Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

বিস্মৃতি থেকে পুনরাবিষ্কার

বাঙালির ইতিহাস নেই। থাকলে ভবানীপুরে ইন্দিরা সিনেমার রাস্তাটাকে ইন্দ্র রায় রোড নাম দিয়েই সে কর্তব্য সারত না। ইন্দ্রলাল রায়ের জীবনী এতদিনে স্কুলপাঠ্য হয়ে উঠত।

ফর কিং অ্যান্ড অ্যানাদার কান্ট্রি/ ইন্ডিয়ান সোলজার্স অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট ১৯১৪-১৮, শ্রাবণী বসু। ব্লুমসবেরি, ৫৯৯.০০

ফর কিং অ্যান্ড অ্যানাদার কান্ট্রি/ ইন্ডিয়ান সোলজার্স অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট ১৯১৪-১৮, শ্রাবণী বসু। ব্লুমসবেরি, ৫৯৯.০০

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

বাঙালির ইতিহাস নেই। থাকলে ভবানীপুরে ইন্দিরা সিনেমার রাস্তাটাকে ইন্দ্র রায় রোড নাম দিয়েই সে কর্তব্য সারত না। ইন্দ্রলাল রায়ের জীবনী এতদিনে স্কুলপাঠ্য হয়ে উঠত।

বিশ শতকের শুরুতে ইন্দ্রলালের বাবা কলকাতা হাইকোর্টের নাম-করা আইনজীবী। মা ছেলেমেয়েদের নিয়ে লন্ডনে থাকেন। ইন্দ্রর শখ আকাশে ওড়ার। সময়টা প্রথম মহাযুদ্ধের। তখনও ভারতীয়দের উড়ানযুদ্ধে নিতে চায় না ব্রিটিশরা। তাদের ধারণা, বিমানযুদ্ধের প্রযুক্তি ভারতীয়দের কব্জা করা মুশকিল।

কিন্তু ইন্দ্রের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল। ১৮ বছর বয়সেই বাঙালি কিশোর হয়ে গেল রয়্যাল ফ্লাইং কোরের সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট। সিঙ্গল সিটার ‘সপউইথ ক্যামেল’ বিমান নিয়ে আকাশে উড়ে যেত ইন্দ্র, সেখানে ফিট করা রয়েছে মেশিনগান। দশ দিনে ৯টা জার্মান যুদ্ধবিমানকে গুলি করে নামায় সে।

২২ জুলাই, ১৯১৮। সে দিনও ফ্রান্সের আকাশে উড়ছিল ইন্দ্র। আচমকা পিছন থেকে চারটে জার্মান ফাইটার উড়ে এসে মাঝ-আকাশে ঘিরে ফেলল তাকে। ইন্দ্র এক বার নামে, তারা ওপরে উঠে যায়। আকাশে ঘুরতে ঘুরতেই দুটো জার্মান বিমানকে নিকেশ করে দিল ইন্দ্র, কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। তার বিমানের ট্যাঙ্কে গুলি লেগেছে, দাউদাউ করে জ্বলতে জ্বলতে মাটিতে আছড়ে পড়ে সেটি। মৃত্যুর বিনিময়ে আকাশযুদ্ধে প্রথম বীরত্বের সম্মান বা ‘ফ্লাইং ক্রস’ পাওয়া ভারতীয়: ২০ বছরের ইন্দ্রলাল রায়।

স্বীকৃতি এখানেই শেষ নয়। কিশোর ইন্দ্রলালের বিমান যেখানে আছড়ে পড়েছিল, তিন দিন পরে আকাশে উড়তে উড়তে বিমান থেকে সেই জায়গাটায় পুষ্পস্তবক ছুড়ে দেন জার্মান বায়ুসেনানী ম্যানফ্রেড ফন রিখটোফেন। শত্রুপক্ষের এই বাঙালি বীরকে কুর্নিশ না জানিয়ে পারেননি তিনি। আজও ফ্রান্সে ইন্দ্রলালের সমাধিতে ফরাসি ও বাংলা দুই ভাষায় খোদাই-করা: ‘মহাবীরের সমাধি। সম্ভ্রম দেখাও, স্পর্শ কোরো না।’ শ্রাবণী বসু তাঁর ফর কিং অ্যান্ড অ্যানাদার কান্ট্রি-তে অবশ্য বলেননি, ভবিষ্যতে ইন্দ্র রায়ের ভাগ্নেই বায়ুসেনার প্রথম ভারতীয় প্রধান: এয়ারমার্শাল সুব্রত মুখোপাধ্যায়। এখানে অবশ্য তার সুযোগও ছিল না।

হৃষীকেশ থেকে কেদার, বদ্রীর বাস রাস্তায় টিহরি গঢ়বালের ছোট্ট শহর: চাম্বা। এপ্রিল মাসে এখনও সেখানে গব্বর সিংহ নেগির মেলা বসে। উত্তরাখণ্ডের গ্রাম্য বালক গব্বর সিংহ নেগি প্রথম মহাযুদ্ধে গহঢ়বাল রেজিমেন্টের রাইফেলধারী সেনা। ফ্রান্সের নভ্ শাপেল শহরে তখন তাঁদের রেজিমেন্ট। দিনের পর দিন রোদের দেখা নেই, টানা দুই সপ্তাহ বরফগলা জল, কাদায় ভর্তি ট্রেঞ্চে রাইফেল হাতে থাকা। উড়ে আসছে জার্মান গোলা। ভারতীয় সেনানীরা নিজের বুদ্ধিতে বের করেছে ‘জ্যামপট বোম’। জ্যামের কৌটোয় বিস্ফোরক ভর্তি করে সেটা বিপক্ষের ট্রেঞ্চে ছুড়ে দেওয়া। প্রবল গোলাবর্ষণের মধ্যেও বিপক্ষের তিনটে ট্রেঞ্চ দখল হল। চতুর্থটাই আসল টার্গেট। গব্বর সিংহ নেগি এ বার বেয়নেট নিয়ে ‘জয় বদ্রী বিশাল’ চিৎকার করতে করতে ছুটল। আছড়ে পড়ছে গোলা, গব্বর এঁকেবেঁকে ট্র্যাভার্স করে ছুটছে। জার্মান ট্রেঞ্চ দখল হল ঠিকই, কিন্তু বোমায় ছিন্নভিন্ন মৃতদেহটা আর খুঁজে পাওয়া গেল না। গ্রামের বাড়িতে গব্বরের বালিকা স্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বীরত্বখেতাব... ভিক্টোরিয়া ক্রস!

শ্রাবণী বসুর বইটির প্রধান বৈশিষ্ট্য এখানেই। ১৯১৪-১৮ সালে প্রথম মহাযুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের পশ্চিম রণাঙ্গনে যে ভারতীয় সৈন্যরা গিয়েছিলেন, তাঁদের জীবন। সম্প্রতি প্রথম মহাযুদ্ধে ভারতীয় সৈনিকদের নিয়ে নানা বই বেরোচ্ছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিড ওমিসি ভারতীয় সৈনিকদের চিঠিপত্র সঙ্কলন করেছেন, অমিতাভ ঘোষ প্রায় বিস্মৃতির অতল থেকে উঠিয়ে এনেছেন তুরস্কে বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের শিশির সর্বাধিকারীর বই আভি লে বাগদাদ। শ্রাবণী তুরস্ক অবধি যাননি, পশ্চিম রণাঙ্গনই তাঁর পাখির চোখ।

ঐতিহাসিক ও লেখকদের কাছে শতবর্ষের পুরনো এই ভারতীয় সৈনিকরা গুরুত্বপূর্ণ নানা কারণে। প্রথমত, এঁরা বেশির ভাগই তৎকালীন পঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের লোক। তখনকার ইউরোপীয় সভ্যতা এঁদের ‘যোদ্ধা জাতি’ ভাবত। আরও ভাবত, এই ভারতীয় যোদ্ধারা ব্রিটিশ কম্যান্ডারদের নির্দেশ মেনে ভাল যুদ্ধ করে। কিন্তু নিজেরা সেনানায়ক হওয়ার যোগ্য নয়। উপনিবেশ ও জাতিতত্ত্বের সেই মিলমিশ ভয়ঙ্কর। শ্রাবণী দেখাচ্ছেন, হাসপাতালে নির্দেশ ছিল, ব্রিটিশরা সুপারভাইজ করবেন, কিন্তু নিজেদের হাতে অসুস্থ ভারতীয় সৈন্যদের সেবা করবেন না। সিপাহি বিদ্রোহ থেকে শিক্ষা নিয়ে মুসলিম সৈন্যদের জন্য হালাল করা মাংসের বন্দোবস্ত, হিন্দুদের জন্য অন্য রকম।

মহাযুদ্ধের কয়েক বছর আগে বুয়র যুদ্ধে ভারতীয় সৈনিকদের ব্যবহার করা হয়নি। ভয় ছিল, সাহেবদের বিরুদ্ধে কালা আদমি বন্দুক ধরতে শিখলে যদি ভবিষ্যতে অন্য বিপদ আসে! কিন্তু মহাযুদ্ধ অন্য ব্যাপার। প্রায় ১০ লক্ষ ভারতীয় সেখানে যান। মারা গিয়েছিলেন ৬০ হাজার। ইউরোপের ইতিহাস এঁদের কথা মনে রাখেনি। যুদ্ধ থামার পর এঁরা যখন দেশে ফিরলেন, রাওলাট আইন, সত্যাগ্রহ, আইনসভা... অনেক নতুন নায়ক। হারিয়ে গেলেন তাঁরা।

সঙ্গে সদ্যোজাত জাতীয়তাবাদ। স্বদেশের জন্য নয়, বিদেশি রাজার জন্য যুদ্ধে গিয়েছিলেন ওই সৈন্যরা। তাঁদের পরিবার, গ্রাম আর নিজস্ব জাতিগৌরবেরই বর্ধিত অংশ যেন নিজেদের রেজিমেন্ট। সৈন্যদের বেশির ভাগ চিঠিতেই তাই ‘রাজার নিমক খাওয়ার সম্মান রক্ষা’, ‘পরিবার ও জাতের মুখ উজ্জ্বল করা’ জাতীয় শব্দবন্ধের ছড়াছড়ি। মূল ধারার জাতীয়তাবাদও তাই এঁদের বুঝতে না পেরে বিস্মরণের কবরে পাঠিয়ে দেবে।

সুখপাঠ্য এই বইয়ের শুরুতে জার্মান ক্রুজার ‘এমডেন’কে বলা হয়েছে ‘ক্রুজ শিপ’। আর এক জায়গায় সিন্ধ রাইফেলস হয়েছে সিন্ধিয়া। বাংলা প্রকাশনা ধাঁচের অসতর্ক সম্পাদনা ও প্রুফপাঠ আজকাল বিলিতি প্রকাশনার ট্রেঞ্চেও গোলাবর্ষণ করে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE