সম্প্রতি ‘সোসাইটি অব কন্টেম্পোরারি আর্টিস্টস’ দলের ৫৪-তম বার্ষিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল বিড়লা অ্যাকাডেমিতে। দলের সঙ্গে যুক্ত ২১জন শিল্পী অংশ নিয়েছেন। ১৯৬০-এ দল প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলের সঙ্গে রয়েছেন এ রকম কয়েক জন শিল্পী যেমন রয়েছেন এই প্রদর্শনীতে, তেমনই অংশগ্রহণ করেছেন বেশ কয়েক জন তরুণ শিল্পী, যাঁরা বিগত দু’এক বছরের মধ্যে দলে যোগ দিয়েছেন। ২১ জনের মধ্যে চার জন ভাস্কর।
১৯৬০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীদের মধ্যে এই প্রদর্শনীতে ছিলেন সনৎ কর, সুহাস রায়, বি.আর.পানেসর, দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়, গণেশ হালুই, সুনীল দাস, মনু পারেখ ও নিরঞ্জন প্রধান। সনৎ কর প্রতিষ্ঠাতা-সদস্যদের অন্যতম। প্রদর্শনীতে তাঁর দুটি ছবি ছিল বোর্ডের উপর টেম্পারায় আঁকা। সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের উপর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়েছে। ‘এ কমেন্ট অন টর্চার অন উওম্যান’ শীর্ষক ছবিটিতে একটি হাঁসকে আক্রমণ করেছে একটি সাপ। এচিং-মাধ্যমের বুনোটকে অসামান্য দক্ষতা ও ঋদ্ধতায় তিনি এনেছেন টেম্পারা মাধ্যমে। সুনীল দাস তাঁর দুটি প্রায় বিমূর্ত ছবির মাধ্যমকে বলেছেন ‘পেনোগ্রাফি’। ‘এমবস’ পদ্ধতিতে সাদা পুরু বোর্ডের উপর ছাপ তুলেছেন। তারপর কালি-কলমের রেখায় প্রতিমাকল্প সম্পূর্ণ করেছেন। বি.আর.পানেসর ক্যানভাসের উপর অ্যাক্রিলিকের চারটি রচনায় এঁকেছেন নিজস্ব রীতির শূন্যতাদীর্ণ নিসর্গ। ‘ক্রিয়েশন’ শিরোনামে নিরঞ্জন প্রধানের কাঠের ভাস্কর্যটিতে দণ্ডায়মান নারীর অবয়ব বিমূর্তায়িত হয়ে ‘গ্রটেস্ক’ বা কল্পরূপাত্মক এক আবহ তৈরি করেছে। প্যাস্টেলে করা লালুপ্রসাদ সাউ-এর মাছের রূপায়ণটির সারল্যময় উপস্থাপনা ঐতিহ্যদীপ্ত আঙ্গিকের স্নিগ্ধ দৃষ্টান্ত।
১৯৭০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীদের মধ্যে এই প্রদর্শনীতে একমাত্র ছিলেন বিশিষ্ট ভাস্কর মানিক তালুকদার। ব্রোঞ্জ ও মিশ্রমাধ্যমে তাঁর তিনটি ভাস্কর্য ছিল। ‘উইংস’ শীর্ষক রচনাটিতে উড্ডীয়মানতার প্রতীকে মানুষের নিজেকে অতিক্রম করার অভীপ্সা ব্যক্ত হয়েছে।
১৯৮০-র দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন আদিত্য বসাক, মনোজ দত্ত, মনোজ মিত্র, বিমল কুণ্ডু ও সুনীল কুমার দাস। আদিত্য বসাকের বোর্ডের উপর মিশ্র মাধ্যমে আঁকা দুটি ছবির শিরোনাম ‘ক্রাউড’। পুঞ্জীভূত মানুষ এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। নিজস্ব কোনও চরিত্র নেই তাঁদের। অসংজ্ঞায়িত যন্ত্রণায় দ্রবীভূত হয়ে আত্মপরিচয়হীন হয়ে যাচ্ছে তাঁরা। আজকের সন্ত্রাসদীর্ণ নির্মম সময়কে এভাবেই প্রতীকায়িত করেছেন শিল্পী। মনোজ দত্ত বোর্ডের উপর টেম্পারায় এঁকেছেন তিনটি ছবি। তিনটি ছবিতেই বাঘ এসেছে বিশেষ এক চরিত্র হয়ে। ‘হাঙ্গার’ শীর্ষক রচনাটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। একটি মনুষ্যমুণ্ডকে গ্রাস করতে যাচ্ছে ব্যাঘ্রটি। ঐতিহ্যদীপ্ত আঙ্গিকের ভিতর দিয়েই সন্ত্রাসকে আভাসিত করেছেন শিল্পী। ‘প্লেয়ার’ শিরোনামে তিনটি মিশ্রমাধ্যমে সার্কাসের বানর নিয়ে কৌতুকদীপ্ত ছবি করেছেন মনোজ মিত্র। বিমল কুণ্ডুর তিনটি ভাস্কর্যের মধ্যে ‘উডস্’ শীর্ষক ধাতব রচনাটি বনানীর সৌন্দর্যকে কল্পনাদীপ্ত ভাবে রূপায়িত করেছে। সুনীল কুমার দাস পাথর ও ধাতুর সমন্বয়ে গড়েছেন তিনটি পশুর রূপায়ণ।
নব্বইয়ের শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন প্রদীপ মৈত্র ও অতীন বসাক। পাঁচটি জলরঙের নিসর্গ-রচনায় প্রদীপ বিশেষ অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। অতীনের তিনটি ছবি এচিং-মাধ্যমে তাঁর দক্ষতার পরিচয় বহন করে। তিনি কাজ করেছেন শৈশব নিয়ে।
পরবর্তী প্রজন্মের তরুণ শিল্পীদের মধ্যে অতনু ভট্টাচার্যের ১৪ ফুট বিস্তারের ক্যানভাসের উপর অ্যাক্রিলিকের বিমূর্ত রচনাটি বিশেষভাবে স্পর্শ করে। লালের অন্তহীন বিস্তারের মধ্যে হঠাৎই ঝলসে ওঠে কালোর অপরিকল্পিত বিচ্ছুরণ। পার্থ দাশগুপ্ত সিরামিকসে করেছেন ভাস্কযধর্মী ন’টি দণ্ডায়মান বিমূর্ত রচনা। বিমূর্ততার মধ্যেও তাতে রয়েছে ক্লিষ্ট মনুষ্য-অস্তিত্বের আভাস। সোসাইটিতে নতুন যোগ দিয়েছেন শ্রীকান্ত পাল ও রাজেন মণ্ডল। কাঠ-খোদাই মাধ্যমে দুজনেই অসামান্য কাজ করেছেন। শ্রীকান্তের ‘নিও-গডিজম’ শীর্ষক কাঠ-খোদাই ও অ্যাক্রিলিকের রচনাটি এই প্রদর্শনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজের দৃষ্টান্ত। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মূর্তিকে উপস্থাপিত করেছেন ব্রহ্মার প্রতীকে। মহাজাগতিক সৃষ্টি ও ধ্বংসের প্রতীকী আভাস এনেছেন। রাজেনের দুটি সুদক্ষ উড-কাট রচনার শিরোনাম ‘দ্য পাওয়ার’ ও ‘বুলশিট’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy