Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

স্ট্রোক মানেই সব শেষ নয়

রিহ্যাবিলিটেশন ফিরিয়ে আনতে পারে স্বাভাবিক কর্মক্ষম। বলছেন ডা. মৌলিমাধব ঘটক রিহ্যাবিলিটেশন ফিরিয়ে আনতে পারে স্বাভাবিক কর্মক্ষম। বলছেন ডা. মৌলিমাধব ঘটক। যোগাযোগ-৯০৫১৬০৩৪৩১

শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

অফিসে কাজ করতে করতেই হঠাৎ মাথা ঝিমঝিম। পরে এলিয়ে পরলেন অমলেশ। ডান হাত-পা অসাড়, মুখে কথা নেই, অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছেন শুধু। রোগটা যে স্ট্রোক-ই তাতে কোনও সন্দেহ রইল না। সঙ্গে সঙ্গে হাতপাতাল। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর পাড়ার ফিজিওথেরাপিস্ট সকাল-বিকাল থেরাপি করে যেতে লাগলেন। কিন্তু দু’বছর পরও পা টেনে চলার উন্নতি হল না। ডান হাতের কার্যকারিতা সেই যে কমে গেল, তো কমেই গেল।

প্র: স্ট্রোক সেরে যাওয়ার পর ফিজিওথেরাপি করাই তো যথেষ্ট। রিহ্যাব মানে তো সেটাই, তাই না?

উ: স্ট্রোকের পর হাত-পা একেবারে এলিয়ে পড়ে। তাকে সেই অবস্থা থেকে তুলে এনে পেশির জোর বাড়ানো ও হাত-পা যাতে শক্ত হয়ে তার কার্যকারিতা বাড়ানো হয় ফিজিওথেরাপি করে। এটা রিহ্যাব প্রোগ্রামের একটা অংশ মাত্র।

প্র: স্ট্রোকের পর হাত-পায়ের জোর বাড়ানোই তো প্রধান কাজ। বাকি সব তো হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরা বলে দেন।

উ: না, স্ট্রোকের আপৎকালীন চিকিৎসা হয় হাসপাতালে, স্নায়ু বিশেষজ্ঞ ও তাঁর সহযোগীদের তত্ত্বাবধানে। তাঁরা কিছু ওষুধ ও নির্দেশ দেন। পরবর্তী স্ট্রোক ঠেকানোর জন্য সে সব মেনে চলতে হয়। কিন্তু রোগীকে স্বাভাবিক ও কর্মময় জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পুরোপুরি থাকে স্ট্রোক রিহ্যাবিলিটেশন টিমের হাতে। সে কাজ শুধু হাত ও পা-কে সচল করলেই মিটে যায় না।

প্র: আর কী করতে হয়?

উ: স্ট্রোক রিহ্যাবিলিটেশন করেন এমন ফিজিকাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞজের সঙ্গে যোগাযোগ করা। তিনি পরীক্ষা করে রিহ্যাব প্ল্যান তৈরি করেন।

প্র: প্ল্যান কী একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম?

উ: অবশ্যই। কার পরিস্থিতি কতটা জটিল, সঙ্গে হাইপ্রেশার-সুগার জাতীয় সমস্যা আছে কি না, রোগীর বয়স ও সাধারণ স্বাস্থ্য কী রকম ইত্যাদির উপর নির্ভর করে রিহ্যাব কী ভাবে হবে।

প্র: রিহ্যাব ব্যাপারটা কী বলুন তো?

উ: স্ট্রোকের ফলে ব্রেনের কিছু কোষ মরে যায়। ফলে তাদের নির্দেশে শরীরের যে যে কাজ চলত, সেখানে ব্যাঘাত আসে। সেই ব্যাঘাত দূর করা হয় রিহ্যাব প্রোগ্রামে। মৃত কোষেদের চারপাশে যে সমস্ত ঘুমন্ত কোষ থাকে তাদের জাগিয়ে তুলে, ট্রেনিং দিয়ে কর্মক্ষম করা হয়। প্রথম ৪০ দিন এরা দ্রুত জাগতে থাকে, কাজ শেখার হারও খুব চটপট হয়। তারপর গতি কিছুটা কমে গেলেও ৩-৬ মাস পর্যন্ত বেশ ভাল কাজ হয়। রিহ্যাব ঠিক ভাবে চালিয়ে গেলে ৬ মাস থেকে এক বছর, কখনও দু’বছর পর্যন্ত তাদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করা যায়। এবং এরাই ধীরে ধীরে শরীরকে সচল ও স্বাভাবিক করে তোলে।

প্র: কী ভাবে জাগানো হয়? ওষুধে?

উ: মূলত ট্রেনিং দিয়ে।

প্র: কী রকম?

উ: ধরুন ডান হাত অবশ। ফিজিওথেরাপিতে অবশ ভাব একটু একটু করে কাটলেও হাত দিয়ে কিছু করতে গেলে বাঁ হাত আগে এগিয়ে যায়। তখন করা হয় কনস্ট্রেইন্ট ইনডিউজড মুভমেন্ট থেরাপি। এতে বাঁ হাত বেঁধে দেওয়া হয়। তার পর থেরাপিস্টের নির্দেশমতো ডান হাতকে চালনা করা শুরু করলে ব্রেনের যে সমস্ত কোষ এই কাজটা নিয়ন্ত্রণ করে, তারা জেগে উঠতে থাকে। ব্রেনের যে সমস্ত কোষ এই কাজটা নিয়ন্ত্রণ করে, তারা জেগে উঠতে থাকে। ফলে এক সময় থেরাপিস্টের সাহায্য ও নির্দেশ ছাড়াই সচল হয় ডান হাত।

প্র: আর পায়ের অবশ ভাব কাটাতে? সেটা স্বাভাবিক করা যায়?

উ: নিশ্চয়ই। রিফ্লেক্স ইনহিবিটিভ ট্রেনিং ও টাস্ক স্পেসিফিক ট্রেনিং দিলে কাজ হয়।

প্র: এ তো জটিল ব্যাপার-স্যাপার।

উ: একদম জটিল নয়। হাঁটু ভাঁজ করে সঠিক পদ্ধতিতে হাঁটতে শেখানো। প্রথম দিকে থেরাপিস্টের নির্দেশমতো চলতে চলতে এক সময় ব্রেন সঠিক শিক্ষাটা পেয়ে যায়। কাজ শেষ।

প্র: সঠিক শিক্ষা বলছেন কেন? বেঠিক কিছু আছে নাকি?

উ: আছে তো। ওই যে হাঁটু না মুড়ে পা টেনে চলা। দিনের পর দিন এটা চালিয়ে গেলে ব্রেনের মধ্যে ভুল শিক্ষা ঢুকে যায়। আর এক বার ঢুকে গেলে তাকে পাল্টানো প্রায় অসম্ভব কাজ।

মনে সাহস আনা জরুরি


এমারজেন্সি কেটে যাওয়ার পরই রিহ্যাব শুরু করা দরকার।


৫-১০ দিনে হাসপাতাল থেকে ছুটির পর রিহ্যাব সেন্টারে ভর্তি হয়ে যান।


শরীরকে যতটা সম্ভব সচল রাখুন।


টেনশন করবেন না, সময়ের সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে। কাজেই রোগীকে সাহস যোগান।


অ্যান্টিঅক্সিজেন যুক্ত সুষম খাবার খেলে চটপট কর্মক্ষম হওয়া যায়। রঙিন শাক-সবজি-ফল, মাছ, ডিম রাখুন খাদ্য তালিকায়।


একেবারে বেশি খেতে না পারলে অল্প করে বারে বারে খান। পেটে অস্বস্তি থাকলে নিজে থেকে খাওয়া না কমিয়ে ডাক্তারকে জানান।


শুকনো ফল ও বাদাম অল্প করে খান।

প্র: ওষুধ দিয়ে কিছু করা যায় না।?

উ: এ ক্ষেত্রে যায় না। তবে হাত-পা চালনা করার ক্ষেত্রে বোটক্স ইনজেকশনের কিছু ভূমিকা আছে। পেশিকে কিছুটা ঢিলে করে দেয়। তখন ট্রেনিং ও অর্থোসিসের সাহায্যে হাত বা পা-কে কার্যকর করে তোলা যায়।

প্র: অর্থোসিস! সে আবার কী জিনিস?

উ: ধরুন হাতের পাতা ও আঙুল কুঁকড়ে মুঠোমতো হয়ে থাকছে, তখন ককআপ স্প্লিন্ট পরিয়ে আঙুল ও কব্জিকে সোজা করে রাখা হয়। বা পায়ের পাতা ঝুলে থাকছে, যাকে বলে ফুট ড্রপ, তখন অ্যাঙ্কেল ফুট অর্থোসিস পরাতে হয়, এ রকম আর কী।

প্র: তার মানে তো এটাই দাঁড়ালো যে হাত-পায়ের শক্তি ও কার্যকারিতা ফিরিয়ে আনার নামই রিহ্যাব।

উ: না, সেটা অনেক কাজের মধ্যে একটা কাজ। ফিজিওথেরাপি ও অকুপেশনাল থেরাপি করে এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। তার পাশাপাশি কথার জড়তা কাটাতে, সঠিক ভাবে কথা বলা শেখাতে করা হয় স্পিচ থেরাপি। চিন্তাভাবনার স্তরে গোলমাল হয়ে গেলে প্রয়োজন হয় সাইকো-কগনিট থেরাপির। পুষ্টিবিদ দেখভাল করেন খাওয়া-দাওয়ার দিকটা। কোষ্ঠকাঠিন্য ও ইউরিনের সমস্যা সামলান চিকিৎসক। প্রেশার-সুগার-কোলেস্টেরল বা হার্টের সমস্যা থাকলে ওষুধপত্র দিতে হয়। পুরো ব্যাপারটা হয় রিহ্যাব বিশেষজ্ঞের পরিকল্পনা মতো।

প্র: এ তো রাজসূয় যজ্ঞ! বাড়িতে এত সব করা যাবে?

উ: না, রিহ্যাব সেন্টারে ১৫ দিন থেকে মাস দুয়েক ভর্তি থাকতে হবে। তার পর সপ্তাহে ৩-৪ দিন বাড়ি থেকে যাতাযাত করে করা যেতে পারে।

প্র: কত দিন?

উ: মোটামুটি ৩-৬ মাস।

প্র: বাড়ির লোকেরা শিখে নিয়ে করাতে পারবেন না?

উ: পারবেন। তবে প্রথম দিকে নয়। কারণ প্রথম অবস্থায় সেন্টারে দিনে দুটো করে সেশন চলে। সকাল ১০টা থেকে ১টা। বিকেলে আবার দু’আড়াই ঘণ্টা। তা ছাড়া সপ্তাহে সপ্তাহে রিহ্যাব-এর প্ল্যান বদলায়। রোগী, তাঁর বাড়ির একজন ও থেরাপিস্টের উপস্থিতিতে রিহ্যাব বিশেষজ্ঞ রোগীর অবস্থা, কতদিনে উন্নতি সম্ভব, নতুন প্ল্যান ইত্যাদি সব কিছু নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেন। এই পর্যায়ে আত্মীয়রা ধীরে ধীরে বুঝে যান কী করতে হবে। বাড়ি যাওয়ার পর তাঁরা কিছুটা করাতে পারেন।

প্র: রিহ্যাব সেন্টার মানে তো বিরাট খরচাসাপেক্ষ ব্যাপার।

উ: রোগী যতটা কর্মক্ষম হয়ে ওঠেন, সেই তুলনায় খরচ বেশি নয়।

সাক্ষাৎকার: সুজাতা মুখোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Stroke
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE