নব্য-ভারতীয় ঘরানার সূচনাবিন্দু বলে ধরা যায় ১৮৯৭ সালকে, যখন অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রাধাকৃষ্ণ’ চিত্রমালার ছবিগুলো আঁকেন। আধুনিকতার একটি দেশজ ঐতিহ্যগত উত্সের সন্ধান ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। এর আগে ১৮৫০-এর দশক থেকে ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত আর্ট স্কুলে ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতার রীতিতে চিত্রশিক্ষা দেওয়া হচ্ছিল। সেখানে প্রশিক্ষিত হয়ে অন্নদাপ্রসাদ বাগচি, বামাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, শশিকুমার হেশ প্রমুখ শিল্পী যে বিদেশি স্বাভাবিকতাবাদী চিত্রধারা তৈরি করেছিলেন আধুনিকতার প্রথম পর্যায় হিসেবে, সেই আঙ্গিকের সমান্তরালে আধুনিকতার একটি ঐতিহ্যগত উত্সের সন্ধান ছিল অবনীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য। সেই সূচনা থেকে পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের কাজের মধ্য দিয়ে নব্য-ভারতীয় ঘরানা নানা শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়েছে। আমাদের আধুনিকতায় এটিই একমাত্র সংগঠিত আন্দোলন, যেখানে ঐতিহ্যগত আঙ্গিক নিয়ে বিস্তীর্ণ গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছিল। নন্দলাল বসুর ঔপনিবেশিকতা-বিরোধিতা এই ঘরানাকে এক শীর্ষ থেকে অন্য শীর্ষে নিয়ে গেছে।
১৯৩০-এর দশক থেকে আমাদের চিত্রকলা নব্য-ভারতীয় ঘরানার গণ্ডিকে ছাপিয়ে আরও নানা দিগন্তের সন্ধান করেছে। কিন্তু এই ঐতিহ্যগত আঙ্গিকের প্রাসঙ্গিকতা কখনওই নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এমনকী এই একবিংশ শতকেও, যখন উত্তর-আধুনিকতা ও বিশ্বায়নের হাওয়ায় ‘বিকল্প-রূপকল্প’-ই সমকালীন শিল্পীদের প্রধান গবেষণার বিষয়, তখনও ঐতিহ্যগত আঙ্গিক নিয়ে খুবই নিষ্ঠাভরে কাজ করেছেন বহু শিল্পী। সেই কাজের ধারাকে অনুধাবন করতেই আকৃতি গ্যালারি আয়োজন করেছিল একটি ওয়েবসাইট প্রদর্শনী, ‘ইনডিজেনাস আইডেন্টিটি’। ২১ জন শিল্পী আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। প্রত্যেকের দুটি করে ছবি ছিল। শিল্পীরা হলেন: শান্তিরঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, অমলনাথ চাকলাদার, অজয়কুমার ঘোষ, শুক্তিশুভ্রা প্রধান, সৌমিত্র কর, বিশ্বপতি মাইতি, ধীরেন শাসমল, নিত্য কুণ্ডু, অর্পিতা বসু, নীলিমা দত্ত, অজয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমেন খামরুই, রতন আচার্য, স্বপ্না সেন, দীপ্তি চক্রবর্তী, বিশ্বজিত্ সাহা, গৌতম বসু, অসিত মণ্ডল, দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও চন্দ্রশেখর আচার্য।
নব্য-ভারতীয় ঘরানা সূচনা পর্বে গ্রহণ করেছিল ভারতীয় ধ্রুপদী ও মধ্যযুগীয় দরবারি অণুচিত্রের আঙ্গিক থেকে। ১৯৩০ থেকে এর ভিতর দেশীয় লৌকিক আত্তীকৃত হতে থাকে। পরবর্তী কালে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আঙ্গিকের নানা সারাত্সারও গ্রহণ করেন অনেক শিল্পী।
প্রবীণ শিল্পী শান্তিরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের ‘ইলিশ বরণ’ ছবিটি খুবই অভিনব। পূর্ব-বাংলার একটি লোকাচারকে স্মরণ করে তিনি এঁকেছেন জোড়া ইলিশ বরণ করে নেওয়ার একটি মাঙ্গলিক দৃশ্য। রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় লৌকিক আঙ্গিকের নিবিষ্ট অনুধ্যানে এঁকেছেন মূষিক সহ গণপতির রূপকল্প। নীলিমা দত্ত ও অজয় ঘোষের ছবিতে লক্ষ করা যায় ধ্রুপদী উত্সের সুচারু ব্যবহার। অমলনাথ চাকলাদার ধ্রুপদী রীতিকেই অন্য উত্সের সম্মিলনে রূপান্তরিত করে নিয়েছেন তাঁর ‘এক্সট্যাসি’ ও ‘ফ্লাইট অব সোয়ানস্’ ছবিদুটিতে। ধ্রুপদী রীতিকেই সামান্য পরিবর্তিত করে নিত্য কুণ্ডু তাঁর নিজস্ব এক রূপরীতি তৈরি করেছেন। লৌকিক উত্সের খুবই সরল ও মন্ময় প্রকাশ দেখা যায় স্বপ্না সেনের টেম্পারায় আঁকা ‘টুসু পূজা’ ও ‘ছট পূজা’ শীর্ষক ছবিদুটিতে। লৌকিক উত্সব বাংলার গ্রামীণ জীবনে আজও কত প্রাসঙ্গিক তাঁর ছবিদুটি দেখলে বোঝা যায়। অর্পিতা বসু ‘ড্রিম’ ছবিটিতে বাস্তবের নিসর্গকে কল্পরূপে উদ্ভাসিত করেছেন।
নব্য-ভারতীয় ধারার সনাতন আঙ্গিক-পদ্ধতি পাল্টেছে। অনেক শিল্পীর কাজেই পরিবর্তনের পরিচয় পাওয়া যায়। চন্দ্রশেখর আচার্যের ‘লেডি অ্যান্ড টাইগার’ অনেক আধুনিক মননে ঋদ্ধ। গৌতম বসু এঁকেছেন ‘ক্রোধ’ শিরোনামে একটি কুকুরের চিত্কারের ছবি। তিনিও নব্য-ভারতীয় ঘরানার প্রচলিত আঙ্গিককে অনেকটাই প্রসারিত করে নিয়েছেন। সৌমিত্র কর কতগুলি লৌকিক ‘আইকন’ সাজিয়ে আধুনিকতার ভিতর চিরন্তনতার ছোঁয়া এনেছেন। বিশ্বপতি মাইতি, অসিত মণ্ডল, বিশ্বজিত্ সাহা, সৌমেন খামরুই তাঁদের রূপারোপে নব্য-ভারতীয় ধারাকে অনেকটা প্রসারিত করেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy