Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

শিউচরণ

চরকির কাকাদাদুর একটা পোষা ভূত আছে। তার নাম শিউচরণ। যে যখন দুষ্টুমি করে তার সবটুকু নজর করে। অন্ধকার ঘরে ‘শিউচরণ’ বলে কাকাদাদু এক বার ডাক দিলেই, তক্ষুনি সে সব গড়গড় করে বলতে থাকে। ভবানীপুরের বাড়িতে শিউচরণ কাকাদাদুর সঙ্গে থাকে।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

মন্দার মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৫ ০০:০৯
Share: Save:

চরকির কাকাদাদুর একটা পোষা ভূত আছে। তার নাম শিউচরণ। যে যখন দুষ্টুমি করে তার সবটুকু নজর করে। অন্ধকার ঘরে ‘শিউচরণ’ বলে কাকাদাদু এক বার ডাক দিলেই, তক্ষুনি সে সব গড়গড় করে বলতে থাকে। ভবানীপুরের বাড়িতে শিউচরণ কাকাদাদুর সঙ্গে থাকে। আর ওই বাড়িতেই থাকেন চরকির দাদু-ঠাম্মা। চরকির বাবা-মা চাকরিসূত্রে ধানবাদ শহরে থাকেন। চরকিও সেখানকার ইংরেজি মিডিয়াম ইস্কুলে পড়ে। কলকাতায় এলে চরকিরা দাদু-ঠাম্মার সঙ্গে থাকে।

কাকাদাদুও অনেক বছর পটনায় ছিলেন। সেখান থেকেই নাকি শিউচরণ তাঁর ভক্ত হয়ে পড়ে। রিটায়ার করে কলকাতা আসার সময় শিউচরণও দাদুর সঙ্গে কলকাতায় এসেছে। তবে কাকাদাদু ছাড়া অন্য কেউ ডাকলে সাড়া দেয় না শিউচরণ। বাবারা যখন ছোট ছিল, তখন মাঝে মাঝে ঠাম্মাকে না বলে, গরমের ছুটিতে এ-পাড়া ও-পাড়া ঘুরতে চলে যেত। বাড়ি ঢুকলে, ঠাম্মা পেটানি লাগাতে গেলেই কাকাদাদু বলতেন, আগেই মেরো না, শিউচরণের কাছে ব্যাপারটা জেনে নিই। বাবা, ছোটপিসি আর কাকাইকে ঘরে ঢুকিয়ে, অন্ধকার করে, ‘শিউচরণ’ বলে কাকাদাদু হাঁক দিলেই, খোনা গলায় শোনা যেত, ‘জি হুজুর’। কাকাদাদু জিজ্ঞাসা করতেন, এরা দুপুরে কোথায় চরে বেড়াচ্ছিল? শিউচরণ বলে, বাবা নাকি বন্ধুদের সঙ্গে বেপাড়ায় গিয়ে ক্যারাম খেলেছে। আর ছোটপিসি এবং কাকাই তাদের গড়চার দিদুর বাড়ির মস্ত পুকুরে হাঁসের মতো সাঁতার কেটে বাড়ি ফিরেছে।

চরকির মা এ পাড়ারই মেয়ে। শিউচরণ তাই মাকেও চেনে। এক বার মায়ের ইস্কুল কামাই হয়ে যাওয়াতে দিদুন বকাবকি করলে, শিউচরণ বলে দেয়, আগের দিন মা ভিজে ভিজে সন্ধের সময় ছাদে শিল কুড়িয়ে খেয়েছে। চরকি তাই সামলে রাখে নিজেকে। যেখানেই যায় তার মনে থাকে শিউচরণ নিশ্চয়ই কাকাদাদুকে সব বলে দিচ্ছে। সে বার ধানবাদ ইস্কুলের পাশের বাজারে চরকি ঢুকেছিল বড় বড় খাজা খেতে। সঙ্গে কৃশানু আর প্রিয়াঙ্কাও ছিল। চরকি তাদের সাবধান করে দিয়েছিল, কারণ শিউচরণ তাকে নজরে রাখছে। কৃশানু আর প্রিয়াঙ্কা টিফিন ফেলে দিলেও চরকি তা করেনি। ইস্কুল-বাসে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে খাজাটা খেয়েছিল। পাশে বসা ভার্গবকেও একটু ভাগ দিতে হয়েছিল। ইস্কুলের ড্রেসে লেগে থাকা খাজার গুঁড়ো দেখে মা বিস্কুটের গুঁড়ো ভেবেছিল, তাই রক্ষে!

এক বার নাকি বাবারা দল বেঁধে রাজপুরে মামার বাড়িতে পুকুরে নেমে বিকেল থেকে সন্ধে অবধি স্নান করছিল। ঠাম্মা ডাকতে গেলেই জলে ডুব দিয়ে লুকিয়ে পড়ছিল। দাদু ভয় দেখাচ্ছিল মাছ ধরার জাল ফেলে সব ব্যাটাকে ধরবার। তখন নাকি কাকাদাদু এসে পাড়ে দাঁড়িয়ে ‘শিউচরণ’ বলে হাঁক দিতেই সবাই সুড়সুড় করে উঠে এসেছিল। দাদু গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, জল থেকে উঠলেই তাদের মারবে বলে। কিন্তু কাকাদাদু মারতে দেয়নি। বলেছিল, দাদা, তুমি আর হাত ব্যথা করবে কেন? শিউচরণ তো আছেই। যা করবার ও-ই করবে।

গত বার কলকাতায় এসে চরকি, টুনি, গোপাল সকলে মিলে যখন ছাদে লাফালাফি সেরে সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় করে নামা-ওঠা করেছিল, সে দিনও সন্ধেবেলা ঘর অন্ধকার করে শিউচরণ বলে দিয়েছিল, চরকির সঙ্গে কে কে ছিল। চরকির সন্দেহ হয়েছিল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বাবা-মা আর ঠাম্মার হাসির শব্দ শুনে সন্দেহটা আরও বেড়ে গিয়েছিল। চরকির বন্ধু সৌরভ ভেন্ট্রিলোকুইজ্ম শিখছে তার বাবার কাছে। সৌরভের বাবা নাকি বিভিন্ন জায়গায় ভেন্ট্রিলোকুইজ্ম-এর শো করেন। ‘শতাব্দী’ নামে একটা পুতুলকে কোলে বসিয়ে প্রশ্ন করেন আর ‘শতাব্দী’ সব উত্তর দিয়ে দেয়। সৌরভ বলেছে, তার বাবা দু’তিন জনের গলায় একসঙ্গে কথা বলতে পারেন। এমন কায়দা করে বলেন, কেউ বুঝতে পারে না। চরকি টিভিতেও দু’এক বার দেখেছে। বোঝাই যায় না পুতুলের গলাটাও সৌরভের বাবার। সৌরভ কায়দাটা শেখায়নি, কিন্তু দু’এক বার ছেলে এবং মেয়ের গলায় প্রশ্ন-উত্তর করে চরকিকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।

চরকির মনে তাই সন্দেহ, কাকাদাদু শিউচরণ নাম দিয়ে ভেন্ট্রিলোকুইজ্ম করেন না তো? ঠাম্মাকে জিজ্ঞেস করলে বলেন, ও মা! শিউচরণ নকল গলার কাকাদাদু হবেন কী করে! সেই কবে থেকে ও আমাদের সঙ্গে থাকে। ওর জন্যে রোজ এক গ্লাস দুধ আর দুটো পানতুয়া ওপরে পাঠিয়ে দিই। ও তো আর কিছু খায় না। তবে শিউচরণ তো ভূত, তাই ওর জামা-কাপড়-বিছানা লাগে না। ও কাকাদাদুর বুকপকেটে থাকে।

দাদুকে জিজ্ঞেস করতেই বলেন, ওরে বাবা! শিউচরণ না থাকলে তোর বাবা-কাকা-পিসিরা পেটান খেতে খেতে নির্জীব হয়ে যেত। ওরা যা দস্যি আর ফাঁকিবাজ ছিল, ও না থাকলে বছর বছর ফেল করে, পাড়ার ক্যারাম টিমের ক্যাপ্টেন হয়ে জীবন কাটাত। বাবা ফোড়ন কাটেন, শুধু আমরা কেন, ও তো চরকির মা’র দুষ্টুমির কথাও কাকাদাদুকে বলে দিত। চরকির মা রিনা নাকি ভাঙা পাঁচিলে উঠে চোর চোর খেলত। দিদুনের শাড়ি চুরি করে পরে পাড়ার নাটকে পার্ট করে আসত। নাচের ইস্কুল যাবে না বলে ঘুঙুরের বটুয়াটা সুইমিংপুলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। দিদুনের ওপর রাগ করে আলমারির চাবি নিয়ে ইস্কুলে চলে গিয়েছিল। শিউচরণ না থাকলে জানাই যেত না চাবিটা ওর ব্যাগেই আছে। আর এটাও জানা যেত না যে, নাচতে রিনার একদমই ভাল লাগে না।

এত শোনার পরও চরকির সন্দেহ যায় না। দুপুরের খাওয়া শেেষ সে চলে যায় কাকাদাদুর ঘরে। কাকাদাদু দুপুরে বিশ্রাম করেন না। বসে বসে অভিধান পড়েন। কাকাদাদুর বিছানায় শুয়ে চরকি বলে, কাকাদাদু, শিউচরণের গল্প বলবে? কাকাদাদু বলতে শুরু করেন, শিউচরণ পটনার লোক। ঘন দুধ আর তিলের রেউড়ি খেতে ভালবাসে। এখন অবশ্য কলকাতার পানতুয়া-সন্দেশই তার প্রিয়। ভিক্টোরিয়ার সামনে ঘোড়ার গাড়ি চেপে বেড়াতে ভালবাসে। পুরনো বাড়ি, আমবাগান তার পছন্দ। তবে ন্যাশনাল লাইব্রেরির সাবেক রিডিং রুমটা নতুন বাড়ি ‘ভাষাভবন’-এ চলে এলে সে খুব দুঃখ পেয়েছিল। দাদুর ঘরের সবই তার নখদর্পণে। মোবাইলটা ঘন ঘন বাজলে শিউচরণ রাগ করে। কাকাদাদুর দোক্তার কৌটোটাও লুকিয়ে রাখে, বেশি খেলে শরীর খারাপ...। কাকাদাদুর বুকপকেটে সে থাকে বলে তাঁর সব পাঞ্জাবিতে বুকপকেট চাই-ই চাই। কাকাদাদুর সঙ্গে থাকতে থাকতে হিন্দিভাষী শিউচরণ বাংলা ও ইংরেজি দুটোই বলতে পারে।

বিকেল শেষ হয়ে সন্ধে লেগেছে দেখে কাকাদাদু বললেন, দাঁড়া, আলো জ্বালবার আগে শিউচরণকে এক বার ডাকি। এখন তো তোর বাবা কাকারা বড় হয়ে গেছে, কেউ আর দুষ্টুমি করে না। আর দাদুভাই তুমিও তো সারা দিন লক্ষ্মী হয়ে বাড়িতে বসে গেম খেেলা, হোম ওয়ার্ক করো, ঠাম্মার পাশে শুয়ে গল্প শোনো— শিউচরণকে ডাকার দরকারই পড়ে না। কাকাদাদু শিউচরণকে ডাক দিতেই ‘জি-হুজুর’ বলে সে সাড়া দিল। চরকি নড়েচড়ে বসল। কাকাদাদু জিজ্ঞেস করলেন, চরকি কি বড় হয়ে গেল, আর দুষ্টুমি করে না কেন রে? শিউচরণ চুপ করে থাকে। অন্ধকার ঘরে কাকাদাদুকেই শিউচরণ বলে মনে হতে লাগল চরকির।

ধানবাদ ফেরার কয়েক দিন বাদেই চরকিদের আবার ভবানীপুরের বাড়িতে ফিরতে হল। ঠাম্মা, দাদু খুব ভেঙে পড়েছেন। মাকে দেখেই ছোটপিসিও জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ছোটকাকু বাবাকে বলল, যা ওপরের ঘরে গিয়ে দেখ, মনে হবে যেন ঘুমোচ্ছে। চরকি বুঝতে পারল কাকাদাদু আর নেই। দোতলার ঘরে ঢুকে আন্দাজ করতে চেষ্টা করল, শিউচরণ আশেপাশে কোথাও আছে কি না। হ্যাঙ্গারে কাকাদাদুর পাঞ্জাবিগুলো ঝুলছে। চরকিকে বাবা বলল, চরকি কাকাদাদু স্টার হয়ে গেল রে! চরকি বলল, শিউচরণও! আর সে ‘জি হুজুর’ বলে সাড়া দেবে না? চরকির চিৎকার করতে ইচ্ছে করল, শিউচরণ কাকাদাদু কোথায়? চরকি যেন শুনতে পেল সে বলছে, তোমার গলায়। একটু প্র্যাক্টিস করলেই তোমার কাছেও আসব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mandar Mukhopadhyay story job
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE