ক’দিন থেকেই শুনছিলাম এমনটা হতে যাচ্ছে। এক দিন রাতে ঘুমনোর আগে দেখলাম, যাঁরা আমাদের জন্য রান্না, ঝাড়পোঁছ করতেন, স্কুলের বাগান টিপটপ রাখতেন— তাঁরা বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে চলে যাচ্ছেন।
পর দিন সকাল থেকে আমাদের নিত্যদিনের রুটিনটাই গেল বদলে। সকালে পিটি-র পরেই কারও ডাক পড়ল রান্নাঘরে, কারও ঝুড়ি হাতে আমবাগানে। সব জায়গাতেই হাজির আমাদের শিক্ষকেরা। হঠাৎ করে সব কর্মীরা যে উধাও হয়ে গিয়েছেন তা বোঝা চলবে না, এমনই ছিল নির্দেশ। ছাত্র-শিক্ষক মিলে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে চেষ্টা করলে কিছুই যে কঠিন মনে হয় না, তা শিখিয়েছিল ওই আটটা দিন।
১৯৭০ সাল। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ে আমরা তখন ক্লাস সেভেন-এর ছাত্র। সিক্স-সেভেনের জন্য জুনিয়র, একটু দূরে উঁচু ক্লাসের জন্য সিনিয়র সেকশন। সেখানে বড়দের জন্য অন্য হোস্টেল, অডিটোরিয়াম, কলেজ— সব কিছু।
নরেন্দ্রপুরের আবাসিক জীবন সম্পর্কে বাইরে অনেক কথাই শোনা যায়। পুরোটাই যে অমূলক তাও বলব না। কিন্তু ছ’বছরের মিশন-জীবনে শিক্ষকদের বন্ধু বা দাদা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারিনি। সম্প্রতি রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পর্কের নানা টানাপড়েনের সংবাদ ঘাঁটতে ঘাটতে নরেন্দ্রপুর-জীবনের কথা মনে পড়ে গেল।
মনে আছে, যে দিন ধর্মঘট শুরু হল সে দিন সকালে পিটি যাওয়ার আগেই আমাদের ডেকে পাঠালেন হোস্টেলের ওয়ার্ডেন অমলদা (অমল মহারাজ)। পুরো পরিস্থিতি বুঝিয়ে ক্লাস সেভেনের ক’জনকে আলাদা করে বললেন, ‘‘তোরা ডাইনিং হল-এ চলে যা। দীননাথদা আছেন, কাজ বুঝিয়ে দেবেন।’’ নিজে একটা বিশাল ঝাঁটা নিয়ে অন্য কয়েক জনকে হাতে ঝুড়ি ধরিয়ে দিয়ে নেমে গেলেন আমবাগানে। বুঝলাম, অমলদা নিজে সাফাইয়ের দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন।
ডাইনিং হলের পাশে তরকারি কাটা, ময়দা মাখা, রান্না করা হত। সেখানে কী কর্মকাণ্ড হত তা দেখার সুযোগ তখনও পর্যন্ত আমাদের অনেকেরই হয়নি। দেখলাম, বাংলার শিক্ষক দীননাথ সেন সেখানে টুল পেতে বসে আছেন। সামনে বিশাল বঁটি। তিনি তরকারি কুটছেন। দীননাথদা কবিতা লিখতেন, চমৎকার নাটক করতেন। তিনি যে এত চমৎকার তরকারি কোটেন, জানতাম না। সুনীলদা (সুনীল মহারাজ) কোমরে চাদর বেঁধে বামুন ঠাকুরের ভূমিকায়। কালীদাদু (ভবনে আমাদের দেখভালের দায়িত্ব ওঁর উপরেই ছিল) মাটিতে থেবড়ে বসে মশলা বাঁটছেন।
আমাদের কাজটা যে কী হবে তখনও জানতাম না। দেখলাম কয়েকটা বস্তা সামনে রাখা, তার পাশে ডাঁই করে রাখা আলু। বস্তার গায়ে আলু ঘষে ঘষে কী ভাবে খোসা ছাড়াতে হয়, দেখিয়ে দিলেন দীননাথদা। ব্যস, আমরা খুশি!
বিশাল বিশাল ডেকচিতে ভাত রান্না হত সে সময়। সেই ডেকচি পরিষ্কার করা একটা সমস্যার কাজ। দীননাথদা একটা ফর্মুলা বের করে ফেললেন। আমাদের মধ্যে সব থেকে যে ছোট সাইজের, তাকে নামিয়ে দেওয়া হল সাবান-জল দেওয়া ডেকচিতে। হাতে একটা কাপড়। সে কাপড়টা জলে চুবিয়ে ডেকচির গায়ে তা বেশ কয়েক বার বুলিয়ে দিল। তার পরে তাকে টেনে তোলা হল। পাঠিয়ে দেওয়া হল স্নান করতে। আর পাইপের জলে ধোওয়া হল ডেকচি।
এমন ভাবেই কেউ বাগান পরিচর্যা করেছে। কেউ সাফাইয়ের কাজ। কেউ বা শিক্ষকদের সঙ্গে লাঠি হাতে পাহারা দিয়েছে জুনিয়র সেকশন। কোথা দিয়ে যে দিনগুলো কেটে গিয়েছে, বুঝতেই পারিনি। যে সংস্কৃত শিক্ষককে যমের মতো ভয় পেতাম, তাঁকে দেখেছি, কী মমতায় ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে বাগান পরিচর্যা করছেন! যে ইংরেজি শিক্ষককে ক্লাসে ভয় পেতাম, তাঁর সঙ্গে বসে ডেকচি-ভর্তি সেদ্ধ আলুর খোসা ছাড়িয়েছি গল্প করতে করতে। এর পরেও কিন্তু মান্থলি টেস্ট হয়েছে নিয়ম মেনেই।
আর এতটুকুও দমে না গিয়ে আমরা ছাত্র ও শিক্ষকেরা যে ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছিলাম, তাতে ধর্মঘটীরাও বুঝতে পেরেছিলেন যে ওঁদের ছাড়াও কাজ চলবে। তাই দিন আটেকের মধ্যেই আন্দোলন ছেড়ে তাঁরা ফিরে এসেছিলেন কাজে।
সেই সময় আমাদের অভিভাবকেরা কিন্তু আমাদের রাঁধুনি, সাফাইকর্মী, মালি, দারোয়ানের কাজ করতে হচ্ছে জেনেও কোনও প্রতিবাদ জানানি। বরং নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখছি বলে খুশিই হয়েছিলেন। এখনকার অভিভাবকেরা এমন অবস্থায় পড়লে কী করতেন, সেটাই এক বার দেখতে ইচ্ছে হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy