Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৮
Share: Save:

ইডলি

পিনাকী ভট্টাচার্য

ই ডলির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ৯২০ খ্রিস্টাব্দে কন্নড় ভাষায় শিবাকোটিআচার্যের লেখা ‘ভাদ্দারাদ্ধান’ পুঁথিতে। সেখানে আছে, কোনও মহিলার ঘরে ব্রহ্মচারী এলে ‘অষ্টাদশ দান-দ্রব্য’-এর যে নিয়ম ছিল, তাতে ইডলি-ও থাকত। দ্বিতীয় চাভুন্দার্য ১০২৫ সালে ইডলি তৈরির রেসিপিটা জানিয়েছিলেন। কলাইয়ের ডাল ঘোলে ভিজিয়ে মিহি করে বাটতে হবে। তাতে দইয়ের জল মিশিয়ে ধনে, জিরে, মরিচ আর হিং দিয়ে গোল গোল করে নিলেই ইডলি রেডি। ১১২৯ সালে লেখা সংস্কৃত পুঁথি ‘মানসোল্লাশ’-এ ইদ্দারিকা’র কথা আছে। বানানো হত কলাইয়ের ডালের ছোট মণ্ডের সঙ্গে মরিচ গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো আর হিং মিশিয়ে। তামিল দেশে ইডলিকে প্রথম খুঁজে পাওয়া যায় অনেক পরে। আঠেরো শতকে লেখা ‘মাক্কাপুরাণম’-এ।

চেনা ইডলিতে কলাইয়ের ডাল এল কোত্থেকে? ঘাবড়াবেন না, আসলে, আজকের ইডলির রেসিপি আলাদা। চালের গুঁড়ো, লেই গাঁজানো আর ভাপে সেদ্ধ লেই থেকে ইডলি তৈরি হয় এখন। এর কোনওটাই সেই জমানায় ইডলি বানাতে লাগত না। হিউয়েন সাঙ তাঁর ভ্রমণকথায় লিখেছিলেন, ভারতীয়রা ভাপে সেদ্ধ করে রাঁধতে জানত না। তবে কি আজকের ইডলি আদতে ভারতীয় খাবারই নয়?

এ দেশের খানা-বিশারদরা মেনে নিয়েছেন, ইডলি জন্মেছিল ইন্দোনেশিয়াতে। হিন্দু রাজারা যখন ইন্দোনেশিয়া পাড়ি দিয়েছিলেন, তখনও বেশ কয়েকশো বছর ধরেই তাঁদের শেকড়ের টান অটুট ছিল। দেশের বাড়ি বেড়াতে আর কনে দেখতে রাজারা মাঝেমধ্যে ভারতে ফিরতেন, সঙ্গে আসত তাঁদের রাঁধুনিরা। রান্নার উপকরণ গেঁজিয়ে নিতে নিতে তাদের হাত পেকে গেছে। রাঁধুনিদের সেই পাকা হাত ধরেই ইডলি এ দেশে এসেছিল। এখন ইন্দোনেশিয়ায় সয়াবিন, বাদাম, মাছ গেঁজিয়ে তৈরি হয় জনপ্রিয় খাবার কেডলি। নামের মিলটা রান্না-পরিবারের তুতো ভাইয়ের সঙ্গে মিলের কারণেই বোধহয়।

এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু হালে বাদ সেধেছে কায়রোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে পাওয়া কিছু নথি। নথি বলছে, আরব দেশে ইডলির জন্ম। আর আরব বণিকদের জন্যই ইডলি ছড়িয়ে পড়ে দিগ্বিদিক। মিশরে আরব বণিকরা যখন পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করলেন, তখনই ইডলি ঢুকে পড়ে নীল নদের দেশে। হজরত মহম্মদ বেঁচে থাকতেই সদ্য ইসলাম ধর্ম নেওয়া আরব বণিকরা মিশরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেন— সেখান থেকেই এ দেশেও এসে পৌঁছন। হজরতের জন্মের আগে থেকেই নাকি আরব বণিকদের ভারতের দক্ষিণ উপকূলে আসা-যাওয়া ছিল। তবে, তাঁরা এ দেশে উপাসনার জন্য প্রথম মসজিদ তৈরি করেন ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে। এই নব্য ইসলামধর্মী বণিকেরা খাবারের ব্যাপারে খুবই গোঁড়া ছিলেন। হালাল করা ছাড়া মাংস ছুঁতেনই না। তার ওপর এ দেশের খাবার তাঁদের কাছে একেবারেই অপরিচিত। তাই হালাল-হারামের সংশয়ে না থেকে ভাতের মণ্ড বানাতেন, আর তা কিছুটা চ্যাপটা করে নারকেলের চাটনি দিয়ে খেয়ে পেট ভরাতেন। যেমনটা তাঁরা মিশরেও করেছেন। সেখান থেকেই ইডলি’র উৎপত্তি।

সময়ের সঙ্গে, বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা পেরিয়ে ইডলি আজ অনেক রকম। তবে দেবরাজস্বামীর মন্দিরে ভোগের কাঞ্চিপুরম ইডলির ধারেকাছে বোধহয় কেউ নেই। চাল গুঁড়ো, হিং, জিরে, মরিচ আর দইয়ের মাঠা দিয়ে একটা মিশ্রণ তৈরি হয় প্রথমে। সেটাকে গেঁজিয়ে তৈরি হয় দেড় কিলোর এক-একটা ইডলি!

পেন ধরেছেন কাব্যলোচন শর্মা

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

আমার সন্তান যেন শুধুই দুধে ভাতে নয়/ থাকে যেন কবিতার কুয়াশা ভাষায়.../ অন্নপ্রাশনে আসা চাই। থাকলাম সেই আশায়। — এটা ছিল অন্নপ্রাশনের চিঠির শেষ ক’টি লাইন। এর আগেও লাইন দশেক ছিল। ফোনেও বহু বার বলেছেন। গেলাম। সোনারপুর স্টেশনে নেমে রিকশায় কিছু ক্ষণ। বাড়ির নাম ‘ছন্দ নিকেতন’। ছাদে শামিয়ানা খাটানো। একটা ফেস্টুন: ভর্তৃহরির শুভ অন্নপ্রাশনে কবিতা উদ্‌যাপন। সিঁড়িতে এলায়ে আছে কবিদের জুতো। ছাদে কবিতা পাঠ চলছে। এসেছি কবি ও বাচিক শিল্পী উদ্দালক রায়ের বাড়িতে। এটা ছদ্মনাম। আসল নাম অন্য।

সিঁড়ির পাশের দেওয়ালটি ছবিময়। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক মঞ্চে; সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত থেকে গ্রহণ করছেন ‘নীরা’ পুরস্কার; নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সস্নেহে আশীর্বাদ করছেন পায়ে ঝোঁকা উদ্দালককে; গিরিধারী স্মৃতি আধ্যাত্মিক কাব্য প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থানাধিকারী কবি উদ্দালক রায় প্রণবানন্দ গিরি অবধূতের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করছেন; নিজের লেখা কবিতা শুনে মুগ্ধ শঙ্খ ঘোষ উদ্দালকের দিকে অপলক... এত সব দর্শনীয় বস্তু দেখতে দেখতে ছাদে পৌঁছলাম। উদ্দালক এসে আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ‘কী যে খুশি হলাম...শ্যামল, ও শ্যামল, ছবি তোল।’ আমার হাত ধরেই রইলেন যত ক্ষণ না শ্যামল চা শেষ করে শাটার টিপলেন। জিজ্ঞাসা করি, ছেলের এত কঠিন নাম রাখতে গেলেন কেন? ভর্তৃহরি? বললেন, কোনও কবির নাম ভেবেছিলাম, ইচ্ছে করেই ঋ-কার এবং রেফ একসঙ্গে থাকা একটা নাম ভেবেছি। নাম ডাকার সময় জিভের জড়তা ভাঙবে। এটা বাঙালির ফোনেটিক চেতনার একটা আন্দোলনের অংশ। বাড়িতে আর্দ্র নামে ডাকব। রেফ ও র-ফলা আছে। সবাই ঠিক উচ্চারণটা অভ্যেস করুক।

কলকাতা বেতারের প্রভাতী অনুষ্ঠান ‘প্রাত্যহিকী’-র নিয়মিত পত্রদাতা উদ্দালকবাবু। এখানে সেরা পত্রদাতাকে স্টুডিয়োতে আহ্বান করে কিঞ্চিৎ আলাপচারিতা করা হয়। উনি এক বার সেরা পত্রদাতা নির্বাচিত হলেন। স্টুডিয়োতে ঢোকার আগে গরম জলে গার্গল করে, লবঙ্গ চিবুলেন। সঙ্গে শ্যামল, সেই ফোটোগ্রাফার।

আমি বলি, করেন কী? চাকরি চলে যাবে। সেই ব্রিটিশ আইনে ভিতরে ছবি তোলা নিষেধ। উনি বললেন, সে কী? যেখানে বসেছেন শরৎ-নজরুল-সুনীল-আলোক, সেইখানে আজ আমি রায় উদ্দালক। কোনও রেকর্ড থাকবে না! আমার মোবাইলে অন্তত একটা তুলে দিন, টুক করে। তুলে দিয়েছিলাম অগত্যা।

ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিলাম। আমার এক পরিচিতের বাড়িতে একটা প্রচ্ছদ দেখে আমি থ। দেখি, আকাশবাণীর স্টুডিয়োর মাইকের সামনে বসে আছেন উদ্দালক রায়। আমারই তোলা সেই ছবিটা। বইটির নাম ‘যে জীবন দোয়েলের’। ব্র্যাকেটে কবি ও বাচিক শিল্পী উদ্দালক রায়ের কর্ম ও জীবন।

মলাট ওলটালে, উদ্দালকের একটি স্কেচ। অবয়বটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে আছে বিখ্যাত কিছু কবিতার লাইন। ‘পৃথিবীতে নেই কোন বিশুদ্ধ চাকরি’, ‘কবিই শুধু নিজের জোরে মাতাল’, ‘আমি স্বেচ্ছাচারী’, ‘যমুনা আমার হাত ধরো, স্বর্গে যাব’... এর পর বারো-চোদ্দো পাতা জুড়ে উদ্দালক সম্পর্কে বিভিন্ন গণ্যমান্যদের মূল্যায়ন। যথা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, মহারাজ, এবং অবশ্যই বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক। এর পর দোয়েল জীবনে অর্জিত মানপত্রাদির প্রতিলিপি। তার পর বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঁর ছবি। আমার সেই হাতধরা ছবিটা দেখার আশায় সব ছবিগুলিই দেখলাম। কুড়িটার মতো ছিল। হায়, আমি নেই। এর পরের পর্বে ‘প্রাত্যহিকী’তে লেখা চিঠিগুলি, এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা ভেবে পঠিত হওয়ার দিন-তারিখ। অতঃপর স্বরচিত কবিতাবলি। কবিতাগুলি বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত। যেমন: প্রকৃতি পর্যায়, প্রতিশোধ অধ্যায়, সে ভাবেই আধ্যাত্মিক, দেশপ্রেম, চিত্তশুদ্ধি, দহন, সংগ্রাম, ভ্রমণ... ভবিষ্যতের গবেষকদের কথা বিবেচনা করে রচনাস্থান ও রচনাকালও দেওয়া আছে। যথা: বাইশে শ্রাবণ, ১৪১০, মম শ্বশুরালয়, ভ্যাবলা। নিজগৃহ প্রাঙ্গণ, সোনারপুর। তাজমহলের চাতাল; মালতীভিলা, পুরী। প্রকৃতি পর্যায়ের একটি কবিতার নাম ময়নার বন্যা। রচনাস্থান ময়নার লাভলি হোটেল শীর্ষ। ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০০২। ছাদে দাঁড়িয়ে বন্যা দেখতে দেখতে লেখা। কবির সততা অস্বীকার করার উপায় নেই। শেষের দিকে কবির কয়েকটি বিভিন্ন মুডের ছবি— যেমন আকাশে তাকিয়ে কলম হাতে কবিতার সন্ধান। মাতৃশোকে বিধ্বস্ত কবি। তাজমহল পদপ্রান্তে পলকে পুলকে কবিদম্পতি। ধুতি ও গেঞ্জি পরিহিত। গেঞ্জির উপর স্টেথোস্কোপ ঝোলানো হোমিয়ো ডাক্তার পূজ্যপাদ শ্বশুরমশাইও আছেন।

কিছু দিন আগে আমার বাড়ি এলেন উদ্দালক। বললেন, অনেক খুঁজে এলাম। আমায় নিয়ে লেখা একটা বই আছে। দ্বিতীয় সংস্করণ হবে। আপনারও ছবি থাকবে আমার সঙ্গে। তোলাই আছে। আমার একটা মূল্যায়ন করে দিতে হবে। বুঝলাম, আনন্দ পুরস্কারটা পেয়ে ‘বিখ্যাত’ হয়ে গেছি আমি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE