Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ডাক্তারবাবু বাড়ি আছেন...

কাতর এই ডাকটা আজ নিস্ফল! কোথায় গেলেন সেই সব ধন্বন্তরী? অগ্রজদের স্মরণ করলেন এ কালের চিকিৎসকরা। শুনলেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়কাতর এই ডাকটা আজ নিস্ফল! কোথায় গেলেন সেই সব ধন্বন্তরী? অগ্রজদের স্মরণ করলেন এ কালের চিকিৎসকরা। শুনলেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

অলংকরণ: সুব্রত চৌধুরী

অলংকরণ: সুব্রত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

• খয়েরি রঙের অস্টিন গাড়িটা থেকে নেমে গটগট করে দোতলায় উঠে এলেন ডাক্তারবাবু।

চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। ব্যাকব্রাশ চুল। পাটভাঙা স্যুটে চুরুটের গন্ধ।

প্যান্টের পকেট থেকে স্টেথোটা উঁকি মারছে। হাতে অ্যাটাচি।

দোতলার ঘরের খাটে আধশোওয়া হয়ে রয়েছেন গৃহকর্তা। সামনে দাবার ছক সাজানো।

ডাক্তারবাবুকে দেখে তিনি চনমনে, “এসো, এসো সখা, তোমার পথ চেয়েই বসে আছি। এক দান হয়ে যাক।”

ততক্ষণে কর্তার হাত টেনে নিয়ে প্রেশার মাপতে শুরু করেছেন ডাক্তার। মুখে কপট রাগ, “বৌদি বললেন, আবার লুকিয়ে সিগারেট টানছ! কাজের লোককে দিয়ে বাইরে থেকে পাঁঠার মাংস রাঁধিয়ে, ছাদে বসে খাচ্ছ! আজ একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক। হয় এ সব বন্ধ করো নয়তো অন্য ডাক্তার খোঁজো।”

কর্তার চোখে এ বার দুষ্টুমির ঝিলিক, “ঠিক আছে বন্ধুবর। চুক্তি হোক। আমি সিগারেট ছাড়ব, যদি তুমি চুরুট ত্যাগ করো!”

• রাতের চার নম্বর কল সেরে সাইকেল চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে চক্রবেড়িয়া রোডের বাড়ি ফিরেছেন ডাক্তারবাবু।

হাত-মুখ ধুয়ে খাবার ঘরের টেবিলে সবে বসেছেন। দরজায় তুমুল কড়া নাড়ার শব্দ। পাড়ার কয়েকজন ছেলেছোকরা হাজির।

চক্রবর্তী বাড়ির মেজমা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন। নাক দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। বাড়িতে কান্নাকাটি শুরু হয়ে গিয়েছে। রাতের খাবার ফেলে বেরিয়ে গেলেন ডাক্তার। রোগীকে দেখেটেখে সুবিধে লাগল না। তাই পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করলেন। বাড়ি ফিরলেন যখন, তখন আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। সুস্থ হয়ে ফেরার পর আজীবন ডাক্তারবাবুকে ভাইফোঁটা দিয়েছিলেন মেজগিন্নি।

ডাক্তার তো নন, সাক্ষাৎ দেবতা যেন! এমন জনের সঙ্গ পাওয়াও যে কী নিশ্চিন্তি! এই নিশ্চিন্তির স্বাদ পেয়েছে ক’দশক আগের মানুষজনও। আর আজ?

কখন যেন পরিবারের একজন হয়ে যেতেন সেই সব ডাক্তারবাবু। খুনসুটি-আবদার-পরামর্শ সব চলত তাঁদের সঙ্গে।

‘শঙ্খবেলা’-র বসন্তচৌধুরী যেমন। ডাক্তারির পাশাপাশি বন্ধুর ভাঙা দাম্পত্য জুড়েছিলেন। কিংবা ‘অগ্নীশ্বর’-এর উত্তমকুমার। চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে যিনি ছিলেন পুরোদস্তুর সমাজসংস্কারক। মনে করিয়ে দিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়।

৬৪-৬৫ সালের কথা। মির্জাপুর স্ট্রিটে বেশ ভাল পসার ছিল ধীরেন ডাক্তারের।

ধীরেন চক্রবর্তী। মোটাসোটা গোলগাল চেহারা। স্পষ্ট মনে আছে ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের।

সুবীরবাবুর ভাইবোনেরা তখন ছোট ছোট। থাকতেন গোপাল মল্লিক লেনে। বাবা শিক্ষক। তিনি আবার পড়াতেন ধীরেন ডাক্তারের মেয়েদের। সেই সুবাদে সুবীরবাবুদের ন’ ভাইবোন এবং বাবা-মায়ের চিকিৎসার ভরসা ওই ধীরেনডাক্তার। পাড়ার এমবিবিএস পাশ জেনারেল ফিজিশিয়ান ধীরেনবাবুর কাছে নির্দ্বিধায় কাশি থেকে শুরু করে জন্ডিস, এমনকী স্ত্রীরোগও দেখানো যেত। সেরেও যেত।

মাঝেমধ্যেই বাড়িতে কল দেওয়া হত ধীরেনবাবুকে। বুকে স্টেথো বসিয়ে, নাড়ি দেখে, পেট-টেট টিপে, জিভে-চোখে টর্চ ফেলে ওষুধ লিখে দিতেন। লাল রঙের মিকশ্চার। শিশির গায়ে কাটা-কাটা ফালি কাগজ সাঁটা। ওটাই ওষুধ মাপার দাগ। কখনও গুঁড়ো কি গোটা ওষুধে মোড়া সাদা পুরিয়া। ধীরেনবাবুর চেম্বারে দু’জন কম্পাউন্ডারবাবু। প্রেসক্রিপশন দেখে তাঁরাই ওষুধ তৈরি করে দিতেন। মার্কামারা লাল ওষুধ-সাদা পুরিয়া তো ছিলই, আর থাকত মুখে মুখে বলে দেওয়া বাঘা-বাঘা সব পথ্য। বার্লি-সাগু-কাঁচকলা সেদ্ধ-ভিজে চিঁড়ে...।

স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আশির দশকের একেবারে প্রথম দিকে জামশেদপুরের জমানো প্র্যাকটিস ছেড়ে উত্তর কলকাতায় চলে আসেন ডা. বিষ্ণুপদ মুখোপাধ্যায়। থাকতেন বেলগাছিয়ায়। চেম্বার করেছিলেন শ্যামবাজারে ড্রিমল্যান্ড নার্সিংহোমের কাছে।

বিষ্ণু ডাক্তারের (কেউ ডাকতেন বিষ্টুডাক্তার) চেম্বার শুরু হত রাত দশটায়। চলত ভোর আড়াইটে-তিনটে অবধি।

গভীর রাতে রোগী দেখার পিছনে দু’টো যুক্তি ছিল তাঁর। এক, রাতে মানুষের তাড়া থাকে না। সময় নিয়ে সবার সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে হাল্কা মেজাজে রোগ পরীক্ষা করা যায়! দ্বিতীয়ত, খেটে খাওয়া গরিবগুর্বোর এক দিনের কাজ কামাই করে ডাক্তার দেখাতে আসতে হয় না।

দিনের বেলা ডাক্তারবাবু থাকতেন লেখালেখি নিয়ে। আর পাড়া বেড়িয়ে এর-তার খোঁজখবর নেওয়া তো ছিলই। আবার প্রায়ই দেখা যেত তাঁর সাইকেলের রডে বসে পাড়ার কোনও এক বাচ্চা দিব্যি হাওয়া খেতে বেরিয়েছে!

আরও খানিকটা পিছিয়ে যাই। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি। চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় তখন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। তাঁদের এক শিক্ষক, যোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সাদা কোট পরে কালো গাড়িতে চেপে কাঁটায়-কাঁটায় সকাল সাড়ে আটটায় হাসপাতালে ঢুকতেন। থাকতেন বেলা তিনটে পর্যন্ত। মাঝখানে শুধু একটা মিষ্টি খেতেন আর বাকি সময়টা চলত ওয়ার্ডে চর্কির মতো পাক খাওয়া। বেডে-বেডে প্রত্যেক রোগীর কাছে গিয়ে আলাদা করে কথা বলা, নাড়ি ধরে পরীক্ষা করা। সন্ধে থেকে রাত ছিল তাঁর প্রাইভেট প্র্যাকটিস। কিন্তু যত রাতই হোক, চেম্বার থেকে বাড়ি ফেরার পথে হাসপাতালে একটা রাউন্ড দিয়ে যাওয়া চাই-ই।

এ কালের চোখের চিকিৎসক হিমাদ্রী দত্তের মনে পড়ে যাচ্ছিল ছোটবেলার পাড়ার ডাক্তারকাকুকে। পুরো নামটা জানা হয়নি কখনও। সবাই ডাকত পিকে ভট্টাচার্য।

টালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের উপরে মাঝারি মাপের ঘরে তাঁর চেম্বার। মাঝখানে ডাক্তারবাবুর চেয়ার-টেবিল। একটু তফাতে ডানদিক-বাঁদিকে দেওয়াল ঘেঁষে রোগীদের বসার জায়গা। যে রোগীর নাম ধরে ডাকা হবে, তিনি উঠে এসে ডাক্তারবাবুর ডান দিকে রাখা চেয়ারে বসবেন।

প্রায় সবাই পরিচিত রোগী। দেখাতে-দেখাতেই সুখদুঃখের বিনিময় চলত। অপেক্ষায় থাকা রোগীরা তাতে যে বিরক্ত হতেন, তাও না। বরং কথার মাঝে তাঁরাও যোগ দিতেন প্রায়ই।

একটা মরিস গাড়ি ছিল ডাক্তারবাবুর। কিন্তু ‘কল’ এলে গাড়ি নয়, সাইকেলে চড়ে, মাথায় শোলার টুপি পরে রোগী-বাড়ি যেতেন।

হিমাদ্রীবাবুর মনে আছে, একবার পাড়ার এক বন্ধুর ঠাকুমা গুরুতর অসুস্থ হলেন। বাড়ির লোকেদের সঙ্গে সারারাত তাঁর মাথার পাশে জেগে বসেছিলেন ডাক্তারবাবু। অনেক চেষ্টা করেও সে দিন ফি পর্যন্ত নেওয়ানো যায়নি তাঁকে।

ডা. ব্যোমকেশ ভট্টাচার্য। ছাপ্পান্ন-সাতান্ন বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর চেহারাটা এখনও চোখের সামনে ভাসে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সুপার, কার্ডিওথোরাসিক সার্জন সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর।

ওয়ার্ডে একটা নিচু কাঠের স্টুল হাতে ব্যোমকেশবাবু ঘুরছেন। এক-এক জন রোগীর পাশে স্টুল পেতে জমিয়ে বসছেন। বলছেন, “ও কত্তা, গ্রাম কোথায়? বদরপুর? ও, ওখানে তো গিয়েছিলাম এক বার। ঢোকার মুখে ঝঁকড়া গাছটা এখনও আছে নাকি?”

সবটাই বানানো, রোগীকে কাছে টানার ছল মাত্র। কোন গ্রামে আর ঝাঁকড়া গাছ নেই? কিন্তু রোগী ওইটুকুতেই অভিভূত। বড় ডাক্তারবাবু, তাঁর সঙ্গে বসে গল্প করছেন, এতেই তিনি অর্ধেক সুস্থ।

কলকাতা ছাড়িয়ে গাঁ-গঞ্জে ঢুকলে গল্প কখনও’বা আরও মধুর।

বীরভূমের গঞ্জ করিধ্যা। এই করিধ্যা থেকে প্রায় দু’কিলোমিটার দূরে নগরী নামের এক গ্রামে ছোটবেলা কেটেছে গ্যাসট্রোএন্ট্রোলজিস্ট ডা. অভিজিৎ চৌধুরীর। তাঁর কাছেই শ্যাম ডাক্তারের গল্প শোনা।

দালানবাড়ির চওড়া বারান্দা জুড়ে রোগীরা বসে। মাঝখানে চেয়ারে ডাক্তার শ্যামচাঁদ রায়।

ষাটের দশকের শেষ ভাগ। শ্যাম ডাক্তার এমবিবিএস নন। তখনকার দিনে এলএমএস নামে একটা ডাক্তারির কোর্স ছিল। তিনি সেই গোত্রের।

তাঁর রোগীরা বেশিরভাগ-ই ফি দিতে পারতেন না। তা নিয়ে ডাক্তারবাবুর ভ্রুক্ষেপ নেই। সকাল, দুপুর, রাত তিনি এ পাড়া-ও পাড়া ছুটতেন। কখনও সাইকেলে, কখনও রিকশায়, কখনও বা হেঁটে হেঁটেই।

সাদা খাটো ধুতি। হাফ ফতুয়া। গলায় স্টেথোস্কোপ। সঙ্গে কালো ঢাউস একটা ব্যাগ নিয়ে কম্পাউন্ডারবাবু।

ওষুধের দাম হালখাতার সময় একসঙ্গে দিলেও চলত। ওই দিন ডাক্তারবাবু সবাইকে ঠান্ডা কমলা রঙের শরবত খাওয়াতেন।

শীতল ডাক্তারের গল্প বলছিলেন তাঁর ছাত্র বক্ষ চিকিৎসক পার্থসারথি ভট্টাচার্য।

মরণাপন্ন রোগীকে বাঁচানোর পর বাড়ির মেয়েরা মাথার চুল দিয়ে পা মুছিয়ে দিতে চেয়েছেন এমন অভিজ্ঞতাও নাকি রয়েছে শীতলবাবুর।

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। শিমলা, দিল্লি, কলকাতা ঘুরে শেষে বর্ধমানের কাটোয়ার কাছে শ্রীখণ্ড গ্রামে পাকাপাকি ডাক্তারি করতে গিয়েছেন শীতল বন্দ্যোপাধ্যায়।

আচমকা এক রাতে সেখানে দু’দলের মধ্যে সংঘর্য লাগে আর কী! সবার হাতে হাতে বন্দুক। ছোরাছুরি। গ্রামের সীমানার বড় মাঠে মারমুখী দু’পক্ষ সামনাসামনি। পুলিশ পালিয়েছে। নেতারাও উস্কে দিয়ে হাওয়া।

শেষে প্রবীণ কয়েকজন মরিয়া হয়ে ডেকে আনলেন ডাক্তারবাবুকে। দু’পক্ষের মাঝে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। বন্দুকবাজদের লালচোখ নিমেষে সাদা। ডাক্তারবাবুর কথা ফেলতে পারলেন না কেউই। ফিরে গেলেন তাঁরা।

পঁচাশি পার করে এখনও গ্রামেই থাকেন শীতলবাবু। ডাক্তারি করেন। কয়েক বছর আগে গ্রামের লোক প্রায় মিছিল করে এলেন বাড়িতে। সঙ্গে বিশাল বিশাল তিন-চারটে মরণাপন্ন হনুমান।

কী ভাবে যেন খাবারে বিষক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে গ্রামের রাস্তায় পড়েছিল। নিজের বিছানায় শুইয়ে তাঁদের স্যালাইন দিতে শুরু করলেন শীতল ডাক্তার। নিজের হাতে খাওয়ালেন।

এক সপ্তাহ লাগল তাদের সুস্থ করতে। তার পর একে-একে তারা ঝোপজঙ্গলে চলে গেল। কিন্তু আবার এল এবং আসতেই থাকল। এখনও হনুমানের পাল নিয়ম করে আসে শীতল ডাক্তারের বাড়ি। চুপ করে ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে খানিক বসে থাকে, হাত থেকে খাবার খায়, তার পর চলে যায়!

তাদেরও যে কখন আত্মার আত্মীয় হয়ে পড়েছেন ডাক্তার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar patrika doctor parijat bandyopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE