Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

বেড নম্বর ৬ ও অন্যান্য

সাড়ে চার বছর ধরে রোগ পড়া আছে বটে, কিন্তু অন ডিউটি জুনিয়র ডাক্তার তার হাতের চেটোয় দেখতে পায় মৃত্যুকে। সে শূন্যতা সিলেবাসের বাইরে।স্য র, আইসিইউ ছয়ের পেশেন্ট ফ্ল্যাটলাইন হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি…’ সবে চোখটা লেগেছিল। কমদামি স্লাইডিং কাচের জানলার বাইরে রাত আড়াইটের অন্ধকার তখন। সিস্টার-দিদির গলায়ও মানুষের মৃত্যুর খবরের যে স্বাভাবিক নিস্পৃহতা থাকে, তার বদলে সেই অন্ধকারের মতন একটা চাপা কষ্ট জড়িয়ে যেন। আদিত্যদা সিনিয়র রেসিডেন্ট— অন্যান্য যে কোনও খারাপ পরিস্থিতিতে যেমন জুনিয়রকে পেছনে রেখে নিজেই হাত লাগায়, এখানেও তাই।

ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

অনীক চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

স্য র, আইসিইউ ছয়ের পেশেন্ট ফ্ল্যাটলাইন হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি…’
সবে চোখটা লেগেছিল। কমদামি স্লাইডিং কাচের জানলার বাইরে রাত আড়াইটের অন্ধকার তখন। সিস্টার-দিদির গলায়ও মানুষের মৃত্যুর খবরের যে স্বাভাবিক নিস্পৃহতা থাকে, তার বদলে সেই অন্ধকারের মতন একটা চাপা কষ্ট জড়িয়ে যেন। আদিত্যদা সিনিয়র রেসিডেন্ট— অন্যান্য যে কোনও খারাপ পরিস্থিতিতে যেমন জুনিয়রকে পেছনে রেখে নিজেই হাত লাগায়, এখানেও তাই। মনিটরে ইসিজির লাইন নিস্তরঙ্গ, শুধু একটা দড়ির মতো শুকিয়ে যাওয়া মেয়ের বুকে তার সেন্সরগুলো লাগানো।
দু’দিন আগের সকালেও ‘দাদা, অপারেশনের জায়গাটায় খুব ব্যথা করছে’ বলেছিল, তার পর হঠাৎ সন্ধ্যায় ভেন্টিলেটরে ঢুকে গেল। আমরা দুজনে পালা করে কৃত্রিম ভাবে ওর হৃৎপিণ্ডকে চালানোর চেষ্টা করতে থাকলাম। কিন্তু প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে নিশ্চিত হেরে যাওয়া একটা ম্যাচে সজোরে ব্যাট চালিয়েও পিচের দু’প্রান্তে দুটো মানুষ দেখল, সমস্ত গ্যালারি জুড়ে পড়ে আছে শিশিরমাখা খালি চেয়ার… আর একে একে নিভে যাচ্ছে ফ্লাডলাইটগুলো। কয়েকটা খালি অ্যাড্রিনালিনের অ্যাম্পিউলকে সাক্ষী রেখে যখন টর্চের তীব্র আলো একটা চোদ্দো বছরের তারারন্ধ্রে পড়ে নিজের অস্তিত্বের কোনও প্রতিক্রিয়া পায় না— তখন আমরা মাথা নিচু করে অন্ধকার প্যাভিলিয়নের দিকে হাঁটা লাগাই।
পথ আটকে দাঁড়ায় এক জন বাবা। বাকি রাতটা, ওই আইসিইউয়ের কনকনে এসি থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল এক মৃত কিশোরীর বাবার হাহাকারের প্রখর তাপ।
বাকি রাতটায় ঘুমও আসেনি আর। ভোর পাঁচটায় শ্যামলী অধিকারীর ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে গিয়ে মাথা দপদপ করছিল। ক্লাস এইটের একটা মেয়ে— চু কিতকিত খেলত বান্ধবীদের সঙ্গে, খাওয়া নিয়ে রোজ ঝামেলা মায়ের সঙ্গে, হয়তো পাশের বাড়ির বড় বড় চোখের ছেলেটাকে আড়ালে দেখত বিকেলবেলায়— সে হঠাৎ পেটব্যথা আর বমি নিয়ে ভর্তি হল হাসপাতালে; বোঝা গেল অন্ত্রের একটা অংশ কোনও একটা কারণে আটকে আছে। সঙ্গে সঙ্গে ওটি’তে—পেট কেটে দেখা গেল বাচ্চাদের ফুটবলের সাইজের গোলকৃমির একটা বল!
ওটির পরে আইসিইউতে। কিন্তু ৩২ কেজির অ্যানিমিক শ্যামলীকে আর সেই ছেলেটাকে লুকিয়ে দেখার সুযোগ করে দিতে পারেনি কেউ। মাথার দপদপ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল শরীরের আনাচে-কানাচে। একটা খিদে কমে যাওয়া অ্যানিমিক কিশোরীকে আট টাকা দামের দুটো অ্যালবেন্ডাজোল ট্যাবলেট খাওয়াতে পারেনি এ পৃথিবীর কেউ?! ঢপবাজি ভরা পাঁচটা হজমের সিরাপ বা থানকুনি-কালমেঘ পাতারা— আজ কে ওর মৃতদেহের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখে?

তার পর রোদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগগুলো কিছুটা থিতিয়ে পড়ে, উঠে আসে গত দু’বছরে মানুষের মৃত্যু দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া একটা মন, আর তার বিবর্তনের অবাক ইতিহাস।

বছর দেড়েক আগের অন্য এক শীতের রাতে ফিরে গেলে দেখি, গালভর্তি খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, গায়ে তিন দিনের না-কাচা প্যান্ট-শার্ট, আর চোখে একটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়া দৃষ্টি নিয়ে এক বাবা হাঁটু মুড়ে বসে আছেন শিশুবিভাগের বাইরের বারান্দায়। তাঁর অ্যাকিউট লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত বছর পাঁচেকের মেয়েটি মারা গেছে এই মিনিট কুড়ি হল।

মেডিকাল কলেজের শিশু-বিভাগে একটা ‘লিউকেমিয়া ঘর’ আছে। রোগ ধরা পড়ার পর বিদিশাকে কখনও এক মাস, কখনও আড়াই মাস ভর্তি থাকতে হয়েছে তাতে; এ বার একটু বেশিই বাড়াবাড়ি— ছ’মাস! ছুঁচের দাগে সারা শরীরটা কালো, মুখ ফুলে চোখ দুটোকে প্রায় ঢেকে দিয়েছে, যে মাথায় ছোট ছোট দুটো বিনুনি বেঁধে দিত ওর মা সেখানে পাতাঝরা শালবনের মরা ক্যানভাস— এই নিয়েই বিদিশা বেঁচে ছিল পশ্চিম কোণের দূরতম বেডটায়।

ওর মা ছাপাশাড়ি-তেলচিট বাসনপত্র-দাঁতভাঙা চিরুনি-স্কচব্রাইট-লোকনাথ বাবার ফোটোতে গুছিয়ে নিয়েছিল কোণটা। কখনও সাইক্লোফসফামাইড চালাতে গিয়ে, কখনও রক্ত টানতে গিয়ে, ওদেরকে খুঁটিয়ে দেখতাম অনেক ক্ষণ ধরে—পৃথিবীর কতটুকু হবে এই কোণটা? তাতে এক নিশ্চিত মৃত্যুপথযাত্রী শিশু আর তার পাহাড়সম স্বপ্ন দেখা মা কী ভাবে বেঁচে রয়েছে দিনের পর দিন— তা জানবে না কেউ?

বিদিশার বাবার দিনের শুরুটা কাটত টাকা জোগাড় করে এনে; তার পর বাকি দিনটা কাটত সেই টাকায় বউয়ের জন্য বিস্কুট আর মেয়ের জন্য সব ওষুধ আর প্যাকেটের পর প্যাকেট রক্ত জোগাড় করে; আর গোটা রাতটা কাটত ইমার্জেন্সির বাইরে ত্রিপল পেতে, বাকি একশো মানুষের সঙ্গে স্বপ্ন দেখে। একই রুটিন। ছ’মাস।

রুটিন সিপিআর দেওয়ার পর পিজিটি দিদি যখন ‘ও মারা গেছে’ উচ্চারণ করল, তখন করিডোর জুড়ে হাঁটু পর্যন্ত এক কন্যাহারা মায়ের চিৎকারের ঢেউ। আর আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম বিদিশার বাবাকে— কোনও কান্না নেই, চিৎকার নেই, প্রলাপ নেই— শুধু এক অসীম শূন্য দৃষ্টি আর নিজেকে নিয়ে বসেই ছিলেন ঠায়। এ কি শুধু সন্তান হারানোর যন্ত্রণা, মৃত্যুর কাছে অসহায় মাথা নামিয়ে নেওয়ার বিহ্বলতা? না বোধহয়।

মেয়ে নিশ্চিত মরে যাবে জেনেও এক মুদি দোকানি ও তাঁর স্ত্রী প্রতিটা দিন সব ভুলে শুধু লড়ে গেছেন, দেড় বছর। নিজের সন্তান, এক মারণরোগ আর দৌড়— এ ছাড়া যে একটা পৃথিবী আছে, তার বাস্তবতা আছে, তাতে বাঁচা আছে— তা বোধহয় পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিলেন ওঁরা। আসছে সকাল থেকে সেই বাস্তবতায় আবার বাঁচবেন কী ভাবে— বিদিশার বাবা জানেন না।

আসলে সাড়ে চার বছরের সিলেবাসে রোগ পড়েছি, তার উপসর্গ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসা পড়েছি; কিন্তু মানুষের যন্ত্রণা ও তার বিষাদসুর, মৃত্যু ও তার শূন্যতাপাহাড়কে দেখিনি চোখের সামনে, হাতের চেটোয়। যে ছেলেটা ফার্স্ট ইয়ারে মাইক্রোস্কোপের তলায় নিজের এক ফোঁটা রক্ত দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিল, সে সাত বাই এক ইঞ্চি হাঁ হয়ে যাওয়া মাথার চামড়া অবলীলায় সেলাই করছে; যে মেয়েটা ফোর্থ ইয়ারেও তার প্রেমিক রুমাল ছাড়া হেঁচে ফেলেছিল বলে এক সপ্তাহ কথা বলেনি, সেও সুগারের রোগীর পচে যাওয়া পা থেকে লার্ভা টেনে বের করেছে দ্রুত হাতে। আজকেও যে রোগীটা বলেছে, ‘ডাক্তারবাবু, আস্তে সিরিঞ্জ ফোটাবেন’, কাল সে খাবি খেতে খেতে থেমে যাচ্ছে, সকালেও যে বলছিল ছুটি হওয়ার পর বন্ধুদের সঙ্গে পুরী যাবে, রাত্রে তার ইসিজির লাইন ঢেউশূন্য হয়ে পড়ে থাকছে— এগুলো ঘণ্টায়-সেকেন্ডে, মিটারে-ইঞ্চিতে দেখতে দেখতে একটা নির্লিপ্ততা আসে— মানুষ নিয়ে, জীবন নিয়ে, নিজেকে নিয়ে।

সে নির্লিপ্ততা মানুষের জীবন মৃত্যুর সরু গলিপথে দাঁড়িয়ে নির্ভুল পথ খুঁজে নিতে বিচক্ষণ করে তুললেও, দিনের শেষে আমাকে, আমাদেরকে কষ্টে রাখে।

আবার সেই মৃত্যুও দেখেছি যেখানে কোনও হাহাকার নেই, ভেঙে যাওয়া নেই; শুধু কাছের মানুষটা কখন চলে যাবে তার জন্য সময় গুনে যাওয়া আছে। আশি বছরের বৃদ্ধ হাঁপানির টান বেড়ে গেলে যখন ভেন্টিলেটরে ঢুকে যায় ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা জীবনটুকু নিয়ে, তার লিভাইস আর রোলেক্স শোভিত ছেলে অনায়াসে জানতে চায়, ‘স্যর, আর ক’দিন টানবে মনে হচ্ছে?’ মরে গেলে দু’ঘণ্টার মধ্যে সব অফিশিয়াল কাজ চুকিয়ে ডেডবডি নেওয়ার জন্য তাড়া। নিজের নেকুপুষু মধ্যবিত্ত বাঙালি মানসিকতায় লাথি পড়ে। মানুষ এই রকম একটা কান্নাকাটিহীন, ‘বাঁচা গেল শালা’-যুক্ত মৃত্যুর সপাট থাপ্পড়ের মায়ায় আশি বছর বেঁচে থাকে? কেন?

মৃত্যু মানুষকে, তার পরিজনকে শিশুর মতো নগ্ন করে দেয়। সমস্ত আস্তরণগুলো সরে গিয়ে ভয়-কষ্ট-ইচ্ছে-অসততা মেশানো মানুষগুলো উঠে আসে। অয়নের কথা মনে পড়ছে—কেমিস্ট্রিতে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় মুখগহ্বরে ক্যান্সার ধরা পড়ল, তার পর সার্জারি। দাড়ি ট্রিম করত, জুলপি রাখত মেপে— সেখানে গভীর সেলাইয়ের দাগ।

শুধু এটুকুই না, ওর জিভটাও বাদ দিতে হয়েছিল অর্ধেকটা। আইসিইউতে শুয়ে চ্যানেল করা হাতে কোনও মতে সাদা কাগজে লিখেছিল— আমি বাঁচতে চাই না। কিন্তু ও বেঁচে গেল। তিন মাসের মাথায় পাঁচ পাতা ক্লোনাজেপাম গিলে কোনও মতে নিজেকে মারতে পেরেছিল অয়ন। সে বারেও আইসিইউয়ের আট নম্বর বেডেই শুয়েছিল ও। আমি ওকে নিঃশব্দে সমর্থন জানিয়েছিলাম।

যে মৃত্যুগুলো কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে তার মধ্যে মহুয়ার মৃত্যুটাও আছে। অয়নেরই বয়সি; যে দিন শ্বাসকষ্ট নিয়ে আইসিইউতে ভর্তি হল, আমি অন ডিউটি। পুরনো কাগজ ঘেঁটে আর ওর বাবার সঙ্গে কথা বলার পরে একটা বাইশ বছরের মেয়ের এ হেন শ্বাসকষ্টের কারণটা বোঝা গেল। কমার্স পড়া শেষ হয়েছে কয়েক মাস হল— শপিং মলে, ফুচকায়, হোয়াট্‌সঅ্যাপে জীবন উড়ছিল মেঘের পাশাপাশি। হঠাৎ এক মাস আগে লক্ষ করে, ডান দিকের স্তনে একটা মাংসপিণ্ড। দিন কয়েকের মধ্যেই সেটা একটা রক্ত-পুঁজ মাখা ছোট ফুলকপির মতো বেড়ে ওঠে। জ্বর, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট নিয়ে ওটি’র টেবিলে। মাংসপিণ্ডটা কিছুটা কেটে বাদ দেওয়া হয়। বুকে অনেকটা জল জমেছিল, সেটাও বার করা হয়। তার তিন দিনের মাথায় আবার শ্বাসকষ্ট— এ বার আইসিইউতে ভর্তি। আবার জল জমেছে বুকে। আমাদের সন্দেহ সত্যি করে দু’দিনের মাথায় বায়োপ্‌সি রিপোর্ট এল— সারকোমা, একটি অত্যন্ত খারাপ ধরণের স্তন ক্যান্সার। অংকোলজিস্ট বলে গেলেন, খুব বেশি হলে এক মাস…

এখনও চোখ বুজলে দেখতে পাই, ভিজিটিং আওয়ার শুরু হলেই ওর দিদি ছুটে ওর বেডের পাশে গিয়ে ওকে আলতো জড়িয়ে ধরে বলছে, ‘আর বড়জোর দিন সাতেক, তার পরেই তো বাড়ি নিয়ে যাব তোকে’, আর মহুয়া হাসছে। নিস্তেজ একটা হাসি, কিন্তু তাতে লেগে আছে দিদির ওপর বিশ্বাস, যন্ত্রণা থেকে স্বাভাবিকতায় ফেরার হিমালয়সম ইচ্ছে আর নিজের অসহায়তার যুগপৎ রং। আমাদের দিক থেকে আমরা ওর দিদিকে, বাবাকে যত বার বোঝাতে গিয়েছি সারকোমা দৈত্যটা আসলে কী— অদ্ভুত ভাবে ওরা শুনতেই চায়নি। ভালবাসা আর স্নেহের এক আলো জোর দিয়ে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিল আমাদের নৈরাশ্যের তথ্য ও বিজ্ঞান। এক সাইকেল কেমোও চলল, যদিও তাতে কিছুই হওয়ার ছিল না। চিকিৎসার ভাষায়— প্যালিয়েটিভ কেমো। দিন এগোল— মহুয়া আরও নিস্তেজ হচ্ছিল— শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি হচ্ছিল, বাড়ছিল শ্বাসকষ্ট। যে রোগীর জন্য অপেক্ষাই একমাত্র উপায় তার শরীরটাকে আর ছুঁচ, কৃত্রিম শ্বাসনল, কড়া অ্যান্টিবায়োটিকে ঝাঁঝরা না করে একটু শান্তি দিতে চাইছিলাম আমরা। শেষ পর্যন্ত ভেন্টিলেটরে যায়নি মহুয়া, তবে আইসিইউতে ভর্তি হওয়ার ঠিক সতেরো দিনের মাথায় আবার একটা ছটফটে, প্রাণোচ্ছল ঢেউ ‘ফ্ল্যাটলাইন’ হয়ে গেল মনিটরে। সে দিনও আমারই ডিউটি ছিল, ওর ডেথ সার্টিফিকেটটা আমাকেই লিখতে হল। লেখা শেষ করে জীবনে প্রথম বার সকাল সাড়ে সাতটায় নিজের প্রেমিকাকে ফোন করে খুব নির্লিপ্ত গলায় ‘কী রে, ওঠ ঘুম থেকে’ বলেছিলাম, আর হালকা খুনসুটি। আমার মাথার ভেতরের ঝড়, গলায় দলা পাকিয়ে থাকা অসহায়তা আর মহুয়ার দিদির চিৎকারে চিৎকারে গলে যাওয়া আমার সুষুম্নাকাণ্ডের কথা ও কোনও দিনও জানেনি।

আমি মেডিসিনে ইন্টার্ন থাকার সময় এক শরৎসকালে আটাশ বছরের ভাইকে কাঁধে বয়ে নিয়ে তিরঙ্গা চিবোতে চিবোতে ওয়ার্ডের মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে গিয়েছিল মণীশ। কোলে মার্কেটে সবজির ঝুড়ি ট্রাকে তোলে দুই ভাই; তিনকুল সাহারা মরু। গত এক মাস ধরে ভাইয়ের জ্বর আর কমেই না, শরীর শুকিয়ে নারকেল দড়ি। দেখেই যে সন্দেহটা করলাম, দুপুরে আইসিটিসি রিপোর্ট তাতে ঘাড় বেঁকিয়ে হ্যাঁ বলে দিল— এড্স। কুঁচকি থেকে রক্ত টানতে গিয়ে ‘দ্য মেশিনিস্ট’-এর ক্রিশ্চিয়ান বেলের কথা মনে পড়ত। অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দিলে মণীশ তার ট্রেডমার্ক তিরঙ্গা চেবানো মুখে একটা বেপরোয়া মুচকি হাসি দিয়ে বলত, ‘দিখতে হ্যায় স্যর, কিতনা লা পায়েঙ্গে।’ রক্ত টেনে পরীক্ষা করতে পাঠালে মুখে তিরঙ্গা আর হাসি নিয়ে ছুটত। এক দিন আবার পরীক্ষার জন্য রক্ত নিচ্ছি কুঁচকি থেকে— খেয়াল করিনি মণীশ পাশেই দাঁড়িয়ে— তিরঙ্গা মুখে হেসে বলেছিল, ‘স্যর ছোড় দিজিয়ে না শালে কো, মর হি তো যায়েগা...’ সে দিন আর পারিনি রক্ত নিতে। তার পর ঠিক দু’দিনের মাথায় ভাই মরে গেলে তিরঙ্গায় রাঙানো ঠোঁট দুটো চেপে মৃতদেহটা স্ট্রেচারে চাপিয়ে ওয়ার্ড ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল মণীশ।

মৃত্যু নিয়ে একটা ছায়াঘন রোমান্টিসিজ্ম থাকে জীবনের চব্বিশ গ্রীষ্ম পর্যন্ত। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে কাজ করার দুটো বছর সেই রোমান্টিকতাকে স্ট্রেট সেটে হারিয়ে দেয় বেমালুম। জীবনের নগ্ন শেষটুকু দেখতে দেখতে কষ্টের পরে কষ্ট জমে জমে এক অদ্ভুত পরিণত ব-দ্বীপ তৈরি হয় আমার, আমাদের।

anik.cmc@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE