Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
আলোচনা

মনন আর কল্পনার রঙে

‘সীতাহরণ’-এ দেখতে পাই সম্পূর্ণ আধুনিক সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে সীতার বিপন্নতার করুণ ছবি—যেখানে তাঁকে দেখানো হয়েছে লালসালিপ্ত ব্র্যাঘ্ররূপী রাবণের অপহরণের শিকার হিসেবে।

পৌরাণিক: অ্যাকাডেমিতে দীপককুমার শাহ-র একক প্রদর্শনীর একটি ছবি

পৌরাণিক: অ্যাকাডেমিতে দীপককুমার শাহ-র একক প্রদর্শনীর একটি ছবি

শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

সম্প্রতি দীপককুমার শাহ-র একক অনুষ্ঠিত হল অ্যাকাডেমিতে। বিশ্বভারতীর এই নবীন শিল্পীর কাজ অবশ্যই নতুনত্বের দাবি রাখে। বর্তমান সমাজে ভারতের পৌরাণিক ও ধর্মীয় উপাখ্যান, উপকথার যে প্রভাব বহমান, সেটি তাঁকে ভাবায়, গভীর ভাবে নাড়া দেয়। তাই অতি প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনিগুলি থেকে বিভিন্ন ঘটনা, চরিত্র, দৃশ্যকল্প ইত্যাদি অবলীলায় উঠে আসে তাঁর ভাবনায়। রেখাপাত করে অনুভূতির গভীর স্তরে, চেতনা, মনন আর কল্পনার রঙে। শিল্পীর চিন্তায়, খেয়ালরসের বুনটে মিলেমিশে যায় সম্ভব-অসম্ভবের সীমারেখা। তিনি বিশ্বাস করেন প্রত্যেকটি মানুষের আপাত সভ্য উজ্জ্বল পোশাকের মধ্যে, তার সভ্যতা-ভব্যতার মধ্যে বাসা বেঁধে আছে কোনও আদিম পাশবিক সত্তা। তাই অর্ধমনুষ্য কায়া তার কল্পনার তুলিতে ধারণ করে নানা জন্তুর শরীরাঙ্গ। এই ‘জংলি’ সংসারে বাঁচতে গেলে ‘নখী দন্তী শৃঙ্গী’ জন্তুর মতো মানুষেরও প্রয়োজন কুটিল শিকারি সত্তা, চটুল মানসিকতা বা সুযোগ বুঝে পলায়ন করবার দুর্বার প্রবৃত্তি।

শিল্পীর রঙের ব্যবহারও চিত্তাকর্ষক। ‘সীতাহরণ’-এ দেখতে পাই সম্পূর্ণ আধুনিক সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে সীতার বিপন্নতার করুণ ছবি—যেখানে তাঁকে দেখানো হয়েছে লালসালিপ্ত ব্র্যাঘ্ররূপী রাবণের অপহরণের শিকার হিসেবে। আর আধুনিক যন্ত্রতাড়িত মানুষ যেখানে আর্তের পাশে না দাঁড়িয়ে দূর থেকে মজা লোটে। ‘দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ’ শীর্ষক টেম্পারার কাজটিও ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত দ্যোতনার ছন্দে। যেখানে গরুর মস্তকে প্রদর্শিতা বিবস্ত্রা দ্রুপদ রাজকন্যার উদ্ধারকারী হিসেবে আমরা কৃষ্ণকে পাই এক দ্বৈত এবং দ্বিখণ্ডিত ভূমিকায়। সংবেদনশীল দর্শকের কাছে শিল্পী ছুড়ে দেন এই মর্মস্পর্শী প্রশ্ন—ব্যাঘ্রমস্তক কৃষ্ণ এক দিকে যেমন পালন করছে ত্রাতার ভূমিকা, আবার অন্য দিকে, বর্তমান সমাজে শঠতার প্রতীক হিসেবে তিনি কি পদদলনে নিগৃহীত করেন সমাজের অনুন্নত শ্রেণির বানর রূপী নিঃসহায় মানুষদের?

সেই একই প্রশ্ন উঠে আসে তাঁর ‘দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর’ কাজটিতে। যেখানে বিড়ালরূপী অর্জুনকে লক্ষ্য ভেদ করতে দেখা যায় দ্রুপদ রাজকন্যার স্বয়ম্বর সভায়। চেয়ারে উপবিষ্ট ব্যাঘ্রমস্তক কৃষ্ণ সমস্ত অনুষ্ঠানটি প্রত্যক্ষ করেন এক আপাত উদাসীন মানসিকতায়। সন্দেহ জাগে ত্রিকালদর্শী কৃষ্ণ কী ভাবে মেনে নিলেন স্বয়ম্বর সভায় ‘সূতপুত্র’ কর্ণের প্রবেশের অনধিকার? সে কি পরোক্ষ ভাবে প্রিয়পাত্র অর্জুনকে সাহায্য করার পক্ষপাতদুষ্ট এক ক্রূর তাগিদে? সেই শঠতা আড়াল করতেই কি তাকে নিতে হয় ভাবলেশহীন বাঘের মুখ? ‘দ্য লাস্ট সাপার’-এর কাজটিকে করেছেন বাঙ্ময়। পশু আর মানুষের ভাষা, কথা, মনের ভাব, আর্তি। যেখানে শৃগালরূপী এক মানুষ পা ধুইয়ে দেয় অজারূপী আরেকটি মানুষকে। ছবিটি মনে করিয়ে দেয় সমাজের বর্তমান ভেকধারীদের কথা, যারা অবলীলায় প্রবঞ্চিত করে অসহায়, নিঃশংসয়ী ছাগলরূপী ভক্তদের। ভবিষ্যতে দীপককুমারের আরও বৃহৎ ও বিস্তৃত মাপের কাজ দেখার বাসনা রইল।

শমিতা বসু

দ্রৌপদী ও নারীর সম্মান

রবীন্দ্রসদনে মুদ্রা-র পঁচিশ বছর পূর্তি উৎসবের শুরুতেই ছিল শিশুশিল্পীদের নৃত্যনাট্য ‘বর্ষার জলছবি’। মন মাতিয়েছে শ্রোতাদেরও। দ্বিতীয়ার্ধে ছিল ‘দ্রৌপদী’। মহাভারতের দ্রৌপদী ও এ কালের দামিনী যেন সমাজের সব কলঙ্কের বোঝা বইছে। এই দুই চরিত্রে অদ্রিজা ভট্টাচার্য অভিনয় ও নৃত্যে মন কেড়ে নেন। দ্রৌপদীর কণ্ঠে ছিলেন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিকল্পনায় ছিলেন অদ্রিজা ভট্টাচার্য। নৃত্য পরিকল্পনায় অসিত ভট্টাচার্য, মহুয়া চক্রবর্তী, গীতিকার পদ্মনাভ দাশগুপ্ত ও আবহ সঙ্গীতে দেবাশিস সাহা। নৃত্যে অংশ নিয়েছিলেন মহুয়া চক্রবর্তী, অসিত ভট্টাচার্য, মৌসুমী ভট্টাচার্য, সৌরভ নন্দী, শুভ্রনীল, সায়ন্তনী, সৌমাল্য ও অদ্রিজা।

পলি গুহ

কর্মক্ষমতা বাড়ে শুধু মগজ ধোলাইয়ে

নাটক: ইক্যুয়েশনস

যাঁরা হালকা মজার মনোরঞ্জনমূলক নাটকের পরিবর্তে সিরিয়াস নাটক ভালবাসেন, তাঁদের কাছে নিভা আর্টস ও ব্ল্যাংক ভার্স-এর যৌথ প্রযোজনায় ‘ইক্যুয়েশনস’ অবশ্য দ্রষ্টব্য। এর প্রথম কারণ আনাতলি দনেপ্রভের ‘ম্যাক্সওয়েল ইক্যুয়েশনস’ গল্প অনুসরণে তীর্থংকর চন্দের এই নাটকে রয়েছে কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় রাজনীতির চমৎকার মিশেল। খাফস্ড্যুট নামে এক কোম্পানি গণিত এবং পদার্থবিদ্যায় জ্ঞানীগুণীদের চাকরির লোভ দেখিয়ে ধরে এনে মগজ ধোলাই করে এবং তাঁদের মস্তিষ্কের হিসেব-ক্ষেত্রটিতে বাইরে থেকে ইলেকট্রনিক্স ট্রিগারের সাহায্যে ইমপাল্স পাঠিয়ে সেগুলির কর্মক্ষমতা কোটিগুণ বাড়িয়ে দিয়ে, তার সাহায্যে কঠিনতম গাণিতিক সমস্যার খুব দ্রুত সমাধান করেন। প্রতিরক্ষার স্বার্থে রাষ্ট্রও কোম্পানির এমন অনৈতিক কাজের সাহায্য নেয়। যে সব প্রতিভাধর গণিতজ্ঞ ও বিজ্ঞানীর মস্তিষ্ক তারা শোষণ করছে, তাঁরা শরীরে ও মনে হয়ে ওঠেন অ্যাবনর্মাল। তখন তাঁদের ঠাঁই হয় জ্ঞানীগৃহ পাগলা গারদে।

রহস্য উন্মোচন করতে আগ্রহী হলেন বিজ্ঞানী রাউখ। পরে জড়িয়ে গেলেন ফাঁদে। শেষ পর্যন্ত কী ভাবে তিনি রহস্য উন্মোচন করলেন, নিজে উদ্ধার পেলেন তা এক রুদ্ধশ্বাস কাহিনি। ধরা পড়ার পর খাফস্ড্যুটের বিচার এবং সাজা, পরে আবারও কোম্পানির উত্থান।

দ্বিতীয় কারণ, নাট্যরূপায়ণে রাজা ভট্টাচার্যের মুনশিয়ানা প্রশংসনীয়। তপন থিয়েটারের মতো অপরিকল্পিত-অপ্রশস্ত হলকে তিনি সাইক্লোরামার প্রয়োগে, মঞ্চের অ্যাপ্রন স্টেজকে মাঝ বরাবর প্রশস্ত করে প্রেক্ষাগৃহের শেষ পর্যন্ত প্রসেনিয়াম ক্ষেত্রকে পরীক্ষামূলক ভাবে বাড়িয়ে নিয়েছেন।

তৃতীয় কারণ, প্রফেসর চরিত্রে দেবশঙ্কর হালদারের অভিনয় এখানে টিপিক্যাল দেবশঙ্করের মতোই। এলজা চরিত্রে মন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং হান্স বলসং চরিত্রে গৌতম সরকারের অভিনয়ে পরিমিতিবোধ চোখ টানে। চতুর্থ কারণ অজিত রায়ের মঞ্চ, দীনেশ পোদ্দারের আলো, অনিন্দ্য নন্দীর শব্দ, দ্রোণ আচার্যের সঙ্গীত ও মহম্মদ আলির রূপসজ্জা প্রযোজনাকে আকর্ষণীয় করেছে।

মলয় রক্ষিত

অনুষ্ঠান

সম্প্রতি মহাজাতি সদনে ‘সৃষ্টি পিয়াসী’ নিবেদন করল তরুণ মজুমদারের ভাবনায় ‘যে আছ অন্তরে’। সমবেত কণ্ঠে ছিল একঝাঁক নতুন প্রতিভা। এ দিন গান শোনালেন রূপঙ্কর, অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়তী চক্রবর্তী, দেবাঙ্গনা সরকার। সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন শান্তনু বসু।

সঙ্গীত সর্বশ্রেষ্ঠ উপাসনা। স্বামী বিবেকানন্দের সেই উপলব্ধি যেন প্রতিফলিত হল ‘বাবা আলাউদ্দিন সঙ্গীত সমারোহ’ সম্মেলনে। রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠান, পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র এবং তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের যৌথ আয়োজনে তিন দিনের এই সঙ্গীত সম্মেলনের উদ্বোধক ছিলেন শ্রীমৎ স্বামী নিত্যকামানন্দজি মহারাজ। সেতার, সরোদ, সন্তুর ও কণ্ঠসঙ্গীত পরিবেশনে শিল্পীরা নিজেদের সুনাম বজায় রেখেছেন।

রবীন্দ্র সদনে আনন্দধারা আয়োজন করেছিল রবীন্দ্রগানের অনুষ্ঠান ‘আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে’। একক গানে ছিলেন চিত্রলেখা চৌধুরী, স্বপ্না ঘোষাল প্রমুখ। নজর কাড়ে বন্দনা সিংহের পরিচালনায় সঙ্গীতালেখ্য ‘ঝুলন’। পাঠে মধুছন্দা তরফদার ও শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানের শুরুতেই ছিল ‘বাণীমাল্য’ ও ‘কলাভৃৎ’-এর সমবেত সঙ্গীত।

পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমি সভাঘরে ‘কাব্যপথিক’ আয়োজন করেছিল ‘তুমি মনোহর’ শীর্ষক একটি সুন্দর অনুষ্ঠান। একক আবৃত্তিতে ছিলেন আশিস ঘোষ। এ ছাড়াও আবৃত্তি পাঠ করলেন অন্যান্য শিল্পীরা। তবে কয়েক জনের শ্রুতি-অভিনয় শ্রোতাদের মনে দাগ কেটেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Shows Drama Dance Drama Theatre
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE