Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

অবনীন্দ্রনাথকে নতুন করে চেনা

যথোচিত উৎসাহ পেলে মারুতির পুঁথি-র পরে নিকষীর পুঁথি, মন্দোদরীর পুঁথি, বিভীষণের পুঁথি, জানকীর পুঁথি ইত্যাদি ইত্যাদি ক্রমশ প্রকাশ্য হবে, জানিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মারুতির পুঁথি-র অভিপ্রেত ভূমিকায়৷

বিশ্রাম: পম্পা সরোবর তীরে হনুমান। ছবি: রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। বই থেকে

বিশ্রাম: পম্পা সরোবর তীরে হনুমান। ছবি: রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। বই থেকে

আশিস পাঠক
শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

মারুতির পুঁথি

লেখক: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মূল্য: ৬০০.০০

প্রকাশক: প্রতিক্ষণ

যথোচিত উৎসাহ পেলে মারুতির পুঁথি-র পরে নিকষীর পুঁথি, মন্দোদরীর পুঁথি, বিভীষণের পুঁথি, জানকীর পুঁথি ইত্যাদি ইত্যাদি ক্রমশ প্রকাশ্য হবে, জানিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মারুতির পুঁথি-র অভিপ্রেত ভূমিকায়৷ ভূমিকাটিকে ‘অভিপ্রেত’ বলার কারণ, সেটি অবনীন্দ্রনাথের জীবনকালে গ্রন্থিত হয়নি, ছিল পাণ্ডুলিপিতেই। পরে অবনীন্দ্র রচনাবলী-র (প্রকাশ ভবন) পঞ্চম খণ্ডের পরিশিষ্টে প্রকাশিত হয় ভূমিকাটি। ১৩৪৪-৪৫ বঙ্গাব্দের ‘মৌচাক’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশের সময় তো নয়ই, অবনীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে ৭ আশ্বিন ১৩৬৩ গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময়ও ভূমিকাটি প্রকাশিত হয়নি৷ ষাট বছর পরে রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন অলংকরণে প্রতিক্ষণ থেকে অসাধারণ মুদ্রণে সম্প্রতি প্রকাশিত মারুতির পুঁথি-ও রইল ভূমিকা-বর্জিত। কোন সংস্করণ অবলম্বনে এ বইয়ের পাঠ তৈরি হল, তা কোথাও বলা নেই এই প্রতিক্ষণ-সংস্করণে। তবে ধরে নেওয়া যায়, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিংয়ের প্রথম সংস্করণ অবলম্বনেই এই নতুন সংস্করণ। কারণ ছবির ক্যাপশনও এখানে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড সংস্করণের অনুরূপ। বইটির আনুপূর্বিক প্রকাশের ইতিহাস এই রাজকীয় সংস্করণটিকে সম্পূর্ণতা দিতে পারত। সেই ইতিহাস আরও একটা কারণে জরুরি ছিল। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোম্পানি থেকে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণে মনে রাখার মতো প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছিলেন অজিত গুপ্ত। বাংলা বইয়ের অলংকরণের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকা সেই কাজে ধরা ছিল অবনীন্দ্রনাথের রচনা-মেজাজের তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের দিকটি।

সম্পূর্ণ অন্য শৈলীতে এই প্রতিক্ষণ-সংস্করণে রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রঙিন প্রচ্ছদ ও অলংকরণগুলির বিশেষত্ব এইখানে যে তিনি অবনীন্দ্রনাথের এই পরীক্ষামূলক রচনার মাধুর্য ও কোমলতার দিকটি ধরেছেন। ষাট বছর আগের অজিত গুপ্তের অলংকরণের সঙ্গে বর্তমানের রামানন্দের অলংকরণ পাশাপাশি রাখলে বাংলা বইয়ের অলংকরণের বিবর্তনের একটা সুলুক-সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। সে দিক থেকে, এই মারুতির পুঁথি বাংলা বইয়ের অলংকরণের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য উপাদান। পুরনো বইয়ের অলংকরণগুলি সব বর্জন করে নতুন করে ছবি আঁকানোর পরিকল্পনা সুবিবেচিত। কারণ অবনীন্দ্রনাথের রচনার মধ্যে যে অমিত চিত্র-উপাদান, নানা সময়ে তা নতুন নতুন সৃজন-সম্ভাবনার জন্ম দেবে, এটাই স্বাভাবিক।

যা আছে এই বইয়ে, তা-ই বা কম কী! শুরু থেকেই বৈঠকি চালে হাসির ধারা ছুটিয়েছেন পুঁথি-লেখক ওবিন ঠাকুর, ‘সত্য ত্রেতা দ্বাপর, তারপর কলির তিপ্পান্ন হাজার বচ্ছর গতে গন্ধমাদন পর্ব্বত ক্ষয় পেতে পেতে হয়ে পড়েছে যখন মরুত্তাশ্রমের চাঁই-বুড়োর ঠেসান দেবার গের্দ্দাটি, সেই কালে আশ্রমের ভোগমণ্ডপের সামনে গাঁজাল-কুঞ্জে জোড়া-পেঁপেতলায় সেই গন্ধমাদনের সামনে আসন পেতে বসে চাঁই-বুড়ো মারুতির পুঁথি পাঠের পূর্বেব গণ্ডূষ করছেন আর মন্ত্র পড়ছেন...’৷ এর পরে পাতায় পাতায় নতুন, স্বল্প-পরিচিত অবনীন্দ্রনাথকে আবিষ্কারের মজা, যাতে তাল দিয়ে চলেছে রামানন্দের চমকে দেওয়া রেখা আর রঙ৷ মতং মুনির কাছে বিদ্যাশিক্ষা করতে হনুমান চলেছেন কিষ্কিন্ধ্যায়৷ কিন্তু ‘পথ চলতে আর মন চায়না পবন-পুত্রের৷ ইচ্ছা করে এই সব গাঁয়ের এখানে থেকে যাই—ফলও প্রচুর ছায়াও মেদুর/বসলেই হল বিছায়ে মাদুর,/ কে আর যায় কিষ্কিন্ধ্যায়—অতদূর! চলতে চলতে কোনখানে দেখা যায়—একটি কুয়োতলা, একটি বটগাছ, একটি কালো কোলো পল্লীবালা, পোড়ো মন্দির, ইষ্টকালয়, দেখে হনুমানেরই মন খারাপ হয়ে যায়, মানুষ তো দূরের কথা—এমন সুন্দর সেসব স্থান৷’

বস্তুত কিষ্কিন্ধ্যা এই বই জুড়ে আছে৷ আর তাই হয়তো অবনীন্দ্রনাথ এর আর এক নাম দিতে চেয়েছিলেন ‘কিষ্কিন্ধ্যাই রামায়ণ’৷ যে দুটি ভূমিকা মারুতির পুঁথি-র জন্য পাণ্ডুলিপিতে লিখে রেখেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ, তার একটিতে লেখকের বিজ্ঞাপন, ‘এই মারুতির পুঁথি বা কিষ্কিন্ধ্যাই রামায়ণ প্রকাশিত হইল; পাঠকগণের উৎসাহ পাইলে বিভীষণের পুঁথি বা রাবণাই রামায়ণ এবং উর্মিলার পুঁথি বা অযোধ্যাই রামায়ণ সম্পাতির পুঁথি বা পাখাই রামায়ণ ক্রমশঃ প্রকাশ্য করিবার ইচ্ছা রহিল।’ অবনীন্দ্রনাথ আরও লিখে রেখেছিলেন যে সচিত্র এই পুঁথি ‘কলাবিদ্ পুঁথিকণ্ঠ বাবাজী কথিত’ আর এর আবিষ্কর্তা ‘অজ্ঞাত ও অখ্যাতনামা জনৈক ছেলেধরা বুড়া’৷ সর্বসত্ত্বাধিকারী শ্রীঅবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও যে কিনে ফেলে সে৷ মূল্য? অবনীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘মলাটে চাপা রহিল’৷

বোর্ডে বাঁধাই, দামি আর্ট পেপারে রঙিন অলংকরণ-সহ এই বাক্সবন্দি প্রতিক্ষণ-সংস্করণ সংগ্রহযোগ্য। কেবল একটিই দুঃখ, অবনীন্দ্রনাথের ওই ঐতিহাসিক ভূমিকা আর বইটির প্রকাশের ইতিহাস ‘চাপা’ই রহিল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Abanindranath Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE