Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

সাহসী মন্তব্যেও দ্বিধাহীন

যে হেতু পুরনো যাত্রার সঙ্গে, পাঁচালি গানের সঙ্গে আমাদের নাটকের একটা উৎসমূলগত সম্বন্ধ আছে, তাই সেই ধারাটি অব্যাহত ভাবে চলে এসেছে বাংলা নাট্যধারায়।

গীতিনাট্য: ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’র অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথ-সহ ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা। 

গীতিনাট্য: ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’র অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথ-সহ ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা। 

পিনাকেশ সরকার
শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৮ ০০:২৭
Share: Save:

গানের নাটক নাটকে গান

লেখক: আলপনা রায়

৩৫০.০০

দে’জ পাবলিশিং

নাটকের সঙ্গে গানের যোগাযোগ বহু পুরনো ব্যাপার। শেক্সপিয়রের আমল থেকে শুরু করে বিশ শতকের ব্রেশ্‌ট প্রমুখ নাট্যকারের রচনায় গান একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। ভারতবর্ষের মাটিতে যে সব নাটক জন্মেছে— কালিদাস প্রমুখের ক্ল্যাসিকাল নাটক কিংবা লোকনাট্যের প্রাদেশিক নানা আঙ্গিক, সেখানেও গান বাদ দিয়ে নাটক প্রায় ভাবাই যায় না। বাংলা নাটকের সঙ্গে গানের সম্পর্কও অনুরূপ। একেবারে আদি পর্ব থেকেই লক্ষ করা যায় এই সংযোগ। যে হেতু পুরনো যাত্রার সঙ্গে, পাঁচালি গানের সঙ্গে আমাদের নাটকের একটা উৎসমূলগত সম্বন্ধ আছে, তাই সেই ধারাটি অব্যাহত ভাবে চলে এসেছে বাংলা নাট্যধারায়। রামনারায়ণ তর্করত্ন থেকে শুরু করে মধুসূদন দীনবন্ধু গিরিশচন্দ্র মনোমোহন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দ্বিজেন্দ্রলাল ক্ষীরোদপ্রসাদ অমৃতলাল এবং পরবর্তী কালের নাট্যচর্চাতেও দেখা যায়, গান বাদ দিয়ে নাটক লেখার কথা নাট্যকাররা কল্পনাও করতে পারতেন না। পেশাদারি মঞ্চে তো বটেই, শখের থিয়েটারেও নাটক আর গান বরাবর হাত ধরাধরি করেই চলে এসেছে। কারণ বিনোদনের অঙ্গ হিসাবে নাটকে গান অপরিহার্য বলেই বিবেচিত হয়েছে। ‘রত্নাবলী’ নাটকের বিজ্ঞাপনে তাই রামনারায়ণকে বলতে শুনি, ‘‘যদিচ যাত্রার প্রতি আমাদিগেরও অসীম অশ্রদ্ধা আছে, তথাপি এককালে সংগীতমাত্র উচ্ছেদ করা অভিমত কখনই নয়। প্রত্যুত নাটক অভিনয়ে সংগীত সম্পর্ক নিতান্ত পরিবর্জিত হইলে তাহাতে রস ও সৌন্দর্যের বিশেষ হানির সম্ভাবনা।’’ ফলে পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক নাটকে-পালায় তো বটেই, সামাজিক নাটক-প্রহসনেও গান গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। সে কারণে সে কালে যাঁরা নাটকে বা যাত্রায় মঞ্চাবতরণ করতেন, তাঁদের প্রায় বাধ্যতামূলক ভাবেই গান গাইতে জানতে হত।

রবীন্দ্রনাথও তাঁর ব্যতিক্রম নন। ঠাকুরবাড়ির সাংস্কৃতিক আবহেই ছিল গান ও নাটকের দ্বৈতচর্চা। বিশেষত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ গান ও নাটক উভয়ের চর্চা করতেন প্রথমাবধি। ফলে রবীন্দ্রনাথের সারা জীবনের নাট্যচর্চায় গান যে অন্যতম বিশিষ্ট ভূমিকা নেবে সে তো স্বাভাবিক। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘সরোজিনী’ নাটককে কেন্দ্র করে আত্মপ্রকাশ ঘটল গীতরচয়িতা রবীন্দ্রনাথের। তখন তিনি নিতান্তই বালক, বয়স চৌদ্দ বছর। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘পুরুবিক্রম’, ‘অশ্রুমতী’ প্রভৃতি নাটকে প্রযুক্ত হয়েছিল রবীন্দ্র-রচিত গান। পরে কবি নিজে যখন নাট্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করলেন, গান সেখানে গ্রহণ করল এক জরুরি ভূমিকা।

রবীন্দ্রনাটকের ইতিহাস নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে। লেখা হয়েছে রবীন্দ্রগান নিয়েও। এমনকী রবীন্দ্রনাটকে গানের ব্যবহার প্রসঙ্গেও রচিত হয়েছে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধগ্রন্থ। বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে নানা প্রবন্ধনিবন্ধ। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে গভীর চিন্তামূলক বিশ্লেষণ বা তথ্যনিষ্ঠ গবেষণা আমার অন্তত চোখে পড়েনি। নাটকে ব্যবহৃত এ সব রবীন্দ্রগানের প্রয়োগ-তাৎপর্য প্রায়শই নির্দেশিত হয়নি। অন্য নাট্যকারদের ক্ষেত্রে গান যেখানে প্রায়শই দর্শক-শ্রোতার হাঁফ ছাড়ার জায়গা, নিতান্ত বহিরঙ্গ অলঙ্করণ, রবীন্দ্রনাটকে গান সেখানে হয়ে ওঠে চরিত্রগুলির ভাবপ্রকাশেরই বিকল্প মাধ্যম। কী ভাবে সেটা সম্ভব হয়েছে, অধিকাংশ সমালোচকই সেটা স্পষ্ট করেননি। আলপনা রায় সেই কাজটিই সুসম্পন্ন করলেন। এর আগে তাঁর লেখা আলাপ থেকে বিস্তার, রবীন্দ্রনাথের গান: সঙ্গ-অনুষঙ্গ, রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী গান বইগুলি পড়েছি। তখনই মনে হয়েছে, এ ধরনের শ্রমসাধ্য অথচ মৌলিক দৃষ্টিকোণসম্পন্ন রচনা তাঁর পক্ষেই লেখা সম্ভব। কারণ, তিনি একাধারে অনুসন্ধিৎসু অধ্যাপক এবং সংবেদনশীল সঙ্গীতগুণী।

রবীন্দ্রনাটকে গানের প্রয়োগ নিয়ে বিচ্ছিন্ন যে কাজগুলি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে প্রধানত সাঙ্কেতিক নাটকগুলিতে গানের ব্যবহার নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির মধ্যে শান্তিদেব ঘোষ মুখ্যত রবীন্দ্রনাথের কিছু সাঙ্কেতিক নাটক ও গীতিনাট্য-নৃত্যনাট্য নিয়েই তাঁর বক্তব্য বলেছেন— অবশ্যই তার সঙ্গে উপরি পাওয়া তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতিচর্যা। ইন্দিরা দেবীর রবীন্দ্রস্মৃতি বা স্মৃতিসম্পুট বইগুলি সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। অরুণকুমার বসু অবশ্য তাঁর বাংলা কাব্যসংগীত ও রবীন্দ্রসংগীত গ্রন্থে ‘নাটকের গান ও গানের নাটক’ নামে একটি অধ্যায় রেখেছিলেন স্বতন্ত্র ভাবে। তবে আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে শঙ্খ ঘোষের কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক বইয়ের প্রাসঙ্গিক রচনাগুলি, যদিও তিনিও মূলত সঙ্কেতনাট্যগুলির গানের কথাই তুলে ধরেছেন তাঁর কয়েকটি লেখায়।

আবাল্য শান্তিনিকেতনে বেড়ে ওঠায় সেখানকার শিক্ষকদের সান্নিধ্যে এবং বিশেষ ভাবে রবীন্দ্র-ভবন অভিলেখাগারের পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যবহারে আলপনার পক্ষে সম্ভব হয়েছে এমন সার্থক একটি গবেষণাগ্রন্থ রচনা। সূচনাপর্বের তিনটি গীতিনাট্য (বাল্মীকিপ্রতিভা-কালমৃগয়া-মায়ার খেলা) থেকে শুরু করে পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে তিনি অপেক্ষাকৃত গৌণ রুদ্রচণ্ড-প্রকৃতির প্রতিশোধ-নলিনী শুধু নয়, রাজা ও রানি-তপতী-বিসর্জন এমনকী হাস্যকৌতুক-ব্যঙ্গকৌতুক-বৈকুণ্ঠের খাতা-গোড়ায় গলদ-শেষরক্ষা-চিরকুমার সভা-মুক্তির উপায়-এর মতো লঘু কমেডি অথবা পরবর্তী শোধবোধ-গৃহপ্রবেশ-নটীর পূজা-বাঁশরি নাটকে গানের প্রয়োগ নিয়েও খুঁটিয়ে আলোচনা করেছেন— যা এর আগে সে ভাবে কোথাও পাইনি। তা ছাড়া যথাবিধি শারদোৎসব থেকে রক্তকরবী-তাসের দেশ সঙ্কেতনাট্যগুলি কিংবা শাপমোচন-চিত্রাঙ্গদা-চণ্ডালিকা (গদ্যনাট্য ও নৃত্যনাট্য)-শ্যামা (পরিশোধ-সমেত) পালাগান-নৃত্যনাট্যগুলি সম্পর্কেও পাচ্ছি লেখিকার বোধদীপ্ত বিশ্লেষণ। নিছক মুগ্ধতা নয়, প্রয়োজনে সাহসী মন্তব্য করতেও এতটুকু দ্বিধা দেখাননি তিনি। যেমন— শারদোৎসব নাটকের গান প্রসঙ্গে: ‘‘নতুন ধারার এই প্রথম নাটকে গান বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হলেও সে-যোগ সুদৃঢ় হয়ে ওঠেনি। অনিবার্য মনে হয় না সব গানগুলি। বরং খোলামেলা এই নাট্য-গড়নে শরৎঋতুর অনুষঙ্গী অন্য গানও যেন প্রবেশাধিকার পায় অনায়াসে।’’ (পৃ ৬৩) কিংবা প্রায়শ্চিত্ত নাটক নিয়ে সরাসরি বলেন: ‘‘যে গভীর অনুভবের প্রকাশ শুধু কথায় হয় না, সেখানে গানের সহায়তা নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাটকে বারবার। কিন্তু ধনঞ্জয়ের অধিকাংশ গানে আমরা এমন-কিছু শুনি না যা সংলাপে নেই বা সংলাপে বলা যেত না।’’ (পৃ ৭২)

রক্তকরবী নাটকে গান যে আর অলঙ্কার হয়ে নেই, তা যে হয়ে উঠেছে নাটকের মূল ভাবের অপরিহার্য অনুষঙ্গী, তা জানিয়ে আলপনা বিশুর নন্দিনীকে শেষ গান শোনানোর প্রসঙ্গে বলেন: ‘‘ব্যথার সাধনায় নিজেকে রাঙিয়ে তুলে যেমন জীবনের সৌন্দর্যময় প্রকাশ হয়ে ওঠে রক্তকরবী তেমনি মনে হয় ব্যথার সংগ্রামের শেষেও হয়ত অপেক্ষা করে আছে কোনো গীতসৌন্দর্যময় জীবন, জীবনের মুক্তি, যার ইঙ্গিত আছে নাটকের অন্ত্যগীতিটির সমবেত প্রয়োগে।’’

বইটির ৬৩ পৃষ্ঠাব্যাপী পরিশিষ্টে সংযোজিত হয়েছে— (১) নাটকের প্রচল সংস্করণে গানের বর্ণানুক্রমিক তালিকা, (২) নাটকে গানের বিন্যাস, সংস্করণভেদ, স্বরলিপি-নির্দেশ। কোন দৃশ্যে কোন চরিত্রের কণ্ঠে গানগুলি প্রযুক্ত তা-ও জানানো হয়েছে। প্রতিটি নাটকের প্রথম প্রকাশ সন (পত্রিকায় ও গ্রন্থাকারে), গানগুলির স্বরলিপিকারদের নাম, গানের রাগ-তালের উল্লেখ থাকলে তার বিবরণও মুদ্রিত হয়েছে। সব মিলিয়ে বলতে হয়, বইটি হয়ে উঠেছে একাধারে একটি পূর্ণাঙ্গ আলোচনাগ্রন্থ ও তথ্যকোশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE