Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

হিন্দুস্তানি শুনলেই ওঁরা মেহমান মানেন

ওয়াঘার ও পারে এমন ছবি ভূরি ভূরি। ফাওয়াদ খানের বিদায়, কী সীমান্তের রক্তারক্তির মধ্যে দাঁড়িয়েও পাকিস্তানের অলিগলিতে দেখা বহু মায়াতুর স্মৃতিতে ফিরলেন অনিলাভ চট্টোপাধ্যায় ।করাচির ওই সাজানো ড্রয়িং রুমটায় তখন জমাট কিছুটা নিস্তব্ধতা। নিচু গলায় একটু পর মুখ খুললেন বাড়ির মালিক। ‘রিনা আর আমার বিয়েটা ভাঙত না জানেন। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল। মেয়ে হল আমাদের। খুব আনন্দে কাটছিল।

গ্রাফিক্স: শেখর রায়

গ্রাফিক্স: শেখর রায়

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

করাচির ওই সাজানো ড্রয়িং রুমটায় তখন জমাট কিছুটা নিস্তব্ধতা।

নিচু গলায় একটু পর মুখ খুললেন বাড়ির মালিক।—

‘‘রিনা আর আমার বিয়েটা ভাঙত না জানেন। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল। মেয়ে হল আমাদের। খুব আনন্দে কাটছিল।

আমার সিনেমা রিলিজ হল। কিন্তু শিবসেনা তার পরই ঝামেলা শুরু করল। আমাকে ইন্ডিয়াতে থাকতে দেওয়া যাবে না। মু্ম্বই ছাড়তে হল।

পাকিস্তান ফিরে এলাম। রিনার সঙ্গে দূরত্ব বাড়়ল। আস্তে আস্তে মানসিক দূরত্বও বাড়তে লাগল। বিয়েটা তার পর আর বেশি দিন টেকেনি। মুম্বই আর করাচির মাঝের ব্যবধানটা আর ঘোচাতে পারিনি আমরা,’’ একটানা অনেকটা বলে থামলেন মহসিন খান।

বহু পুরোনো একটা স্মৃতি, জীবনের একটা অধ্যায়কে টেনে বের করে আনার কষ্টটা চোখেমুখে। তারই মাঝে আমাকে ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছেন।

সাক্ষাৎকারের সময়টা ২০০৪।

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতীয় ক্রিকেট দল গেছে পাকিস্তানে সৌহার্দ্য সিরিজ খেলতে।

আর আমরা সাংবাদিককুল গেছি পাকিস্তান সফরের খবর তুলে ধরতে। আর ক্রিকেটের পাশাপাশি চলছে পাকিস্তান দেখা।

কখনও সারারাত জেগে ঘুরছি লাহোরের ফুড স্ট্রিট। কখনও পেশোয়ারের রাস্তায় কাওয়ায় চুমুক দিচ্ছি। কিংবা কখনও হানা দিয়েছি মুলতানে চটির মহল্লায়।

মহসিন খানের পাশে রিনা রায়

আর সঙ্গে ঘুরে ফেলেছি পাকিস্তানের প্রায় সব প্রখ্যাত ক্রিকেটারের বাড়ি। হানিফ মহম্মদ, মুস্তাক মহম্মদ থেকে রশিদ লতিফ, সেলিম মালিক — কেউ বাদ নেই। সবারই অবারিত দ্বার।

ইন্ডিয়া থেকে আসছি শুনলে আপ্যায়নে কোনও ত্রুটি নেই। নির্বাসনে চলে যাওয়া, অবসাদে ভুগতে থাকা সেলিম মালিক, কিংবা শাহিদ আফ্রিদি, শোয়েব আখতার — সবার বাড়িতেই একই রকম উষ্ণতা, আদর আপ্যায়ন। করাচিতে মহসিন খানের বাড়ি চলে যাওয়া সে ভাবেই।

সত্তরের সেই ফ্ল্যামবয়েন্ট পাকিস্তানি ওপেনারও দেখলাম বয়সের শাসনে বেশ অন্য রকম। তবু ক্রিকেটের সব প্রশ্নে বেশ অনর্গল। থামলেন শুধু এই একটা প্রসঙ্গে। রিনা রায়।

পাকিস্তানি ক্রিকেটার আর ভারতীয় নায়িকার প্রেম, বিয়ের কাহিনি একটা সময় বলিউড ফিল্ম ম্যাগাজিনগুলোর হট টপিক ছিল। মহসিন সবটা বলে আবার থামলেন।

শেষ করার আগে শুধু বললেন, ‘‘বাল ঠাকরেই আমাদের আলাদা হতে বাধ্য করেছিল।’’

প্রায় এক যুগ পর মহসিন খানের সঙ্গে কাটানো সেদিনের সন্ধেটা মনে পড়ল ফাওয়াদ খানের খবর শুনে। সে দিনের শিবসেনার বদলে আজ মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা।

আর বাল ঠাকরে বদলে গিয়ে ভাইপো রাজ। কিন্তু দাবিটা এক। ফাওয়াদকে ভারত ছাড়তে হবে।

কর্ণ জোহরের ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’ সিনেমায় ফাওয়াদ অভিনীত দৃশ্যগুলোয় কাঁচি চালাতে হবে। কোনও রকমে মুচলেকা দিয়ে ফিল্ম রিলিজ করালেন জোহররা।

পরোয়ানাটা থাকল!

এর পর আর কোনও সিনেমায় ফাওয়াদকে নেওয়া যাবে না। এটাই এখন জাতীয়তাবাদ। এটাই এখন দেশপ্রেমের জ্বলন্ত বিবেক।

বাল ঠাকরে, রাজ ঠাকরেদের দায়টা তবু বোঝা যায়, কিন্তু অবাক লাগে যখন হোয়াটসঅ্যাপে, ফেসবুকে গোছা গোছা মেসেজ ভেসে আসে ওই একই দাবি নিয়ে, উড়িয়ে দাও, গুঁড়িয়ে দাও পকিস্তানকে।

অথচ পাকিস্তানি ক্রিকেটার, পাকিস্তানি অভিনেতা-গায়ক-শিল্পীদের প্রতি অপরিসীম ভালবাসা, শ্রদ্ধা গোটা দেশজুড়ে।

গুলাম আলি, মেহেদি হাসান, নুসরত ফতে আলি খান, ইমরান খান, ওয়াসিম আক্রমদের কোনও সময় কি আমরা পাকিস্তানি দাঁড়িপাল্লায় মেপেছি!

আর বিশ্বাস করুন, এই শ্রদ্ধা-ভালবাসাটা শুধু ওয়াঘার এ পারে নয়, ও পারেও একই রকম জীবন্ত।

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে পাকিস্তানি জনগণ ইনজামাম উল হকের চেয়ে কম শ্রদ্ধা দেখিয়েছে, এ রকম অভিযোগ খোদ সৌরভও বোধহয় কোনও দিন করতে পারবেন না।

২০০৪-২০০৬, দুটো বছর ভারতীয় ক্রিকেট টিমের সঙ্গে প্রায় চারটে মাস পাকিস্তানে কাটিয়েছি আমরা ভারতীয় সাংবাদিককুল। কিন্তু কোথাও একদিনের জন্য মনে হয়নি দেশের বাইরে আছি। বরং সর্বত্রই ওই একটাই অভ্যর্থনা —

‘আপ ইন্ডিয়ান হ্যায়, ভাই হ্যায়, মেহেমান হ্যায়।’

এই অভি়জ্ঞতাটা আমাদের সবার। ভূরি ভূরি। রেস্তোরাঁয় খেয়েছি, পয়সা নিতে চাননি মালিক। মেডিসিন শপে বিল মেটাতে চেয়েছি, শুনেছি ওই একই কথা, ‘আপ ভাই হ্যায়, মেহেমান হ্যায়।’

লাহোরে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের অফিসে দেখা হয়ে গেল রেশমাজির সঙ্গে। ফেরার টিকিট করাতে গেছি এয়ারলাইন্স অফিসে। দেখি মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে এক প্রবীণা আমাদের সামনে ঘোরাঘুরি করছেন।

সঙ্গী সাংবাদিক দীনেশ চোপড়া দিল্লির লোক। ওই প্রথম আবিষ্কার করল, ‘দাদা, দেখো রেশমাজি।’ তার পর এয়ারলাইন্স অফিসেই বসে শুনলাম ওঁর গান, ‘লম্বি জুদাই...!’

যত বার বলছি, তত বার গাইলেন।

পরে জেনেছি, দীর্ঘ দিন ধরে গলার ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। হ্যাঁ, তখনও। কিন্তু কে বলবে!

গল্প শোনাচ্ছিলেন ছোটবেলার।

বাবা অবিভক্ত ভারতে উটে সওয়ারি চাপিয়ে মরুভূমি পার করতেন। দেশভাগের পর গোটা পরিবার বিকানির থেকে করাচি চলে আসে। কিন্তু ভারত মানেই রেশমাজির কাছে যেন বাড়তি আবেগ।

বেশ মনে আছে, সে দিনও বলেছিলেন, ‘‘আমি তো সব সময় বলি, ইন্ডিয়া আর পাকিস্তান আমার দুটো চোখের দুটো তারার মতো। আমি তো ইন্ডিয়ার মেয়ে। বড় হয়েছি পাকিস্তানে। দুটোই আমার দেশ।’’

দুটোই আমার দেশ — এই যন্ত্রণা নিয়ে দুই দেশে বেঁচে আছেন কয়েক হাজার মানুষ!

২০০৪-য়ে ভারত থেকে ওয়াঘা পার করে যখন মৈত্রী বাস লাহোর পৌঁছল, সেখানে হাজির ছিলাম।

বাস থেকে যাঁরা নামছিলেন, তাঁদের চোখে জল। লাহোরের রাস্তার মাটি হাতে নিয়ে তাঁরা কাঁদছেন। এ মাটি তো তাঁদেরও মাটি।

কলকাতা থেকে কসমেটিক সার্জন ডা. মনোজ খন্না তাঁর মাকে নিয়ে লাহোর গেছিলেন সে সময়। মায়ের বাড়ি ছিল লাহোর।

একবুক আবেগ নিয়ে সে সব পুরোনো বাড়ি, মহল্লা আর দিনগুলো খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন ওঁরা।

আবার ২০০৫-এ যখন পাকিস্তান ভারতে এল, সৌহার্দ্য বাস এসে থেমেছিল চণ্ডীগড়ে। সেক্টর ১৬ মার্কেটে সে দিনও হাজির ছিলাম, মনে আছে বেশ।

চারদিকটায় যেন উৎসব চলছে মনে হচ্ছিল। ওঁরা গাইছেন, ওঁরা নাচছেন দেশে ফেরার আনন্দে। ক্রিকেটের কার্নিভাল ওঁদের নিজের মাটিতে ফেরার সুযোগ করে দিয়েছিল।

২০০৪ সিরিজেই একদিন শুনলাম, ইমরান খান পার্টি দিচ্ছেন। ইসলামাবাদে। ভারতীয় ও পাকিস্তানি ক্রিকেটার সবাই থাকবেন। কিন্তু কোথায় নৈশভোজ কেউই বলতে পারছে না।

শেষ অবধি বিস্তর খোঁজাখুঁজি করে, এক সিকিউরিটি অফিসারের সাহায্যে পৌঁছলাম গন্তব্যে।

ইমরানেরই এক বন্ধুর বাড়ি। সেখানেই পার্টি দিচ্ছেন ইমরান। নিশ্চিত ছিলাম, বাড়ির গেট অবধি পৌঁছতে পারলে পার্টিতেও ঢুকতে পারব। কারণ তখন অবধি অভিজ্ঞতা কিংবা বিশ্বাস দুটোই বেশ জোরালো যে, পাকিস্তানি কোনও পরিবার ভারতীয় কাউকে বাড়ির গেট থেকে ফেরাবে না।

তা-ই হল।

বাড়তি সুবিধা পেলাম, ইমরানের বন্ধুর স্ত্রীর আবার লখনউয়ে বাড়ি। ওঁদের আতিথেয়তায় ভিতরে ঢুকে দেখি, একেবারে চাঁদের হাট। সৌরভ, ইরফান থেকে ভারতীয় দলের অনেকেই হাজির। সঙ্গে গোটা পাকিস্তান টিম। আর কত কত ম্যাজিকাল মোমেন্টস!

কোথাও বাড়ির লনে মোমবাতির আলোয় শোয়েব আখতারকে গ্রিপ দেখাচ্ছেন ইমরান। কোথাও সৌরভের কাছে অটোগ্রাফ নিচ্ছে ইমরানের ছেলেরা। ভারতীয় অধিনায়কের সঙ্গে আলাপ সারছেন জেমাইমা খান। সফররত কোনও ক্রিকেট সাংবাদিকের কাছে এর চেয়ে ভাল কিছু হতেই পারে না। কিংবা ইমরানের শওকত খানুম হাসপাতালের অনুষ্ঠান।

২০০৪-এ লাহোরে যখন ভারতীয় দল খেলছে, তখনই শওকত খানুমের চ্যারিটি ডিনারের আয়োজন করেছিলেন ইমরান খান। মিডিয়ার প্রবেশ একেবারেই নিষেধ।

বেশ মনে আছে, এক সর্বভারতীয় চ্যানেলের স্পোর্টস এডিটরকে সবিনয় ‘না’ বলে দিলেন।

রাতে একা একাই চলে গেছি শওকত খানুমে। মনে ওই বিশ্বাস, পৌঁছতে পারলে ফেরত আসব না। অটো রিকশা যেখানে নামিয়ে দিল, সেখান থেকে প্রায় কিলোমিটার দুয়েক হাঁটতে হয়। আর মাঝে মাঝেই পুলিশের ব্যারিকেড।

কোথায় যাবেন?

প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সাংবাদিকের পরিচয়পত্র দেখালেই একগাল হেসে এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে।

এ সব করে হাসপাতালের প্রধান গেটে পৌঁছলাম। এখানে নিরাপত্তার আরও একটু কড়াকড়ি।

গেটে আটকে আছি দেখে এক ভদ্রলোক এসে আলাপ করলেন। কামরান গোরেই। লাহোরের ‘খবরে’ পত্রিকার সম্পাদক। ইমরানের খুব ঘনিষ্ঠ। কামরান ভাই নিয়ে গেলেন ইমরানের কাছে।

ইমরান বললেন, ‘‘এসে পড়েছ যখন, অনুষ্ঠানটা দেখে যাও।’’

নিজে ইন্টারভিউও দিলেন। গোটা পর্বটা দেখভাল করলেন কামরান। আলি জাফরকে প্রথম বার শুনলাম সেখানেই। আর শেষে গাইলেন দালের মেহেন্দি। পঞ্জাবি পপ আর ভাংরা বিটস মিলেমিশে একাকার।

লাহোর-চণ্ডীগড়ে আসলে তফাত নেই। মানুষগুলো এক, ভাবনাগুলো এক, নায়করা এক — অথচ আমরা সীমান্তে লড়ে যাই। আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ে একটা সফট ড্রিঙ্কস কোম্পানি গাওস্কর-ইমরানের পাশাপাশি কাঁধে হাত-রাখা এক ছবির পোস্টকার্ড রিলিজ করত।

বিশ্বাস করুন, কোনও দিন মনে হয়নি ইমরান পাকিস্তানের। কত ঘনিষ্ঠ ভাবে ওঁরা জড়িয়েও ছিলেন ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতি-মানুষজনের সঙ্গে।

এই তো কয়েক দিন আগে পরমেশ্বর গোদরেজ মারা যাওয়ার পর ইমরান খানের টুইট দেখছিলাম, ‘‘আমার জীবনের কঠিন সময়গুলোয় পাশে পেয়েছিলাম পরমেশ্বর গোদরেজকে।’’

হ্যাঁ, আত্মীয়তাটা বহু ক্ষেত্রে এমনই ছিল দুটো দেশের মানুষের মধ্যে। তা হলে এই দুটো দেশের মানুষ সীমান্তে যুদ্ধ করে কেন? কেন জঙ্গি পাঠায় অন্য দেশে?

উত্তরটা দিয়েছিলেন খাইবার পাসের এক ট্রাইবাল যুবক। ২০০৬-এ ভারতীয় ক্রিকেট দলের পিছু নিয়ে একবার খাইবার পাসে পৌঁছে গিয়েছিলাম।

প্র্যাকটিসের পর ভারতীয় দল খাইবার মিউজিয়ামে যাবে খবর ছিল। গাড়ির চালক ছিলেন স্থানীয় পাঠান।

তাঁকে বললাম, যাবেন খাইবার পাস?

তিনি রাজি।

খাইবার গেট পার করার পরই মনে হল, বড্ড ভুল হয়ে গেছে। খাইবারে সাধারণত বিদেশি পর্যটকদের প্রবেশ নিষেধ। ভারতীয়দের তো প্রশ্নই নেই।

পাহাড়ের রাস্তাটায় এক কিলোমিটার অন্তর অন্তর মিলিটারি চেকপোস্ট। ক্যামেরা আর আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি সব ঢুকিয়ে ফেলেছি গাড়ির সিটের নীচে।

পাঠান ড্রাইভার বলে দিয়েছেন, ‘‘আর্মি যদি কোনও প্রশ্ন করে, তা হলে আপনারা কথা বলবেন না। আপনাদের কথা শুনে ওঁরা বুঝে যাবে, আপনারা স্থানীয় মানুষ নন। তাই আমিই কথা বলব।’’

না, কোনও চেকপোস্টে আটকাইনি ঠিকই, কিন্তু খাইবার পয়েন্টে গিয়ে মনে হল, কাজটা সত্যিই খুব ঝুঁকির হয়ে গেছে।

দূরে দেখা যাচ্ছে আফগানিস্তান বর্ডার। আর চার পাশে মেশিনগান হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েক জন পাঠান যুবক। কালো আফগান স্যুট পরা।

ওঁরা শুনলাম স্থানীয় আদিবাসী, আফ্রিদি। শাহিদ আফ্রিদির মতো। আফ্রিদিরা প্রচণ্ড সাহসী, যোদ্ধা জাত।

শাহিদ আফ্রিদির বাড়ি গিয়ে শুনেছিলাম, তাঁর বাবার খালি হাতে দশজন ডাকাতকে ঘায়েল করার গল্প পেশোয়ারের মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

এই অঞ্চলের গ্রামগুলোকে কাবিলা বলে। সব কাবিলার নিজস্ব নিরাপত্তাবাহিনী আছে। খাইবার পাসকে গার্ড দেয় ওঁরাই। ওঁদের নিজস্ব আইনও আছে। পাকিস্তানি আইন সেখানে রীতিমতো তুচ্ছ।

এ ভাবেই এই যোদ্ধারা যুগের পর যুগ ভারতীয় ভূখণ্ডকে রক্ষা করেছে বিদেশি হানাদারি, আগ্রাসন থেকে। শক, হুন, পাঠান, মোগলরা ভারতে এসেছে, কিন্তু খাইবারের স্থানীয় এই যোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধ পার করে, তবেই।

ফেরার পথে খাইবার গেটটা দেখে অল্প সাহস এল মনে। পাশেই একদল স্থানীয় যুবক ফুটবল খেলছিলেন। তাঁদের সঙ্গে খানিকটা ফুটবল খেলে ঘনিষ্ঠতা বাড়ল।

সাহস করে নিজের পরিচয়ও দিলাম। ভারত থেকে আসা সাংবাদিক। বিশ্বাস করুন অভ্যর্থনার বহর আরও বাড়ল। আর টিভি ক্যামেরার সামনে আফ্রিদিদের প্রতিনিধি ওই যুবকের কথাগুলো এখনও কানে বাজে। ‘‘আমাদের দু’দেশের জনগণের মধ্যে কোনও রকম সমস্যা নেই। এই যুদ্ধ যুদ্ধ ভাবটা জিইয়ে রাখে দু’দেশের সরকার। কারণ এতে ওদের অনেক সুবিধা। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কেউ প্রশ্ন করবে না। শিক্ষা স্বাস্থ্য নিয়ে কেউ জানতে চাইবে না। একটাই মকসদ থাকবে, হিন্দুস্তান কো মারো। আর তোমাদের দেশে পাকিস্তান কো মারো। এ সব পলিটিশিয়ানদের তৈরি। ভোটের জন্য।’’

এই বৈরিতার পিছনে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির একটা জঘন্য দিকও আছে। ঘোর পাকিস্তান-বিরোধিতা মানে জাতীয়তাবাদের সফল বিপণন আর জাতপাতের রাজনীতিতেও সিলমোহর।

একই ছবি পাকিস্তানেও।

ক্রমাগত উস্কানি, ক্রমাগত জেহাদি ভাবনায় ভারতকে শত্রু ভাবতে শেখানো। এক দেশে মোল্লাতন্ত্রের দাপাদাপি, অন্য দেশে বানর সেনার দাপট।

এতে যা হতে পারে সেটাই হচ্ছে।

২০০৪-য়ে রাওয়ালপিন্ডিতে শেষ টেস্টের সময় গেছিলাম ডাক ইসমাইল খেল নামের এক গ্রামে। রাওয়ালপিন্ডি থেকে দূরত্ব ছিল ১৫০ কিলোমিটার।

ওদের নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্সে চেরহাট রেঞ্জে একটা পাহাড়ি গ্রাম এই ডাক ইসমাইল খেল। চার পাশে পাহা়ড়। এই গ্রামটায় গেছিলাম আমির খান খাটাকের সঙ্গে দেখা করতে।

আমির খান ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহযোদ্ধা। নেতাজিকে পায়ে হেঁটে পেশোয়ার থেকে কাবুল অবধি পৌঁছে দেন এই আমির খান।

২০০৪-য়ে যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম, তখন তাঁর বয়স ৯৬। দৃষ্টিশক্তি কমেছে। স্মৃতিশক্তিও ধূসর হচ্ছে। কিন্তু নেতাজির কথা এলেই অনর্গল।

পেশোয়ারে থাকাকালীন আমির খান খাটাকের কথা প্রথম আমায় বলেন ইন্ডিয়া টিমের সিকিউরিটি অফিসার সোহেল খান।

তিনি জানতেন, তাঁর এক বন্ধুর বাবা নেতাজিকে কাবুল পৌঁছে দিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন আমাদের কয়েক জন সাংবাদিককে।

পেশোয়ারে থাকাকালীন সুযোগ হয়নি, কিন্তু রাওয়ালপিন্ডি থেকে চলে গেছিলাম সেখানে। এমন একটা জীবন্ত ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ ছাড়া যায়!

অনেক পাহাড়, নদী, শরণার্থী শিবির পার হয়ে দাঁড়ালাম ওঁর সামনে।

৯৬ বছরের ঋজু, পাঠান শরীর। সাদা দাড়ি, মাথায় ফেজ টুপি। আমির খান খাটাক নেতাজিকে প্রথম দেখেন রামপুরা কংগ্রেসে।

নেতাজি ফরওয়ার্ড ব্লক গড়ে তোলার পর পেশোয়ারের একদল কংগ্রেসকর্মী যোগ দিয়েছিলেন সে দলে। আমির খানও যোগ দেন ফরওয়ার্ড ব্লকে।

হঠাৎই একদিন নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রেসিডেন্ট মিঁয়া আকবর শাহ ওঁকে জানান, স্টেশনে যেতে হবে।

একজন ‘মেহমান’ আসছেন, তাঁকে রিসিভ করতে হবে। ‘মেহমান’কে দেখে অবশ্য চমকে যান আমির খান।

মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি, পাঠানের ছদ্মবেশে নেতাজিকে তিনি চিনতে পারেন। প্রথমে ওঁরা নেতাজিকে তোলেন পেশোয়ারের এক বাড়িতে।

তত দিনে এলগিন রোডের বাড়ি থেকে নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য শোরগোল ফেলে দিয়েছে গোটা ভারতে।

নজরদারি বাড়ছে সর্বত্র।

শহরে নেতাজিকে রাখা ঠিক হবে না ভেবে ওঁরা নিয়ে আসেন এই ডাক ইসমাইল খেল গ্রামে। যে অতিথিনিবাসে (ওঁরা বলেন, হুজরে) নেতাজি থাকতেন, সেটাও দেখালেন আমির খান খাটাক।

কয়েক দিন ওঁর অতিথি হয়ে, নেতাজি পায়ে হেঁটে পাড়ি দেন কাবুলের দিকে। তবে নেতাজি এই গ্রামে থাকাকালীনই আমির খান আর আবদুর রশিদ নামে এক যুবক কাবুল অবধি ঘুরে এসে নেতাজির রাশিয়া যাওয়ার রুট ম্যাপ তৈরি করেন। কাবুলে নেতাজির থাকার ব্যবস্থা করে আসেন।

পরে নেতাজি যান ওঁদের সঙ্গে। পাঠানদের পোশাক, সঙ্গে মূক ও বধিরের অভিনয় করেন। যাতে পাঠান গ্রামগুলোতে কোনও ভাবে ধরা না পড়েন।

প্রায় দু’দিন হেঁটে ওঁরা জালালাবাদ পৌঁছন, তার পর বাসে চেপে কাবুল। সারা দিন হাঁটতেন, রাতে বিশ্রাম নিতেন পাঠান গ্রামগুলোতে।

আব্দুর রশিদ নেতাজির সঙ্গেই থেকে যান। আর ছিলেন ‘ভগতরামের ভাই’। এই নামটা মনে করতে পারেননি আমির খান খাটাক।

নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য বিষয়ক সমস্ত লেখালিখিতে পাই, ভগতরাম ছিলেন নেতাজির সহযোগী।

আমির খান খাটাক বলেছিলেন, নেতাজির সঙ্গী ছিলেন ভগতরামের ভাই।

তাঁর দাবি অনুযায়ী, আব্দুর রশিদ আর ‘ভগতরামের ভাই’, দু’জনেই নেতাজির সঙ্গে রাশিয়া যান।

তিনি একমাত্র ফিরে আসেন, বাড়ি থেকে অনুমতি না মেলায়।— ‘‘নেতাজি আমাকেও অনেক বার অনুরোধ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘তিনজনের মধ্যে তুমিই একমাত্র আমাদের কর্মী। তোমাকে আমার প্রয়োজন।’ তবুও বাড়ির অনুমতি না থাকায় আমি যেতে পারিনি।’’

আর এসব স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছেন আমির খান খাটাক। ইতিহাস তাঁকে মনে রাখেনি। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটা বড় মিসিং লিংক হয়ে পাকিস্তানে ছিলেন তিনি।

এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন, আদৌ জীবিত আছেন কি না — কিছুই জানা নেই। তবে একবুক যন্ত্রণা আর আফসোস নিয়ে বেঁচে ছিলেন তিনি। ‘‘এই দেশভাগের স্বাধীনতা আমরা চাইনি। এখানে স্বাধীনতা পেল তাঁরাই, যাঁরা ইংরেজদের গোলামি করেছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধ লড়েছিলাম আমরা, আর শাস্তিও পেলাম আমরা।’’

ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভারত-পাকিস্তান যখন নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ লড়ে, কী মনে হয় আপনার?

রেশমা

একটু থেমে বৃদ্ধ বলেছিলেন, ‘‘খুব খারাপ লাগে। এরা জানে না আজাদির মূল্য কী! কী ভাবে, কীসের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছিল।’’

না, আমরা সব ভুলে গেলাম। দু’দেশের রাজনৈতিক নেতারা ভুলে গেলেন, ধর্মান্ধ নেতারা ভুলে গেলেন, ভুলে গেলাম আমরাও। এখন মোবাইলে পাকিস্তান-বিরোধী মেসেজ ফরোয়ার্ড করে দেশপ্রেমের নমুনা দেখাই আমরা, কিন্তু দুটো দেশের সাধারণ মানুষের ধমনি তো একই সঙ্গে জোড়া। কোথায় কাটবেন, রক্তপাত তো হবে আপনারও। আপনারই প্রিয় কারও হৃদয়ে এমন রক্তক্ষরণ হবে, আপনি জানতেও পারবেন না।

পেশোয়ারের এক গলি, তস্য গলির মধ্যে দিলীপকুমারের বাড়িটা খুঁজে পেয়ে এ রকমই মনে হয়েছিল।

কিসসা খোয়ানি বাজারের বাড়িটা এলাকার প্রায় সবাই চেনে। দিলীপকুমারের জন্য ওঁরা গর্বিত হয়। ভারতীয় সাংবাদিক... দিলীপকুমারের বাড়ি খুঁজছি শুনে স্থানীয় কয়েক জন দল বেঁধে বাড়িটা দেখিয়ে দিলেন।

এই বাড়ির মালিক এখন খান-ফ্যামিলির কেয়ারটেকার। দোতলা কাঠের বাড়িটায় আর কেউ থাকে না। দিলীপকুমার এসেছিলেন দু’একবার। শিকড়ের টান এখনও ভুলতে পারেননি যে!

এই ব্যাপারটা অনেকটা গর্বিত করে ওঁদের। বলিউডের সাফল্য, ভারতের মাটিতে দিলীপকুমার হয়ে ওঠার বীজ যে বপন হয়েছিল ওই মাটিতেই।

পেশোয়ারেই আরও একটা বাড়িতে আকাশছোঁয়া উচ্ছ্বাস দেখেছিলাম শাহরুখ খানের জন্য। হ্যাঁ, ওটাই শাহরুখের নিজের বাড়ি। এখন ওখানে থাকেন শাহরুখের জ্যাঠতুতো বোন। ডাকনামটাই মনে আছে, মুন্নি।

শাহরুখের জ্যাঠা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। শাহরুখের বাবা যখন কলেজে পড়ছেন, তখন জ্যাঠার খোঁজে বাড়িতে বারবার পুলিশ আসত।

পুলিশি অত্যাচার যাতে অকারণে ছোট ভাইয়ের ওপরও না আসে, সে জন্য শাহরুখের বাবাকে পড়াশোনা করতে দিল্লি পাঠিয়ে দেন ওঁদের পরিবার।

সেই থেকে খান-পরিবারের এক শাখা বেড়ে উঠেছে দিল্লিতেও। খুব ছোটবেলায় শাহরুখ বাবা-মায়ের সঙ্গে পেশোয়ারে গিয়ে নিজেদের বাড়িতে কিছু দিন কাটান।

সেই স্মৃতি বেশ টাটকা মুন্নির।

অ্যালবাম ঘেঁটে বার করেছিলেন ছোটবেলার সে সব হলুদ, পুরনো ছবি। মাঝে দিল্লি গিয়ে দেখাও করে আসেন সুপারস্টার দাদার সঙ্গে।

কয়েক দশক পরে ভাইবোনের দেখা হয়!

হ্যাঁ, ওই একবারই দেখা হয়।

কারণ, ওঁরা দুই দেশের।

দাদা হিন্দুস্তানের।

বোন পাকিস্তানের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

India Pakistan Relationship
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE