দু’হাতে। আলমারি খুলে দিয়েছিলেন কনকের ভাইঝি ঝুমুর গঙ্গোপাধ্যায়। থরে থরে সাজানো অবর্ণনীয় সুন্দর সব শাড়ি। ভাগ করে নিয়েছিলেন কনকের দুই চোখের মণি।

‘‘এখনও যত্নে রেখেছি। যা যা দিয়ে গিয়েছেন আমাদের,’’ আস্তে আস্তে বললেন কনকের আপনজন। দেবশ্রী রায়। কালীপুজোয় দেওয়া সুতোর কাজের শাড়ি, কড়ির মালা, নাকছাবি, এমনকী টিপও। ‘‘মাঝেমাঝে পরি, মনে হয় কনককেই জড়িয়ে ধরে আছি।’’

জীবন সবচেয়ে বড় সিনেমা। ছিনিয়ে নেয়। আঘাত করে। কত রকম অভিনয় হিঁচড়ে বের করে আনে। আবার অনেক কিছু ফিরিয়ে, ভরিয়েও দেয়। গল্প হলেও সত্যি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE