Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

বুবুর ‘ডে আউট’

ঘুমটা ভাঙতেই আমি উঠে বসলাম। এ বাবা কোথায় আমি? এখানে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সে খেয়াল তো ছিল না! মা আর ভাই আমাকে ছেড়ে চলে গেল কেন? আমি আবার ভাল করে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম। নাহ্, মা বা ভাই কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না!

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

অনন্যা দাশ
শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৯
Share: Save:

ঘুমটা ভাঙতেই আমি উঠে বসলাম। এ বাবা কোথায় আমি? এখানে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সে খেয়াল তো ছিল না! মা আর ভাই আমাকে ছেড়ে চলে গেল কেন? আমি আবার ভাল করে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম। নাহ্, মা বা ভাই কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না! ‘আমি কি হারিয়ে গেছি’! কথাটা মনে হতেই আমার খুব কান্না পেল, আর ভয়ও লাগল খুব। আমি তো ছোট, কিছুই চিনি না এই শহরে! এ বার কী করব? কিছু ক্ষণ একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে কাঁদলাম। তার পর মনে হল বেশ খিদে পাচ্ছে! তখন কান্না থামিয়ে ভাবতে শুরু করলাম খাবার কোথায় পাব। খাবারের জন্যই তো মার সঙ্গে এ দিকে এসেছিলাম। গাছের আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখলাম। রাস্তায় লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। মা তো বলে দিয়েছেন অচেনা মানুষদের সঙ্গে কথা বলবে না, কার মনে কী কুমতলব আছে কে জানে! মা কেন যে আমাকে এখানে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন, নির্ঘাৎ খেয়াল করেননি! গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলাম। রাস্তার ওপারেই একসারি দোকান। ওখানে গেলে নিশ্চয়ই খাবার পাওয়া যাবে। কিন্তু আমার কাছে পয়সা নেই আর আমি কথাও বলতে পারি না, তা হলে কী ভাবে ওদের বোঝাব? খুব মুশকিল। যাক ও সব এখন ভেবে লাভ নেই। যা করার আমাকেই করতে হবে। মা বলেছেন সাহসী হতে, ভয় যারা পায়, তারা জীবনে কিছুই করতে পারে না।

রাস্তাটা পার হলাম। নীচের তলার দোকানটা বন্ধ কিন্তু দোতলার একটা দোকানে লোকজন রয়েছে দেখতে পেলাম। আমি ঠিক করলাম ওখানেই যাব। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। খিদেতে পেট জ্বলছে। দোকানের বাইরের দরজাটা কাচের। খোলা ছিল। আমি ঢুকলাম। ভিতরে অনেক লোক ছিল, তারা সবাই কথা বলছিল হঠাৎ আমাকে দেখেই কথা বন্ধ হয়ে গেল!

ভাবলাম, একা একা এসেছি বলে এরা মারবে না তো? কী ভাবে ওদের বোঝাব যে আমার খিদে পেয়েছে। এমন সময় বাবার কোলে বসা একটা বাচ্চা মেয়ে বলল, ‘ওমা, কী মিষ্টি বেবি-ভাল্লুক! ওকে বিস্কুট দেব, বাবা?’ ওর বাবা বললেন, ‘দাও! ওর নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে!’

মেয়েটা কী সুন্দর একটা নীল রঙের জামা পরেছিল। আমি ওর দিকে তাকাতেই ও আমার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল। দেখলাম, ওর হাতে দুটো গোল গোল খাবার জিনিস, ওগুলোই মনে হয় বিস্কুট। ওর হাত থেকে সেগুলো নিয়ে গপ গপ করে খেয়ে নিলাম! বেশ খেতে।

অমনি আমার চার পাশের লোকজন নানা রকম কথাবার্তা বলতে শুরু করে দিল। ‘আহারে ছোট বাচ্চা, খুব খিদে পেয়েছে!’

‘কিন্তু ওর মা কোথায়? এত ছোট বাচ্চার তো একা ঘোরাঘুরি করা উচিত নয়। গাড়ি চাপা পড়ে গেলে!’

‘খুব সাবধান, ওর মা নিশ্চয়ই আশপাশেই কোথাও আছে! বেশ ভয়ের ব্যাপার!’

‘হয়তো চোরাশিকারির গুলিতে মারা গেছে ওর মা...!’

আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম, এরা বলে কী!

একটা বাচ্চা ছেলে আমার কাছে এসে আমার গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছিল তখন ওর মা হাঁ-হাঁ করে ছুটে এলেন, ‘না, না সোনা, অত কাছে যেয়ো না! ওর শরীরে যদি কিছু জীবাণু থাকে তা হলে তোমার অসুখ করবে!’

আমি ভাবলাম জীবাণু আবার কী রে বাবা?

আমাকে লোকে এটা সেটা খেতে দিচ্ছিল আর আমিও দিব্যি খাচ্ছিলাম, তাই দেখে এক জন বললেন, ‘না, না, আপনারা ওই ভাবে যা খুশি খেতে দেবেন না ওকে! শেষে কিছু গণ্ডগোল হলে আপনাদের জেলে পুরবে পুলিশ!’

‘পুলিশ? হ্যাঁ হ্যাঁ, পুলিশেই খবর দেওয়া উচিত!’

যত ক্ষণে পুলিশের লোকজন মেরি বলে এক দয়ালু মহিলাকে সঙ্গে করে নিয়ে হাজির হল, তত ক্ষণে আমার অনেক কিছু খাওয়া হয়ে গিয়েছে।

মেরি পুলিশকে বলল, ‘আমি ওকে নিজের কাছে রাখছি। আপনারা ওর মাকে খুঁজুন!’ বলে মেরি একটা নরম তুলতুলে জিনিস দিয়ে আমাকে জড়িয়ে বোতলে করে দুধ খেতে দিল আমাকে। আমার তো খুব ফুর্তি, চুক চুক করে সবটা খেয়ে ফেললাম। বাচ্চাগুলো হাঁ করে দেখছিল।

মেরি ওদের জিজ্ঞেস করল, ‘একে কী বলে ডাকা যায় বলো তো?’

যে মেয়েটা প্রথম আমাকে বিস্কুট দিয়েছিল সে বলল, ‘আমি বইতে পড়েছি ওর নাম বুবু! বুবু ভাল্লুকের গল্প নিয়ে আমার কাছে একটা বই আছে!’

অন্যরাও রাজি হল। নামটা শুনে নড়েচড়ে বসলাম দেখে মেরি বলল, ‘নামটা ওর পছন্দ হয়েছে মনে হচ্ছে!’

শুনে সব বাচ্চারা হাততালি দিয়ে উঠল।

এর পর মেরি আমায় কোলে নিয়ে ওর গাড়িতে বসল। গাড়ি করে যেতে আমার ভালই লাগছিল। মেরির বাড়িতে ওর দুটো কুকুর আছে। তারা আমাকে দেখেই চিৎকার জুড়ে দিল! আমি ভয়ে মেরিকে জড়িয়ে ধরলাম। মেরি বাগানের একটা ছোট আউটহাউস মতন ঘরে বন্ধ করে দিল! সেখানে একা থাকতে আমার মোটেই ভাল লাগছিল না। মেরি খাবার দিল কিন্তু আমার একদম খেতে ইচ্ছে করছিল না, কেবল মা আর ভাইয়ের কথা মনে পড়ছিল। যদি মাকে শিকারিরা মেরে ফেলে থাকে তা হলে... আর ভাবতে পারলাম না আমি। কেঁদে ফেললাম। মেরি দুধের বোতল আনতে আমি সেটাকেও হাত দিয়ে সরিয়ে দিলাম।

শুনলাম মেরি কাকে যেন বলছে, ‘বুবুকে নিয়ে তো মহাসমস্যা হল! কিছুই খেতে চাইছে না! এ দিকে দোকানে যখন লোকে হাবিজাবি খেতে দিচ্ছিল, তখন সেগুলো দিব্যি খেয়ে নিচ্ছিল! হ্যাঁ, আপনারা তাড়াতাড়ি ওর মাকে খুঁজে বার করুন। আমার কুকুরের জ্বালায় ওকে একটা ঘরে বন্ধ করে রাখতে হয়েছে তাতেই মনে হয় ওর মন খারাপ!’

একটু পরে মেরি এসে আমাকে নিয়ে বাগানে গেল। সেখানে অনেক রঙিন ফুল। দুষ্টু কুকুরগুলোও সেই সময় হয় ঘরে বন্ধ ছিল। পাশের বাড়ির দুটো বাচ্চা এল আমাকে দেখতে। ওদের সঙ্গে বল নিয়ে খেলা করলাম। মনটা ভাল হল। মেরি আমাকে দুধ আর কলা খেতে দিল।

একটু পরে বিকেলবেলা যখন সূর্যের তাপ অনেকটা কমে এসেছে তখন দু’জন লোক এসে হাজির। ওরা নাকি বন বিভাগের লোক। তারা মেরিকে বলল, ‘হ্যাঁ, মনে হচ্ছে এর মাকে পেয়েছি। তার সঙ্গে আর একটা পুঁচকে ছিল। সে তো আমাদের দেখেই পালালো! এ বার একে নিয়ে যেতে হবে! একে মার কাছে ছেড়ে দিয়ে আসব। আশাকরি ওর মা ওকে দেখে খুশি হবে! অনেক সময় অবশ্য নিতে চায় না, দেখা যাক কী হয়!

ভয়ে আমার বুক কাঁপছিল, লোকগুলো বলে কী! মা আমাকে নেবে না? একই সঙ্গে আনন্দ আর ভয়! মাকে দেখতে পাব কিন্তু মা আমাকে নাও নিতে পারে!

মেরি আমাকে একটা তোয়ালে জড়িয়ে নিয়ে চলল। গাড়ি কিছু দূর যাওয়ার পর পাহাড়ের ধারে যে জঙ্গলটা, সেখানেই দেখতে পেলাম মাকে! ওরা বেশ কিছু দূরে গাড়ি থামিয়ে আমাকে নামিয়ে দিল! আমি ছুটতে ছুটতে মার কাছে গিয়ে হাজির। মা দেখে বললেন, ‘বলেছিলাম না, অচেনা মানুষের সঙ্গে কথা বলবে না! আর একটু হলেই হয়েছিল আর কী, হয় চিড়িয়াখানা না হয় সার্কাস!’

আমি আপত্তি করলাম, ‘না, মা, সবাই খারাপ না। মেরি খুব ভাল, ওর কুকুরগুলো অবশ্য ভাল নয় আর দোকানেও ভাল লোক ছিল তারা আমাকে খেতে দিল!’

‘থাক আর ও সব আমাকে শোনাতে হবে না! এ বার চলো আমার সঙ্গে আর একদম একা একা এ-দিক সে-দিক যাবে না!’ আমি মার পিছন পিছন চললাম। ওমা ভাইও কোথা থেকে এসে হাজির, নির্ঘাৎ লোক দেখে গাছের আড়ালে লুকিয়েছিল!

আমি পিছন ফিরে এক বার তাকালাম। মেরি হাত নাড়ছে। ওদের শেষ বারের মতন এক ঝলক দেখে আমি মা আর ভাই গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেলাম। জানি না আবার কোনও দিন শহরে যাওয়া হবে কি না, তবে যত দিন এই জঙ্গল আছে, তত দিন আমাদের ভয় নেই।

গল্পের শেষটা অন্য রকমও হতে পারত। বুবুর মা শিকারিদের গুলিতে মারা যেতেও পারত আর তা হলে তাকে চিড়িয়াখানা বা সার্কাসে যেতে হত। ক্রমাগত জঙ্গল কাটার ফলে ভাল্লুকদের খাবারের ভীষণ অভাব দেখা দিচ্ছে আর খিদের তাড়নায় তারা শহরে ঢুকে আসছে। বহু দেশে বুবু আর ওর মার মতন অনেক ভাল্লুক অনিচ্ছা সত্ত্বেও লোকালয়ে ঢুকে পড়তে বাধ্য হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE