Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

দুষ্টু দেবতা

দেবরাজ ইন্দ্রকে আমরা এক জন খুবই দুষ্টু দেবতা বলে চিনি, যিনি নারী ভোগ করার জন্য বহু নষ্টামি করেছেন। তিনি গৌতম মুনি সেজে মুনিপত্নী অহল্যার সঙ্গে সহবাস করেছেন। রাজা জনমেজয় সর্পযজ্ঞের পর যখন অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে শুরু করেন, তখন ইন্দ্র কৌশলে রানি বপুষ্টমার পর্যন্ত ধর্মনষ্ট করেছিলেন।

চিরশ্রী মজুমদার
শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

দেবরাজ ইন্দ্রকে আমরা এক জন খুবই দুষ্টু দেবতা বলে চিনি, যিনি নারী ভোগ করার জন্য বহু নষ্টামি করেছেন। তিনি গৌতম মুনি সেজে মুনিপত্নী অহল্যার সঙ্গে সহবাস করেছেন। রাজা জনমেজয় সর্পযজ্ঞের পর যখন অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে শুরু করেন, তখন ইন্দ্র কৌশলে রানি বপুষ্টমার পর্যন্ত ধর্মনষ্ট করেছিলেন। গ্রিক পুরাণেও কাছাকাছি এক ভ্রষ্ট দেবতার কথা পাওয়া যায়। তাঁর নাম জিউস। তিনিও দেবতাদের রাজা। সকলে তাঁকে ‘পিতা’ বলে ডাকে। ডাকবে না-ই বা কেন, এক বার নাকি এক গণৎকার হিসেব করে দেখেছিলেন, সেই অতি পুরনো দিনের গ্রিসদেশে যত্ত কচিকাঁচা জন্মাত, অন্তত তিরিশ শতাংশের নাজায়েজ পিতা মহামান্য জিউস!

জিউসের গোটা বংশের কাজকর্ম দেখলেই আঁতকে উঠতে হয়! জিউসের ঠাকুরদা ইউরেনাস ছিলেন দেবতা ও স্বর্গের প্রথম অধীশ্বর। তাঁর মা ও স্ত্রী ছিলেন গেইয়া। হ্যাঁ, তাঁরা একই মহিলা। গেইয়ার গর্ভে বারে বারে কিম্ভূত সব খোকাখুকু জন্মাচ্ছিল। প্রথম দিকে জন্মাল বারো জন টাইটান। তাদের চেহারা পাহাড়ের মতো। তার পর এল সাইক্লোপসরা। তাদের কপালের ঠিক মধ্যিখানে ড্যাবড্যাব করছে বিরাট বড় চোখ। এদের পরে জন্মাতে লাগল রাজ্যের দৈত্য-দানব। তিনশোটা করে হাত, পঞ্চাশটা মাথা। ইউরেনাস আর নিতে পারলেন না। এই সব অসুন্দর খোকাদের এক ধাক্কায় পাতালের চোরকুঠুরিতে ঠেলে ফেলে দিলেন। তখন টাইটান আর দৈত্যরা সবাই এক সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাষণ্ড ইউরেনাস বাবাকে মারার ছক করল। ক্রোনোস নামের টাইটান ছিল সবচেয়ে ছোট আর সবচেয়ে হিংস্র। বাবা যখন আরামে ঘুমোচ্ছিলেন, সে তাঁর অণ্ডকোষটি কেটে সমুদ্রে ফেলে দিল। তার পর স্বর্গরাজ্য দখল করল। কিন্তু ক্রোনোস জানতে পারল, তাকেও তার নিজের ছেলে মারবে। তাই ছেলে জন্মালেই সে তাকে খেয়ে নিত।

জিউস এই ক্রোনোসেরই ছেলে। জিউস জন্মাতে তাঁর মা ক্রোনোসকে একটা পাথর গিলিয়ে দিয়েছিলেন। তাই জিউস প্রাণে বেঁচে যান। পরে জিউস ক্রোনোসেরই কাস্তে দিয়ে তাকে টুকরো টুকরো করে কেটে পাতালে ছড়িয়ে দেন।

জিউসের প্রথম স্ত্রী ছিলেন মেটিস। তাঁর গর্ভে জিউসের সন্তান আসতেই জানা গেল, জিউসেরও রাজদণ্ড কেড়ে নেবে তাঁর নিজের আত্মজ। এ কথা শুনে জিউস তাঁর স্ত্রীকে টপ করে গিলে ফেললেন। কিন্তু বুঝতে পারলেন, স্ত্রীকে হজম করা গেলেও, সন্তানটি তাঁর নিজের মধ্যেই ক্রমশ বেড়ে চলেছে। জিউসের মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হল। তাঁর কথায় হেফেস্টাস ঠাকুর তাঁর মাথা ফাটিয়ে দিতেই, চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এলেন এথেনা। দৈববাণী হল, এই মেয়েটি বুদ্ধি ও শক্তিতে বাবার থেকে কোনও অংশে কম নয়।

এই এথেনা হলেন জ্ঞান, সাহস, সভ্যতা, আইন, ন্যায় ও বিচারের দেবী। এক কথায় বললে, দেবমহলে বিদ্বজ্জন। কিন্তু তাঁর মনের ভিতর? থিকথিকে রাগ আর হিংসে। অ্যারাকনি নামে একটা মানুষের মেয়ে খুব ভাল সেলাই করত। সে তার সেলাই করা কাপড়ে দেবতাদের গুচ্ছের অপকর্মের কথা আঁকত। দেবী তাতে খেপে গেলেন, তার ওপরে অ্যারাকনির অত প্রতিভা দেখে তো হিংসেয় মটমট করছেনই। অ্যারাকনিকে এক ঘেয়ো মাকড়সা বানিয়ে দিলেন। বললেন, যা বেটি, তোর মুখ দিয়ে এ বার সারা ক্ষণ নাল ঝরবে। তাই দিয়ে লোকের তেলচিটে ঘরবাড়িতে ঝুল-শিল্প বানাগে যা।

জিউসের সুযোগ্য ভাই, সমুদ্রঠাকুর পসেইডন এক বার এথেনার এক মন্দিরে ঢুকে জোর করে এক পুরুত-মেয়ের সর্বনাশ করে গেলেন। এথেনা কোথায় পসেইডনের ওপর রাগ করবেন, তা না, উলটে টুঁটি চেপে ধরলেন সেই অভাগিনী পুরোহিতনির। ‘ও এল তো এল, তুই কেন বাধা দিসনি? তোর দোষ!’ এই বলে, খাপ পঞ্চায়েত সেজে, মেয়েটাকে ডাইনি বানিয়ে পাতালের অতলে ঠেলে দিলেন। তার সমস্ত চুল হয়ে গেল এক একটা লকলকে হিসহিসে বিষধর সাপ। আর বন্দোবস্ত করে দিলেন, মেয়েটা যার দিকেই তাকাবে, সে পাথর হয়ে যাবে। এই রাক্ষসীই শতবদনামকুড়ুনি মেডুসা। পরে আবার পার্সিয়াস বলে এক আধাদেবতাকে ডেকে, মেডুসার মুন্ডু কেটে নিয়ে আসার কায়দাটা দেবী এথেনা নিজেই শিখিয়ে দিলেন।

গ্রিসের যুদ্ধবিগ্রহ আর ঝগড়াঝাঁটির দেবতা ছিলেন এইরিস। টকটকে লাল রঙের দেখতে, গায়ে রক্ত লেগে, চোখ দুটো সব সময় ভাঁটার মতো জ্বলছে। এইরিসের দুটো হাড়বজ্জাত ড্রাগন-ছেলে। রাজার ছেলে ক্যাডমাস, এক বার তার প্রজাদের জন্য জল আনতে গেল। গিয়ে দেখে, জল পাহারা দিচ্ছে একটা ড্রাগন। কেউ ধারেকাছে গেলেই সে তাকে আগুনের হলকায় পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে, বা ধড় থেকে মাথা ছিঁড়ে নিচ্ছে। ক্যাডমাস ছিলেন দুর্দান্ত বীর। তিনি ড্রাগনটাকে কচুকাটা করে ফেললেন। ছেলের মরার খবর শুনে এইরিস দাপাদাপি শুরু করলেন। তখন দেবতার গ্রাস থেকে বাঁচতে ক্যাডমাস বিয়ে করে নিলেন এইরিসের মেয়ে হারমোনিয়াকে। ভাবলেন, জামাইকে তো আর শ্বশুর কিছু করবেন না! কিন্তু এইরিস অন্য ধাতুতে গড়া। তাঁর অভিশাপে ক্যাডমাসের মেয়ে আত্মহত্যা করল, জামাই পাগল হয়ে গিয়ে নিজের কাচ্চাবাচ্চাকে কেটে ফেলল। আর এক মেয়ের ওপর নজর পড়ল দেবরাজ জিউসের। ক্যাডমাস শেষ বয়সে রাজ্য হারিয়ে বনে বনে ঘুরতেন। এক দিন আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে ফেললেন, হায় রে, ঠান্ডা রক্তের সরীসৃপগুলোর জন্যও দেবতার এত দরদ, আর আমাদের জন্য এতটুকু দয়ামায়া নেই। মানুষের চেয়ে সাপ হয়ে জন্মালেই ভাল হত ভগবান! যেই না বলা, সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটা বিকট বুড়ো অন্ধ দুর্গন্ধযুক্ত সাপ হয়ে পড়ে রইলেন পাহাড়ের ভাঁজে। তাঁর বউ হারমোনিয়া কাঁদতে কাঁদতে সব কাজের কাজী আপন বাপ এইরিসের পায়ে গিয়ে পড়ল। হয় জামাইকে মাপ করে দাও, নয়তো আমাকেও সাপ বানিয়ে দাও। তা, এইরিস যে দ্বিতীয়টিই করবেন সেটাও কি বলে দিতে হবে?

উত্তর ইউরোপের নর্স পুরাণে পাই বিশৃঙ্খলার দেবতা লোকি-র নাম। তিনি একটু নিচু স্তরের দেবতা হলেও, প্রভূত ক্ষমতা ছিল তাঁর। কখনও মাছি সেজে দেবী ফ্রিয়ার নেকলেস চুরি করে যুদ্ধ বাধিয়ে দিচ্ছেন, কখনও দেবতাদের নামে মিথ্যা কথা রটাচ্ছেন। এক বার এক স্বর্গীয় ভোজসভায় গিয়ে তিনি প্রত্যেক দেবতাকে সামনাসামনি অপমান করতে শুরু করলেন। সকলের কাছে গিয়ে হাসছেন আর তাঁর ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা বলছেন রসিয়ে রসিয়ে। দেবতারা খেপে লাল। সবাই মিলে লোকিকে তাড়া করলেন। শেষে একটা জলপ্রপাতের কাছে এসে, লোকি দেখলেন, পালাবার পথ নেই। তিনি একটা স্যামন মাছ হয়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অমনি দেবতারা একটা জাল এনে তাঁকে ধরে একটা গুহায় পুরে দিলেন।

তাঁর নিজেরই ছেলের অন্ত্র দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে লোকিকে একটা ধারালো বড় পাথরের সঙ্গে বাঁধা হল। তার পর একটা বিষাক্ত সাপ এনে লোকির চোখ-মুখ বেঁধে দেওয়া হল। এই সময়, লোকির স্ত্রী ছুটে এসে একটা বড় পাত্র ধরলেন সাপটার বিষদাঁতের নীচে। শিগগিরি বিষে ভরে গেল পাত্রটা। লোকির বউ সেটা ফেলে আসতে গেলেন। কিন্তু বেকায়দায় বিষ উপচে গিয়ে পড়ল লোকির সারা শরীরে। বজ্জাতির দেবতা এমনধারা ছটফটিয়ে উঠলেন যে, মাটি দুলে উঠল। এ ভাবেই সৃষ্টি হল ভূমিকম্প।

মেসোপটেমীয় সভ্যতার ব্যাবিলনে নরকের প্রভু বলে পূজা পেতেন নের্গাল দেবতা। নরকের রানিকে মিষ্টি কথায় বশ করে, তাঁকে বিয়ে করে, নরকের রাজা হয়ে, তিনি নিজের নতুন নাম নিলেন ‘এরা’। নতুন বিয়ের পর কিছুটা নিষ্কর্মা হয়ে বিলাসে-ব্যসনে ডুবে গিয়েছিলেন। তাঁকে উত্তেজিত করে তুলল সিবিত্তি বা ‘সেই সাত জন’। তারা পাতাললোকের দেবসেনা। মাথায় সারা দিন ভনভন করে রক্তের গন্ধ। এরা’র কাছে দরবার করল, ‘প্রভু, এত শান্তিতে আমরা জেরবার হয়ে পড়ছি। হাতে-পায়ে খিল ধরছে। কাটার মতো গলা না পেয়ে অস্ত্রগুলোয় মরচে পড়ছে। মানুষ মেরে আমাদের বাঁচান। পৃথিবী জুড়ে আপনাকে লোকে ভুলতে বসেছে। আপনার ত্রাসের ক’টা উদাহরণ দেখান।’ শুনে সিংহনাদ করে উঠে দাঁড়ালেন এরা। বললেন, ‘পৃথিবীতে সকলের সুখ, শান্তি, ঐশ্বর্য, ভালবাসা আর আয়ু উপচে উপচে পড়ছে? এ হতে পারে না। এক্ষুনি একটা বড় ঝাঁকুনি দেওয়া দরকার।’ সে সময়ে মেসোপটেমিয়ার রক্ষক দেবতা ছিলেন মারডুক। এরা মারডুক’কে গিয়ে বোঝালেন, মর্ত তো প্রায় স্বর্গের সমান হয়ে যাচ্ছে! তাঁর চালাক চালাক কথায় মারডুকও মজলেন। দেবতাদের মন্দির রক্ষার ভার দিলেন এরা’র হাতে।

শুরুর দিকে এরা কিচ্ছুটি করলেন না। মানুষেরা আরও ফুলেফেঁপে উঠতে লাগল। কোথাও কোনও কাজ নেই দেখে ভগবানরাও আরামে গা ভাসালেন। মানুষেরা শুরু করল যথেচ্ছাচার। এই বার এরা তাঁর আসল রূপটি দেখালেন। মৃত্যুর দূত পাঠিয়ে গ্রাম আর শহরকে মশান বানিয়ে দিতে লাগলেন। যে দিকে তাকাও কাক-চিল আর ধিকিধিকি আগুন। ছেলেদের মনে বাবার প্রতি, মায়ের মনে মেয়ের প্রতি ঘেন্না। খোঁড়া লোকে এখানে সুস্থ লোকের থেকে জোরে দৌড়োয়। বুড়ো মানুষে শয়ে শয়ে যুবকের মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যায়। মানুষ খিদের জ্বালায় মানুষের মাংস খায়। বহু বছর ধরে এরা’র বর্বরতার রাজত্ব চলার পর, তাঁকে আলাদা মন্দির দেওয়া হল। সেখানে সিবিত্তিদের সাত জনকে নিয়ে সরে এলেন তিনি। ধ্বংস থামল।

মিশরের এক দেবতা: সেঠ। মাথাটা গাধা আর শেয়ালের মিশেল, তাতে মোটা দুটো শিং, লেজ যেন ছোরার ছুঁচলো ফলা, শরীরটা সাজোয়ান এক মনুষ্যের। সেঠের আপন ভাই-বোন ওসিরিস আর আইসিসের মধ্যে বিয়ে হল। তাদের শাসনকালে সভ্যতা এল মিশরে। ওসিরিসের এত সম্মান আর প্রতিপত্তি সেঠের ভাল লাগল না। তিনি ওসিরিসকে মেরে তার দেহ কুচিয়ে ফেলে এলেন। সেই মড়া সেলাই করে, তার সন্তান গর্ভে ধরলেন রানি আইসিস। তার পর ওসিরিস আইসিসে মিলে হেসেখেলে রত্নরথে চড়ে স্বর্গে চলে গেলেন। পৃথিবীতে থেকে গেল তাঁদের ছেলে হোরাস। তার সঙ্গে মিশরের অধিকার নিয়ে জোর সংঘাত লাগল সেঠের। কে জিতবে? কে হারবে? অনেক যুদ্ধ-অশান্তি আর রক্তক্ষয়ের পর, সেঠ বাঁকা রাস্তা নিলেন। হোরাসকে নিজের রূপের মায়ায় ভোলালেন। তার পর যখন দুজনের মিলন হয় হয়, এমন সময় হোরাস সেঠ-দেবতার দুই পায়ের মধ্যিখানে নিজের হাত পেতে তাঁর বীর্য নিয়ে ফেলে দিলেন নদীতে। তার পরে আর এক দুর্বল মুহূর্ত আসতেই লেটুস পাতায় নিজের বীর্য ভরে খাইয়ে দিলেন সেঠকে। তার ক’দিন পরেই সেঠ হাজির দেবতাদের দরবারে। বললেন, হোরাসকে আমি অধিকার করেছি, মিশরের সিংহাসনে এখন আমারই বসার কথা। দেবতারা সেঠের বীর্যকে ডাক দিলেন। সে নদীর ভেতর থেকে সাড়া দিল। এমন সময় হাসতে হাসতে দরবারে প্রবেশ করলেন হোরাস। তিনি বললেন, কই, এ বার আমার বীর্যের ক্ষমতার পরীক্ষা নিন। তিনি ডাকতেই তাঁর বীর্য গমগম করে উঠল সেঠের ভেতরে। এর পরেও অবশ্য সেঠ হার মানতে রাজি হননি, কিন্তু সে অন্য গল্প।

তখন সেঠ হার মানলেও, পরে কিছু ফারাও তাঁকে কুলদেবতা ও পূর্বপুরুষের মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাদেরই এক জন দিব্যি দেশ শাসন করছিলেন, কিন্তু তাঁর উপপত্নীর সঙ্গে প্রেম হয়ে গেল রাজপুরোহিতের! সেই পুরোহিত আর মেয়েটি মিলে, খুন করল এই শাসককে। ও মা, তার পর সেই পুরোহিত— ইমহোটেপ— কোথায় সারা মিশর জুড়ে চিরকাল নিন্দিত হবেন, তা না, তাঁকে পুজো করা হতে লাগল শান্তির দেবতা হিসেবে! তার মানে দেবতা শুধু বদ হন না, বদ মানুুষকেও দেবতা করা হয়!

আমাজনের বৃষ্টি ও উর্বরতার দেবতা ত্বালোক। তাঁর কাছে বলি হিসাবে জলে ডুবিয়ে মারতে হত শিশুদের। আমাদের পুরাণের মাতৃকাদের সঙ্গে মিল আছে। মাতৃকারা কিন্তু জন্মেছিল লোকের মঙ্গলসাধনের জন্য। অন্ধক নামের দৈত্যদের সঙ্গে শিবঠাকুরের ঘোর যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে অন্ধকের শরীরে মহেশ্বর তাঁর ত্রিশূল বিঁধোলে, গলগল করে বেরচ্ছিল রক্ত। কিন্তু প্রতিটি রক্তকণা থেকে হাজার জন করে অসুর জন্মে তেড়ে আসতে লাগল। এই ব্যাপার দেখে দেবাদিদেব মাতৃকাদের সৃষ্টি করেন। তারা অন্ধকাসুরের গা থেকে রক্ত বার হওয়া মাত্র তা চেটে নিচ্ছিল। আর নতুন অসুর জন্মানোমাত্র তাকে চিবিয়ে ফেলছিল। এ ভাবে অন্ধকাসুর যখন রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে মরে পড়ে রইল, শিব সেখান থেকে চলে গেলেন। কিন্তু মাতৃকাদের তো পেট ভরেনি। জ্যান্ত খাবার খাওয়ার অভ্যাসও যায়নি। সেই থেকে তারা নাকি সদ্যোজাত শিশু ও ভ্রূণ খুঁটে খেতে ভালবাসে। হয়তো ওদেরই লোকায়ত অপভ্রংশ বাদাবনের ওলা বিবি, যক্ষ্মা বিবি, কলেরা বিবি, শীতল ষষ্ঠীরা। নামেই আতঙ্ক। হয় ওলা-বুড়িকে ভাল মতো ভুজ্যি দাও, নইলেই নোংরার পুঁটলি নিয়ে ভর সন্ধ্যাবেলা গ্রামে ঢুকে পুকুরপাড়ে কাপড় কাচতে শুরু করবে। যত দিন সে কাপড় কাচছে, ছেলেমেয়েগুলো খেলতে ভুলবে। মায়েরা তাদের নিভে আসা মুখের দিকে তাকিয়ে বুক চাপড়াবে, ‘একেও কি নেবে গো মা?’ তার পর গ্রাম উজাড় হলে এক দিন ঠিক ঝুঝকিবেলায় দেখা যাবে, একটা সুন্দর মতো মেয়ে শৌখিন কাপড়চোপড় পরে পুব-দখিন কোনা বরাবর মাঠ পাড়ি দিচ্ছে। এই সেই বুড়ি। নিজের আবর্জনা মানুষের চিতায় জ্বালিয়ে, তাদের আয়ু খেয়ে খেয়ে এমন ডাগর হয়েছে।

মনসা আর মেডুসাকে পাশাপাশি রাখলেই কত অবাক হতে হয়। এক জনের চুলে সাপ কিলবিল করছে, অন্য জনের মাথার ওপর ছাতা ধরে আছে সাতটি গোখরো সাপের ফণা। দুজনেই পূর্ব জীবনে বড় অসুখী। মেডুসাকে যেমন দেবী এথেনা গালমন্দ করেছিলেন, তেমনি মনসাকে উঠতে বসতে কথা শোনাতেন স্বয়ং দেবী চণ্ডী! মনসা শিবের মন থেকে জন্মেছেন, পার্বতীর সৎমেয়ে। অনেকেই ফিসফাস করেন, কুন্তীর মন্ত্রবলে কানীন দেব-পুত্র লাভ করার মতো রেখেঢেকে বলা কথা এ সব। সে কারণেই কিনা জানি না, মনসাকে মেনে নিতে পারতেন না এই জগজ্জননী। বিয়ের রাতে মেয়েটি শখ করে সাপের গয়না পরেছিল। দেবীমা তাই জন্য তার ঘরে কুনোব্যাং ঢুকিয়ে দেন। সারা ঘরে সাপরা প্রাণভয়ে ছুটে বেড়াল আর মেয়ের ফুলশয্যার রাতটা গেল কেঁদেককিয়ে। মেয়েটার একটা চোখ পুড়িয়ে কানা করে দিয়েছিলেন মা। সেই থেকে নাকি মনসার স্বভাব এমন তেলেবেগুনে।

এমন কত কূট প্রশ্ন রয়ে যায় রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ-লোককাব্যেও। টুকরো টুকরো অপরাধ করেই গেছেন দেবতারা। ছোট্ট গণেশ তো শুধু মায়ের স্নান করার সময় বাবাকে বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছিল না। তাই বলে শিব-বিষ্ণুরা মিলে তাঁর গলাই কেটে ফেললেন একেবারে? না-ই বা চিনতেন নিজের ছেলে বলে। এ যে একটা বাচ্চা ছেলে সে দেখে তো বুঝেছিলেন নিয্যস! দেবতারা হাড় দিয়ে অস্তর বানাবেন বলে দধীচি মুনি প্রাণত্যাগ করলেন। দেবতারা তাঁর হাড় নিয়ে কেটে পড়ার তাল করতে লাগলেন। কারণ, মুনি নির্বিরোধী ভালমানুষ ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর স্ত্রী প্রাতিথেয়ী ছিলেন ভারী তেজস্বিনী মহিলা। তিনি তখন ঘরে ছিলেন না, এলে না জানি কী কাণ্ড হবে— ভেবে তাড়াতাড়ি কাজ হাসিল করতে দেবতারা গরুর দল ডেকে আনলেন। তারা এসে চটপট মুনির শরীরটি গুঁতিয়ে ফালা ফালা করে দিল। সেই হাড় নিয়ে দেবতারা চম্পট দিলেন। প্রাতিথেয়ী আশ্রমে ফিরে দেখলেন মহর্ষি নেই। তাঁর লোম, চামড়া ও মাংস ছড়িয়ে আছে ঘরে। তিনি ওই দেহাবশেষটুকু নিয়ে আগুন ঝাঁপ দিলেন। তার আগে নিজের শিশুপুত্রটিকে গাছপালার কাছে রেখে বলে গেলেন, এই অভাগা অনাথটিকে দয়া করে দেখো। পিপুল গাছেরা যত্ন করে তাকে বড় করে তুলল, তাই তার নাম হল পিপ্পলাদ। একটু বড় হতেই সে তার মা-বাবাকে খুঁজে বেড়াতে লাগল। যখন অন্য ছোট ছেলেরা বাবার কাছে শাস্ত্র পড়ছে, মায়ের কোলে বসে দুধের সরটুকু খাচ্ছে, তখন সে প্রকৃতি-মায়ের কাছে সব ঘটনা শুনছে ও রাগে কাঁপছে। সে ঠিক করল, তার দেবতুল্য মাতাপিতাকে যারা হত্যা করেছে, তাদের সে মারবে। ঘোর তপস্যা শুরু করল। তখন নিজেদের দোষ চাপা দিতে দেবতারা অনেক বর দেওয়ার লোভ দেখালেন, শেষে শিবঠাকুর এসে নানান উপদেশ দিয়ে তাকে শান্ত করলেন। সে নয় শান্ত হল, ক্ষমা করে দিল দেবতাদের। কিন্তু দেবতারা এই অবস্থায় পড়লে, ক্ষমা করতে জানতেন কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE