Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

শ্রীমতীরাও কম গেছো ছিল না

মেয়েরা নামের আগে এখন আর শ্রীমতী লেখে না। এ সম্বোধন বড্ড সেকেলে। এখন তো নব্য যুগ, এখন সবাই কেবল মেয়ে। কিন্তু শ্রীমতী কথাটার মধ্যেই তো একটা শ্রী আছে। বিশেষণটা ছাড়তে গিয়ে সেটাও হারাব?

শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৭ ০০:২৩
Share: Save:

শ্রীসদনের শ্রীমতীরা

লেখক: ঋতা বসু

মূল্য: ১৫০.০০

প্রকাশক: আনন্দ

মেয়েরা নামের আগে এখন আর শ্রীমতী লেখে না। এ সম্বোধন বড্ড সেকেলে। এখন তো নব্য যুগ, এখন সবাই কেবল মেয়ে। কিন্তু শ্রীমতী কথাটার মধ্যেই তো একটা শ্রী আছে। বিশেষণটা ছাড়তে গিয়ে সেটাও হারাব?

আর, শ্রীমতীদের মধ্যে কি বালখিল্যপনা থাকে না? গেছোমি কম থাকে? মোটেই না। সে কথা বেশ বোঝা যায় ঋতা বসু’র বইটিতে। অর্ধ শতাব্দী আগে শ্রীমতী বসু যখন শ্রীসদনে প্রবেশ করেন, তাঁর বয়েস তখন আট। নানা ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে বিশ্বভারতীতে মেয়েদের বোর্ডিং স্কুল পাকাপাকি ভাবে চালু হয় ১৯২২ সালে। ১৯২৮ সালে তৈরি হল হস্টেলের নতুন বাড়ি, শ্রীভবন। পরে সেটাই শ্রীসদন। সেই থেকে এখনও শ্রীসদন জমিয়ে রেখেছে অজস্র মেয়ের কথা, তাদের বড় হয়ে ওঠার কথা, তাদের কৃতিত্বের কথা, তাদের ব্যর্থতার কথা, তাদের নিতান্ত আটপৌরে কথা। সুখ-দুঃখ, সরল-কুচুটে, খোলা হাওয়া-দমবন্ধ, বাধানিষেধ-বেনিয়ম, বাংলা গুলে খাওয়া-ইংরেজি এড়িয়ে চলার মিশেল। হস্টেল পালিয়ে দুষ্টুমি কিংবা ‘পরপুরুষ ফুচকাওয়ালা’র সামনে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া এবং সে জন্য কপালে পরিশীলিত ও সুতীব্র বকুনি।

শ্রীসদনের শ্রীমতীরা অত কম বয়সেই বেশ পাকাপোক্ত নারী হয়ে উঠত, এক শাড়িতে দিনের পর দিন পরিপাটি চালানো থেকে চটপট মশারি টাঙানো— জীবনের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো দক্ষতায় সামলানোর ফলেই হয়তো। আবার জীবনের সেই দৈনন্দিনতায় কী করে যেন রবীন্দ্রনাথের দর্শনের ভিত গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। ব্যক্তিত্বের ভিতও। সুরসিকাও হয়ে উঠত অনেকে। তা না হলে, শাড়ির বদলে মোরব্বা কেনার পর মিষ্টিওয়ালা শাড়িটি নিয়ে ‘বকুল বিছানো পথে’ অদৃশ্য হয়ে গেল— এ হেন বর্ণনা মেলা ভার।

শ্রীসদনের শ্রীমতীরা কোনও ভিনগ্রহের প্রাণী ছিল না, যাদের বসন্ত-উৎসবের সময় দল বেঁধে দেখতে যেতে হয়। তারাও পাতে আস্ত ডিম পেলে শিহরিত হত, আর গুজবে যারপরনাই উদ্বেলিত। হস্টেল জীবনে গুজব প্রায় নিত্যবন্ধু। ‘একদিন চৈতালী এসে খবর দিল আর খালি পায়ে হাঁটা যাবে না। প্রস্টিটিউটরা নাকি যেখানে সেখানে ইচ্ছে করে হিসি করে বেড়াচ্ছে। পা দিলেই সিফিলিস।’— এমন রোমহর্ষক গুজবই কিনা ঘ্যানঘেনে সন্ধেবেলাকে হাসনুহানার চেয়ে অনেক বেশি আমোদিত রাখতে পারে।

আর রাখতে পারে বান্ধবীর বা দিদিদের প্রেম, লুক্কায়িত প্রেম, প্রেমপত্র, প্রেম কত দূর গড়াল— এই সব হিসেবনিকেশ। প্রতি দলে এক জন রাধিকে তো থাকবেই। তার প্রেম-অপ্রেম নিয়ে বেলা বইয়ে দেওয়ার সময় দলের সখীটি বাজি মেরে বেরিয়ে যেত, এ ঘটনাও কম বিস্ময়কর কি?

হস্টেল জীবনে কখন যে প্রকৃতি থেকে রঙ সোজা বারান্দা পেরিয়ে শ্রীসদনের ঘরে ঢুকে পড়ত, তার সন-তারিখ অতএব হিসেব না করাই ভাল। চমৎকার, স্বাদু বাংলায় লেখা বইটি নিটোল মেদুর ষাট-সত্তর দশকের আমেজ এনে দিল। যার ওম এখনও, এই উদ্দাম টেকনোলজির যুগেও বেশ পোহানো যায়।

স্বামী বিবেকানন্দের লেখা ও কথা

লেখক: স্বামী বিবেকানন্দ

মূল্য: ৩০০.০০

প্রকাশক: তালপাতা

গন্ধমাদন থেকে বিশল্যকরণী খুঁজে আনা সহজ নয়। স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা বাঙালির ঘরে ঘরে সাজানো থাকে, সেই খণ্ডগুলি খুব একটা খুলে দেখার চেষ্টা পাঠকেরা করেন বলে মনে হয় না। আলোচ্য বইটি বিশল্যকরণী। লেখায় আছে বিবেকানন্দের ‘বিলাতযাত্রীর পত্র’ নামক ভ্রমণকাহিনির অংশ। বলা অংশে টুকরোগুলি নেওয়া হয়েছে শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর ‘স্বামী শিষ্য সংবাদ’ রচনা থেকে। শেষ অংশে রয়েছে স্বামীজির কথা। স্বামীজিকে যাঁরা দেখেছেন এমন মানুষজনের স্মৃতিকথন রয়েছে সেখানে। এই নির্বাচিত টুকরো থেকে যে বিবেকানন্দ উঠে আসেন তিনি পর্যবেক্ষক, দার্শনিক, রসিক, বাকপটু, স্বদেশপ্রেমী সন্ন্যাসী। ‘সাহেবদের… সমস্ত দ্রব্যেই utility, আমাদের সর্বত্র আর্ট।’ ‘আমাদের বাঙলা দেশটা বড় sentimental কি-না, তাই এখানে এত dyspepsia।’ মুখের কথার মতো লেখার ভাষাও কোথাও কোথাও মুচমুচে, কোথাও ভাবগম্ভীর। বিবেকানন্দের উদার মানবতাবাদী মুখটিকে তুলে ধরাই এই সংকলনটির উদ্দেশ্য। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই স্বল্পায়ু এই চিন্তকের চলতে চলতে বলা ও বলতে বলতে চলার মধ্যে কখনও কখনও ভাবনার বিরোধ তৈরি হয়েছিল— সেই বিরোধের বিন্যাসটি প্রকাশ করা এ সংকলনের লক্ষ্য নয়। বিবেকানন্দের লেখা ও বলা নির্বাচনে একটি করে রচনাকে প্রাধান্য দেওয়াতেই তা স্পষ্ট।

সাদাসিধে খসড়া

লেখক: ফাদার দ্যতিয়েন

মূল্য: ২০০.০০

প্রকাশক: আনন্দ

স্বদেশে স্মৃতিলেখ তৈরির সময়ই স্থির করেন ‘পুনরায় বঙ্গদেশে পর্যটন করে পরিচিত-অপরিচিতদের কাছে নব নব আখ্যায়িকার উপাদান সংগ্রহ করব।’ ফাদার দ্যতিয়েন-এর (১৯২৪-২০১৬) জন্ম বেলজিয়ামের রশফর-এ, থাকতেন ব্রাসেলস-এ। কলকাতায় আসেন ১৯৪৯-এ, ফিরে যান ’৭৭-এ। কলকাতায় তো বটেই, বাংলা ভাষা শেখেন শ্রীরামপুর, বিশ্বভারতীতেও। নিজস্ব প্রতিভায় পৌঁছেছিলেন বাংলা ভাষার এতটাই গভীরে যে তাতে সৃষ্টি করেন উচ্চ মানের সাহিত্য, প্রবন্ধ-অনুবাদ-রম্যরচনা। সাদাসিধে খসড়া তাঁর শেষ লেখা। বঙ্গভাষাপ্রিয় এই রসিক মানুষটি নিজস্ব শৈলীতে, এক অননুকরণীয় ভঙ্গিতে, মৃদু পরিহাস কিংবা কৌণিকতা মিশিয়ে যে কোনও বিষয়কে অনায়াসে স্বাদু সাবলীল ও পাঠযোগ্য গদ্যে পেশ করতেন। যেমন ‘অনুবাদ প্রসঙ্গে’ লিখছেন ‘স্মরণে রাখুন যে, অপরভাষী কোনও লেখকের লেখা যাঁরা অনুবাদ করতে উদ্যত হন, তাঁদের পক্ষে সেই লেখকের শুধু ভাষার সঙ্গে নয়, সংস্কৃতির সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ পরিচয় থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়।’ আবার ‘স্ত্রীর প্রতি পত্র’-এ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে পত্রালাপ প্রসঙ্গে ফাদার লিখছেন ‘‘সত্যেন্দ্রনাথ মনমরা, বৎসরব্যাপী বিচ্ছেদের জন্য পত্নী তবু বন্ধুবর্গের সান্নিধ্যলাভ করেন। পতি কিন্তু সম্পূর্ণ একাকী, লিখছেন, ‘অধিক কাহারও সঙ্গে মিশি নে— কেবল তোমার আসার প্রতীক্ষা করিয়া আছি।’’ প্রথম রচনাটি ‘বঙ্গদেশে প্রত্যাগমন’, সেটির শেষে লিখছেন ‘গতদিনগুলির অনবদ্য সেই ম্যাজিক কোথায়? কোথায় শিয়ালের ডাক? কোথায় ঢেঁকির ছন্দোময় আওয়াজ? প্রগতি দেবীকে পেন্নাম, উন্নতি দেবতাকে ধন্যবাদ। আমি চললাম।’ বইটিতে চমৎকার প্রচ্ছদ ও অলংকরণ দেবাশীষ দেবের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Swami Vivekananda
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE