Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

আড়ালবিলাসী লেখকেরা

এই তো গত বছর জুন মাসের কথা। ‘ডিয়ার লাইফ’ বইটির জন্য অন্টারিয়ো রাজ্যের অন্যতম সাহিত্য সম্মান, ট্রিলিয়াম পুরস্কার দ্বিতীয় বার পেলেন ছোটগল্পকার অ্যালিস মানরো। কানাডিয়ান সাহিত্য জগতের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র ৮১ বছরের এই লেখক। বোমাটা ফাটালেন মানরো নিজেই, পুরস্কার বিতরণ শেষ হওয়ার ঠিক পরে। কানাডার ‘ন্যাশনাল পোস্ট’ পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিতে বসে জানালেন, এ বার তিনি লেখালেখি থেকে অবসর নিচ্ছেন। সাহিত্যপ্রেমীরা রে রে করে উঠলেন।

রজত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

এই তো গত বছর জুন মাসের কথা। ‘ডিয়ার লাইফ’ বইটির জন্য অন্টারিয়ো রাজ্যের অন্যতম সাহিত্য সম্মান, ট্রিলিয়াম পুরস্কার দ্বিতীয় বার পেলেন ছোটগল্পকার অ্যালিস মানরো। কানাডিয়ান সাহিত্য জগতের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র ৮১ বছরের এই লেখক। বোমাটা ফাটালেন মানরো নিজেই, পুরস্কার বিতরণ শেষ হওয়ার ঠিক পরে। কানাডার ‘ন্যাশনাল পোস্ট’ পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিতে বসে জানালেন, এ বার তিনি লেখালেখি থেকে অবসর নিচ্ছেন। সাহিত্যপ্রেমীরা রে রে করে উঠলেন। বলে কী? সাহিত্যিকরা আবার রিটায়ার করতে পারে না কি? নতুন বই পড়ব না? উত্তরে মানরো বললেন, পুরনো বইগুলো নতুন করে পড়োগে যাও। তাঁর বক্তব্য, ‘ইটস নাইস টু গো আউট উইদ আ ব্যাং।’ অর্থাৎ, একটা ধামাকা করে কেটে পড়াই ভাল। কিন্তু সেই বছরেই অ্যালিস মানরো সাহিত্যে নোবেল পেয়ে বসলেন। কী কাণ্ড! তবে তিনি আর কলম ধরেননি। যদিও এর আগে এক বার এ রকম ঘোষণা করে, পরে আবার লেখা শুরু করেন।

একই ভাবে লেখা থেকে রিটায়ার করে বসে রয়েছেন বিখ্যাত আমেরিকান সাহিত্যিক ফিলিপ রথ। সাঁতার কেটে, বেসবল দেখে বেশ দিন কেটে যাচ্ছে। ২০১২ সালে ঝাঁপ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন, তার পর আর ও পথ মাড়াননি। একটি ফরাসি ম্যাগাজিনকে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, ‘এনাফ ইজ এনাফ’ (ঢের হয়েছে বাপু)! মানরো তো তাঁর অবসর নেওয়ার কথা বলতে গিয়ে রথ-এর নাম করে বলেই ফেললেন, তাঁর অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্তে তিনি অনুপ্রাণিত।

ছবি: সুমন চৌধুরী

কেন এই সাহিত্যের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া— বার্ধক্য একটা কারণ হতে পারে কি? মানরো এক জায়গায় বলেছেন, তাঁর স্মৃতিশক্তি আগের মতো প্রখর নেই। কিন্তু শুধুই কি তাই? না কি ফিলিপ রথ যে কথাটা বলেন সেটাই খাঁটি? রিটায়ারমেন্টের আগে একটা ফরাসি কাগজকে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘লেখার জন্য আর সেই অন্ধ উন্মাদ তাগিদ অনুভব করি না।’ উনি ‘ফ্যানাটিসিজ্ম’ শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন। সত্যি তো, নিজের অভিজ্ঞতা ঘেঁটে একটার পর একটা পাণ্ডুলিপি তৈরি করে চলার মধ্যে কেমন একটা যুক্তিকে তোয়াক্কা না করা উন্মাদনা বা ফ্যানাটিসিজ্ম-এর গন্ধ আছে, সেটা বহু দিন ধরে কারও ভাল না-ই লাগতে পারে।

অবসরপ্রাপ্ত লেখকদের মধ্যে সব চেয়ে সিনেম্যাটিক বিদায় ছিল এক জন ফরাসির। তাঁর একশো লাইনের কবিতা ‘মাতাল তরণী’ প্যারিসের রু্য ফেরো’র দেওয়ালে লেখা হল বছর কয়েক আগে (হল্যান্ড ছাড়া অন্য কোনও দেশে, এটিই প্রথম ‘মুর্যাল পোয়েম’)। আর্ত্যুর র্যাঁবো যখন কবিতার জগৎ থেকে সরে পড়েন, তখন তিনি মাত্র কুড়ি বছরের যুবক। ওই ‘কাঁচা’ বয়সেই ‘আর লিখব না’ প্রতিজ্ঞা নিয়ে উধাও হয়ে যান মায়াবী নীল চোখের এই বোহেমিয়ান ছোকরা। সময়টা ১৮৭৬। প্রথমে ডাচ সেনাদের সঙ্গে ভিড়ে জাহাজে চেপে জাভা যাত্রা। তার পর সেখান থেকে পালিয়ে ফ্রান্স হয়ে সাইপ্রাস, ইথিয়োপিয়ার নানা জায়গায় চাকরির চেষ্টা। অবশেষে ইথিয়োপিয়ার হারার শহরে চোরাই অস্ত্র আর কফির ব্যবসায় নেমে পড়লেন। যে বয়সে লোকে সাধারণত ভাল কবিতা লিখতে শুরুই করে না, সে বয়সে একটা লোক পৃথিবীর সেরা কিছু কবিতা লিখে স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যাচ্ছে, এ আখ্যান এমন আশ্চর্য, এই নিয়েই অনেক লেখা হয়েছে। ফরাসি কবি রেনে শার তাঁর কবিতায় যা লিখেছেন, তাতে এই ছেড়ে যাওয়াটাকে একটা দৃঢ় স্টেটমেন্ট হিসেবে ভাবা হয়েছে। প্রথম কয়েকটি লাইন: ‘তুমি ছেড়ে গিয়ে ভালোই করেছো, আর্তুর র্যাঁবো। বন্ধু ও শত্রুদের প্রতি সমানভাবে তোমার আঠারো বছরের অবহেলা, প্যারিসের কবিদের ন্যাকামির প্রতি, আর সেই বন্ধ্যা ঝিঁঝির একঘেয়ে সুর— তোমার গ্রাম্য ও পাগলাটে পরিবার— তুমি ভালো করেছো তাদের উদার বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে, তাদের অহংকারী গিলোটিনের খাঁড়ার নীচে পেতে। তুমি বেশ করেছো, ছেড়ে চলে গেছ অলসদের রাস্তা, লিরিক-প্রস্রাবকারীদের সরাইখানা— পশুর নরকস্থানের জন্য, প্রতারকদের ব্যবসা এবং সরল মানুষের অভ্যর্থনা।’ (অনুবাদ: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বই: ‘অন্য দেশের কবিতা’)।

এ তো গেল রিটায়ারমেন্টের গল্প। কিন্তু কেউ কেউ আবার ‘সন্ন্যাসী লেখক’, লেখার জগতে সারা ক্ষণ থেকেও অদৃশ্য! পোস্টমডার্ন ফিকশন-এর মহাগুরু, টমাস পিনচন। কিন্তু কেউ জানে না, পিনচন আসলে কে? পিনচন কি পিনচন নিজে? না কি, আসলে জে ডি স্যালিঞ্জার (‘ক্যাচার ইন দ্য রাই’-এর লেখক) পিনচন সেজে কিছু বই লিখেছিলেন? পিনচন-এর মতো স্যালিঞ্জারও ছিলেন ‘রেক্লিউস’ লেখক, পাবলিসিটির ঈগলদের থেকে গা ঢাকা দিয়ে, লোকচক্ষের অন্তরালেই কাটিয়ে দিলেন সারাটা জীবন। ‘ক্যাচার ইন দ্য রাই’ (১৯৫১) বইটি প্রকাশের দুই বছরের মধ্যে সেই যে ভ্যানিশ হলেন, জীবনের শেষ দিন (২০১০) অবধি তাঁর টিকিটাও পাড়া-প্রতিবেশী ছাড়া আর কেউই দেখতে পেল না। সাক্ষাৎকার তো দূর অস্ত, স্যালিঞ্জারের ছবি খুঁজে বার করতেও এডিটরদের কালঘাম ছুটে যেত।

সে রকমই মানুষ পিনচন। ইন্টারভিউ, বুক রিলিজ, লাইমলাইট— কিচ্ছু তাঁর পছন্দ নয়। আমেরিকার কোন কোণে বসে লিখেছেন মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া সব পোস্টমডার্ন উপন্যাস, ‘দ্য ক্রায়িং অব লট ফর্টি নাইন’, ‘গ্র্যাভিটি’স রেনবো’, আরও কত। ওঁকে নিয়ে কত রটনা: পিনচন কি সিআইএ? উনি কি বম্বার? ‘সোহো উইকলি নিউজ’-এর প্রবন্ধ থেকে গুজব ছড়াল, জে ডি স্যালিঞ্জারই আসলে পিনচন নাম নিয়ে লিখছেন। উত্তরে পিনচন মজা করে বলেছিলেন, ‘নট ব্যাড, কিপ ট্রায়িং’ (খারাপ বলোনি, চেষ্টা চালিয়ে যাও)। আজকাল শোনা যায় পিনচন নিউ ইয়র্কেই থাকছেন, কিন্তু তাঁর কাছের মানুষরা কেউ মুখ খুলতে চান না।

বছর দুই আগে অমিতাভ ঘোষ তাঁর ব্লগে লিটারারি ফেস্টিভাল নিয়ে একটা দীর্ঘ পোস্টে ‘তামাশা’ শব্দটি ব্যবহার করে লিখেছিলেন, তামাশা তাঁকে আকৃষ্ট করে না। তাঁর বক্তব্য, সাহিত্যকে তামাশার অঙ্গ করার ফলে, সাহিত্য ক্রমশ পারফরমেন্স আর পাবলিক স্পেকট্যাক্ল-এর সঙ্গে এমন ভাবে মিলেমিশে যাচ্ছে যে, সাহিত্য করাটাই যে লেখকের জীবনের মূল লক্ষ্য সেটা সকলে ভুলতে বসেছে। তাঁর মতে, পাঠক আর লেখকের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের যত বেশি রাস্তা তৈরি করা হবে, লেখকের ওপর পাঠকের চাপ সৃষ্টি করার ক্ষমতা ততই বাড়বে এবং তাতে লেখকের শৈল্পিক স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পাবে।

অমিতাভ ঘোষের এই লেখা নিয়ে বহু বিতর্ক হয়। যাঁরা নতুন লিখছেন তাঁরা অনেকে মনে করেন ফেস্টিভ্যাল, বুক রিডিং ইত্যাদি থেকে তাঁদের পরিচিতি বাড়ে এবং হয়তো নতুন পাঠক তৈরি হয়। এ সব অনুষ্ঠানে যেতে অনেকে পছন্দ করেন, আর কোনও কোনও ক্ষেত্রে এগুলো এড়িয়ে চলাও সম্ভব হয় না। অমিতাভ নিজেও লিখেছেন, বই পড়ার অনুষ্ঠানে যেতে, বই সই করতে বেশির ভাগ লেখকরাই এখন অভ্যস্ত বা চুক্তিবদ্ধ। তবে, তার মধ্যেও খানিকটা বেছে নেওয়ার জায়গাও থেকে যায়।

মনে পড়ছে একদম একাচোরা দক্ষিণ আফ্রিকান সাহিত্যিক জে এম কোয়েট্জি বা বিশ্বখ্যাত স্যামুয়েল বেকেট-এর নাম। দুজনেই নোবেল লরিয়েট। কোয়েট্জি প্রচারের থেকে নিজেকে দূরে রাখতে এতটাই সচেষ্ট যে দু’বার বুকার প্রাইজ পাওয়া এই লেখক কোনও বারই প্রাইজ নিতে গেলেন না! আর বেকেট তো নোবেল প্রাইজটাও নিতে যাননি! শৈল্পিক স্বাধীনতা খর্ব হওয়া ছাড়াও আর একটা কারণে কোনও কোনও লেখক নিজেদের লুকিয়ে রাখতে খুব পছন্দ করেন। সেটা হল, পাঠকরা অনেক সময় বইয়ের সঙ্গে লেখকের জীবনকে জড়িয়ে ফেলে, তার ফলে লেখার মূল্যায়নে মারাত্মক ভুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কবিকে তার জীবনচরিতে খুঁজতে যতই বারণ থাকুক, নাগালে পেয়ে গেলে সকলেই উপন্যাসটার সঙ্গে ঔপন্যাসিকের চেহারা আর হাবভাবের মিল খুঁজতে থাকে, আর না খুঁজে পেলে, রেগে যায় তাঁর সাহিত্যকর্মের ওপরেই!

দুর্দান্ত সাহিত্যের ভেতরের ধকধকে আগুনকে কাছ থেকে দেখার ইচ্ছে মানুষের হতেই পারে। কিন্তু সেই গুপ্ত কুঠুরির প্রবেশাধিকার লেখক ছাড়া আর কারও নেই, আর ছল করে যদি কেউ সেখানে পৌঁছেও যায়, তা হলেও সে যা দেখতে পায়, তা হয়তো সৃষ্টির রেসিপি নয়, রংবেরঙের কিছু এলোমেলো নকশা মাত্র। কী ভাবে একটা অলোকসামান্য মহাকাব্য নির্মিত হয়, স্বয়ং লেখক চেষ্টা করলেও সেই খবর বাইরে এসে বুঝিয়ে বলতে পারবেন না। তাই হয়তো, সন্ন্যাসী সাহিত্যিকরা অনেকেই এই বৃথা চেষ্টায় সময় নষ্ট না করে, নিজের সৃষ্টিটা করে চলা-ই শ্রেয় বলে মনে করেন। তাঁদেরকে সেখান থেকে টেনে বার করে, নাচ দেখাতে বলাটা বোধহয় খুব একটা কাজের কথা নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rajat chowdhury rabibasariya anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE