Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

আকাঙ্ক্ষা আর বাস্তবের গরমিল

প্রায় ভুলে যাওয়া পিসির সন্ধানে গ্রামে আসে শহুরে যুবক। রক্তের টানের দোহাই দিয়ে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধাকে কলকাতায় নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। ক্রমশ পিসি বুঝতে পারেন শিশুপুত্রকে তাঁর কাছে রেখে চাকুরে দম্পতি যাতে নিশ্চিন্তে বাইরে বেরোতে পারে, তাই তাঁকে বহাল করা হয়েছে বিনে পয়সার কাজের লোকের ভূমিকায়। অন্য আত্মীয়রা একই উদ্দেশ্যে তাঁকে নিয়ে টানাটানি শুরু করলে বৃদ্ধা সাফ জানতে চান তারা তাঁকে মাইনে কত দেবে।

ঈশিতা চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

প্রায় ভুলে যাওয়া পিসির সন্ধানে গ্রামে আসে শহুরে যুবক। রক্তের টানের দোহাই দিয়ে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধাকে কলকাতায় নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। ক্রমশ পিসি বুঝতে পারেন শিশুপুত্রকে তাঁর কাছে রেখে চাকুরে দম্পতি যাতে নিশ্চিন্তে বাইরে বেরোতে পারে, তাই তাঁকে বহাল করা হয়েছে বিনে পয়সার কাজের লোকের ভূমিকায়। অন্য আত্মীয়রা একই উদ্দেশ্যে তাঁকে নিয়ে টানাটানি শুরু করলে বৃদ্ধা সাফ জানতে চান তারা তাঁকে মাইনে কত দেবে। সংক্ষেপে এই হল ১৯৬০-এর দশকের কলকাতার প্রেক্ষিতে তপন সিংহ নির্দেশিত ‘আপনজন’ ছবির পশ্চাৎপট।

একুশ শতকের কলকাতায় অলিগলিতে গজিয়ে উঠেছে শিশু ও বৃদ্ধদের দেখভাল করার পরিষেবা সরবরাহকারী সংস্থা— গৃহকর্মী/ আয়া সেন্টার। তারাও কেউ কেউ সংস্থার নাম রাখছে ‘আপনজন’। গত দু-তিন দশকে কলকাতা সহ সারা দেশের শহরাঞ্চলে গৃহকর্ম-সহায়তা ও যত্ন-পরিষেবা (কেয়ার) কেনার অভ্যাস ব্যাপক ভাবে বেড়েছে। সৌজন্যে মধ্যবিত্তের উল্লেখযোগ্য অংশের আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি ও সমাজের উপরতলার মেয়েদের আরও বেশি বেশি সংখ্যায় রোজগার করতে বেরনো। সংসারের দেখভাল করার কাজে রোজগেরে মধ্যবিত্ত গিন্নির যে ঘাটতি পড়ছে, তা পুষিয়ে দিতে এগিয়ে আসছেন মজুরির বিনিময়ে গৃহশ্রমিকেরা। ঘরের কাজে মেয়েদের স্বাভাবিক দক্ষতা থাকে বলে ধরে নেওয়া হয়, তাই গৃহশ্রমের বাজার ক্রমশ ছেয়ে ফেলেছেন ‘নয়নচাঁপা’-রা। অবশ্য তামিলনাড়ু, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, সাবেক অন্ধ্রপ্রদেশ বা দিল্লির মতো অর্থনৈতিক ভাবে এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলির শহরাঞ্চলের গৃহশ্রমের বাজার থেকে ‘রামুকাকা’-রা যেমন প্রায় পুরোপুরি বিদায় নিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে অবস্থাটা ঠিক তেমন নয়। কিছু পুরুষ গৃহশ্রমিক এ রাজ্যে এখনও আছেন। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, এ রাজ্যে শিশুকন্যা গৃহশ্রমিকের ছড়াছড়ি।

‘কাজের মেয়ে’ ছাড়া শহুরে মধ্যবিত্ত সংসার অচল, অথচ অন্তত আমাদের দেশে আলোচনা-গবেষণায় মজুরিভিত্তিক গৃহশ্রম এখনও সে ভাবে উঠে আসছে না। কলকাতা শহরের নারী গৃহশ্রমিকদের নিয়ে শমিতা সেন ও নীলাঞ্জনা সেনগুপ্তের সাম্প্রতিক গবেষণা সেদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও পথিকৃৎ প্রয়াস।

ক্ষেত্রসমীক্ষা-নির্ভর এই গবেষণাগ্রন্থের মূল উপজীব্য ‘নয়নচাঁপাদের দিনরাত্রি’-র সন্ধান। শিরোনামটি জুতসই— ‘ডোমেস্টিক ডেজ’। দক্ষিণ কলকাতার দু’টি লাগোয়া বস্তিতে প্রায় দেড়শো জন প্রাপ্তবয়স্ক ঠিকে গৃহশ্রমিক মেয়ের সঙ্গে কয়েকটি পর্যায়ে সমীক্ষকদলের সংলাপের ভিত্তিতে উঠে এসেছে এই মেয়েদের মজুরির হার, কাজের অন্যান্য শর্ত, নিয়োগকারী পরিবারের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ইত্যাদি দরকারি তথ্য। এর আগেও কলকাতার গৃহশ্রমিকদের নিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে ছোট মাপের যে-সব সমীক্ষা করা হয়েছে, সেগুলির সঙ্গে বর্তমান গবেষণার সিদ্ধান্ত মিলিয়ে পড়া যায়। দশশালা জনগণনা, পাঁচশালা নমুনা সমীক্ষা, পারিবারিক স্বাস্থ্যসমীক্ষা থেকে মেলা ফলাফলের প্রেক্ষিতে সেন ও সেনগুপ্তের সিদ্ধান্তগুলি ফের পড়তে পারেন উৎসাহী পাঠক। বইটির জোরের জায়গা অবশ্য ভিন্ন: মজুরির বিনিময়ে অন্যের সংসার দেখভাল করার কাজে নিযুক্ত মেয়েদের দৈনন্দিন যাপন, তাঁদের আশা-আশঙ্কা-হতাশার বিবরণ তাঁদেরই কণ্ঠস্বরে ধরে রাখার চেষ্টা।

সাম্প্রতিকতম হিসেব অনুযায়ী সারা দেশে শহরাঞ্চলে কর্মরত মেয়েদের মধ্যে শতকরা ১০ জনই গৃহশ্রমিক, পশ্চিমবঙ্গে ২৩ জন। এ রাজ্যে এঁদের একটা বড় অংশ শিশুকন্যা, অর্থাৎ ১৪ বছরের নীচে। বড় মেয়েরা কেউ শহরের কাছাকাছি গ্রামাঞ্চল থেকে লোকাল ট্রেনে (মধ্যবিত্ত বয়ানে ‘ঝি-স্পেশাল’) যাতায়াত করে একাধিক বাড়িতে ঠিকে কাজ সারেন। কেউ পরিবার সমেত গ্রাম ছেড়ে চলে এসে বাসা বেঁধেছেন বস্তির ঘরে, কেউ ২৪ ঘণ্টার কাজ নিয়ে থাকছেন নিয়োগকর্তার পরিবারে। ঠিকে কাজে নিযুক্তরা প্রায় সবাই প্রাপ্তবয়স্ক, শিশুকন্যারা সাধারণত খাটছে পুরো সময়। বর্তমান সমীক্ষায় আলোচ্য শহরে বাসা নেওয়া প্রাপ্তবয়স্ক ঠিকে কাজের মেয়েরা। এঁদের গ্রাম থেকে শহরে আসার অভিজ্ঞতা, নিত্য উচ্ছেদ হওয়ার আশঙ্কা নিয়ে নতুন পরিবেশে টিকে থাকার লড়াই, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে বহু ক্ষেত্রেই সংসারে প্রধান রোজগেরের দায়িত্ব সামলানো, কাজের বাড়িতে দৈনন্দিন দর-কষাকষি অথবা তা না করতে পারা— এ সব নিছক বিবরণ হয়ে থাকেনি, রক্ত-মাংসের আদল পেয়েছে। প্রান্তিক মানুষকে পরিস্থিতির শিকার (ভিক্টিম) জনপিণ্ড হিসেবে না দেখে লেখকেরা জোর দিয়েছেন তাঁদের অভিজ্ঞতার বৈচিত্র, পরিস্থিতিকে বাগে আনার সক্রিয়তার (এজেন্সি) আখ্যানে। কম মজুরি, ছুটি চাইলে কাজ হারানোর হুমকি, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অভাব নিয়ে উত্তরদাতাদের বক্তব্যে মিল যথেষ্ট। অনেকের অভিজ্ঞতা, বেশি দিন ধরে কোনও বাড়িতে কাজ করলে সুসম্পর্ক থাকে, বিপদে-আপদে ধার মেলে, কিন্তু মাইনে বাড়ানো কঠিন। নিয়োগকারী সম্পর্কে কেউ তিক্ত, কেউ আবার রীতিমতো উষ্ণ, অনেকের দৃষ্টিভঙ্গি পেশাদার। এঁরা কাজটাকে চুক্তি হিসেবে দেখেন, মধ্যবিত্তের আপনজন হয়ে ওঠার বাসনা রাখেন না।

ভূমিকা ও সিদ্ধান্ত বাদে আরও সাতটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত আলোচ্য গ্রন্থে পঞ্চম ও ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে পাচ্ছি গৃহশ্রমিক মেয়েদের নিজেদের পরিবারে অবস্থান। দিনভর বাইরে খাটা আর নিজের সংসারের দাবি মেটানোর লড়াই এঁদের প্রত্যেকের। অনেকের কাছেই স্ত্রী হিসেবে, মা হিসেবে পরিচিতি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, কর্মী বা শ্রমিকের পরিচয় ততটা নয়। ঠিকে কর্মী এই মায়েরা আয়ের একটা অংশ ব্যয় করছেন সন্তানের, কন্যাসন্তানেরও লেখাপড়ার খাতে। নিজের মেয়ে বড় হয়ে পরের বাড়ি খাটুক, তা চান না কেউ। মনে করেন বিয়ে হওয়া উচিত প্রাপ্তবয়সে। কিন্তু সমীক্ষকেরা দেখেছেন, আলোচ্য দু’টি বস্তিতে মেয়েদের ১৮ বছরের নীচে বিয়ে বন্ধ হয়নি। আকাঙ্ক্ষা আর বাস্তবের এই গরমিল-ই গৃহশ্রমিক মেয়েদের দৈনন্দিন।

ডোমেস্টিক ডেজ/ উইমেন, ওয়ার্ক, অ্যান্ড পলিটিক্স ইন কনটেম্পোরারি কলকাতা। শমিতা সেন, নীলাঞ্জনা সেনগুপ্ত। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ৯৯৫.০০

সপ্তম পরিচ্ছেদে আলোচনা করা হয়েছে চাওয়াগুলিকে বাস্তব রূপ দিতে সংগঠিত হওয়ার উদ্যোগ। গৃহশ্রমিকদের দাবিদাওয়া আদায়ে পশ্চিমবঙ্গ অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় পিছিয়ে। ন্যূনতম মজুরি, সবেতন নির্দিষ্ট ছুটি, শ্রমিক হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি, বিপিএল কার্ড ও পরিচয়পত্র পাওয়া ইত্যাদি দাবি নিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করতে বাম-ডান নির্বিশেষে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বের স্পষ্ট অনীহা। নেতৃত্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যে নিজেরাই গৃহশ্রমিক নিয়োগকারী, অনীহার কারণটা যে সেখানেই নিহিত, গবেষকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সে কথা মেনেও নিয়েছেন এক শ্রমিক-নেত্রী।

ব্যাপারটা অন্য রাজ্যের ক্ষেত্রেও সত্যি, তবু সেখানে গৃহশ্রমিকেরা সংগঠিত হয়ে অন্তত কিছু দাবি আদায় করতে সফল। ‘ডোমেস্টিক ডেজ’ যাঁদের কথা শোনাল, হয়তো তাঁরাও অদূর ভবিষ্যতে সংগঠিত হবেন, সফল হবেন। কিন্তু এই গবেষণায় যাদের কথা সে ভাবে শোনা গেল না, সেই শিশুকন্যা গৃহশ্রমিকদের কী হবে? রাষ্ট্রপুঞ্জ যাদের অবস্থা সমকালীন ক্রীতদাসত্ব বলে বর্ণনা করেছে, খুন-ধর্ষণ থেকে শুরু করে কাজের বাড়িতে আরও নানা অত্যাচারের শিকার হয়ে যাদের একাংশ আজ নিয়মিত সংবাদপত্রের শিরোনামে? রাজ্যের ভুখা গ্রামাঞ্চল থেকে কেবল কলকাতায় নয়, তারা যাচ্ছে দিল্লি-মুম্বই-বেঙ্গালুরু-হায়দরাবাদের মতো শহরে। আড়কাঠির মাধ্যমে কেবল ‘নিষিদ্ধপল্লি’-তে শরীর বেচতে নয়, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে শ্রমও বেচতে। অথচ ২০০৬ সালে শিশুশ্রম আইন সংশোধনের পর থেকে ১৪ বছরের নীচে গৃহশ্রমে নিয়োগ করা বেআইনি।

লেখকেরা অবশ্য প্রথমেই বলে নিয়েছেন, তাঁদের গবেষণার উদ্দেশ্য প্রাপ্তবয়স্ক ঠিকে গৃহশ্রমিকদের জীবনযাপন বুঝতে চেষ্টা করা। তবু মনে হয়, বৃহৎ প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো ব্যবহার করে সংগৃহীত গৃহশ্রমিকদের রোজনামচায় এই শিশুদের কণ্ঠস্বরও শোনা জরুরি ছিল। কিছু বছর আগেও তো তারা ছিল এ রাজ্যের শহরাঞ্চলে নারী গৃহশ্রমিকদের শতকরা ১৪ জন। সম্প্রতি হিসেবটা খুব যে বদলেছে, তেমন ইঙ্গিত নেই। রোজনামচায় এই মেয়েশিশুরা ছায়া ফেললে গৃহশ্রমিক নারীর ‘এজেন্সি’ তৈরির আখ্যান হয়তো খানিকটা প্রশ্নের মুখে পড়ত, জটিলতা বাড়ত— সে ঝুঁকি নিয়েও কাজটা জরুরি ছিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE