Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

এক চিলতে শিল্পের মরুদ্যান ওশিয়া

প্রাচীন ওশিয়ার রমরমা আর নেই। তাতে কী! রাজস্থানের খাজুরাহোয় ১৮টি মন্দিরের পরতে পরতে হলুদ পাথরের কারুকাজ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। লিখছেন অত্রি মিত্রপ্রাচীন ওশিয়ার রমরমা আর নেই। তাতে কী! রাজস্থানের খাজুরাহোয় ১৮টি মন্দিরের পরতে পরতে হলুদ পাথরের কারুকাজ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। লিখছেন অত্রি মিত্র

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৭ ০৭:০০
Share: Save:

আমরা খাজুরাহো দেখেছি। দেখেছি রাজস্থানের মাউন্ট আবুতে অসামান্য কারুকাজের জৈন মন্দির দিলওয়ারা। এ বার চলুন ঘুরে আসি রাজস্থানের খাজুরাহোয়। মরুভূমির উপরে একচিলতে শিল্পের মরুদ্যান, ওশিয়া।

ভারতের ইতিহাসে অষ্টম শতাব্দী থেকে বারোশো শতাব্দী পর্যন্ত অবশ্য ওশিয়া একচিলতে জনপদ ছিল না। রীতিমতো জমজমাট বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল থর মরুভূমির মধ্যে অধুনা পশ্চিম রাজস্থানের ওই শহর। সে সময়ে ওশিয়ার নাম ছিল উকেশা বা উপকেশপুর। তখন রাজস্থানের মেবারে গুর্জর প্রতিহারদের রমরমা। ওই বংশেরই রাজপুত রাজা উৎপলদেব তৈরি করলেন মরুভূমির উপরে ওই শহর উপকেশপুর। ধীরে ধীরে মেবার রাজত্বের মুখ্য ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে উঠল ওশিয়া।

ধর্ম আর সংস্কৃতিকে হাতিয়ার করে ওশিয়া হয়ে উঠেছিল অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্রও। আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য এবং আরব থেকে বণিকেরা যে সে সময়ে নিয়মিত ওশিয়ায় আসতেন, তারও বিভিন্ন নিদর্শন পেয়েছেন ঐতিহাসিকেরা। বারোশো শতাব্দীর শেষের দিকে ওশিয়া আক্রমণ করেন মহম্মদ ঘুরি। তুর্কি শাসকের আক্রমণে ওশিয়া ধ্বংস হয়েছিল। জনগণ পালিয়েছিল শহর ছেড়ে। তার পর থেকেই ওই শহর ভগ্নস্তূপ।

এখন ওশিয়ায় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে শুধু দাঁড়িয়ে রয়েছে বালিপাথরের অপরূপ শিল্প নিদর্শন নিয়ে ১৮টি মন্দির। যার মধ্যে ১২টি তৈরি হয়েছে অষ্টম শতাব্দীতেই। বাকি ছ’টি বারোশো শতাব্দীর মধ্যে। জোধপুর থেকে ওশিয়ার দূরত্ব ৬৫ কিলোমিটার। গাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। যেতে পারেন বাসে কিংবা ট্রেনেও। জোধপুর শহর পেরোলেই মরুভূমির মধ্য দিয়ে ছুটে যাবে গাড়ি। ধূ-ধূ প্রান্তরের মধ্যে শুধু কাঁটাঝোপের জঙ্গল। ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যে পৌঁছে যাবেন ওশিয়ায়।

ওশিয়ার প্রধান আকর্ষণ অবশ্যই সচিয়ামাতা মন্দির এবং মহাবীর মন্দির। এ ছাড়াও একে একে দেখে নিতে পারেন সূর্য মন্দির, হরিহর মন্দিরের মতো একাধিক মন্দির।

ইতিহাস বলে, প্রতিহার রাজা বৎস ৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে জৈন ধর্মগুরু মহাবীরকে উৎসর্গ করে তৈরি করেছিলেন মহাবীর মন্দির। বলা হয়, জৈনদের অশওয়াল সম্প্রদায়ের প্রধান তীর্থক্ষেত্র এই ওশিয়ার মহাবীর মন্দির। বালিপাথরে তৈরি মূল মন্দির একটি বড় চাতালের উপরে। মূল মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে অজস্র ছোট ছোট মন্দির। মন্দির চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছোট-বড় স্তম্ভ আর ‘আর্চ’। প্রতিটি কাঠামোতেই অপূর্ব সুন্দর কারুকাজ শিল্পীরা ফুটিয়ে তুলেছেন বালিপাথরে।

মহাবীর মন্দির থেকে কিছুটা দূরেই সচিয়ামাতা মন্দির। অপূর্ব কারুকাজের অজস্র আর্চ পেরিয়ে মন্দিরে গর্ভগৃহের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। যেখানে রয়েছেন সচিয়ামাতা। কেউ কেউ বলেন, ইনি আসলে দেবরাজ ইন্দ্রের ধর্মপত্নী শচী, অশওয়ালদের কুলদেবী। সে কারণে স্থানীয়েরা এঁকে ওশিয়া মাতাজিও বলেন। শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর দিন অশওয়ালেরা নিজেদের সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হিসেবে পালন করেন। ওই দিন জমজমাট হয়ে ওঠে ওশিয়া।

তবে অন্য একটি গল্পও কথিত রয়েছে ওশিয়ায়। সচিয়ামাতা মন্দিরের মূল দেবী আসলে চামুণ্ডা মা। প্রতি বছর নবরাত্রির দিন চামুণ্ডা মাকে মোষবলি দিয়ে পুজো দেওয়া হতো। জৈন ধর্মগুরু রত্নপ্রভ সুরি আচার্য চামুণ্ডা মায়ের পুজোয় মোষবলি বন্ধ করে দেন। এতে রেগে যান দেবী। আচার্যের চোখ নষ্ট করে দেন তিনি। তাতেও আচার্যের হেলদোল নেই দেখে, চামুণ্ডা ঠিক করেন, আচার্যকে ক্ষমা করে দেবেন। তখন আচার্য দেবীকে বোঝান, মানুষের পুজোর জন্য আপনি আর এক প্রাণীর প্রাণ নিচ্ছেন! অবশেষে আচার্যের বক্তব্য মেনে নেন দেবী। তার পর থেকেই ওখানে মায়ের পুজো হয় কেশর, চন্দন আর ধূপ দিয়ে। সঙ্গে থাকে ভোগপ্রসাদ। আর চামুণ্ডা মা বলি বন্ধ করে দেওয়ায় আচার্য তাঁর নাম দেন ‘সচ্চি মাতা’।

ওশিয়ার মন্দিরের কারুকাজ আজ বিগ্রহ দেখতেই এক দিন কেটে যাবে। পরদিন দেখে নিন ওশিয়ার চারপাশের থর মরুভূমি। সোনার কেল্লায় লালমোহনবাবুর স্মৃতি উসকে এখানে করতে পারেন উট ভ্রমণ বা ‘ক্যামেল সাফারি’। মরুভূমির ধূ-ধূ বালির মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছে ট্রেন লাইন। তার পাশ দিয়েই উটে চড়ে যাওযার অভিজ্ঞতা অবশ্যই মনে রাখার মতো। তার সঙ্গে মরুভূমির সূর্যাস্ত তো আছেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE