Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

পথের নিশানা হিসেবে থেকে যাবে

লিখনদাস রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে বিশ্বভুবনটাই আদতে গল্পভুবন। চোখ, নাক, কান খোলা রাখতে হবে, মনটা সতেজ থাকবে, ব্যস। গল্প খুঁজে পেতে অসুবিধে হবে না, যেন হাত বাড়ালেই বন্ধু। কিন্তু কথন বানানোই তো মুশকিলের, কথনের জোরেই তো চুপকথা গল্প হয়ে ওঠে, উঠতে চায়, ছড়িয়ে দেয় আরও অনেক গল্পবীজ, ধরতে চায় আরও উন্মুখ অনেক গল্পকে।

রক্তজবা রহস্য। রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃতীয় পরিসর, ২৫০.০০

রক্তজবা রহস্য। রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃতীয় পরিসর, ২৫০.০০

গৌতম ভদ্র
শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

লিখনদাস রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে বিশ্বভুবনটাই আদতে গল্পভুবন। চোখ, নাক, কান খোলা রাখতে হবে, মনটা সতেজ থাকবে, ব্যস। গল্প খুঁজে পেতে অসুবিধে হবে না, যেন হাত বাড়ালেই বন্ধু। কিন্তু কথন বানানোই তো মুশকিলের, কথনের জোরেই তো চুপকথা গল্প হয়ে ওঠে, উঠতে চায়, ছড়িয়ে দেয় আরও অনেক গল্পবীজ, ধরতে চায় আরও উন্মুখ অনেক গল্পকে। ধরাবাঁধা গল্পের পাক্কি সড়কের আশেপাশে ঝুপসো বসে থাকা অনেক কথা সেই ঐকান্তিক চাওয়ার টানেই সোচ্চার হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের জলাজঙ্গলে আর তেপান্তরে, হাঁটতে শুরু করে কোনও এক ‘নিরুদ্দেশ লোক’-এর দিকে। আর বলুন তো মৃত্যুলোকের চাইতে নিরুদ্দেশ জগৎ আর কী-ই বা আছে? কথিত যে সেই লোকে যাওয়ার আগের মাসটিতে দুই সপ্তাহের মধ্যে এক রহস্য কথা রাঘব স্বচ্ছন্দে লিখে শেষ করেছিল, টান টান জমাটি রহস্য যেন তাকে লিখিয়ে নিয়েছিল। রাঘব তো বরাবরের লিখনদাস, কথা লেখার চেনা সরণি ছেড়ে পথে-বিপথে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়ানোই তার অভ্যাস, ইচ্ছে দিগন্ত অতিক্রম করা।

রবিদাস ও ভক্তদাসের মতো দেশি কথকদের সঙ্গে আমার একটু মেলামেশা আছে, সেই ভরসাতে রক্তজবা রহস্য-এর কথাবীজটা নিজের বুঝভাবনা মতো সাজিয়ে দিচ্ছি, ভক্তমণ্ডলী ক্ষমাঘেন্না করে নেবেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, কলকাতা তথা বাংলার কর্পোরেট জগৎ আতঙ্কিত, কয়েক দিনে ছ’জন সুপার বসের আকস্মিক মৃত্যু ঘটেছে, এঁদের বয়স ৪৫ থেকে ৫৫-এর মধ্যে। এঁরা সবাই সাফল্যের তুঙ্গে, একেবারে পয়লা নম্বর সেলিব্রেটি। মেডিক্যাল রিপোর্টে মিলটা এই রকম, সব ক’টি ঘটনাতেই মৃত্যুর কয়েক দিন আগে এঁরা চোখে রক্তজবা দেখছিলেন, কাজে দিলচস্‌পি কমে আসছিল, ভোর রাতেই ঘুমে মৃত্যু। ভট্টরাজের মতো বাঘা আমলারা ভয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন, বুকে চাপ বাড়ছে আর নেটিজেন জগতের উঠতি সফল তরুণ-তরুণী অ্যাচিভারদের মধ্যেও অবসাদ ছড়িয়ে পড়েছে, অনেকেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যোম ভোলা হয়ে বসে থাকছে। উন্নয়নের মুখে মাছি, মুখ্যমন্ত্রী রাগে অস্থির, তদন্তে নেমে পুলিশ প্রশাসন ল্যাজেগোবরে। কারণ, বেশির ভাগ বিদ্রোহীই তো গত শতকেই সাবাড়, কয়েক জন জেলবন্দি, বাকিরা দলদাস। ঝান্ডা, ফেস্টুন, স্লোগান কিছু নেই, স্মৃতিমেদুর ম্যান্তামারা একটি ইস্তাহার পাওয়া গিয়েছে মাত্র। কারা বা শত্রু? রক্তজবাই বলার মতো ক্লু। অগত্যা ‘পূর্বচর্চা’ কেন্দ্রের অধিকর্তা ও বিশেষজ্ঞ প্রফেসর সান্যালকে গোপন রিপোর্ট দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেই গোপন রিপোর্টের তথ্য সংগ্রহের জন্য সান্যাল মহাশয় মুখে রা না কাটা ছাত্রছাত্রীদের দলকে উত্তর কলকাতায় রাত টহলের জন্য নামিয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি সরকারি সেমিনারে নামজাদা বুদ্ধিজীবীরা সঙ্কটমোচনী প্রবন্ধ আওড়ে যাচ্ছেন। ডিসি ডিডিরাও বসে নেই, জেরা করার খতিয়ান বানাচ্ছেন, থার্ড ডিগ্রির আয়োজনও মজুত। এত সব বন্দোবস্তের মধ্যেই তৈরি হয়েছে রক্তজবা রহস্য, কর্পোরেট জগতে ঘটে চলা নিদারুণ অন্তর্ঘাতের এক আলো-আঁধারি বয়ান।

এই ছাপা বয়ানের উৎসর্গপত্রে ২০১১ সালের ওয়াল স্ট্রিট অবরোধ স্মরণের একটা পোস্টার গাবদা করে ছাপা হয়েছে, দেখতে অধিকন্তুই লাগে, আতঙ্ক যেন ফিকে হয়ে যায়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, গৌরকিশোর ঘোষ ও শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো সৃজনশীল সাংবাদিক রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বাংলার মুখ’ ও ‘কেশপুর কথা’র পাতায় পাতায় তার প্রমাণ আছে, অনুসন্ধিৎসার চাপে ওই সব লেখায় তৈরি হয়েছে নানা নতুন শব্দ, যেমন ‘পাট্টাদাস’ বা ‘পার্টি সমাজ’। অন্তর্ঘাতের সদ্য লেখা বৃত্তান্তের খোঁচ-খাঁজেও আনকোরা শব্দবন্ধ বসে আছে, ‘মাঠ-মজুর’, ‘ভৌতিক বাস্তব’, বা ‘কল্প-তথ্য’, টুকে রাখার মতো, শব্দসন্ধানীদের কাজে লাগবে। তবে রাঘব ভাল ভাবে জানেন যে কোনও উপন্যাসই সাংবাদিকতা নয়, একেবারেই নয়, কেবলমাত্র স্বভাব অনুকৃতি বা সমাজতাত্ত্বিক তাৎপর্যে আটকে গেলে উপন্যাসের বারোটা বেজে গেল। রাজনীতির বস্তুজীবন তো শুরুয়াত মাত্র, স্বপ্নজীবনটা তো অভীষ্ট। পৌঁছন তো যাবে না, গেলেই সেটা বস্তুজীবন হয়ে যাবে, আবার শুরু হবে নতুন এক স্বপ্নসাধনার ইতিবৃত্তান্ত। বাস্তব ও স্বপ্নের ফাঁকটুকু নিয়ত জিইয়ে রাখাই তো অন্তর্ঘাতের মর্মকথা।

রক্তজবা রহস্য উন্মোচন বৃত্তান্তের সিংহভাগ জুড়ে আছে একরাশ স্বপ্ন সংলাপ। সান্যাল মশায়ের গো-এষণা টিমের ছাত্রছাত্রীদের কাছে, পুলিশ কর্তাদের তদন্তকালে বা সরকারি সেমিনারে বক্তৃতার ফাঁকে হাজির হয়েছেন ইতিহাসের চেনাজানা স্বপ্নবিলাসীরা, ক্ষুদিরাম ও বঙ্কিমচন্দ্র, মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী ও অরবিন্দ আর সর্বোপরি বৈদ্যকুলজাত কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ। সওয়াল জবাবে এরা দুরুস্ত, লম্বা বক্তৃতা দিতেও এঁদের কেউ কেউ নারাজ নন। যেমন, তরুণ-তরুণীদের কাছে দেওয়া ভাষণে ক্ষুদিরাম সাফসুতরো বলেই দেন, বাস্তবের শরীরে নয় বরং স্বপ্নজীবনে কেউ কেউ বেঁচে থাকে, আর ‘তোমাদের পণ্যসভ্যতার একটা গোড়ার সমস্যা হল এ সম্পূর্ণ রূপে স্বপ্নবিরোধী এবং শরীরকেন্দ্রিক। সুখ, আরাম, প্রতিপত্তি, যশ— এর কোনওটাই স্বপ্নভূমির সন্তান নয়।’ ক্ষুদিরাম একেবারে নাদান নন, তাই আগেই তিনি গেয়ে নেন, ‘হ্যাঁ, আমি শুনেছি নতুন কীসব তত্ত্ব এসেছে, তাতে সমস্ত বড়ো বড়ো স্বপ্ন, মহতী পরিকল্পনাকে খুবই সন্দেহের চোখে দেখা হয়। সত্য-মিথ্যা-সত্য, কল্পনা-বাস্তব সব গুলিয়ে এতটাই একসা যে ধ্রুব বলে কিছু নেই। আমার বাপু এসব শুনলে কেমন ন্যাংটা ন্যাংটা লাগে।’ ক্ষেত্রসন্ধানী গবেষকরা চুপচাপ বক্তৃতা শুনে যায়, রহস্য উন্মোচনের প্রথম পরতটা হয়ত বা ঠাহর করে।

তবে গোয়েন্দা-কর্তার সঙ্গে সওয়াল জবাবে জমিয়ে দিয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র। রহস্যের অবয়বটা তো আগে ভাষায় আকার দিতে হবে, নিজের ভাষাটিকে তো আগে চিনতে, বুঝতে, পড়তে হবে। আদ্যন্ত ভাষার তন্তুতে তৈরি স্বপ্নজীবন আর জ্ঞানের নানা কাণ্ড; সেই ভাষাকেই তো কেড়ে নিচ্ছে ভারচুয়াল মিডিয়া। ঐক্যমত হই বা না হই, রাঘবের লেখা সওয়াল জবাবে বঙ্কিমচন্দ্রের অনন্য মেজাজি প্রতিভার অম্লকষায় স্বাদটুকু আম বাঙালি পাঠকের ভাল লাগবে, এই ভরসা রাখি।

মন চল নিজ নিকেতনে। বলতে দ্বিধা নেই যে উপন্যাসের মাঝে মাঝেই ভাবমাতাল রামপ্রসাদ পাঠকদের বড় উত্যক্ত করেছেন, সন্ধ্যাভাষায় চর্যাপদের গাওনা শোনা গিয়েছে, তন্ত্রধ্বনিও বাদ যায়নি। ঠেকে গিয়ে অগতির গতি শশিভূষণ দাশগুপ্তের শরণ নিয়েছিলাম। পণ্ডিতপ্রবরের মতে, এই সবই ভারতীয় পন্থিক সাধনার ‘উঁজু বাট’-এর কথা। বাইরে গিলে খাওয়া পণ্যসভ্যতার আগ্রাসনের হাত থেকে বাঁচতে হলে নিজের নির্মোক সত্তা, সহ-জ রূপকে ছুঁতে হবে। সেই পরশ পাওয়ার জন্য ‘উজানি’ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। উজানি হওয়ার ইচ্ছেটাই তো রক্তজবার রূপ নেয়, মরণকেও ডেকে আনে। তবে সব মরণ তো সমান নয়। মাস্টার মশায়ের কথা শুনতে শুনতে আমার মনে পড়ছিল দরবেশি তত্ত্বের বাঙালি গানটি, ‘ওরে মরার মতো মরতে পারলে শমন জ্বালা ঘুচে যায়, ও সে কেমন মরা, সাঁইকে ধরে জানতে হয়।’ কর্পোরেট জগতের মিসেস পটেল কি সেই মরাই মরেছিলেন? রহস্যটা অজানা থেকেই গেল।

লেখাজোকায় রাঘব বরাবরই সময় সচেতন। তবে তাঁর সময়বোধ ইতিহাসের পূর্বাপর ক্রমপরম্পরায় আটকে থাকেনি, বরং তাঁর কাহিনিগুলিতে কালের কথা বেণীসদৃশ, বিনুনির প্রতিচ্ছেদের নানা গিঁটে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাঁধা থাকে, গিঁটগুলি খুললেই মানুষের নিজের সময়ের পরিসর ছড়িয়ে পড়ে। একবিংশ শতকের কর্পোরেট টাইম এই পরিসরটুকু দুরুস্ত করেছে, গোলকায়নের প্রযুক্তি আরাম দিয়েছে, বোঝা কমিয়েছে কিন্তু একান্ত ব্যক্তিগত সময় কেড়ে নিয়েছে। ‘প্রতিটি দিন এক ভাবে শুরু হয়, একই ভাবে শেষ হয়।... অতীত একটা মৃতদেহ, যা তারা চিতেয় তুলেছে, কবর দিয়েছে। ভবিষ্যৎ এতটাই জানা যে, যে, তাকে ঘিরে বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই,... আগামীর বীভৎস এক চকচকে ক্যালেন্ডার। আর বর্তমান সেই ঘড়ি যা তাঁদের মাছির মতো কাঁটায় বিঁধে ফেলেছে।’

গত শতকের সত্তর দশকে যুবক রাঘবের সঙ্গী ছিল ভরতিয়ার শ্রমিক কপিল, তার বুকপকেটে টেঁকো লেনিন ও মোচওয়ালা এস্‌তালিনের ছবি থাকত, নিজের ইচ্ছেয় আসলিদের খোঁজে এক দিন কপিল মুলুক যাত্রা করেছিল, কারখানার দেশোয়ালি ভাইরা অপেক্ষা করত, খোঁজ নিয়ে সে কবে ফিরবে, এক দিন তো ফিরবেই। (‘অকালবোধন ও অন্যান্য গল্প’)। একবিংশ শতকের উপন্যাসে কর্পোরেট হয়ে উঠতে যাওয়া কলকাতার রাস্তায় জঞ্জালিদের আস্তানার দিকে বুড়ো রাঘব তাকিয়ে থাকে, প্রাণ ও স্পন্দন খোঁজে, ‘উলঙ্গ শিশু দু-দিকে দুহাত ছড়িয়ে, মুখে ভোঁ ভোঁ শব্দ করতে করতে ট্রামলাইন ধরে ছুটছে।’ ওই চির-অভাবী অথচ সহজ খুশির বস্তিতেই কি ছড়ানো হয়েছে শব্দবীজ, কোনও দিন গজিয়ে উঠবে রক্তজবা গাছের ঝাড়।

পড়েছি যে ফুল জমে জমে পাথর হয়। পাথরটা সরানো যায়, ফুলগাছ কাটতেও অসুবিধা নেই। রাঘব তো রেখে গিয়েছে কয়েকটা মাত্র বই, কেউ কেউ পড়ে, অনেকেই পড়ে না। কর্পোরেট বাস্তবের পোক্ত দেওয়ালে ওইগুলি অন্তর্ঘাতের ফাটল, না খেয়ালি আঁচড়, তা-ও বলা মুশকিল। তবে গোলকায়িত জগৎ থেকে মনুষ্য ভুবনের দিকে হেঁটে যেতে উন্মুখ রামকানাই-এর মতো হাতে গোনা কয়েক জন নির্বোধের কাছে রাঘবের পা-চালির স্মৃতিগদ্যগুলি পথের নিশানা হিসেবে থেকে যাবে, এই প্রত্যয়ে কোনও খাদ নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mystery novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE