Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

নীলচাষ বন্ধ হয়নি, ব্যবহার পাল্টেছে

উনিশ শতকের গোড়ায় বাংলার মাটিতে নীলচাষ কী ভাবে জাঁকিয়ে বসেছিল, ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে তা সবিস্তার আলোচনা করেছেন। আপাতত এই তথ্যটিই যথেষ্ট যে, ১৭৮৩-’৮৪-র ১২০০ মন থেকে ১৮০৪-’০৫ সালে নীল উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে হয়েছিল ৬২ হাজার মন।

সৌমিত্রশংকর সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

ইন্ডিগো রিবেলিয়ন: আ সিলেকশন, সম্পা: আনন্দ ভট্টাচার্য। দে’জ, ৫০০.০০

যুক্তবঙ্গে নীলচাষ: নীলবিদ্রোহের ইতিহাস, সম্পা: সুস্নাত দাশ। নক্ষত্র, ৫০০.০০

ইন্ডিগো প্ল্যান্টেশন ইন বেঙ্গল, অমলেন্দু দে। পারুল, ২৯৫.০০

কালচার অব ইন্ডিগো ইন এশিয়া: প্ল্যান্ট প্রোডাক্ট পাওয়ার, সম্পা: কপিলা বাৎস্যায়ন। নিয়োগী বুকস, ৭৯৫.০০

ই হুদি উপাসনাস্থল সিনাগগের একটি কক্ষে পুরনো বই ও নথি রাখা হয়। কক্ষটির নাম গেনিজা। পুরনো কায়রোর বেন এজরা সিনাগগে ১৮৯৬-’৯৭ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন গবেষক গেনিজা পেপার্স-এর বিপুল ভাণ্ডার খুঁজে পান। একটি নথি অনুযায়ী, বণিক ইবন আক্কাল ৯৮০-১০৩০ খ্রিস্টীয় কালপর্বে কোঙ্কন উপকূল থেকে মিশরে নীল আমদানি করতেন।

বেন এজরার গেনিজার এই তথ্য নেহাতই হাজার বছরের পুরনো। ২৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরে শেষকৃত্যের আগে মৃতদেহ নীলে ছোপানো কাপড়ে ঢাকা হত। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে নীলের উল্লেখ আছে, আছে জাতকে। নীল রঙের গামলায় পড়ে যাওয়া পঞ্চতন্ত্রের শৃগালটি তো এ সবের মূর্তিমান সাক্ষী।

বহুজাতিক ভারতবর্ষে অঞ্চলভেদে নীলের অষ্টোত্তর শত নাম। ভারতের বাইরে আরবি আল-নিল, পর্তুগিজ অনিল, ইউরোপের সর্বত্র ইন্ডিকাস এবং ইন্ডিগো— সব নামেরই উৎস ভারতীয়। প্লিনির লেখাতে পণ্যটির নাম ইন্ডিকাস, অর্থাৎ ভারতাগত পণ্য। বিশেষ পণ্যের নাম হিসেবে সামান্যীকৃত শব্দের ব্যবহার ভারতের পণ্য সমাহারে নীলের আপেক্ষিক গুরুত্বের সাক্ষ্যই দেয়।

শিল্পবিপ্লবোত্তর ইউরোপে বস্ত্রশিল্পে নীল রঙের চাহিদা মেটাত ওড নামে একটি গুল্ম। ভারতের নীল ওড-কে সরিয়ে ইউরোপের বাজার দখল করলে আসরে নামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্ল্যান্টাররা। আঠারো শতকের শুরুতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ইউরোপে নীল রফতানি বন্ধ করতে হল। পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নীলকররা লাভজনক কফি ও চিনি চাষে উদ্যোগী হলে কোম্পানি ফের ভারত থেকে ইউরোপে নীল পাঠানো শুরু করে। এ বার ঠিকানা হল বাংলাদেশে। উনিশ শতকের গোড়ায় বাংলার মাটিতে নীলচাষ কী ভাবে জাঁকিয়ে বসেছিল, ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে তা সবিস্তার আলোচনা করেছেন। আপাতত এই তথ্যটিই যথেষ্ট যে, ১৭৮৩-’৮৪-র ১২০০ মন থেকে ১৮০৪-’০৫ সালে নীল উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে হয়েছিল ৬২ হাজার মন।

উনিশ শতকের শুরুতে নীলচাষের যে প্রসার, তার সাময়িক বিরতি ঘটে ১৮৩০ সাল নাগাদ এজেন্সি হাউসগুলির পতনে। এ সময় অধোগতি থেকে নীলকরদের বাঁচায় ইউনিয়ন ব্যাংকের মতো কিছু প্রতিষ্ঠানের ঋণ এবং নতুন কিছু আইন, যার অন্যতম শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ প্রজাদের ভারতে বসবাস ও জমি কেনার অধিকার। এর সঙ্গে নীলকর সভা প্রতিষ্ঠা, ‘দ্য প্ল্যান্টার্স জার্নাল’ প্রকাশে নীলকরপন্থী রাজনৈতিক কণ্ঠ তৈরি হল। ১৮৩০ পর্যন্ত যদি প্রসার কাল, তা হলে ১৮৩০-’৫০ ছিল বাংলায় নীলের সুবর্ণ যুগ এবং একই সঙ্গে নীলকরদের প্রাধান্য ও শোষণের কালপর্ব। নীলবিদ্রোহ তার সচেতন প্রত্যাঘাত।

এই নীলবিদ্রোহ দুটি বইয়ের মূল আলোচ্য। আনন্দ ভট্টাচার্যের ইন্ডিগো রিবেলিয়ন: আ সিলেকশন ১৮৫৯-’৬২ পর্বে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ ও ‘দি ইন্ডিয়ান ফিল্ড’-এ প্রকাশিত রচনার নির্বাচিত সংকলন। হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় (১৮৫৬-’৬১) ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ হুল ও মহাবিদ্রোহের প্রতি বিরূপতা দেখালেও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উচ্চকিত হয়েছিল। নীলবিদ্রোহের তুঙ্গমুহূর্তটি ধরার তাগিদে আনন্দ ভট্টাচার্য ১৮৫৮-র আগে প্রকাশিত কোনও লেখা না নেওয়ায় বঙ্গমানসের পরিবর্তনের দিকচিহ্নগুলি অধরা থেকে গেছে। ‘ইন্ডিয়ান ফিল্ড’-এর চারটি রচনাই ১৮৬১-র। কিশোরীচাঁদ মিত্রের সম্পাদনায় প্রতিষ্ঠালগ্ন (মার্চ, ১৮৫৮) থেকে প্রকাশিত নীলকরবিরোধী বহু আলোচনা তাই থেকে গেছে বাইরে।

অতিদীর্ঘ ভূমিকাটি পূর্বাপর আলোচনার পুনরুক্তি, ফলত মৌলিকত্বহীন ও ক্লান্তিকর। কাম্য ছিল সংকলনের উদ্দেশ্য ও গৃহীত রচনাগুলির আলোচনা। সংকলিত প্রতিটি লেখাই গুরুত্বপূর্ণ। লং-এর ‘স্ট্রাইক বাট হিয়ার’ নামের প্রসিদ্ধ প্রচারপত্র সংক্রান্ত প্রতিবেদনও স্থান পেয়েছে। সংকলনের আকরমূল্য মনে রাখলে অজস্র মুদ্রণপ্রমাদ ক্ষমার্হ থাকে না। প্রচ্ছদ ও আখ্যাপত্রে ভিন্ন গ্রন্থনাম, সংকলককে ব্লার্বে ‘লেখক’ হিসেবে উল্লেখ করা বিভ্রান্তিকর।

সুস্নাত দাশ সম্পাদিত সংকলনে একত্রিশটি প্রবন্ধ, চারটি বিভাগে বিন্যস্ত। গোড়ায় পথিকৃৎ নানা লেখা। প্রমোদরঞ্জন সেনগুপ্ত, ব্লেয়ার ক্লিং, সুপ্রকাশ রায়, অমলেন্দু দে-র সঙ্গে আছেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রবন্ধ নির্বাচনে পরিকল্পনার ছাপ আছে। কেন্দ্রে আবদ্ধ না থেকে প্রান্তীয় বিষয়গুলিকেও স্পর্শ করা হয়েছে। অপ্রাপ্তির মধ্যে মনে পড়ছে মেসবা উল হকের ‘পলাশী যুদ্ধোত্তর মুসলিম সমাজ ও নীলবিদ্রোহ’ বইটির কথা, যার প্রাসঙ্গিক অংশ অন্তর্ভুক্ত হতে পারত। সাম্প্রতিক চর্চা অংশের প্রবন্ধগুলি আশা পূরণ করে না। অজস্র পুনরুক্তি সংকলনের ভার বাড়িয়েছে। সম্পাদকের দীর্ঘ প্রবন্ধটিতেও পুনরাবৃত্তি না থাকলেই ভাল হত।

নীলবিদ্রোহের শতবর্ষ উদযাপন কালে অমলেন্দু দে তখন পর্যন্ত উত্থাপিত রাজনৈতিক প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজেছিলেন আরও গভীর ও বিস্তৃত পরিসরে। দক্ষতা ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সম্মেলনে কী ভাবে যুক্তবঙ্গে নীলশিল্পের কাঠামো তৈরি হয়েছিল এবং নীল কী ভাবে গড়ে দিয়েছিল ঔপনিবেশিক অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পথরেখা তা-ই ছিল তাঁর তন্নিষ্ঠ অধ্যয়নের বিষয়। ১৯৬০-’৮২ কালপর্বে প্রকাশিত সাতটি প্রবন্ধ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। ভারতে নীলচাষের ঐতিহাসিক সমীক্ষার পর আলোচিত হয়েছে বাংলাদেশে নীলচাষের বৃদ্ধি ও বিস্তার। বাংলা থেকে নীল রফতানি, এবং কী ভাবে নীলচাষ রায়ত নিষ্পেষণের যন্ত্রে পরিণত হল নীলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও ভৌগোলিক প্রসারণের সূত্রে, তা আলোচিত হয়েছে। দু’দশক ধরে বিচ্ছিন্ন প্রবন্ধ হিসেবে লেখা হলেও মূলত প্রাথমিক সূত্র থেকে আহরিত তথ্য বিশ্লেষণে ঐতিহাসিক অন্তর্দৃষ্টি ও লেখাগুলির পূর্বাপর সংহতির কারণে একই গ্রন্থশরীরে আনুপূর্বিক পাঠ অন্যতর অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করায়।

১৮৫০ নাগাদ যে সংকটের সূচনা, তার ঘনীভবন ও পরিণতি নীলবিদ্রোহে। বাংলার কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের প্রধান ধারা হিসেবে নীলের পতন ঘটল। ওই সময়েই ফন বেয়ার কৃত্রিম নীল আবিষ্কার করলেন, যার বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হল ১৮৯০ সালে। প্রাকৃতিক নীল তার পথ ছেড়ে দিতে বাধ্য হল।

কয়েক হাজার বছর আগে তিনটি মহাদেশে যার চাষ শুরু— ভারত মহাসাগর, পারস্য উপসাগর, ভূমধ্যসাগরের বাণিজ্য যার শাসনে ছিল, প্রায় সাতশো প্রজাতি নিয়ে যে কৃষিপণ্যটি দাপটের সঙ্গে রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে, উনিশ শতকের শেষ পঞ্চাশ বছরে নিঃশেষিত শক্তি সে হারিয়ে গেল! একদা বাংলার নীলের প্রধান প্রজাতি ইন্ডিগোফেরা টিংকটোরিয়া খুঁজে পাওয়ার কথা লিখেছেন রবি গজনভি, কপিলা বাৎস্যায়ন সম্পাদিত ইন্ডিগো ইন এশিয়া বইয়ে। বাংলাদেশের উত্তর প্রান্তের চাষিরা জৈব সার হিসেবে ব্যবহারের জন্য ওই প্রজাতির চাষ করে। নীলের চাষ বন্ধ হয়নি, ব্যবহার পাল্টেছে মাত্র। এই সূত্রেই রুবি এবং অন্য আলোচকেরা জানান প্রাকৃতিক নীল ফিরিয়ে আনার বহুতর উদ্যোগের কথা।

এক সেমিনারে আলোচিত গবেষণাপত্রগুলি সংকলনে চার ভাগে বিন্যস্ত হয়েছে: বৈজ্ঞানিক দিক, ইতিহাস ও নৃতত্ত্ব, বিশ্বায়নপূর্ব বিশ্ববাণিজ্য এবং সাম্প্রতিক নীলচর্চা। আলোচকেরা প্রায় সবাই এশিয়ার বিভিন্ন দেশের নীলের সঞ্জীবন প্রকল্পের অংশভাক। নীলের প্রজাতিগত বৈচিত্র, রঙ নিষ্কাষণ-জারণ প্রক্রিয়া, সারখেজ, বায়ানা-সহ একদাপ্রধান কেন্দ্রে নিষ্কাষণ পদ্ধতির পুরাতাত্ত্বিক তথ্য, পরিবেশচেতনার কালে প্রাকৃতিক নীলের সঞ্জীবন ভাবনার সঙ্গে আলোচিত হয়েছে এশিয়ার দেশগুলিতে চারুকলায় অপরিহার্যতা, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও অন্যত্র পার্বত্য জনজাতির জীবনে নীল, নীলরঙ ঘিরে বিবিধ সংস্কার তথা নীল উৎপাদনে যুক্ত জনগোষ্ঠীর সমাজচ্যুতির বৃত্তান্ত।

লেখাগুলি পড়ে আগ্রহী হয়ে ভারতে এখন কী ভাবে প্রাকৃতিক নীল তৈরি হয়, ইন্টারনেটে তার কয়েকটি তথ্যচিত্র দেখি। অস্বাস্থ্যকর আদিম পদ্ধতিতে, অর্ধনগ্ন একদল মানুষের প্রবল কায়িক শ্রমে নীল নিষ্কাষণের চলচ্ছবি দেখে প্রশ্ন জাগে, ‘ন্যাচারাল’ ও ‘অর্গানিক’ পণ্যের পশ্চিম নির্ণীত চাহিদা অববিশ্বের শ্রমশোষণের নতুন পথ উন্মুক্ত করছে না তো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE