Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

জুনিয়র হয়েই থাকতে চাই

সিনিয়রের আসনটা বাবার জন্যই থাক। বাবাকে খুব মিস করি। যেমন রংচঙে মানুষ, তেমনই সাদাসিধে। সবাই এত সম্মান করত, চোর অবধি ফোন করে ব্যাগ ফেরত দিয়েছে!আমার বাবা, পি সি সরকার (সিনিয়র) ম্যাজিক শিখেছিলেন আমার ঠাকুরদার কাছ থেকে। ঠাকুরদা শিখেছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। সে দিক থেকে দেখতে হলে আমরা বংশপরম্পরায় ম্যাজিক শিখে আসছি। কিন্তু আমার ঠাকুরদার সময় পর্যন্ত ম্যাজিক সে ভাবে সমাজে কদর পায়নি। জাদুবিদ্যাকে তখন এ দেশের সমাজে খুব একটা ভাল চোখে দেখা হত না। এটা নাকি নেহাতই অ-বিজ্ঞান, মনোরঞ্জনের জিনিস।

পি সি সরকার (সিনিয়র) ও তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী। জাদুসম্রাট আনন্দবাজার পড়ছেন। ছবি সৌজন্য: পি সি সরকার (জুনিয়র)

পি সি সরকার (সিনিয়র) ও তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী। জাদুসম্রাট আনন্দবাজার পড়ছেন। ছবি সৌজন্য: পি সি সরকার (জুনিয়র)

পি সি সরকার (জুনিয়র)
শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

আমার বাবা, পি সি সরকার (সিনিয়র) ম্যাজিক শিখেছিলেন আমার ঠাকুরদার কাছ থেকে। ঠাকুরদা শিখেছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। সে দিক থেকে দেখতে হলে আমরা বংশপরম্পরায় ম্যাজিক শিখে আসছি। কিন্তু আমার ঠাকুরদার সময় পর্যন্ত ম্যাজিক সে ভাবে সমাজে কদর পায়নি। জাদুবিদ্যাকে তখন এ দেশের সমাজে খুব একটা ভাল চোখে দেখা হত না। এটা নাকি নেহাতই অ-বিজ্ঞান, মনোরঞ্জনের জিনিস। বাবা প্রথম প্রতিবাদ করলেন। বললেন, সমস্ত বিজ্ঞান। জানলে বিজ্ঞান, আর না জানলেই সেটা ম্যাজিক।
শুধু মুখে বললেন না। তিনিই প্রথম রাস্তার মাদারির খেলা, বেদেদের খেলাকে মর্যাদা দিয়ে স্টেজে তোলার জন্য এগিয়ে এলেন। ভারতের নিজস্ব জাদুবিদ্যাকে গোটা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরলেন। অনুষ্ঠানটির নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘ইন্দ্রজাল’। নিছক ম্যাজিক নয়, তার সঙ্গে বাবা জুড়লেন মঞ্চমায়া, সংগীত, আলোকসম্পাত, আর জাদুকরকে দিলেন একটা পোশাক। সে পোশাক পশ্চিমকে কপি করে ম্যানড্রেকের মতো কালো টুপি আর কোট-প্যান্ট নয়। সেটা আদ্যন্ত ভারতীয় পোশাক, রংচঙে ঝলমলে। বাবা বলতেন, আমি মানুষটাই রংচঙে। আমার পোশাকটাও তা-ই। চিরাচরিত জাদুকরের পোশাকের বদলে মাথায় পাগড়ি-সমেত এমন পোশাক বেছে নেওয়ার পেছনে আবার একটা মজার গল্প আছে। বাবার এক জন ভাল বন্ধু ছিলেন— হনবন্ত সিংহ। তিনি তখন জোধপুরের মহারাজ। গান-বাজনা ভালবাসতেন, নাটক করতেন। সেই সঙ্গে বাবার কাছে অল্পবিস্তর ম্যাজিকও শিখতেন। এক বার তিনি ঠিক করলেন, বন্ধুদের সেই ম্যাজিক দেখাবেন। তাঁদের চমকে দেবেন। নেমন্তন্ন গেল শুধুমাত্র বাছাই করা রাজন্যবর্গের কাছে। এঁদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ ছিলেন, যাঁদের সব জেনেশুনে বেশ হিংসে হল। তাঁরা ঠিক করলেন, মহারাজকে জব্দ করতে হবে। নির্দিষ্ট দিনে ম্যাজিক দেখানো শুরু হল। কিন্তু দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যেই হনবন্তের খেলা দেখানো শেষ। যে সব ম্যাজিকে তিনি হাত পাকিয়েছেন, তাদের সংখ্যা বেশি নয়। বিরোধী পক্ষ এ বার গোলমাল শুরু করল। ‘আরও চাই।’ হনবন্ত তখন ফাঁপরে পড়েছেন। বললেন, ‘আমার হয়ে আমার বন্ধু প্রতুল খেলা দেখাবেন।’ বিরোধী পক্ষ ফের বাধা দিল। বলল, ‘এটা হবে না, আপনি তো শুধু রাজন্যবর্গের কথা বলেছেন। ইনি তো তা নন।’ হনবন্ত তখন বাবাকে নিয়ে ড্রেসিংরুমে ঢুকলেন। বাবাকে দিলেন চোস্ত পাজামা, শেরওয়ানি, নাগরাই, আর জয়পুরের প্রতীক-সাঁটা পাগড়ি। এবং সবার সামনে এসে বললেন, ‘এ অনুষ্ঠান শুধুমাত্র রাজন্যদেরই জন্য। নাউ আই প্রেজেন্ট দ্য মহারাজা অব ম্যাজিক।’ পি সি সরকার পেলেন তাঁর পোশাক, আর জাদুবিদ্যা পেল পি সি সরকারকে। বাবা মারা যান জাপানে। একটা শহরে টানা শো চলার সময়ই। আমি তখন কলকাতায়। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে জাপান উড়ে গেলাম। গিয়ে শুনলাম, বাবা বলে গিয়েছেন, শো যেন বন্ধ না হয়। তাঁর মৃত্যুর পর জাপানেই আমি ম্যাজিক দেখানো শুরু করি। গায়ে সেই পোশাক।

বাবা মানুষটা ছিলেন একেবারে ডালে-ভাতে বাঙালি। কিন্তু মানসিকতায় বহু দূর এগিয়ে। সে আমলে মেয়েরা ম্যাজিকের স্টেজে নামবে, এমনটা ভাবাই যেত না। বাবা উলটো গাইলেন। বললেন, ‘ম্যাজিকের শো সফল করতে হলে মেয়েদের তো স্টেজে আসতেই হবে।’ মা বাবার পাশে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘তোমার নিজেরই তো দুটো মেয়ে। ওদের স্টেজে নিয়ে এসো।’ বাবা তা-ই করেছিলেন।

অসম্ভব দারিদ্রে মানুষ হয়েছেন বাবা। নিজেও খুব কষ্ট করে রোজগার করতেন। কিন্তু আমাদের কোনও দিন তা বুঝতে দেননি। আমরা ভাবতাম, বাবার আলমারিটা বোধহয় ম্যাজিক আলমারি। ভর্তি টাকা। যখনই বাবা মায়ের কাছে টাকা চান, মা আলমারি খুলে বের করে দেন। এখন বুঝতে পারি, বাবা তাঁর রোজগারের পুরোটাই মায়ের হাতে তুলে দিতেন। আর মা প্রয়োজন মতো আলমারি খুলে টাকা বের করে বাবার হাতে দিতেন। আসলে বাবারও যে অভাব থাকতে পারে, আমরা জানতামই না। আমরা ভাইবোনেরা প্রত্যেকেই ভাল ভাবে পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। শুধু একটাই দুঃখ, খেটেখুটে ভাল রেজাল্ট করতাম, আর বন্ধুরা বলত, বাবা ম্যাজিক করেছে।

একটা সময় বাবা ডলারে টাকা রোজগার করেছেন। সে টাকার অনেকটাই দেশকে দিয়েছেন। আবার ঠিকমত ইনকাম ট্যাক্স ফাইল করেননি বলে লেট ফাইলিং-এর জন্য চিঠিও পেয়েছেন। এখানে ম্যাজিক চলেনি। মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়েও রীতিমত আনন্দবাজারে বিজ্ঞাপন দিতে হল। ভোজবাজিতে ভর করে পাত্র হাজির হল না। রোজকার জীবনে একেবারে আটপৌরে বাঙালি মানুষটার মধ্যে এক প্রচণ্ড আত্মাভিমানী ভারতীয় লুকিয়ে ছিল। যে কারণে নিজের নামের বানানটা ‘Sorcar’ করে নিয়েছিলেন। ‘Sarkar’, ‘স্যারক্যার’— কেমন যেন ইংরেজদের চাপিয়ে দেওয়া পদবি মনে হয়। আমরা তো তা নই। আবার পশ্চিম ভাবল, এটা নেওয়া হয়েছে ‘sorcery’ থেকে। ইংরেজিতে এর মানে ম্যাজিক। ফলে এই পদবি পরিবর্তনকে আমরা ভাবছি ‘আমিত্ব’-র দিক দিয়ে, আর ইংরেজরা ভাবছে ম্যাজিক দিয়ে। দু’দিকটাই কিন্তু ঠিক।

আমার এ হেন বাবা, যিনি হামেশাই বাইরে বাইরে ঘুরতেন, তাঁর বিরুদ্ধে কিন্তু আমার দিদিমার ভয়ংকর অভিযোগ ছিল। প্রত্যেক বছর জামাইষষ্ঠী আসত, আর দিদিমা হা-হুতাশ করতেন, ‘প্রতুলকে এ বছরও খাওয়াতে পারলাম না।’ দিদিমা প্রচণ্ড ভাল রান্না করতেন। নিজে যেমন খেতেন, তেমনই খাওয়াতেন। তিনি কিনা বাবাকে খাওয়াতে পারছেন না! কী দুঃখ! আবার দাদু ছিলেন একনিষ্ঠ ডাক্তারমানুষ। দিদিমা বেহিসেবির মতো তেল-মশলা ঢেলে রান্না করতেন, আর দাদু সেগুলো সমস্ত বাতিল করতেন। এক বার দিদিমা বাবার নাগাল পেলেন। সে বছর জামাইষষ্ঠীতে বাবা এ দেশে। বাবারও বোধহয় একটু অপরাধবোধ ছিল। নেমন্তন্নতে রাজি হয়ে গেলেন। দিদিমা খাওয়ার আগে মা’কে ইশারা করে দিলেন, প্রতুল কিন্তু একা খাবে। অর্থাৎ মনোযোগের সবটুকু যাতে প্রতুল একা পায়। কিন্তু ঠিক খাওয়ার আগে দাদু বাবার পাশটাতে একটা চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসলেন। খাবার এল। অ্যাত্ত বড় কাঁসার থালা। তাতে ভাত, ঠিক যেন একটা বৌদ্ধ স্তূপ। তার চার পাশে প্রচুর বাটি। এবং বাটির পর বাটি আসছে। বাবা আঁতকে উঠলেন। কিন্তু তার চেয়েও বেশি আঁতকে উঠলেন দাদু, ‘প্রতুল, তুমি এটা খাবে না’, ‘ওটা খাবে না’। একের পর এক বাটি বাতিল। বাবার বোধহয় কয়েকটা খাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু স্বয়ং শ্বশুরমশাই বাদ দিলে কী করবেন? দিদিমা তো এই সব দেখে আঁচলে মুখ ঢেকে ভ্যাঁ করে কেঁদে সোজা রান্নাঘরে। আর বাবা দাদুর ইচ্ছেমত কয়েকটা পদ দিয়ে খাওয়া সেরে মুখ-হাত ধুয়ে বিশ্রাম নিতে গেলেন পাশের ঘরে। গিয়ে দেখেন, বাতিল হওয়া সব বাটি সেখানে সাজানো। এবং দিদিমা ফিল্ডে। বেচারা বাবাকে দ্বিতীয় বার খেতে হল।

বাবা কড়া ধাতের মানুষ ছিলেন। আমি জাদুজীবন যখন শুরু করি, তখন বিশ্ববাসীকে জানান দেওয়ার জন্য সেই বিখ্যাত, থুড়ি, কুখ্যাত খেলাটা দেখাব বলে ঠিক করেছিলাম— বাক্সবন্দি হয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ। বাবাকে গোড়ায় এটা জানাইনি। আমি যে এটা করতে চলেছি, বাবা আনন্দবাজারে পড়ে আঁতকে ওঠেন। মা’কে বলেন, ‘ওকে এক্ষুনি এটা করতে বারণ করো।’ মা’র সঙ্গে বাবার এক প্রস্থ ঝগড়াই হয়ে যায় এটা নিয়ে। বাবা মা’কে বলেন, ‘তোমার প্রশ্রয়ে আমাদের বাড়িতে একটা বিরাট অমঙ্গল হতে চলেছে। ম্যাজিকটা দেখাতে গিয়ে এর আগে মোট বারো জন শিল্পী মারা গিয়েছেন। তুমি কি চাও তোমার ছেলে তেরো নম্বর হোক?’

মা আমায় ডাকলেন। সরাসরি জানতে চাইলেন, ‘তোমার বাবা বলছেন এটা প্রচণ্ড বিপজ্জনক আর তুমি নাকি জেনেশুনে সুইসাইড অ্যাটেম্পট করছ? তুমি কি পারবে?’ আমি বুক ফুলিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ পারব। সে জন্যই তো করতে যাচ্ছি।’ মা তখন বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শুনছ? ও বলছে ও পারবে।’ বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে। তা হলে অনুমতিটা তুমি দাও তোমার দায়িত্বে।’ মা তখন আমার দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘যদি পারো, তবে করো। আর যদি না পারো, ডুবে মরো। হেরো ছেলে আমি চাই না।’

পেরেছিলাম। ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯। রাত দেড়টা-দুটো নাগাদ ‘ইন্দ্রজাল’ বাড়ির সামনে বাস থেকে নামছি। দেখি সদর দরজায় বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জাদুকর এবং আমার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী জাদুসম্রাট
পি সি সরকার (সিনিয়র)— আমার বাবা— একটা ফুলের মালা নিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা করার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। আমি প্রণাম করতেই বাবা মালাটা আমাকে পরিয়ে দেন। আমিও জাদুকরি ক্ষিপ্রতায় নিজেকে সরিয়ে নিয়ে মালাটা তাঁর গলাতেই পরিয়ে দিই। বাবার চোখে জল। মালাটা খুলে বললেন, ‘আসল জায়গায় পরিয়ে দাও।’ পিছনে মা দাঁড়িয়েছিলেন। মালাটা আমি মায়ের পায়ে দিয়ে দিই।

বাবার ম্যাজিক আমি একেবারে কাছ থেকে দেখেছি। প্রত্যেকটার সঙ্গেই আমার আত্মার সম্পর্ক। কিন্তু আমার সবচেয়ে পছন্দের খেলা ছিল এক্স রে আই-এর ম্যাজিক। এটা বাবা শিখেছিলেন মাদারিদের কাছ থেকে, কৌশলটা পুরোপুরি ভারতীয়। বাবা একে রপ্ত করে বিদ্বজ্জনদের উপযুক্ত করে মঞ্চে উপস্থাপিত করতেন। এবং যোগ করেছিলেন সুশিক্ষার হাওয়া। দর্শকদের বলতেন, যে কোনও একটা দাগ কাটতে। বাবার দু’চোখ তখন সম্পূর্ণ বন্ধ। ওই অবস্থাতেই তিনি ওই দাগকে অনুসরণ করে ছবি আঁকতেন। আঁকার শেষে মনে হত, দাগটা যেন আগে আঁকা হয়নি। ওটা ছবিরই একটা মূল্যবান অংশ। আর সবশেষে আঁকতেন নিজের মুখ। আঁকা শেষ হয়ে গেলে, হঠাৎ যেন মনে পড়ে গিয়েছে, এমন মুখ করে দৌড়ে এসে ছবির ডান গালে একটা তিল এঁকে দিতেন। বাবার ডান গালে একটা তিল ছিল। প্রচুর প্রশংসা পেয়েছেন বাবা এই ম্যাজিকের জন্য। আমিও ম্যাজিকটা দেখাই। বলেই দিই, এটাই বাবার দেখানো সেই বিখ্যাত ম্যাজিক। দেখানোর সময় হুবহু বাবাকে নকল করি। শুধু ভুলে যাওয়ার অভিনয়টা বাদ দিয়ে। কারণ বাবার মতো আমার গালে কোনও তিল নেই।

বাবার আর একটা ম্যাজিকের কথা বলি। এটাও খুব বিখ্যাত। স্টেজে খেলা দেখাতে দেখাতে বাবা হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যেতেন। যেন হারিয়ে গেলেন। আর তক্ষুনি দর্শকদের পিছন থেকে বলে উঠতেন, ‘আই অ্যাম হিয়ার।’ ওখানে আসতেন কী করে? রহস্যটা এখানে ফাঁস করছি। কারণ বুদ্ধিমানমাত্রেই জানেন যে, এখানে তন্ত্রমন্ত্রের কোনও ব্যাপার নেই। ওই সময়টায় বাবা স্টেজে একটা দারুণ চিত্তাকর্ষক খেলা দেখাতেন। সমস্ত দর্শক মন্ত্রমুগ্ধ। সেই সুযোগে বাবা কখন যেন টুক করে উইংসের আড়ালে ঢুকে যেতেন। আর এক নকল বাবা স্টেজে চলে আসতেন। দর্শক খেলায় এত বুঁদ হয়ে থাকত যে, এই বাবা পালটাপালটির ব্যাপারটা ধরতেই পারত না। তারা নকল বাবার খেলাই দেখত। বাবা তখন ধীরেসুস্থে অডিটোরিয়ামের পাশের গলি দিয়ে, প্রয়োজনে একটু দৌড়ে, প্রেক্ষাগৃহের পিছনের দরজাটা খুলে চুপচাপ দর্শকদের সঙ্গে মিশে দাঁড়িয়ে থাকতেন। একটা সময় স্টেজের নকল বাবা উধাও হয়ে যেতেন। আর পাবলিকের মধ্যে থেকে আসল বাবা বলে উঠতেন, ‘আই অ্যাম হিয়ার।’ এত সুন্দর ভাবে ঘটনাটা ঘটত, যেন মন্ত্রের মতো। কত বার দেখেছি, আসল বাবা পাশে দাঁড়িয়ে স্টেজে ‘নিজের’ খেলা দেখছেন।

এক বার অসমে শো করছি। আমিও গিয়েছি বাবার সঙ্গে। দিনের বেলা বাবার সহকারীদের সঙ্গে সমস্ত যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক সাজিয়ে রাখা, সেগুলোকে পরীক্ষা — এই সব কাজ করতাম। এক দিন কাজটাজ করে ক্লান্ত হয়ে চায়ের দোকানে চা খাচ্ছি। একটু দূরে স্থানীয় ছেলেরা আড্ডা দিচ্ছে। শুনলাম ওদের এক জন বলছে, ‘পি সি সরকারের একটা ম্যাজিক আমি জেনে গেছি। শেষ খেলাটাতে নকল পি সি সরকার ম্যাজিক দেখায় আর আসল জন এখান দিয়ে হেঁটে হেঁটে যায়। অন্ধকারে চুপচাপ। ঠিক করেছি আজ ধরব। যখন যাবে এখান দিয়ে, আটকাব। দেখি কী করে বলে, আই অ্যাম হিয়ার!’ আমি তো আতঙ্কিত। কী হবে? বাবাকে বললাম। বাবা নির্বিকার। খালি বললেন, ‘বাদ দে তো। কত তো দেখলাম!’ কিন্তু আমার অশান্তির ঝড় যে কতটা গভীর, সেটা কী করে বোঝাই। জানতাম ছেলেটা সিরিয়াস। বাবা শিল্পী মানুষ, অন্য জগতের লোক। অত নীচে নামতে পারবেন না। বাবাকে বোঝাতে পারলাম না। আমি নিজে একটা প্ল্যান করলাম। বাবার একটা শেরওয়ানি আমি নিজে গায়ে চাপিয়ে স্টেজের পিছনের ওই অন্ধকার পথে হাঁটতে শুরু করলাম। যা ভেবেছি তা-ই। পাঁচ-ছ’জন আমায় জাপটে ধরল। কেউ চেপে ধরল মুখ, কেউ হাত। তার পর পাঁজাকোলা করে পাশের বাগানে নিয়ে গেল। দু-চারটে কিল-চড়ও পড়ল। ওই মার খেতে খেতেও দেখতে পেলাম একটা ছায়ামূর্তি কেমন নিশ্চিন্তে প্রেক্ষাগৃহের পিছনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই শুনতে পেলাম বাবার সেই বিখ্যাত গলায় চিৎকার, ‘আই অ্যাম হিয়ার।’ আমি নিশ্চিন্ত। অপারেশন সাকসেসফুল। তবে সবচেয়ে বড় ম্যাজিক দেখল সেই বদমায়েশ ছেলেগুলো। আরে, এটা তা হলে কে? আমায় ফেলে তারা দে দৌড়। বাবার এই ‘আই অ্যাম হিয়ার’ কথাটা আমার মনে যে কী সাংঘাতিক প্রশান্তি এনে দিয়েছিল, তার তুলনা হয় না। বাবার মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ কফিনবন্দি করে যখন কলকাতায় পাঠানোর তোড়জোড় চলছে, আমি ছটফট করছি। এক বার শুনতে চাই, ‘আই অ্যাম হিয়ার।’ বিশ্বাস করুন বা না করুন, আমার জীবনের দুর্বলতম মুহূর্তে যখন বাবাকে খুঁজি, আমি আমার মধ্যে শুনতে পাই ‘আই অ্যাম হিয়ার।’

আমার বাবা শুধু আমার বাবা ছিলেন না। অনেক বেশি জনগণের সম্পত্তি ছিলেন। দুটো গল্প বলি। বাবার একটা বেশ বড় মানিব্যাগ ছিল। বাবা বাজার যেতেন। আমি সঙ্গে যেতাম সেই ব্যাগ পাহারা দেওয়ার জন্য। যেখানে-সেখানে ব্যাগ ফেলে আসা বাবার একটা অভ্যেস ছিল। বড়বাজারে মনোহর দাস কাটরার গলিতে বাবা কাপড় কিনতে যেতেন। ঘিঞ্জি গলি। আমার তো দমবন্ধ হয়ে আসত। বাবা নির্বিকার। গদিতে পা ঝুলিয়ে কাপড় পছন্দ করতেন। এক বার সেখানে গেছি। দেখি এক ভদ্রলোক কিছুতেই কী কিনবেন, যেন বুঝতে পারছেন না। ভারী ছটফট করছেন। হঠাৎ আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘ইনি কি পি সি সরকার?’ বললাম, ‘হ্যাঁ’। ‘আর আপনি?’ বললাম ‘ছেলে’। তিনি যেন ভারী নিশ্চিন্ত হলেন। অবাক লাগল। তখন উনি খুব সংকোচের সঙ্গে আমার কানে কানে বললেন, ‘আমি এক জন পকেটমার। ওঁর ব্যাগটা সরিয়ে রাখুন। আশেপাশে আমার অন্য বন্ধুরা আছে। তারা তো ওঁকে চেনে না।’

আর এক বার নিউ মার্কেট থেকে ফিরে এসে বাবার কী চেঁচামেচি! তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। দেখি বাবার গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। (সেই বিখ্যাত রংচঙে অ্যাম্বাসাডর। পার্কিং লটে খুঁজতে সুবিধে হবে বলে, যেটার এমন রং)। কাচ ভাঙা। ভাঙা কাচের ভেতর থেকে হাত ঢুকিয়ে চোর বাবার রেখে যাওয়া একটা ব্যাগ চুরি করেছে। ব্যাগে টাকাপয়সা তো ছিলই। আরও অনেক অমূল্য কাগজপত্র ছিল। বাবা গুম। বললেন, ‘পুলিশে খবর দেব না। ওরা খুঁজে পাবে না। বড় ক্ষতি হল আমার।’ এমন সময় টেলিফোন। চোরের। বলল, ‘সরকারবাবু আমি আপনার ব্যাগ চুরি করেছি। জানতাম না, ওটা আপনার। বাড়ি এসে বুঝলাম। আমি বড্ড গরিব। টাকাটা খুব প্রয়োজন। ওটা নিয়েছি। কিন্তু বুঝলাম কাগজপত্রগুলো দরকারি। তাই ওগুলো-সমেত ব্যাগটা আপনার লেটারবক্সে ঢুকিয়ে এসেছি।’

বাবাকে বলেছিলাম, যতই ম্যাজিক করো, তোমার থেকে আমার কপাল ভাল। বাবা বললেন, ‘কেন?’ বললাম, ‘আমার বাবা পি সি সরকার, তোমার বাবা নন। ম্যাজিক আমার বাবার সম্পত্তি।’ আমি আজ যা হয়েছি, যেটুকু শিখেছি, সব বাবার জন্য। আমার পি সি সরকার (জুনিয়র) নামটাও বাবারই দেওয়া। তাই এটা পালটাইনি। আমি চিরকাল ‘জুনিয়র’ থাকতে চাই। কারণ ওই ‘জুনিয়র’-এর মধ্যেই এক জন ‘সিনিয়র’ বেঁচে আছেন। বাবাকে খুব মিস করি। তবে তাঁর উপস্থিতিটা সব সময় অনুভব করতে পারি। প্রতি দিন প্রার্থনা করি আর বলি, তুমি তো চলে যাওয়ার নও। কিন্তু তোমার তো কায়া নেই। তুমি আমার দেহটাকে ব্যবহার করতে পারো।

sorcar@pcsorcarjr.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE