Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কতটা জনপ্রিয় ছিল পাকিস্তান আন্দোলন

গত কয়েক দশকে পাকিস্তান সৃষ্টির যে ইতিহাস লেখা হয়েছে সেই বিশেষ বিদ্যাক্ষেত্রে আলোচ্য বইটি নতুন সংযোজন। পিএইচ ডি গবেষণাপত্রকে ভিত্তি করে লেখা ৫৩০ পৃষ্ঠার এই বইতে লেখক পাকিস্তান চর্চার ক্ষেত্রে বেশির ভাগ অনুসন্ধানের সঙ্গে হয় দ্বিমত পোষণ করে বা কয়েকটিতে নতুন উপাদান যোগ করার যে চেষ্টা করেছেন, তা অভিনন্দনযোগ্য।

মহম্মদ আলি জিন্না (বাঁ দিকে), মৌলানা হুসেন আহমদ মাদানি (ডান দিকে)।

মহম্মদ আলি জিন্না (বাঁ দিকে), মৌলানা হুসেন আহমদ মাদানি (ডান দিকে)।

মইদুল ইসলাম
শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৬ ০০:১৪
Share: Save:

গত কয়েক দশকে পাকিস্তান সৃষ্টির যে ইতিহাস লেখা হয়েছে সেই বিশেষ বিদ্যাক্ষেত্রে আলোচ্য বইটি নতুন সংযোজন। পিএইচ ডি গবেষণাপত্রকে ভিত্তি করে লেখা ৫৩০ পৃষ্ঠার এই বইতে লেখক পাকিস্তান চর্চার ক্ষেত্রে বেশির ভাগ অনুসন্ধানের সঙ্গে হয় দ্বিমত পোষণ করে বা কয়েকটিতে নতুন উপাদান যোগ করার যে চেষ্টা করেছেন, তা অভিনন্দনযোগ্য।

পাকিস্তান গড়ার প্রশ্নে তিনি মূলত তিন ধরনের ঐতিহাসিক মতকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। প্রথমত, ব্রিটিশ সরকার, মুসলিম লিগ নেতৃত্ব ও কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে সাংবিধানিক চুক্তি ও শর্তসাপেক্ষ আলোচনার বিফলতার কারণে পাকিস্তানের জন্ম। দ্বিতীয়ত, জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডের মতো সাবল্টার্ন ঐতিহাসিকদের মতে পাকিস্তান যদিও একটা আবেগপ্রবণ ধর্মীয় প্রতীক ছিল, তাকে যাঁরা সব থেকে বেশি সমর্থন করেছিলেন তাঁরা আসলে পাকিস্তান সৃষ্টির অর্থ ও তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চিত ছিলেন। তৃতীয়ত, জিন্না আসলে একটা উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তিতে এক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী পাকিস্তান গড়তে চেয়েছিলেন।

অন্য দিকে, লেখক দেখানর চেষ্টা করেছেন যে পাকিস্তান গড়ার পিছনে মুসলিম লিগ নেতৃত্বের সঙ্গে দেওবন্দি উলেমাদের (পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের দেওবন্দে অবস্থিত, ইসলাম ধর্মের পণ্ডিতবর্গ) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। লেখকের মতে ১৯৩০-এর দশকের শেষ দিকে মৌলানা আশরাফ আলি থানভি, কংগ্রেস ও কংগ্রেসপন্থী উলেমাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুসলিম লিগকে সমর্থন করেছিলেন। অন্য দিকে ১৯৪০-এর দশকের গোড়া থেকেই মৌলানা শাব্বির আহমেদ উসমানি, দেওবন্দি উলেমাদের ভিতরে জিন্নার প্রতি সমর্থন বাড়ানর চেষ্টা করছিলেন। সেই সময় কংগ্রেসপন্থী উলেমা ও জমিয়ত উলেমা-এ-হিন্দ-এর অগ্রণী নেতা তথা ‘সংযুক্ত জাতীয়তাবাদের’ প্রবক্তা, মৌলানা হুসেন আহমেদ মাদানির বিরুদ্ধে উসমানির তীব্র অবিশ্বাস ছিল। ১৯৪৫ সালে উসমানি জমিয়ত উলেমা-এ-হিন্দ ছেড়ে জমিয়ত উলেমা-এ-ইসলাম গড়লেন এবং ১৯৪৫ সালের জাতীয় নির্বাচন ও ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লিগের হয়ে দেশব্যাপী প্রচার করেছিলেন। লেখক পাকিস্তানের দাবির পিছনে ১৯৪০-এর দশকের সংযুক্ত প্রদেশের (বর্তমান উত্তরপ্রদেশ) মুসলিম লিগের কর্মী, মুসলিম লিগের নেতৃত্ব, আলিগড়ের মুসলিম আধুনিকতাবাদী, মুসলিম উলেমাদের একাংশ ও জিন্নার ভূমিকা বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর বক্তব্য, পাকিস্তান রাষ্ট্র একটা অস্পষ্ট দাবি ছিল না। বরং প্রথম থেকেই সেই দাবি একটা ‘জনপ্রিয়তামূলক কল্পনা ও আগ্রহের’ ফল ছিল যা একটি সার্বভৌম ইসলামি রাষ্ট্র তথা এক ‘নতুন মদিনা’ গড়ার প্রকল্প। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তুর্কি খিলাফতের সমাপ্তির পরে মুসলিম দুনিয়ার রক্ষাকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, তুর্কি খিলাফতের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, মুসলিম দুনিয়ার নেতৃত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তান জাতিরাষ্ট্রের প্রবক্তাদের মধ্যে। লেখকের ভাষায়, পাকিস্তানের মতো একটা ‘জনপ্রিয় ভাবনার’ মধ্যে ধর্মবিযুক্ত ও ধর্মীয়, দুই প্রকারের ভাষা ও দাবিই একত্র হয়েছিল।

লেখকের এই মূল বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে কয়েকটা দুর্বলতা চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত পাকিস্তান আন্দোলনকে সব ভারতীয় মুসলিমের এক জনপ্রিয় আন্দোলন বলার জন্য যে রাজনৈতিক তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘জনপ্রিয়তা’কে বিশ্লেষণ করার দরকার ছিল তা করা হয়নি। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর ১৯৫১-য় যে আদমসুমারি হয় তাতে ভারতে ৯.৮ শতাংশ বা তিন কোটি চুয়ান্ন লক্ষ মুসলিম নাগরিক ছিলেন। তাই কেন অবিভক্ত ভারতের মুসলিম জনগণের এক তাৎপর্যপূর্ণ অংশের মানুষ পাকিস্তান গড়ার ডাকে সাড়া দিলেন না, কেন দেওবন্দি উলেমাদের সংখ্যাগুরু অংশ পাকিস্তানের বিরোধিতা করলেন এবং সর্বোপরি কেন প্রায় সাড়ে তিন কোটি মুসলমান পাকিস্তানের মতো এক ‘ইসলামি রাষ্ট্রে’ না গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে থাকলেন তার কোনও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা এই বইয়ে নেই।

দ্বিতীয়ত পাকিস্তান দাবির পক্ষে বাংলার মুসলিম লিগের ভূমিকা তেমন আলোচনা করা হয়নি। বরং হারুনুর রশিদ ও জয়া চট্টোপাধ্যায়ের দুটি ঐতিহাসিক বইয়ের উল্লেখ করে দায়সারা ভাবে বলা হয়েছে যে বাংলার মুসলিম লিগের নেতারা পূর্ববঙ্গকে হয় স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান অথবা সার্বভৌম সংযুক্ত বঙ্গ করতে চেয়েছিলেন। এখানে লেখকের পক্ষে বলা যেতে পারে যে যেহেতু তিনি উত্তর ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশের মধ্য থেকে পাকিস্তান দাবির সমর্থন খোঁজার চেষ্টা করেছেন তাই বাংলার ইতিহাসকে তিনি পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তান আন্দোলনের ‘জনপ্রিয়তা’ যে প্রথম থেকেই সংকটে ছিল তা পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫০-এর দশক থেকে ভাষা ও শ্রেণিগত দাবি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত সংগ্রাম এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের মধ্যে দিয়ে আরও পরিস্ফুট হয়। ভারত থেকে পাকিস্তানে যাওয়া উর্দুভাষীদের (যারা মোহাজির নামে খ্যাত) সঙ্গে পাকিস্তান হওয়ার অনতিবিলম্বেই যে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু হয়— যা এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে— তা থেকেই স্পষ্ট, পাকিস্তানের দাবি আসলে তেমন ‘জনপ্রিয়’ ছিল না।

তৃতীয়ত, লেখকের মতে বিজনোর থেকে প্রকাশিত ‘মদিনা’ নামক উর্দু পত্রিকা ১৯৪২-’৪৩ নাগাদ পাকিস্তানের দাবিকে পশ্চিমে বম্বে, দক্ষিণে রায়চুর ও পূর্বে চট্টগ্রাম পর্যন্ত জনপ্রিয় করেছিল। তথ্যসমৃদ্ধ প্রামাণিক দলিল ছাড়া, মাত্র কয়েক হাজার ছাপা পত্রিকার কয়েকটা প্রবন্ধের ভিত্তিতে এ হেন দাবি করা যায় কি?

ক্রিয়েটিং আ নিউ মদিনা: স্টেট পাওয়ার, ইসলাম, অ্যান্ড দ্য কোয়েস্ট ফর পাকিস্তান ইন লেট কলোনিয়াল নর্থ ইন্ডিয়া। বেঙ্কট ধুলিপালা। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ৯৯৫.০০

চতুর্থত, উত্তর ভারত থেকে কারা এবং কতজন পশ্চিম পাকিস্তানে গেলেন (কিছু উর্দুভাষী মধ্যবিত্ত চাকুরে ও পেশাজীবী, কিছু ব্যবসায়ী, কিছু জমিদার শ্রেিণর লোক যাঁরা অমুসলিমদের ছেড়ে আসা জমি ক্ষতিপূরণ হিসেবে পেয়েছিলেন, অল্প সংখ্যক উলেমা ইত্যাদি) আর কারা গেলেন না (শহরকেন্দ্রিক বিভিন্ন নিপুণ কারিগর যেমন আগ্রার জুতো ও চর্মশিল্প, মোরাদাবাদ, লখনউ ও রামপুরের হস্তশিল্প, আলিগড়ের তালাশিল্প ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত বহু মুসলিম শ্রমিক এবং উত্তর ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামের প্রচুর চাষি যাঁদের জমির সঙ্গে জীবিকা জড়িত) এবং কেন গেলেন না? পাকিস্তান যাওয়া ও না-যাওয়ার পিছনে রাজনীতি বা অর্থনীতির কোনও যোগসূত্র আছে কি না সে ব্যাপারে লেখক নিশ্চুপ। এই ব্যাপারে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার ভিত্তিতে কোনও যুক্তিগ্রাহ্য বক্তব্য না থাকলে আজ হিন্দুত্ববাদীরা বলতেই পারেন যে যেহেতু পাকিস্তানের দাবি ভারতীয় মুসলিমদের এক ‘জনপ্রিয় দাবি’ ছিল তাই তখন যাঁরা পাকিস্তানে যাননি, আজ তাঁরা যেতেই পারেন। হিন্দুত্ববাদীরা মাঝে মধ্যেই অযথা কিছু মানুষকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে পাঠানর কথা বলেন।

পঞ্চমত, উত্তর ভারতে মুসলিম জনতার একাংশের মধ্যে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের বিকল্প রাজনৈতিক দর্শন যথা বামপন্থী ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তার যে উদ্ভব ঘটেছিল সেই বিষয়ে লেখক তেমন আলোকপাত করেননি। তিনি প্রগতিশীল লেখক সংঘের উপরে কেবল দুটি গবেষণাপত্রের উল্লেখ করেছেন কিন্তু খিজার হুমায়ুন আনসারির বই, দ্য ইমার্জেন্স অব সোসালিস্ট থট অ্যামং নর্থ ইন্ডিয়ান মুসলিমস, ১৯১৭-১৯৪৭ বইটা পড়তে পারতেন। অন্য দিকে আলিগড়ের মুসলিম আধুনিকদের কথা বলার জন্য ফয়সাল দেভজির দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা সুখপাঠ্য, মুসলিম ন্যাশনালিজম: ফাউন্ডিং আইডেন্টিটি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া বইটি পড়তে পারতেন। অনেক জায়গায়, বামপন্থী বুদ্ধিজীবী, কে এম আশরাফকে উদ্ধৃত করা হলেও কয়েকটি ক্ষেত্রে ফুটনোটে কোনও উল্লেখ নেই। বহু জায়গায় পাকিস্তান আন্দোলনের সব থেকে বড় চিন্তাবিদ, মুহাম্মদ ইকবালের কথা উল্লেখ করা হলেও তাঁর কোনও লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়নি। ফুটনোট ও গ্রন্থপঞ্জিতে কোনও বইয়ের প্রকাশকের নামের উল্লেখ নেই যা ছাত্র ও গবেষকদের সাহায্য করত। তবে সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্র নির্মাণের সম্ভাব্য কারণগুলি নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহাসিকদের মধ্যে যে গত কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন মত রয়েছে সেই বিতর্কে এই নবীন ইতিহাসবিদ নতুন উদ্দীপনা ও উৎসাহের উদ্রেক ঘটিয়েছেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE