Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

এক গভীর ভালবাসার উপাখ্যান

সুভাষচন্দ্র বসু কিছুতেই নিজের জন্মদিনটি মনে রাখতে পারতেন না। তা বলে সব কিছুই ভুলে যেতেন, এমনও নয়। বিদেশিনি বান্ধবী যিনি পরে স্ত্রী হবেন, সেই এমিলিয়ে শেঙ্কল-এর ফোন নম্বরটি মোটেই ভুলতেন না। ভুলতেন না এমিলিয়ে ছোটখাট যা যা পছন্দ করেন।

মা-মেয়ে: এমিলিয়ে ও অনিতা, ১৯৪০-এর শেষ দিকে। ছবি বই থেকে

মা-মেয়ে: এমিলিয়ে ও অনিতা, ১৯৪০-এর শেষ দিকে। ছবি বই থেকে

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

এমিলিয়ে ও সুভাষ/ এক অনন্য সম্পর্কের কাহিনি

লেখক: কৃষ্ণা বসু

মূল্য: ২৫০.০০

প্রকাশক: আনন্দ

সুভাষচন্দ্র বসু কিছুতেই নিজের জন্মদিনটি মনে রাখতে পারতেন না। তা বলে সব কিছুই ভুলে যেতেন, এমনও নয়। বিদেশিনি বান্ধবী যিনি পরে স্ত্রী হবেন, সেই এমিলিয়ে শেঙ্কল-এর ফোন নম্বরটি মোটেই ভুলতেন না। ভুলতেন না এমিলিয়ে ছোটখাট যা যা পছন্দ করেন। ভারতের ধূপকাঠি অস্ট্রিয়ার মেয়ে এমিলিয়ের খুব মনে ধরেছিল। তাই ভারত থেকে ঘুরে আবার ইউরোপে আসার সময় সুটকেসে করে ধূপকাঠি আনতে সুভাষ ভোলেননি মোটেই। সঙ্গে অবশ্য আরও একটা উপহার ছিল। স্বামী বিবেকানন্দের লেখা বই: Thoughts on Vedanta.

মোটেই ভুলতেন না এমিলিয়েকে নিয়মিত চিঠি লেখার কথাও। ১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত আট বছরে এমিলিয়েকে ১৬২ খানা চিঠি লিখেছেন তিনি! অত ব্যস্ত নেতা যিনি সমানে জেলে যাচ্ছেন, জেল থেকে বেরিয়ে হয় নির্বাসনে নয় গুপ্ত অভিযানে যাচ্ছেন, তাঁর পক্ষে চিঠির সংখ্যাটি প্রায় অবিশ্বাস্য! প্রথম চিঠিতেই ভালবাসার মানুষটিকে লিখেছিলেন, ‘চিঠিপত্র লেখায় আমি বেশ অনিয়মিত তবে মানুষ হিসাবে আশা করি আমি খুব খারাপ নই।’ এই আত্ম-ঘোষণার পরও ১৬২টি চিঠি, কোনওটি জেলখানা থেকে, কোনওটি গৃহবন্দি অবস্থাতে। বেশির ভাগ চিঠির উপরেই ব্রিটিশ সরকারের সেন্সর-ছাপ মারা। ফলে ব্যক্তিগত কথা বা আবেগের কথা লেখার বড়ই অসুবিধে। কিন্তু তাতে কী অনুরাগের অভিব্যক্তি দমানো যায়! এ দিক ও দিক নানা কথার ফাঁকেফোকরে জার্মান ভাষায় ঢুকিয়ে দেওয়া হত গভীর সব প্রতিশ্রুতি, ‘যদি ভাগ্য আমাদের এই জীবনে বিচ্ছিন্ন করে দেয় আমি পরজন্মে তোমার জন্য অপেক্ষা করব।’

‘মানুষ হিসেবে’ কেমন ছিলেন নেতাজি, অনেক বই অনেক সন্দর্ভের পরও সে কথা যেন অপূর্ণই থেকে গিয়েছিল, অপেক্ষা করছিল এই বইটির জন্য। এই যে অগ্নিকন্দুকের মতো কর্মবীর মানুষটিকে গাঁধীজি বলেছিলেন তাঁর দেখা শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিকদের এক জন, যে বিপ্লবী নিজে প্রণয়িনীকে বলেছিলেন ‘আমার প্রথম প্রেম এবং একমাত্র প্রেম আমার দেশ, তোমাকে দেবার মতো আমার আর কিছু অবশিষ্ট নেই’, তিনি যে কত গভীর ভাবে ভালবেসে ফেলেছিলেন আল্পস-পারের কমনীয় কিন্তু গভীর অন্তরের তরুণীটিকে, কী ভাবে আমরণ রক্ষা করেছিলেন সেই ভালবাসার মর্যাদা, সেটা না জানলে কি তাঁকে জানা কখনও সম্পূর্ণ হতে পারে? তাঁর ‘প্রথম প্রেম এবং একমাত্র প্রেম (তাঁর) দেশ’ কথাটি এত দিনে আমাদের পরিচিত, কিন্তু আমরা জানতাম না যে এমিলিয়েকে সুভাষ এর পরও আর একটি কথা বলেছিলেন: ‘অবশ্য এ কথা জেনেও তুমি আমাকে গ্রহণ করো’! সুভাষের প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র শিশিরের স্ত্রী কৃষ্ণাকে ভাগ্যিস গল্পচ্ছলে কথাটি বলে ফেলেছিলেন এমিলিয়ে! তাই তো কৃষ্ণা জানালেন আমাদের। নয়তো কি আমরা পেতাম সুভাষের আবেগের জ্যোতির্মণ্ডলটির সত্যি পরিচয়? জানতাম ‘দেবতুল্য’ নেতার অবুঝ প্রেমের দাবিটি?

আরও পড়ুন: বাকিংহ্যামের ‘রয়াল কিচেন’

এমিলিয়ের সচেতন চেষ্টাতেই এমিলিয়ে-সুভাষের প্রণয়কাহিনি অপ্রকাশ্য ছিল বহু বহু দিন। সুভাষ নিজেই যদিও তাঁর বিখ্যাত সাবমেরিন যাত্রার প্রাককালে মেজদাদা শরৎ বসুকে জানিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী-কন্যার কথা, বাইরের পৃথিবী তা জানত না অনেক দিন। নীরব একাকিত্বে সাতসমুদ্রপারে নেতাজি-কন্যাকে বড় করেছেন নেতাজি-পত্নী, প্রচারের আলো থেকে যত দূরে সম্ভব লুকিয়ে থেকেছেন। পরে যখন এমিলিয়ের অস্তিত্ব ভারতবর্ষে জানাজানি হল, ভয়ানক ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিলেন এমিলিয়ে, যেন দয়িতের প্রতিশ্রুতিটি তাঁকে ভাঙতে হল। পরিবারের ঘনিষ্ঠ মানুষরা যাঁরা তাঁকে জানতেন, ভালবাসতেন, যোগাযোগ রাখতেন, তাঁদের কাছেও বেশি বলতেন না নিজের গোপন অন্তরধনের কথা। ভিয়েনার বাড়ির বেডরুমের পাশের টেবিলে সযত্নে রিবন-বাঁধা গোছায় রাখা থাকত সুভাষের চিঠি। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৩ সালে এক দিন শিশির বসু কৃষ্ণা বসুর হাতে গোছাটি তুলে দিলেন এমিলিয়ে। কে জানে, পরের বছর ১৯৯৪-এ তাঁর আর সুভাষের দেখা হওয়ার ষাট বছর হবে ভেবে যে আনন্দ তাঁকে ভরিয়ে রেখেছিল, হয়তো তারই অভিঘাতে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন।

সুভাষচন্দ্র বসু ইতিহাসের নায়ক। আর এই বই বলে দেয়, এমিলিয়ে, সুভাষের মনভুবনের নায়িকা কী ভাবে ১৯৪৮ সালে শাশুড়ির পরিয়ে দেওয়া চুড়ি আজীবন হাতে পরে, বিশ্বযুদ্ধের সময় রেশনের দুধ আর ছেঁড়া ফ্রকের সম্বলে শিশুকন্যাকে মানুষ করে তবু ‘ইতিহাসে উপেক্ষিতা’। এত দিনে সেই উপেক্ষিতাকে তাঁর প্রাপ্য বিস্তারে ইতিহাসে জায়গা করে দিলেন কৃষ্ণা বসু। তিনি ছাড়া এ কাজ কেউ করতে পারত না দুটি কারণে। এক, ভ্রাতুষ্পুত্রবধূ কৃষ্ণা এমিলিয়ে ও এমিলিয়ে-সুভাষের কন্যা অনিতার অতি ঘনিষ্ঠ, তাঁর মতো করে কম মানুষই ওঁদের দুই জনকে জানেন। দুই, ভালবাসার এই অসামান্য উপাখ্যান চাইছিল এক অসামান্য লিখনলাবণ্য। অপেক্ষা করছিল এক জন কৃষ্ণা বসুরই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Emilie and Subhas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE