Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

শূন্যতার ভিতরে জেগে ওঠে অধ্যাত্মবোধ

অবনীন্দ্র গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত অতীন বসাক-এর একক প্রদর্শনীটি দেখলেন মৃণাল ঘোষশব্দের ভিতর থাকতে পারে নৈঃশব্দ্য। থাকতে পারে কোলাহলের ভিতরেও। এই স্তব্ধতাই কখনও কখনও জীবনকে চেনায়। অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের মধ্যবর্তী শূন্যতাকে উন্মীলিত করে কোনও শিল্পী অনুধাবনের চেষ্টা করতে পারেন আত্মস্বরূপের এবং প্রবাহিত বাস্তবেরও অন্তর্লীন স্পন্দনকে।

ছবি: অতীন বসাক।

ছবি: অতীন বসাক।

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৭ ০১:২৩
Share: Save:

শব্দের ভিতর থাকতে পারে নৈঃশব্দ্য। থাকতে পারে কোলাহলের ভিতরেও। এই স্তব্ধতাই কখনও কখনও জীবনকে চেনায়। অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের মধ্যবর্তী শূন্যতাকে উন্মীলিত করে কোনও শিল্পী অনুধাবনের চেষ্টা করতে পারেন আত্মস্বরূপের এবং প্রবাহিত বাস্তবেরও অন্তর্লীন স্পন্দনকে। যেমন করেছেন অতীন বসাক আইসিসিআর-এর অবনীন্দ্র গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তাঁর একক প্রদর্শনীতে। ‘আর্ট টুমরো’ সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত এই প্রদর্শনীতে অতীন দেখিয়েছেন টেম্পারা ও এচিং-এ করা তাঁর ৫০টি ছবি।

২০০৩ সাল থেকে কলকাতায় একক প্রদর্শনী করেছিলেন ১৯৯২ ও ১৯৯৯ সালে। ইতিমধ্যে অন্যান্য শহরে অবশ্য অনুষ্ঠিত হয়েছে তাঁর কয়েকটি একক। কলকাতায় আমরা তাঁর ছবি দেখেছি প্রতি বছর ‘সোসাইটি’-র বার্ষিক প্রদর্শনীতে বা অন্যান্য সম্মেলকে। এত দিন পরে তাঁর এতগুলো ছবি একসঙ্গে দেখতে পাওয়ার সুযোগে তাঁর জীবনবোধ ও আঙ্গিকভাবনার প্রায় সামগ্রিক এক পরিচয় উঠে এল আমাদের সামনে। অতীন ১৯৯১-তে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে স্নাতকশিক্ষা শেষ করেছেন। এর পর ১৯৯৩-তে বরোদা থেকে ছাপচিত্রে স্নাতকোত্তর করেছেন। ছাপচিত্রে বিশেষত এচিং মাধ্যমে তাঁর দক্ষতা সুপরিচিত। পাশাপাশি টেম্পারা মাধ্যমটিকেও দীর্ঘ অনুশীলনে তিনি আয়ত্ত করেছেন। আলোচ্য প্রদর্শনীতে তাঁর এই দুটি মাধ্যমের কাজ পাশাপাশি দেখে আমরা অনুধাবন করতে পারি— একই বিষয় বা সমধর্মী বিষয় মাধ্যমের ভিন্নতায় কেমন করে প্রকাশে দুই ভিন্ন মাত্রা আনতে পারে।

অতীনকে বলা যেতে পারে ১৯৯০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পী। এই দশকের প্রধান শিল্পীরা প্রকাশের এক স্বতন্ত্র অভিমুখ সন্ধান করেছেন। এর মূলে ছিল দুটি স্বতন্ত্র সামাজিক ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি। এই দশকেই পাশ্চাত্যের ‘পোস্টমর্ডানিজম’-এর অনুপ্রবেশ ঘটেছে ‘গ্লোবালাইজেশন’ বা বিশ্বায়নের হাওয়ায় ভর করে। এই দুটি পরস্পরের বিপ্রতীপ বা দ্বন্দ্বাত্মক প্রকল্প। বিশ্বায়ন যখন জীবনের ও সংস্কৃতির বৈচিত্রকে একীভূত করতে চায় অথচ কেন্দ্র ও প্রান্তের মধ্যে, সংস্কৃতির বৈচিত্রের মধ্যেও সমন্বয়ের সন্ধান করে। আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পোস্টমডার্ন-তত্ত্বের অনুসারী শিল্পীরা তাঁদের ভাবনা-ভিত্তিক বা ‘কনসেপচুয়াল’ প্রকাশভঙ্গির মধ্য দিয়ে আধুনিকতা-সঞ্জাত ও বিশ্বায়ন-সঞ্জাত অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভাষ্য গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন।

অতীনের ছবিতে প্রবহমান ঐতিহ্য ও ‘কনসেপচুয়াল’ প্রকাশভঙ্গির মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। তাঁর ছবি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অবয়বী, অবয়ব-বিন্যাসেও স্বাভাবিকতার দিকে ঝোঁকই বেশি। সেই স্বাভাবিকের ভিতরেই অভিব্যক্তির ব্যঞ্জনায় এবং অবয়ব ও প্রেক্ষাপটের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় তিনি নৈঃশব্দ্য তাড়িত এক শূন্যতাকে জাগিয়ে তোলেন। এই শূন্যতা হয়ে ওঠে অন্তর্লীন এক অধ্যাত্মবোধের স্মারক। এই যে অধ্যাত্মচেতনা, এর মধ্যে ভারতীয় দর্শনগত ঐতিহ্যের সারাৎসার অনুভব করা যায়। সেই শূন্যতালিপ্ত আধ্যাত্মিকতা দিয়ে তিনি সাম্প্রতিককে আঘাত করেন। এই সংঘাতের মধ্যে থাকে পোস্টমর্ডানের অভিমুখ। যে ঐশ্বর্য ছিল, তা সবই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পড়ে থাকছে তার ‘ফসিল’।

‘ফসিল’ শিরোনামে অন্তত তিনটি ছবি আছে এই প্রদর্শনীতে। যা ফসিল বা মৃতকল্প নয়, যা জীবন্ত— তার ভিতর অনিবার্য ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে জমাট এক নৈঃশব্দ্য বা ‘সাইলেন্স’, যা তাঁর চিত্রভাবনার মূল সুর। সমস্তই আছে অথচ সেই অস্তিতা থেকে জেগে উঠছে শূন্যতা। কতকগুলি ছবিতে তিনি মানবিক বৈকল্যকে সরাসরি আঘাত করেছেন, যেমন ‘দ্য কিং’ শিরোনামের কয়েকটি টেম্পারা। কতকগুলি ছবিতে তিনি অস্তিত্বের আলোর সন্ধান করেছেন, যেমন ‘এক্সিসটেন্স’ শীর্ষক পাখির রূপায়ণগুলি। এই দুই প্রান্তের মাঝখানে রয়েছে অনমিত এক নৈঃশব্দ।

‘সং অব সাইলেন্স’ শীর্ষক একটি এচিং-এ যেমন মিশরীয় স্তব্ধতা মণ্ডিত একটি মুখ, সামনে কণ্টকাবৃত এক বৃক্ষ, তার উপর একটি পাখি। আলো ও আঁধারের সংঘাত থেকেই জেগে ওঠে স্তব্ধতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Exhibition Atin Basak
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE