বুদ্ধ ও সুজাতা: শিল্পী অজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বুদ্ধ-সুজাতা’ ছবিটিতে তথাগতের প্রশান্ত মুখাবয়ব মনোমুগ্ধকর
শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবর্তিত ওয়াশ টেকনিক ভারতীয় ছবির ক্ষেত্রে আর একটি সমান্তরাল ধারা। শিল্পী অজয় বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘদিন এই পদ্ধতিতে ছবি আঁকছেন। ওয়াশ এবং টেম্পারাতে করা বেশ কিছু সুন্দর ছবি নিয়ে গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন গ্যালারিতে তাঁর একক প্রদর্শনী হল।
ওয়াশ পদ্ধতিতে জলরঙের স্বচ্ছ কমনীয় ভাব শিল্পীর পুরাণনির্ভর কাজগুলিতে অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। ‘পূজারিনি’, ‘শ্রীচৈতন্য’ ‘বুদ্ধ-সুজাতা’ প্রভৃতি ছবিগুলি মনোমুগ্ধকর। উজ্জ্বল কমলা আভাযুক্ত চিত্রপটে সমাহিত ভাবময়তা নিয়ে মহাপ্রভু আবির্ভূত হয়েছেন। ড্রয়িং বাস্তবানুগ হলেও অবয়বগুলি একটু লম্বাটে ধরনের।
বেশির ভাগ ছবিই একক নায়িকাপ্রধান কম্পোজিশন। টেম্পারা পদ্ধতির ‘হোম টুওয়ার্ডস’ পরিচ্ছন্ন রচনাবিন্যাস, সাবলীল তুলিচালনায় উল্লেখযোগ্য কাজ।
সমস্ত চিত্রপট জুড়ে সোনালি আভায় উদ্ভাসিত তথাগতের প্রশান্ত মুখবয়বটি চোখে পড়ার মতো।
যদিও ‘দ্য ডে বিগিনস’, ‘গিফ্ট অব নেচার’ ছবিগুলিতে নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা সবুজ মাঠ, ধানজমি ইত্যাদিতে অনেক পুঙ্খানুপুঙ্খতা থাকলেও খানিকটা শিক্ষানবিশদের মতো। তুলনায় ‘পেলিং ওয়াটার ফল্স’ ছবিটি বলিষ্ঠ রচনারীতির, হালকা নীল-সবুজ-হলদে রঙের পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে খরস্রোতা নদীর নেমে আসা।
ছোট কাজ, কিন্তু এখানেও প্রকৃতির অবাধ উদারতা সুন্দর ভাবে ধরা পড়েছে।
এ রকমই আর একটি ছবি ‘ওয়ে টু নাথুলা’ তুষারাবৃত পাহাড়শ্রেণির দিগন্তের দিকে সরে যাওয়া খানিকটা ফটোগ্রাফিক হলেও বেশ। ‘কোভালাম বিচ’-এ বালির উপর গড়িয়ে আসা জল, সাদা ফেনা ইত্যাদি বোঝাতে হালকা হলদে ও বাদামি ব্যবহার বেশ মার্জিত।
টেম্পারা পদ্ধতিতে ‘লুমিং’ উপজাতির মহিলার তাঁত বোনার ছবি। তাতে ভারী বাদামি রঙের অনেকগুলি শেড এবং রেখার ব্যবহার কিন্তু বেশ একটু অন্য রকম। এ ছাড়াও প্রদর্শনীতে একক মহিলা অবয়বের অনেক ছবি ছিল, যেমন ‘মাই পেট’ ছবিটি—ছাগল কোলে নিয়ে শহুরে পেলব আধুনিকা বিষয় অনুযায়ী যদিও বেশ বেমানান।
বেঙ্গল স্কুল মানেই ললিত রেখার দৃষ্টিসুখকর ড্রয়িং নয়, পরন্তু ঐতিহ্য বলে সৃষ্টিসুখই সেখানে বরাবর প্রাধান্য পেয়েছে।
শমিতা নাগ
মনোমুগ্ধকর এক সংগীত সন্ধ্যা
ঠাকুরপুকুর সৃজন ছন্দ আয়োজিত তৃতীয় রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল বিড়লা একাডেমিতে। বৃষ্টিস্নাত বিকেলে শ্রোতাদের উপস্থিতিতে প্রেক্ষাগৃহ ছিল পূর্ণ। প্রথমার্ধে সংস্থার প্রায় ২০ জন সদস্য একক সংগীত ও আবৃত্তির মাধ্যমে দুই কবিকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এঁদের মধ্যে কয়েক জনের পরিবেশনা বেশ ভাল। এই পর্বের অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন দীপঙ্কর আচার্য। দ্বিতীয়ার্ধে মঞ্চে আসেন অনসূয়া মুখোপাধ্যায়, শ্রীকান্ত আচার্য, অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত, শুভঙ্কর ভাস্কর ও সুদেষ্ণা গঙ্গোপাধ্যায়। অনসূয়া মুখোপাধ্যায়ের ‘শ্যাম হিন্দোলা’, শুভঙ্কর ভাস্করের ‘নিশি নিঝুম’ ও সুদেষ্ণা গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মুসাফির মোছ রে আঁখিজল’ গানগুলি মুগ্ধ করে। স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত পরিবেশন করলেন একটি নজরুলগীতি ও রবীন্দ্রনাথের কথায় স্ব-সুরারোপিত গান ‘অন্ধকারের মাঝে আমায় ধরেছ দুই হাতে।’ পরিচ্ছন্ন পরিবেশনা। রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন শ্রীকান্ত আচার্য ও অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্রীকান্তর গাওয়া ‘দীপ নিভে গেছে মম’ এবং অগ্নিভর গাওয়া ‘শেষ গানেরই রেশ’ শ্রোতাদের মনকে নাড়া দেয়। বাংলা কাব্যগীতি কেবল কথা-সুর-তাল-লয় নয়—দাবি করে একটু মর্মোপলব্ধির। বলতে দ্বিধা নেই, এঁদের গান এই দাবি পূরণ করেছে। এঁদের সঙ্গে দীপঙ্কর আচার্যের সঙ্গত যথেষ্ট প্রশংসনীয়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন সুপ্রকাশ মুখোপাধ্যায় এবং পারমিতা সরকার।
কাশীনাথ রায়
নিয়মের বেড়াজাল ডিঙিয়ে
ভরতনাট্যম নৃত্যে এখনও নিজের কৃত্বিত্ব ও জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছেন অনিতা মল্লিক। সম্প্রতি নৃত্য শিক্ষালয়-যোধপুর পার্ক আয়োজন করেছিল নৃত্যানুষ্ঠান ‘ভানুমতী’। দর্শকরা উপভোগ করলেন নাটক ও নৃত্যের সমন্বয়ে একটি সুন্দর উপস্থাপনা।
নিয়মের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা... সুন্দর উপলব্ধি যেন মনকে বড় প্রশান্তি এনে দেয়।
সৃজনশীল ও ভরতনাট্যম নৃত্য আঙ্গিকে প্রতিটি নৃত্য সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করলেন নৃত্যশিল্পীরা। এবং রবীন্দ্রনৃত্যের ভাবধারাও অক্ষুণ্ণ ছিল প্রতিটি ক্ষেত্রে।
বলতে দ্বিধা নেই, শিল্পীদের অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের প্রতিফলন ঘটেছে ‘ভানুমতী’ নৃত্যনাট্যে। যাঁদের ভাবনা ও রূপায়ণে এটি বাস্তবায়িত হয়েছে তাঁরা হলেন সায়ক মিত্র, কবিতা চট্টোপাধ্যায়, অনিতা মল্লিক। আবহে সুমন সরকার, আলো সৌমেন চক্রবর্তীর। নৃত্যে অংশ নিয়েছিলেন অনিতা মল্লিক, জলসা চন্দ, কবিতা, শুভজিৎ প্রমুখ।
পলি গুহ
অনন্য উত্তরণ
দলের ভিতর থেকেই নবীন নাটককার এবং নবীন নির্দেশককে তুলে এনে আভাষ-এর নবতম প্রযোজনা ‘থিম থিম থিম’ প্রথম অভিনয় হল অ্যাকাডেমিতে। থিম-থিমের পুনরাবৃত্তিতে এমনটা অনুমানই করেছিলাম যে, নাটকের বিষয়বস্তু উৎসবপ্রিয় বাঙালির থিম-কেন্দ্রিক চিন্তাবস্তুকে আশ্রয় করে হবে। সে অনুমান হয়তো ভুল ছিল না। কিন্তু চমকে উঠলাম তখনই যখন দেখলাম নবীন নাটককার কাহিনিবস্তুকে শহর-মফস্সলের গণ্ডিতে বেঁধে না রেখে আয়লা বিধ্বস্ত সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো গভীর সমস্যাকে বিষয়ের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। যতক্ষণ এ নাটকে মফস্সলের মানুষদের কলকাতার পুজোর থিম অনুকরণের কাঙালপনা ছিল, ততক্ষণই সে ছিল হাল্কা রসের কমেডি-ফান ও কিঞ্চিৎ উইটের খানিক মোটা দাগের পরিবেশন। নাটককার সংঘমিত্রা চক্রবর্তীকে ধন্যবাদ জানাই, তিনি কমেডির হাল্কা-হাসির মনোরঞ্জন থেকে নাট্যকাহিনিকে নিয়ে গিয়েছেন আর্থ-সামাজিক সমস্যার গভীরে।
গেস্ট হাউসের মালিক সদাশিববাবু, তার ভাগনে পটল, ভৃত্য হাবলু। আর থিম পুজোর উৎপাতে কলকাতা থেকে শান্তির খোঁজে পালিয়ে মফস্সলে আসা শশাঙ্কবাবু ও তার স্ত্রী নীলিমা। তাদের ঘিরে যে হ্যাংলাপনা, হাল্কা দুষ্টুমি, হিংসুটেপনা আর ভালবাসার জমজমাট আসরে অত্যন্ত বেসুরো-রহস্য হয়ে বাজে বোর্ডার পরিতোষ শীল। আর সেই সূত্র ধরেই আসে দোলা চরিত্রটি।
ঘটনাস্রোত বদলে যায়। কমেডির আবহ থেকে দ্রুত নাট্যকাহিনি চলে যায় ট্র্যাজেডির গভীরতায়। মদন হালদারের মঞ্চ আর স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবহ প্রথমার্ধে কিছুটা স্থবির। কিন্তু নাটকের শেষ লগ্নে যখন পাগলি মেয়েটিকে পটের সামনে রেখে হাবলু মাতৃ-আরাধনার ভঙ্গিতে পুজো করে, গোটা নাটক যেন ওই একটি মাত্র দৃশ্যে এসে খুঁজে পায় এক অনন্য উত্তরণ। আলো-আবহ-মঞ্চ ও কোরিয়োগ্রাফির যেন এক অপূর্ব মন্তাজ তৈরি হয়। দিব্যেন্দু বর্ধনের নির্দেশনার হাতেখড়িও এই নাটকের মধ্য দিয়ে। অভিনয়ে দোলা চরিত্রে ঐন্দ্রিলা ঘোষকে বেশ জড়সড় মনে হয়েছে। সামগ্রিক অভিনয়ের মান বেশ সাধারণ হলেও পরিতোষের চরিত্রে দিব্যেন্দু বর্ধন, পটলের চরিত্রে অনন্যশঙ্কর ও শশাঙ্কের চরিত্রে সবিতাব্রত রায়ের অভিনয় আলাদা করে মনোযোগ দাবি করে।
মলয় রক্ষিত
অনুষ্ঠান
• সম্প্রতি উত্তম মঞ্চে সৃষ্টি পরিষদ আয়োজন করেছিল ‘প্রেমগীত-সুধারসে’ নামে একটি অনুষ্ঠানের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্বাচিত প্রেমের ও নববসন্তের গান পরিবেশন করেন এষা মিত্র, শ্রাবণী চট্টোপাধ্যায়, দেবশ্রী নন্দী, উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দ্রজিৎ মুখোপাধ্যায়, শুভাশিস মজুমদার।
• জ্ঞান মঞ্চে কবিতার ক্লাস আয়োজন করেছিল একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের। প্রথমার্ধে সংস্থার ছাত্রছাত্রীরা পরিবেশন করেন ‘এই শহর এই সময়’। দ্বিতীয়ার্ধে কবিতা পাঠে ছিলেন রাজা। যন্ত্রানুষঙ্গে আশিস ঘোষ, অরুণাভ কবিরাজ।
• সম্প্রতি গিরিশ মঞ্চে ভ্রমরা আয়োজন করেছিল লোক উৎসবের। ঝুমুর ও গোয়ালপরীয়া লোকগীতে অনুষ্ঠানসন্ধ্যা মুখরিত হয়েছিল। অংশগ্রহণ করেছিলেন রতন কাঁহার, দেবব্রত দে, অমিতাভ মুহুরী, নিমাই অধিকারী, সুশান্ত কর, মানস দে, শুভঙ্কর রায়, সৃজা রায় প্রমুখ।
• জি ডি বিড়লা সভাঘরে পারম্পরিক আয়োজন করেছিল একটি সংগীত উৎসবের। অনুষ্ঠানটিতে অংশগ্রহণ করেন মহেন্দ্র টোকে, দেবাশিস ভট্টাচার্য, বিদুষী মঞ্জুষা কুলকার্নি পাতিল, তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার, স্বপন চৌধুরী, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
• তৃপ্তি মিত্র সভাঘরে উত্তরপাড়া ব্রাত্যজন মঞ্চস্থ করল নাটক ‘তোতাকাহিনি’। নাটকটি লিখেছেন জহর দাশগুপ্ত। নির্দেশনা দেন কৃষ্ণেন্দু দেওয়ানজি।
• রামমোহন লাইব্রেরি হলে আনন্দধারা নিবেদন করেছিল ব্রহ্ম সংগীতানুষ্ঠানের। সংগীত পরিবেশন করেন সমীর দাস, অব্যয় চট্টোপাধ্যায়, নন্দিনী ভট্টাচার্য, রিনা দোলন বন্দ্যোপাধ্যায়, সীমা ঘোষ, কাবেরী বাগ প্রমুখ। যন্ত্রসংগীতে অমিতাভ সাহা, প্রশান্ত রায়চৌধুরী, তনুশ্রী চট্টোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন অম্বালিকা পালচৌধুরী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy