Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

রক্তেই ছিল আত্মবিরোধের উপাদান

এক-এক জন মানুষ সামাজিক আদলের সরলরেখা থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজের মধ্যে কত সহজেই নানা রকম অভিমুখ তৈরি করে ফেলেন। এক দিক থেকে দেখলে মনে হয় স্ববিরোধ, অলোকরঞ্জন যাকে বলেন ‘দ্বৈতাদ্বৈতের টানাপোড়েন’, কিন্তু কাছে গিয়ে তাঁকে ছুঁয়ে দেখলে মনে হয়, তা নয়, এ যেন একই কেন্দ্র থেকে বহুমাত্রিক এক বিস্তার নানা পথ খনন করেছে নিজের জন্য।

জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র (১৯১১ - ১৯৭৭)

জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র (১৯১১ - ১৯৭৭)

পবিত্র সরকার
শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

এক-এক জন মানুষ সামাজিক আদলের সরলরেখা থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজের মধ্যে কত সহজেই নানা রকম অভিমুখ তৈরি করে ফেলেন। এক দিক থেকে দেখলে মনে হয় স্ববিরোধ, অলোকরঞ্জন যাকে বলেন ‘দ্বৈতাদ্বৈতের টানাপোড়েন’, কিন্তু কাছে গিয়ে তাঁকে ছুঁয়ে দেখলে মনে হয়, তা নয়, এ যেন একই কেন্দ্র থেকে বহুমাত্রিক এক বিস্তার নানা পথ খনন করেছে নিজের জন্য। জমিদারপুত্র, কিন্তু সে জমিদার নিজেই সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ছিলেন, ফলে আত্মবিরোধের উপাদান জ্যোতিরিন্দ্রের রক্তের মধ্যেই ছিল, শ্রীরামপুরের রাজার এই ভাগিনেয়ের ‘জনতার মুখরিত সখ্যে’ এসে বামপন্থী হওয়া তাই যেন সহজ এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। আনখশির কবি আর শিল্পী এই মানুষটি বি এসসি পাশ করলেন কেন, কেন তার পরে ইংরেজি সাহিত্যে স্পেশাল অনার্স আর এম এ করে নিলেন, সেও এক বিরোধ-নির্বাচনের আখ্যান। যাঁরা তাঁকে দেখেছে, তাঁদের কাছে মানুষটিকে মোটেই আত্মদীর্ণ ও চৌচির ব্যক্তি বলে মনে হয়নি।

বরং রগুড়ে আর হুল্লোড়ে, প্রাণ ও সৃষ্টিতে সর্বদা টগবগ করছেন, এমন মানুষ ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র (১৯১১-১৯৭৭)। ‘বটুকদা’— এই অন্তরঙ্গ নামে তাঁকে ডাকবে এমন প্রজন্মও প্রায় অবলুপ্তির কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। মৃত্যু হয়েছে আঠাশ বছরের মতো, শতবর্ষ পার হয়ে গেলেন তিনি— তাও আজ তিন-চার বছর হল। নিশ্চয়ই এ গ্রন্থটি তাঁর বা তাঁর শতবর্ষের একমাত্র স্মারক হবে না, এই আশা করতে গিয়ে একটু থমকে ভাবি, আমাদের বয়সের মানুষদের কাছে— এককালে সমাজ-পরিবর্তনের স্বপ্ন-দেখা মানুষ, শম্ভু মিত্রের কণ্ঠে ‘মধুবংশীর গলি’ শুনে বিহ্বল হওয়া মানুষ, ‘নবজীবনের গান’ শুনে উজ্জীবিত হওয়া মানুষ, দিল্লিতে রামলীলা দেখে মুগ্ধ হওয়া মানুষ, সত্যজিতের ‘রবীন্দ্রনাথ’-এর সংগীত পরিচালনায় অভিভূত হওয়া মানুষ, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের নিজের কণ্ঠে ইমনকল্যাণের আলাপ শুনে স্তব্ধ থাকা মানুষ, পরস্পরের গলা-জড়ানো এবং কোনও-এক প্রাঙ্গণে নৃত্যপর দুই বন্ধু বটুক আর বিজন ভট্টাচার্যের শিথিলমন্থর অগ্রগতি দেখা মানুষ, একটি মাত্র ৭৮ আবর্তনের রেকর্ডে ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে’ আর ‘এ ভারতে নিত্য রাখো প্রভু’ শুনে সচকিত হওয়া মানুষ— তাঁদের অনেকে এখন আর নেই, যাঁরা আছেন, তাঁরাও আর খুব বেশিদিন নেই। অর্থাৎ, যে স্মৃতিগুলি নানা খণ্ডে মানুষ জ্যোতিরিন্দ্রকে ধরে রেখেছে, কিংবা জ্যোতিরিন্দ্রের বহুবিধ খণ্ডকে যে স্মৃতিগুলি কোনও না কোনও ভাবে সংহতি দিতে পারত, সেই স্মৃতিগুলিও একে একে মুছে যাচ্ছে। তা হলে কী বাকি থাকবে? শুধু এই স্মারক-গ্রন্থ?

যাপিত জীবন আর তার ইতিহাসের মধ্যে সংগতি-সাধনের এই এক সমস্যা— জীবনের প্রবল বর্ণাঢ্যতা লুকিয়ে পড়ে কোথাও, তা অনেক সময় পরের প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের তথ্যমাত্র হয়ে পড়ে, সে তথ্য থেকে ওই জীবনটাকে পুনর্নির্মাণ করা সহজ নয়, শুধু জীবনভাষ্য পাঠের মধ্যে নতুন পাঠক সে মানুষটির মহিমা প্রায় কিছুই ধরতে পারে না। তবু রক্ষা যে, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের কবিতার সংগ্রহ আছে, তাঁর গানের ধ্বনিমুদ্রা, দুর্লভ হলেও প্রস্তুত আছে, আছে গণনাট্যের সেই অবিশ্বাস্য উন্মোচক সংগীত— ‘এসো মুক্ত করো, মুক্ত করো, অন্ধকারের এই দ্বার’— যা গণনাট্যের চৌহদ্দি পেরিয়ে অনেক দূরে দূরে বিস্তারিত হয়। এ সবের মধ্যে এখনও জ্যোতিরিন্দ্রকে ধরা যায়।

আর এই স্মারক-গ্রন্থটি যেন ওই কাজটিকেই আরও সমর্থন আর সচ্ছলতা দেওয়ার জন্য তৈরি থাকে। ওই যে মানুষটির কথা বলি, তাঁর সজীব স্মৃতি উঠে আসে অশোক মিত্র, খালেদ চৌধুরি, প্রীতি বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রসূন দাশগুপ্ত, শর্মিলা রায় পোমোর লেখায়। অলোকরঞ্জনের কথিকাটি সংক্ষিপ্ত স্মৃতিসূত্র নিয়ে বটুকদার সৃষ্টি ও মনোজগৎকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছে, পাঠক তার দ্বারা আকৃষ্ট হবেন, তাঁর অনুমান-অ্যাডভেঞ্চারে হয়তো কিছুটা প্রশ্নতাড়িতও হবেন। অলোকরঞ্জনের হায়দরাবাদের স্মৃতিও তাঁর প্রতি পুরোপুরি বিশ্বস্ত থাকেনি, কারণ ‘বিশ্বভারতী পত্রিকা’ গানটি হায়দরাবাদে অবস্থানকালীন বন্ধু বিজন ভট্টাচার্যের অনুরোধে তাৎক্ষণিক ভাবে তৈরি হয়নি— তা তৈরি হয়েছিল বহুরূপীর একটি অভিনয়ান্তিক ট্রেনযাত্রায়, অনেক বছর আগে, সম্ভবত ‘বিশ্বভারতী পত্রিকা’র প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা প্রকাশের দিনই। হায়দরাবাদ তো ঘটল ১৯৬৭-তে। কিন্তু অন্য যাঁরা স্মৃতিচারণ করেছেন, তাঁদের স্মৃতি গায়ক ও সুরস্রষ্টা জ্যোতিরিন্দ্রে বড় বেশি জারিত। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ গায়ক, সংগীতশিক্ষক ও সুরস্রষ্টা জ্যোতিরিন্দ্র অনেক বেশি বর্ণাঢ্য। গান গাওয়া বা সৃষ্টির আবেগ তাঁর আচরণ ও অভিব্যক্তিকে যে প্রবল আকর্ষণ দিত, কবিতার পাঠ বা নির্মাণ সেই পারফরম্যান্স বা অভিকরণ ডেকে আনে না। তাই এ সংকলনে গানের উপর আছে অন্তত চারটি প্রবন্ধ— চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়, পদ্মনাভ দাশগুপ্ত, দেবেশ রায় এবং সুভাষ চৌধুরির। প্রত্যেকটিই বিষয়নিষ্ঠ ও সুভাবিত। শুধু চঞ্চলকুমারের লেখাটি (‘বাংলা গানের সমস্যা’), ইতিহাস-বিশ্লেষণে মূল্যবান হলেও, সাক্ষাৎ ভাবে জ্যোতিরিন্দ্রের সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত নয়, ‘নবজীবনের গান’-এর প্রথম প্রকাশের উপলক্ষসূত্রে রচিত। গান থেকে কবিতাকে পৃথক করে নিলে বলতে হয়— তেমন প্রবন্ধ একটিই। মনে হয় জ্যোতিরিন্দ্রের কবিতার কথা এখানে একটু পার্শ্বিকতা লাভ করেছে। অবশ্যই অলোকরঞ্জন-কৃত তাঁর কবিতার একটি সমৃদ্ধ সংকলন, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচিত অগ্রন্থিত কবিতা ও গান কবি জ্যোতিরিন্দ্রকে আমাদের সানুরাগ মনোযোগের সামনে হাজির রাখে এবং অরুণ সেনের প্রবন্ধটি সে দিক থেকে তাঁর কাব্যিক সমগ্রতাকে ধরবার চেষ্টা করে।

জ্যোতিরিন্দ্রের ১২৭টি চিঠি এই সংকলনকে বিশেষ মূল্যবান করেছে। চিঠিতে ব্যক্তিমানুষটির নানা অন্তরঙ্গ বিচ্ছুরণ ঘটে এবং তাঁর ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিচয়ের একটি ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়, যা অন্যত্র পাওয়া কঠিন। পত্রপ্রাপকদের পরিচিতি এবং প্রাসঙ্গিক সূত্র অংশ দু’টি অতিশয় যত্ন নিয়ে রচনা করা হয়েছে, এর ফলে এ অংশটি যেন বাংলার সংস্কৃতির একটি ‘হু’জ হু’ বা প্রমুখ-চরিত হয়ে উঠেছে। জ্যোতিরিন্দ্রের পারিবারিক ও নানা উপলক্ষে তোলা ছবিগুলিও সংকলনকে আরও কাঙ্ক্ষণীয় করে তুলেছে। তাঁর গ্রন্থপঞ্জি, হাতের লেখা আর আঁকিবুঁকির দু’টি পাতার মুদ্রিত রূপের জন্যও আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।

জ্যোতিরিন্দ্রের জীবনপঞ্জি রচনায় সম্পাদকেরা শ্রমসাধ্য পথটিই বেছে নিয়েছেন। অন্যদের স্মৃতিচারণ থেকে, কখনও কবিতা ব্যবহার করে, জ্যোতিরিন্দ্রের জন্ম থেকে প্রয়াণ পর্যন্ত সমস্ত উল্লেখযোগ্য কীর্তি ও ঘটনা তাঁরা গ্রন্থনা করে দিয়েছেন। শুষ্ক জীবনপঞ্জির থেকে তার আস্বাদ অন্য রকম দাঁড়িয়েছে। একটি অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন: এই অংশে ‘জগদীন্দ্র’ বানানটি কি নামীর নিজের বানান? শেষে সিদ্ধেশ্বর সেনের এই ছত্রগুলি এখনও আলোড়িত করে—

দুরাত পেরিয়ে আসে
করমন্ডল এক্সপ্রেসে
এসো-মুক্ত-করো...
ক্রিমেটারিয়ামে
আমাদের বুক কেঁপে যায়

যেমন সে খুলে দেয় আরও নাকি হিরণ্ময়
ঢাকা,
আশি শৈশবের পাখা ছুঁই ছুঁই করা রাবীন্দ্রিক
এখনি অন্ধ বন্ধ করেছ,
জ্বালো, অন্তিম, উজ্জ্বল
অগ্নির স্পর্শ, দাহ...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE