Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

‘আমার যা সম্পদ তা হারাতে চাই না’

চকলেটরঙা স্কার্ট পরা সুন্দরী কিশোরীটিকে দেখেই সমস্ত শরীর ঝিমঝিম। দশমীর সন্ধেয় করলা নদীতে হত ঠাকুর বিসর্জন। মনটা ভারী হয়ে উঠত। চকলেটরঙা স্কার্ট পরা সুন্দরী কিশোরীটিকে দেখেই সমস্ত শরীর ঝিমঝিম। দশমীর সন্ধেয় করলা নদীতে হত ঠাকুর বিসর্জন। মনটা ভারী হয়ে উঠত।

ছবি: শুভম দে সরকার

ছবি: শুভম দে সরকার

সমরেশ মজুমদার
শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

মাঝরাত পর্যন্ত চোখে ঘুম নেই মাদলের আওয়াজে। মহালয়ার সন্ধে থেকে মাঝরাত পর্যন্ত কুলি লাইনে যারা মাদল বাজায়, তাদের আমি চোখে দেখিনি। চার বছরের এই আমি ভোর হতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বুঝি, পৃথিবীটা কী নরম হয়ে রয়েছে। হাতমুখ ধুয়ে পোশাক বদলে বাবার আলতো বারণ না শুনে বাইরে পা দিয়ে দেখি, চার-পাঁচ জন আমাদের বাড়ির দিকে উদ্‌গ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে। আমাকে দেখেই সেই সমবয়সিরা হাইওয়ের এক পাশ দিয়ে দৌড় শুরু করে। হাইওয়ের দু’পাশে শাল-সেগুন-ইউক্যালিপটাস গাছে কয়েকশো ছোট-বড় পাখি তারস্বরে ডেকে চলেছে অন্য দিনের চেয়ে জোরালো গলায়। যেন ওরাও জেনে গিয়েছে আজ ষষ্ঠী।

তখন আমাদের চা-বাগানে দুর্গাপুজো শুরু হয়নি। পুজো হত আধ মাইল দূরের গয়েরকাটা বাজারের পাঠশালার বারান্দায়। আমরা যখন পৌঁছলাম তখন মণ্ডপে কিছু মানুষ এসে গেছেন, যাঁদের বেশির ভাগই মহিলা। একচালার প্রতিমা। মুগ্ধ হয়ে মা দুর্গাকে দেখছি। পাঁচ বছরের খোকন নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘‘সরস্বতী কি দুর্গার চেয়ে বড়?’’

বললাম, ‘‘ধ্যাত। মেয়ে কখনও মায়ের চেয়ে বড় হয়?’’

খোকন মাথা নাড়ল, ‘‘মেয়ের চেয়ে মা’কে কি কমবয়সি দেখায়?’’

দলের বাকিরাও একমত হল। দুলাল গম্ভীর মুখে বলল, ‘‘সরস্বতী বোধহয় সৎ মেয়ে। হয়তো বয়সে বড়।’’ কথাটা আমরা বিশ্বাস করেছিলাম।

অষ্টমী এবং নবমীর শেষ দুপুরে চা-বাগানের কোয়ার্টারের সামনে বড় ট্রাক এসে দাড়াত। বাগানের বাঙালি কর্মচারীদের পরিবারের সবাই তাতে উঠে বসতাম। সেই ট্রাক আমাদের নিয়ে সরু পিচের জঙ্গুলে পথ দিয়ে একের পর এক চা-বাগানের দুর্গাঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেত। বানারহাটে বেশ বড় মেলা বসত। ওই ট্রাকে চড়ে ঠাকুর দেখা আমাদের চলেছিল চোদ্দো বছর বয়স পর্যন্ত।

চোদ্দো বছরে যখন নাকের নীচের রোমগুলোয় কালচে রং লেগেছে, চুলে কায়দা করে টেরি বাগাচ্ছি, সে সময় এক সন্ধ্যায় বানারহাট চা-বাগানে পুজো দেখতে ট্রাক থেকে নামতেই দেখলাম, অন্য কোনও বাগান থেকে আসা ট্রাক থেকে যারা নামছে তাদের সঙ্গে চকলেট রঙের স্কার্ট পরা ফরসা এক কিশোরী। ট্রাক থেকে নেমে সে মাটিতে পা রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে এমন চোখে তাকাল যা আমরা জীবনে দেখিনি। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। মা-মাসিমা-কাকা-কাকিমা, চা-বাগানে থাকা সূত্রে যাঁরা একটা সম্পর্কে জড়িয়ে আছেন, তাঁরা থাকায় ওই মেয়েটিকে অনুসরণ করতে পারেনি। ভিড়ের মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেল সে। কিন্তু খোকন নাকি তাকে একা একা ভিড়ের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে আবিষ্কার করে এসে বলেছিল, ‘‘মন খারাপ হয়ে গেল রে!’’

‘‘কেন?’’ মেলায় যখন আনন্দ আর আনন্দ, তখন ওর মন খারাপ কেন?

‘‘ওই মেয়েটার জন্যেই মন খারাপ হয়ে গেল। বেচারার চোখ ট্যারা। জীবনে শুভদৃষ্টি করতে পারবে না।’’

সেই প্রথম আমরা কয়েক জন কিশোর একটি কিশোরীর জন্য বেদনা নিয়ে দুর্গাঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করেছিলাম, ওর চোখ সুন্দর করে দাও মা!

আরও পড়ুন:সিনেমার পর্দায় ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে ভৃত্য করিমের সম্পর্ক

ট্রাকে চেপে চা-বাগানের অন্যান্যদের সঙ্গে অন্য বাগানের ঠাকুর দেখতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা হত। তেলিপাড়া চা-বাগানের পুজোয় সে বার ট্রাক থেকে নামতেই এমন এক জনকে দেখলাম, তার মতো মেয়ে চা-বাগান দূরের কথা, জলপাইগুড়ি শহরেও দেখিনি। থ্রি-কোয়ার্টার্স সাদা প্যান্ট আর লাল গেঞ্জি পরে আরও দু’টি মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে সে দুর্গাঠাকুরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদেরই বয়সি। শিবুর এক বন্ধু থাকত ওই চা-বাগানে। তার কাছে জানা গেল, ওই মেয়ে কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছে মাসির বাড়িতে। দু’দিন বাদেই ফিরে যাবে। আমরা ওই সুন্দরীকে মুগ্ধ হয়ে দেখছি। সুন্দরী চোখ ঘুরিয়ে আমাদের দেখে ক্যাটক্যাটে গলায় বলল, ‘‘এ দিকে দেখার কিছু নেই, মা দুর্গা ওইখানে!’’ খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি ট্রাকের কাছে ফিরে গিয়ে শিবু বলেছিল, ‘‘এই মেয়ে বড় হয়ে মাস্টারনি হবে।’’

সে বড় সুখের সময় ছিল। শৈশব থেকে ষোলো বছর পর্যন্ত প্রতিটি পুজোয় ট্রাকে চেপে রোজ তিরিশ কি চল্লিশ মাইলের মধ্যে সব চা-বাগানের ঠাকুর দেখে বেড়াতাম। শেষের দিকে মাটির প্রতিমা দেখতে আসা রক্তমাংসের প্রতিমাদের দেখতেও ভাল লাগত। কিন্তু সেটা দূর থেকে দেখা পর্যন্ত, তার বেশি পা বাড়াবার ইচ্ছে বা সাহস, কোনওটাই থাকত না।

ঠাকুরদার সঙ্গে জলপাইগুড়ি শহরে গিয়েছিলাম চার বছর বয়সে। প্রতি পুজোর ছুটিতে চা-বাগানে বাবা-মায়ের কাছে আসতাম। কালীপুজোর পরের দিন ফিরে যেতাম। কিন্তু স্কুলের শেষ বছরে পড়ার চাপ বেশি থাকায় পুজোয় জলপাইগুড়িতেই ছিলাম। স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে সাইকেলে চেপে পাড়ায় পাড়ায় ঠাকুর দেখতে যাওয়ার উন্মাদনা একদম আলাদা। ঠাকুরদা একটু কড়া ধাতের মানুষ। অন্য দিন বাড়ি ফিরতে হত সন্ধে ছ’টার মধ্যে, পুজোর চার দিন তিন ঘণ্টা সময় বাড়ালেন, ফলে জলপাইগুড়ি শহরটাকে বন্ধুদের সঙ্গে চষে বেড়াতে চাইতাম সেই সময়ের মধ্যে। তখন প্রায় প্রতিটি পাড়ার মানুষ নিজেদের পুজোয় মেতে থাকত। সন্ধের পর অন্য পাড়ায় ঠাকুর দেখতে বেরত অনেকেই। আমার এক প্রিয় বন্ধু, আজ যে পৃথিবীতে নেই, সাইকেল চালাতে চালাতে বলেছিল, ‘‘বুঝলি সমরেশ, জলপাইগুড়িতে সুন্দরী মেয়ের সংখ্যা হুহু করে কমে আসছে। এ ভাবে চললে এক দিন সবাই দিদি বা বোন হয়ে যাবে।’’

অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘‘আরে! দিদি বা বোন সুন্দরী হতে পারে না?’’

‘‘না। যারা দিদি তারা শুধুই দিদি। বোন যত দেখতে ভাল হোক বা না হোক, সে শুধুই বোন। তাদের সুন্দরী বলে ভাবতে যাব কেন? বোন বা দিদির বাইরে যারা, তাদের কেউ কেউ সুন্দরী হলেও হতে পারে।’’

কথাগুলোর, বিশেষ করে শেষ কথাটার অর্থ সে দিন বুঝতে পারিনি। সহপাঠী হওয়া সত্ত্বেও ও মেয়েদের ব্যাপারে বোধহয় আমার চেয়ে অনেক বেশি বুঝত। সেই ষোলো বছর বয়সে, যখন পৃথিবীটা বিস্ময়ে ভরা, যখন সিনেমাহলের দেওয়ালে হাসিমুখের সুচিত্রা সেনকে স্বর্গের মানবী মনে হয়, তখন প্রথম রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়েছিলাম।

জলপাইগুড়িতে দশমীর ঠাকুর বিসর্জন আকর্ষণীয় ছিল। শহরের এক পাশ দিয়ে বয়ে গিয়ে করলা নদী তিস্তায় মিশেছে। আমাদের বাড়ি ছিল হাকিমপাড়ায়। পা বাড়াতেই এক দিকে তিস্তা, অন্য দিকে করলা। এই করলা নদীর বুকে সন্ধে থেকেই নৌকোয় দুর্গাঠাকুরকে তোলা হত। দিনবাজারের পুল থেকে বাবুপাড়া পর্যন্ত ঘুরিয়ে করলার জলে বিসর্জন দেওয়া হত। মিউনিসিপ্যালিটি থেকে যতটা সম্ভব করলার পাড় আলোকিত করা হত। মেলা বসে যেত থানা থেকে নদীর ধার ধরে অনেকটা। কাতারে কাতারে নারীপুরুষ সেই ভাসান দেখতে চলে আসতেন। ঢাকে বোল বাজত, ঠাকুর থাকবি কত ক্ষণ, ঠাকুর যাবি বিসর্জন... আমরা নৌকোর ঠাকুর গুনতে গুনতে খেই হারাতাম। হ্যাজাকের আলোয় উদ্ভাসিত প্রতিমা দেখতে কী চমৎকারই না লাগত! সেই সন্ধেবেলায় মন এত ভারী হয়ে যেত যে জলপাইগুড়ির সেরা সুন্দরী কিশোরীরা, যারা বাড়ির লোকের সঙ্গে ভাসান দেখতে আসত, তাদের দিকে তাকাতাম না। যেন তুচ্ছ হয়ে যেত তাদের উপস্থিতি। মা চলে যাচ্ছেন এক বছরের জন্যে, এই কথাটা বুকে দ্রিমিদ্রিমি বেজে চলত।

রাত ন’টার পর যেহেতু বাইরে থাকার হুকুম নেই, তাই শেষ মুহূর্তে দৌড়ে পৌঁছে যেতাম বাড়িতে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিমার বিসর্জন হয়ে গিয়েছে। ঠাকুরদা বারান্দায় চেয়ারে, বোধহয় আমার অপেক্ষায় বসে থাকতেন। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াতেই নিচু হয়ে তাঁকে প্রণাম করতাম। তিনি বুকে টেনে নিয়ে কোলাকুলি করতেন। তার পর নিচু গলায় বলতেন, ‘‘যাও, পিসিমাকে প্রণাম করো।’’ বিধবা বড়পিসিমা, যিনি আমাকে চার বছর বয়সে মানুষ করবেন বলে মায়ের কাছ থেকে চা-বাগান থেকে নিয়ে এসেছিলেন, বসে থাকতেন তাঁর ঠাকুরের ছবির সামনে। প্রণামের জন্য নিচু হতেই ধমক শুনতাম, ‘‘ঠাকুরের সামনে মানুষকে প্রণাম যে করতে নেই তা কবে শিখবি।’’

‘‘তা হলে বাইরে চলো, বিজয়ার প্রণাম করব।’’

‘‘আমার এখন উঠতে ইচ্ছে করছে না।’’ তার পর চোখ বন্ধ করে বললেন, ‘‘কাল সকালে চা-বাগানে গিয়ে আগে মা’কে প্রণাম করে আয়, তার পর আমাকে করবি।’’

আমার চোখ এক সন্ধ্যায় দু’বার জলে ভেসে যেত।

কলকাতায় পড়তে এলাম। প্রথম কয়েক বছর কলকাতার সরস্বতীপুজো দেখেছি, দুর্গাপুজো দেখিনি। ছুটি হলেই দৌড়তাম জলপাইগুড়িতে। সেখান থেকে চা-বাগান। ফলে কলকাতায় দুর্গাপুজো দেখার সুযোগ হয়নি, বোধহয় ইচ্ছেও হত না।

প্রথম যে বার কলকাতার দুর্গাপুজোয় থাকলাম, বুঝতে পারলাম, এই শহরের বড়জোর দশ ভাগ মানুষ পুজো নিয়ে মাতামাতি করেন। পুজো এলে অনেকেই চলে যান শহরের বাইরে বেড়াতে। বাকিরা ঘরে বসে খাওয়াদাওয়া আর আড্ডায় সময় কাটান। চার দিনের পুজোয় যাঁরা বাড়ির বাইরে বেরোন, তাঁরা ঠাকুর দেখার নাম করে নিজেদের দেখাতেই উদ্‌গ্রীব। রবীন্দ্রনাথ এই সত্যিটা ওই অত দিন আগে জানলেন কী করে, ভেবে অবাক হয়েছি। যাকে পুজো করছি, পুজোর ছলে তাকেই হারিয়ে ফেলতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি আমরা।

এমএ পাশ করার পর সবে একটা চাকরি পেয়েছি। ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি। প্রথম বার কলকাতার পুজো দেখব বলে কলকাতায় আছি। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় মনে হল, কানের পরদা মাইকের কল্যাণে আস্ত থাকবে না। বন্ধুরা, যারা গোটা বছর কফিহাউসে ভাগাভাগি করে কফি খেত, তারা আমাকে দলে টানতে চাইল, ‘‘চল, শ্যামলের বাড়িতে। দারুণ জমবে।’’ শ্যামলের বাড়ির সবাই গ্রামের বাড়ি গিয়েছেন। তাই সেই বাড়িতে আজ পুজোর উৎসব হবে। চাঁদা নেওয়া হল আগেভাগে। গিয়ে দেখলাম, মদের বোতল, গ্লাস, চাট তৈরি। যারা গিয়েছে তাদের কেউ গোটা বছর মদ ছুঁয়েও দেখে না, কিন্তু পুজোর চার দিন আনন্দ করার জন্য মদ না খেলে কী রকম পানসে হয়ে যাবে পৃথিবীটা। চাপে পড়ে সেই প্রথম মদ্যপান, এবং বাথরুমে গিয়ে প্রায় অন্নপ্রাশনের ভাত বের করে ফেলার ফলে বাকি তিন দিন বিছানায় শুয়ে কাটিয়েছিলাম। এই গল্প শুনে অল্পবয়সিরা আমার দিকে এমন চোখে তাকিয়েছে যেন অন্য গ্রহের জীব দেখছে।

চা-বাগানে বা জলপাইগুড়ি শহরে পুজোর সময় যেতে এখনও খুব ইচ্ছে হয়। কলকাতার মাইকের আওয়াজে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া এই আমি ওই চার দিন বধির হয়ে বইমুখো হয়ে থাকি। ভয়, যদি চা-বাগান অথবা জলপাইগুড়িতে গিয়েও আমাকে গৃহবন্দি হয়ে থাকতে বাধ্য হতে হয়!

না, আমার যা সম্পদ তা হারাতে চাই না। বুকের মধ্যে তিনি থাকবেন। চোখ বন্ধ করলেই তাঁর ওম পাব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE