Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

কচ্ছপের পথ

মন্থর গতি নিয়েও সে চিনা খরগোশকে টেক্কা দিতে পারে উদ্ভাবনী শক্তিতে। ধনতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার পথে নেমেও ওই একটি জায়গায় চিন ডাহা ফেল। অ্যাপল ফোনের আদলে বাজারে সে এনেছে হরেক ফোন। কিন্তু বানাতে পারেনি নতুন কোনও অ্যাপল। মন্থর গতি নিয়েও সে চিনা খরগোশকে টেক্কা দিতে পারে উদ্ভাবনী শক্তিতে। ধনতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার পথে নেমেও ওই একটি জায়গায় চিন ডাহা ফেল। অ্যাপল ফোনের আদলে বাজারে সে এনেছে হরেক ফোন। কিন্তু বানাতে পারেনি নতুন কোনও অ্যাপল।

অতীতচিত্র: চিনের বিখ্যাত ‘গণতন্ত্র দেওয়াল’, যার উপর পোস্টারে চিনা জনগণ তাঁদের রাজনৈতিক মতামত জানাতেন। ছবি: গেটি ইমেজেস।

অতীতচিত্র: চিনের বিখ্যাত ‘গণতন্ত্র দেওয়াল’, যার উপর পোস্টারে চিনা জনগণ তাঁদের রাজনৈতিক মতামত জানাতেন। ছবি: গেটি ইমেজেস।

অভীক সরকার
শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

প্রশ্নটা করেছিলেন আমার এক বন্ধু। ১৯৭২। নিক্সনের ঐতিহাসিক চিন সফর। আমার বন্ধু হেনরি কিসিঞ্জার তখন সেক্রেটারি অব স্টেট অর্থাৎ বিদেশমন্ত্রী। নৈশভোজ এবং চিনা মদ ‘মাওতাই’ ঠোঁটে ছুঁইয়ে কিসিঞ্জার ঝাঁ করে ঝাও এন লাইকে প্রশ্ন করলেন, ‘‘আচ্ছা বলুন তো, ফরাসি বিপ্লব সম্পর্কে আপনাদের ধারণাটা কী?’’ ফরাসি বিপ্লব তখন প্রায় দু’শো বছর আগের ঘটনা। চিনা প্রধানমন্ত্রী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তার পর মাওতাই ঠোঁটে ঠেকিয়ে বললেন, ‘‘বলার সময় এখনও হয়নি।’’

পরবর্তী কালে অনেক জল্পনা হয়েছে, ঝাও এন লাই আসলে কী বলেছিলেন। কিসিঞ্জারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাঁর জবাব ছিল, ‘‘ঠিক খেয়াল করতে পারছি না, কী শব্দ ব্যবহৃত হয়েছিল।’’

চিনারা ইতিহাস-বিস্মৃত জাত নয়। কথায় কথায় তাঁরা প্রাচীন ইতিহাসের তুলনা দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। যখন তিব্বতের রাজধানী লাসাতে গিয়েছিলাম, ওখানকার চিনা কর্তারা আমাকে ৮০০ বছরের পুরনো ইতিহাস শুনিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, কেন তিব্বত চিনের অন্তর্গত। ওঁদের দাবি, ৮০০ বছর আগে চিনে যখন ইউয়ান রাজত্ব ছিল, তখন নাকি তিব্বতিরা চিনাদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। স্বভাবতই তিব্বতিরা এই ইতিহাস মানতে রাজি নন।

সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় বেজিংয়ে ‘গণতন্ত্র-দেওয়াল’ নামে এক অভিনব প্রাচীর চিহ্নিত হয়। গিয়ে দেখি, সেটা এক সাধারণ দেওয়াল। সেই দেওয়ালে পোস্টার টাঙিয়ে অবাধে চিনা জনগণ নিজেদের রাজনৈতিক মতামত ব্যক্ত করছে। কোনও কমিউনিস্ট দেশে এর আগে বা পরে এমন বাক্‌-স্বাধীনতা দেখা যায়নি। এমনকী পশ্চিমবঙ্গেও নয়। ভাবা যায়, এসপ্ল্যানেড ইস্টে কোনও দেওয়ালে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে যার যা খুশি লিখে আসছে! বা সিপিএম আমলে অজন্তা বিশ্বাসের নামে!

চিনে কিন্তু রাজনীতির এক মাহেন্দ্রক্ষণে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অবসান হয়েছে। কিন্তু দেং জিয়াও পিং-রা ক্ষমতায় এলেও তাঁদের অধিকার সম্পূর্ণভাবে কায়েম করেননি। এখানেও দেখলাম, ইতিহাসের সাহায্য নিয়েই বর্তমান রাজনীতি সম্পর্কে মতামত দেওয়া হচ্ছে। ঝাও এন লাই-এর সমালোচনা করতে গিয়ে টেনে আনা হচ্ছে পঞ্চম শতাব্দীর কোনও অখ্যাত উজিরকে।

আমার ধারণা হয়েছিল, চিনারা ইতিহাস-প্রিয় জাতি। সুখে-দুঃখে, বর্ষায়-শীতে, অতীতের রোমন্থনই চিনাদের পাথেয়। চিনারা ইউরোপীয় ইতিহাস খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন। এবং তাঁদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, শিল্প-বিপ্লবের আঁতুড় কেন আমেরিকার কাছে হেরে গেল? আমেরিকার জলে বাতাসে কী জাদু আছে, যার ফলে একটা উঠতি সভ্যতা— যেটা প্রাচীনরা চ্যাংড়া সভ্যতা বলেই মনে করেন— বিশ্বের অগ্রগণ্য জাতি হয়ে উঠল? চিনাদের মনে কোনও সংশয় নেই যে মানব-ইতিহাসে সমৃদ্ধতম সভ্যতা হল মার্কিন সভ্যতা।

খুঁজতে গিয়ে উত্তরও মিলে গেল। পণ্ডিতেরা বলেন, শিল্প-বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে সামন্ততন্ত্রের অবসান হয়। টিউবারকিউলোসিস যেমন অ্যান্টিবায়োটিকের আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচাতে সক্ষম হয়, সামন্ততন্ত্রও তেমনি শিল্প-বিপ্লবের আক্রমণ থেকে বেরিয়ে এসেছে। বটগাছ যেভাবে প্রাচীরের আনাচে-ফোকরে সুবিধা পেলেই নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করে, সামন্ততন্ত্রও তেমনি মরেও মরে না।

‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’-এর সময়কার পোস্টার। সামনে সৈনিক, পিছনে দেশের মানুষ, সবার উপরে মাং জে দং।

আমেরিকায় কিন্তু কোনও সামন্ততন্ত্র নেই। এটা সম্পূর্ণ নবীন সভ্যতা। একেবারে ভ্যাকুয়াম থেকে নিজেদের সৃষ্টি করেছে। আমেরিকাতে তাই বংশানুক্রমিক অধিকার নেই। নেই রাহুল গাঁধী বা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়দের কোনও স্থান। ফোর্ড মোটরস-এ ফোর্ড পরিবারের কারও বংশগত অধিকার নেই। তাঁরা ওই সংস্থায় চাকরি করতে পারেন, কিন্তু উঠে আসতে হবে নিজের যোগ্যতায়। আমেরিকায় কোনও মামার জোর চলে না। দীর্ঘ কমিউনিস্ট শাসনে চিনের দু’টো লাভ হয়েছিল। প্রধানত অমর্ত্য সেন যাকে বলেছেন সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট, সেখানে বিশাল লগ্নি, অর্থাৎ শিক্ষা, স্বাস্থ্য এই ধরনের ক্ষেত্রে। দ্বিতীয়ত, কমিউনিস্ট শাসনে স্বাভাবিক ভাবে সামন্ততন্ত্রের অবসান।

মাও-এর কিন্তু ধারণা হল, ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণদের প্রভাব সম্পূর্ণ বিলোপ হয়নি। তাঁর আরও বড় সংশয়, কমিউনিস্ট পার্টি নিজেই এক ধরনের সুবিধাবাদী শ্রেণি তৈরি করেছে কি?

কিছুদিন আগে পূর্ব ইউরোপীয় এক বাম পণ্ডিত একটি তত্ত্ব খাড়া করে বলেন যে, কমিউনিস্ট পার্টি এক শ্রেণির নয়া ব্রাহ্মণ্যবাদ সৃষ্টি করেছে। মাও-এর সাংস্কৃতিক বিপ্লব এক অর্থে এই সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে। সদর দুর্গ গুঁড়িয়ে দেওয়ার ডাক দিয়ে মাও এক নতুন জাতিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। সেটা ঠিক কি ভুল, ভিন্ন তর্ক। যা হল, তাতে সামন্তবাদের রেশ প্রায় সম্পূর্ণভাবে মুছে গেল।

‘গেম অব থ্রোনস’ নামক বিশাল জনপ্রিয় এক মার্কিন টিভি সিরিয়ালে নায়িকা এক আশ্রমে স্থান নেন, যেখানে আবাসিকদের নিজেদের নামটিও ভুলে যেতে হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা, আমেরিকায় তাঁর এক চিনা পিএইচডি ছাত্র, খুব মেধাবী। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় তাঁকে বাধ্য করা হয় লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে দূর গ্রামে গিয়ে ইট-ভাঙা জাতীয় সশ্রম কাজ করতে। পার্থকে তাঁর ছাত্র বলেন, তখন খুব রেগে গিয়েছিলাম। মনটা তিক্ত হয়ে গিয়েছিল আমার। এত বছর পরে সুদূর আমেরিকায় এক জ্ঞান-মন্দিরে এখন তাঁর উপলব্ধি, ওই অভিজ্ঞতাটা হয়তো দরকার ছিল।

দেং-রা যখন শিল্প বিপ্লব আরম্ভ করলেন, তখন চিনে সামন্ততন্ত্র প্রায় লুপ্ত। যে কারণে আমেরিকার চমকপ্রদ অভ্যুদয় হয়েছে সেই কারণটি কিন্তু চিনেও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্য এসে গেল। ইউরোপ বা ভারতবর্ষ সংস্কার-মুক্ত নয়। আমেরিকা এবং চিন প্রায় অনেকটাই সংস্কারমুক্ত। আমেরিকার কাছ থেকে চিনারা আর একটা জিনিস শিখল। প্রতিযোগিতার সার্বভৌমত্ব। আমেরিকা প্রতিযোগিতা আনতে এ টি অ্যান্ড টি-র মতো নাম করা সংস্থাকেও ভেঙে দেয়। বলে একই কোম্পানি লোকাল এবং এসটিডি— দুই পরিষেবা দিতে পারবে না। বেছে নাও কোনটা করবে।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে চিনও প্রতিযোগিতার সম্প্রসারণ করেছে। যেমন বিমান সংস্থায়। ভারতবর্ষে কচ্ছপরা কচ্ছপই থেকে যাবে। তার গতি মন্থর। জেতা অসম্ভব। সামন্ততন্ত্র এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার অভাব জগদ্দলের মতো ভারতকে আটকে রাখবে। সামন্ততন্ত্রের পারিবারিক অভিমান আছে বলেই ইনফোসিস এবং টাটার মতো সংস্থায় উত্তরাধিকার নিয়ে সমস্যা হয়।

চিনের সমস্যা অন্য। সত্তরের দশকের শেষ দিকে দেং জিয়াও পিং চার প্রগতি নামে অর্থনীতির নতুন দিশা ঘোষণা করেন। গণতন্ত্র-দেওয়ালে পোস্টার পড়ে, পঞ্চম প্রগতি চাই। সেটা গণতন্ত্র। কিছুদিনের মধ্যেই এই পোস্টারের লেখককে পুলিশ খুঁজে বের করে এবং গ্রেফতার করে। চল্লিশ বছর হয়ে গেল। সেই ব্যক্তির আর কোনও হদিশ নেই। মাত্র ক’দিন আগে এক জন নোবেলজয়ীকে জেল থেকে ছাড়া হয় শুধুমাত্র এই কারণে যে তাঁর ক্যানসার এত দূর ছড়িয়ে পড়েছে, বাঁচার সম্ভাবনা নেই। স্বভাবতই, সরকার চায়নি, তিনি জেলে মারা যান। দেশের বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না, কেমোথেরাপি হয়নি, বিনা চিকিৎসায় তিন দিন আগে মারা গিয়েছেন নোবেলজয়ী লিউ শিয়াওবো।

এখনও অবধি চিনাদের অর্থনীতিতে উদ্ভাবন কম। যেমন, অ্যাপল ফোনের অনুকরণে নানা রকম ফোন তৈরি করেছে তারা। কলকাতার বাজারে তার বিশাল বিক্রি। ফোনগুলো খারাপ তা হয়তো নয়, কিন্তু অ্যাপল না থাকলে ওই ফোন বেরোতো কি? অর্থনীতির অমোঘ নিয়মে চিনেও ব্যবসার খরচ বাড়বে। সস্তায় কিস্তিমাতের সুযোগ তখন হারিয়ে যাবে। যেমন হয়েছে জাপানে।

অগ্রগতি রাখতে হলে প্রয়োজন উদ্ভাবন। যেটা আমেরিকার প্রাণশক্তি। অর্থনীতির টেবিলের অন্তত তিনটে ‘পা’ লাগবে। প্রতিযোগিতা, জমিদারি মনোভাবের অবসান এবং উদ্ভাবন। প্রথম দু’টিতে আমেরিকার অনুকরণে চিন সার্থক। দশে দশ না হলেও উঁচু নম্বর পাবে। উদ্ভাবনে ফেল। সমাজে যথার্থ স্বাধীনতা না থাকলে উদ্ভাবন কি সম্ভব?

খরগোশকে টেক্কা মারার এই একটা উপায় এখনও কচ্ছপের সামনে খোলা আছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE