Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

লৌকিক চেতনা থেকে উৎসারিত সৌন্দর্য

গ্যালারি ৮৮-তে অনুষ্ঠিত রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষশারদ অর্ঘ্য শিরোনামে রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা ৩৬-টি ছবি নিয়ে প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল গ্যালারি-৮৮-এ। এক ঝলক বিশুদ্ধ বাতাসের মতো তাঁর ছবি আজও দর্শকের মনকে সঞ্জীবিত করে।

শিল্পী: রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়।

শিল্পী: রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

শারদ অর্ঘ্য শিরোনামে রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা ৩৬-টি ছবি নিয়ে প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল গ্যালারি-৮৮-এ। এক ঝলক বিশুদ্ধ বাতাসের মতো তাঁর ছবি আজও দর্শকের মনকে সঞ্জীবিত করে। বিশুদ্ধ বাতাস এখন আর এই শহরে নেই। গ্রামেও কি আছে? রামানন্দবাবু নিজের সম্পর্কে বলেছেন অনেক সময় : ‘এই শহরে আমি গ্রামের প্রতিনিধি’। সেই গ্রাম কি আজকের গ্রাম? না কি চিরন্তনের লৌকিক চেতনা? সাম্প্রতিকের সমস্ত দুরাচার ও সংকট অতিক্রম করে অথবা আত্মস্থ করে আদর্শায়িত এক সৌন্দর্যের স্বপ্ন অনেক সময়ই দেখেন কোনও শিল্পী। সৌন্দর্যের এক অচঞ্চল শিখাকে উন্মীলিত রাখতে চান। অনেক সময় সেটাই হয়ে ওঠে সাম্প্রতিকের ভ্রষ্টতার বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ। সেরকমই এক লৌকিক চেতনা উৎসারিত আদর্শায়িত সৌন্দর্য আলোচ্য প্রদর্শনীর ছবিগুলিতে লিপ্ত হয়ে থাকে।

বাংলা কবিতায় ১৯৮০-র দশক থেকে ‘উত্তর-আধুনিক’ নামে একটি অভিধার কথা বলতে চাইছিলেন অল্প সংখ্যক কয়েকজন কবি ও কবিতা বিষয়ে ভাবুক। এই ‘উত্তর-আধুনিক’ কখনওই সমসাময়িক কালে পশ্চিমী ঝঞ্ঝায় উড়ে আসা ‘পোস্ট-মডার্ন’ নয়। বরং সেই ‘পোস্ট-মডার্ন’-এর ভ্রষ্টতাকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে অবিচলিত এক ‘অসীমের নন্দন’। ঔপনিবেশিকতা আমাদের আত্মচেতনাকে এবং আলোকিত ঐতিহ্যকে তমসালিপ্ত করেছে দীর্ঘদিন থেকে। সেই তমসায় আমাদের আত্মপরিচয় আবিল হয়ে গিয়েছিল। তাকেই পুনরুদ্ধার করার প্রকল্পে কাজ করতে চাইছিলেন সেইসব কবি। এখানকার আলোড়নময় বাজারের গভীরে খুব সন্তর্পণে সেই কাজটি এখনও চলছে।

চিত্রকলার ক্ষেত্রে আধুনিকতার এরকম একটা আত্মপরিচয় সন্ধানের প্রকল্প শুরু হয়েছিল বিংশ শতকের সূচনা থেকে। ‘নব্য-ভারতীয় ঘরানা’-র এই আত্মপরিচয় সন্ধানী আন্দোলনই আমাদের দৃশ্যকলার আধুনিক পর্বে প্রথম এবং শেষ সংগঠিত আন্দোলন। তা কতটা সুফল ফলিয়েছিল, তা আমরা দেখতে পাই অবনীন্দ্রনাথ থেকে নন্দলাল হয়ে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, যামিনী রায় পর্যন্ত চিত্রকলার বিস্তারে। রবীন্দ্রনাথের ছবি একান্ত আপন স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও এই মননেরই আলোকিত ফসল, আজ এ কথা মেনে নিতে কোনও দ্বিধা নেই। স্বদেশচেতনা-অন্বিত এই আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে পরবর্তী কালে অনেক শিল্পী ও তাত্ত্বিকই সোচ্চার হয়েছেন। সেই সুযোগে ধনতান্ত্রিক পাশ্চাত্যের উত্তর-ঔপনিবেশিক ঔপনিবেশিকতা আমাদের জীবনকে যেমন, তেমনই সংস্কৃতিকেও ক্রমাগত ধ্বস্ত করে যাচ্ছে।

কিন্তু ভিতরে একটা প্রতিরোধ সব সময়ই কাজ করেছে। ১৯৬০-এর দশক পরবর্তী আধুনিকতাবাদী বিস্তারের মধ্যে যেটুকু এই ‘অসীমের নন্দন’ আত্তীকৃত হয়েছে, তাতেই কবিতার মতো আমাদের দৃশ্য-কলাও পাশ্চাত্যের চর্বিতচর্বণ পরিহার করে আপন স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর হতে পেরেছে।

রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৬০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পী। কিন্তু ষাটের দশকের প্রচলিত আধুনিকতাবাদী প্রকল্প থেকে তাঁর ছবি একেবারেই আলাদা। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত বিশ্বভারতী কলাভবনে তিনি নন্দলাল বসুর অধীনে চিত্রশিক্ষা করেছেন। বীরভূমের বনপারুলিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম ১৯৩৬ সালে। যে আলো তিনি অর্জন করেছেন এই দুটি উৎস থেকে, তাকেই তিনি সঞ্জীবিত করে গেছেন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। আজ তিনি নাগরিক হলেও কৃষি-ভিত্তিক বাংলার গ্রামীণ কৌমচেতনার সারাৎসার থেকেই উদ্ভাসিত হয় তাঁর রেখাধৃত রূপাবয়ব। সেই রূপ আজ বাস্তবে প্রত্যক্ষভাবে নেই হয়তো, কিন্তু যৌথ নিশ্চেতনার ভিতর রয়ে গেছে। তাকেই শিল্পী উদ্ধার করেন। আজকের বাস্তবতায় প্রতিস্থাপিত করতে চান।

এখান থেকেই হয়তো তৈরি হয় একটি সংশয়ের ক্ষেত্র। যা শুধু স্মৃতির আলেখ্য, অতীতের আদর্শায়িত কল্পনার ফসল, সাম্প্রতিকের বাস্তবতার সঙ্গে তার যে কালিক-ব্যবধান সৃষ্টি হয়, তার নিরসন কীভাবে হতে পারে? কোনও ভাবে কি সেই অতীতকে সমন্বিত করা যায় সাম্প্রতিক মূল্যবোধের সঙ্গে? সেই সমন্বিত রূপকল্প হয়তো সাম্প্রতিকের ভিতর নতুন আলোও জ্বালতে পারে। যে সময়ের মধ্যে বেঁচে আছি, তা থেকে তো আমাদের নিস্তার নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ramananda Bandyopadhy Painting Solo Exhibition
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE