Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

ইন্দিরা আসলে আবেগতাড়িত এক ব্যক্তিত্ব!

ঠান্ডা মাথা, কুশলী অথচ স্বতঃস্ফূর্ত। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট থেকে দেশের সেনাপ্রধান, সবাইকে সরাসরি জানিয়ে দেন তাঁর অনুযোগ। আড়াল থেকে মন কি বাত বলা তাঁর ধাতে ছিল না। ঠান্ডা মাথা, কুশলী অথচ স্বতঃস্ফূর্ত। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট থেকে দেশের সেনাপ্রধান, সবাইকে সরাসরি জানিয়ে দেন তাঁর অনুযোগ। আড়াল থেকে মন কি বাত বলা তাঁর ধাতে ছিল না।

ইন্দিরা গাঁধী। ছবি: গেটি ইমেজেস

ইন্দিরা গাঁধী। ছবি: গেটি ইমেজেস

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ইন্দিরা গাঁধী মনোযোগ দিয়ে একটা ওমলেট খাচ্ছিলেন। খেতে খেতে শুনছিলেন বেঠোভেনের সঙ্গীত। ঘরে ঢুকলেন পুপুল জয়াকার। পুপুল ইন্দিরার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৯৬৯ সালের ২০ অগস্ট, রেডিয়োতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রথম রাউন্ডের ফল বলছে, সঞ্জীব রেড্ডি জিতছেন আর বরাহগিরি ভেঙ্কটগিরি যাঁকে আমরা জানি ভি ভি গিরি বলে, তিনি হারছেন। তত ক্ষণে কামরাজরা জয়ের উল্লাসে রাস্তায়। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কর্মীরা হতাশ, নীরব। ইন্দিরা ওমলেট খাচ্ছেন। উদ্বিগ্ন পুপুল বাড়ি থেকে সটান সেখানে, কী হবে? ইন্দিরার প্রার্থী হেরে যাবেন? ইন্দিরার জীবনীকার পুপুল লিখছেন, নিজের উত্তেজনা ও উদ্বেগকে সম্পূর্ণ গোপন করতে পারতেন না ইন্দিরা। ‘‘দেখো, দ্বিতীয় রাউন্ডে ঠিক জিতে যাবেন গিরি।’’ শুনে ইন্দিরা মৃদু হাসলেন। তার পর বললেন, ‘‘প্রবাবলি। তবে ব্যাপারটা খুব সহজ নয় পুপুল। হেরে যাওয়া মানে সামনে আরও কঠিন লড়াই। কিন্তু আমি তৈরি।’’

সে দিন মাঝরাতে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে একটা ফোন আসে পুপুলের কাছে, ‘‘ম্যাডাম, গিরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিতে গিয়েছেন।’’ পর দিন প্রাতরাশের টেবিলে আবার পুপুল-ইন্দিরা মুখোমুখি। জীবনীকার লিখছেন, ইন্দিরা কিছুতেই নিজের হাসি, আনন্দ চেপে রাখতেও পারছেন না। শুধু বলেছিলেন, ‘‘সংকট এখন সবে শুরু হল।’’

পুপুলকে ভালবাসতেন ইন্দিরা। তাই কাছ থেকে তাঁকে দেখারও সুযোগ পান পুপুল। সে দিন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আর যাই হোক, এই লৌহমানবী আসলে রক্ত-মাংসের এক আবেগতাড়িত ব্যক্তিত্ব। দলের মধ্যে বৃদ্ধতন্ত্র ইন্দিরাকে ছোবল মারতে উদ্যত। কংগ্রেস সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকে সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা ইন্দিরার পাশে নেই। সিন্ডিকেট এক দিকে, আর এক দিকে ইন্দিরা। দেশের মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা যাই হোক, সংগঠনের মধ্যে যদি নিয়ন্ত্রণ না থাকে তবে কী করে জিতবেন তিনি, এ শঙ্কা তখন প্রতি মুহূর্তে। সঞ্জীব রেড্ডির নাম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দলীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করল কংগ্রেস, আর উপরাষ্ট্রপতি গিরি ইন্দিরার সমর্থনে সঞ্জীব রেড্ডির বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। আজ এত বছর পর পিছন ফিরে তাকিয়ে সে দিনটা বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে আজ যে দলীয় রাজনীতির প্রকোপ, তারও শুরু সে দিন করেছিলেন ইন্দিরাই। প্রখর বুদ্ধি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দলীয় সংগঠনকে কবজা করলেন। কিন্তু চাণক্যর বুদ্ধি থাকলেও নানা ঘটনায় বোঝা যেত, তিনি ‘রোবট’ও নন। ক্ষুরধার বুদ্ধির পাশাপাশি ছিল তীব্র আবেগ। আচরণে ছিল স্বতঃস্ফূর্ততা।

যাঁর সম্পর্কে যা শুনতেন সেটা সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ডেকেই জানতে চাইতেন। পিছনে আলোচনা করার চেয়ে সামনাসামনি অভিযোগ উত্থাপন করতে বেশি ভালবাসতেন।

১৯৬৯ সালে দল ভাঙার পর তখন ইন্দিরা গাঁধীর সরকার সংখ্যালঘু সরকারে পরিণত। চারিদিক থেকে নানা সমস্যার বিস্ফোরণ। চন্দ্রশেখরের নেতৃত্বে রাজাদের ‘প্রিভি পার্স’ তোলার দাবিতে দলের মধ্যেই গন্ডগোল, পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়েছে, রাজ্যে রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মূল্যবৃদ্ধি। এমন এক সময়ে গোয়েন্দারা ইন্দিরাকে গোপন রিপোর্ট দিয়ে বললেন, সেনাবাহিনী নাকি গোপনে ষড়যন্ত্র করছে। সামরিক অভ্যুত্থান বা ‘ক্যু’-এর মাধ্যমে ইন্দিরাকে সরিয়ে জেনারেল মানেকশ ক্ষমতাসীন হবেন।

এক দিন অপরাহ্ণে জেনারেল মানেকশ ফোন পেলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর, ‘‘স্যাম, তুমি কি খুব ব্যস্ত?’’ দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল। অনেক সময় রঙ্গরসিকতাও হত। ইন্দিরা ডাকলেন তাঁকে। কিডনি আকৃতির বিখ্যাত টেবিলের সামনে বসে ফাইল দেখছিলেন, মাথায় হাত। মানেকশ নিজেই লিখেছেন সে দিনের ঘটনা।

আরও পড়ুন: ইন্দিরার বামপন্থী পপুলিজমের রাজনীতি থেকে বেরতে পারল না কোনও দলই

‘‘ম্যাডাম, কী সমস্যা? আপনাকে এত হ্যারাসড লাগছে কেন?’’

‘‘আমার কত রকম সমস্যা থাকে স্যাম।’’

‘‘কী সমস্যা আপনার? আমার কাঁধের উপর মাথা রেখে আপনি কাঁদছেন না কেন? কাঁদতে কাঁদতে সে সব সমস্যা বলে দিন।’’ ঠিক তখনই ইন্দিরা সোজাসুজি তাকালেন মানেকশ’র চোখের দিকে। হিমশীতল চাউনি। তার পর বললেন, ‘‘তুমিই তো আমার সমস্যা।’’

‘‘ওহ্‌! সে কী! আমি আবার কী করলাম?’’

‘‘তুমি আমার কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে আমার চেয়ারেই বসতে চাইছ?’’ কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিশ্চুপ জেনারেল। সরাসরি এ প্রশ্নটা আশা করেননি তিনি। তার পর বললেন, ‘‘আপনার কী মনে হয়?’’

‘‘তুমি তা করতে পারো না।’’

‘‘আপনার কি মনে হয় আমি এতটাই অযোগ্য?’’

‘‘নো স্যাম। বাট ইউ ওন্ট। তুমি এই কাজটা করতেই পারো না।’’

এর পর মানেকশ অনেক কথা বলে ফেললেন, ‘‘আপনি জানেন আমার কোনও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। আমার কাজ হল সেনাকে নিয়ন্ত্রণ করা, নির্দেশ দেওয়া, সেনাবাহিনীর মান উন্নত রাখা। আর আপনার কাজ হল, সমগ্র দেশটাকে দেখা।’’ ইন্দিরা বললেন, ‘‘আমার মন্ত্রীরা অনেকেই বলছেন, সামরিক অভ্যুত্থান হবেই।’’ জেনারেল বললেন, ‘‘আমার উপর আপনাকে বিশ্বাস রাখতে হবে। যদি এই বিশ্বাস না থাকে, তবে অন্য কোনও এক জনের উপর আস্থা রাখুন। আমি চলে যাই।’’

এই হলেন ইন্দিরা। যা বলার সামনাসামনি বলে দিতেন। মানেকশ’র সঙ্গে কথোপকথনের পরও সরকার নিয়ে শঙ্কা যায়নি তাঁর। সে বছরই ২৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে লোকসভা ভেঙে দিয়ে অন্তর্বর্তী ভোটের সুপারিশ করেন। ’৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অভূতপূর্ব সাফল্য নিয়ে ফের ক্ষমতাসীন হন।

সচেতন: রাজনীতির মতোই, তাঁর পোশাকেও ছিল নিজস্ব স্টাইল

অনেকে নেহরু ও ইন্দিরার তুলনা করেন। তাঁরা বলেন, নেহরুর জীবনে মতাদর্শের নিয়ন্ত্রণ ছিল বেশি। নৈতিকতা ও রোম্যান্টিসিজমও ছিল বেশি। ইন্দিরার ‘পাপু’ তাই যে কোনও আঘাতে অনেক বেশি ভেঙে পড়তেন। ১৯৬২ সালে চিনের আক্রমণ যদি না হত, আজও অনেকে বলেন, তা হলে হয়তো ’৬৪ সালে তাঁর দেহাবসান হত না। মৃত্যুর আগে ভুবনেশ্বরে কংগ্রেস অধিবেশনে মঞ্চেই নেহরুর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। ইন্দিরা যে প্রকাশ্যে অনেকের সামনেই নিজের আবেগকে প্রকাশ করতেন এমন নয়। বরং স্বামীর মৃত্যু, পুত্র সঞ্জয়ের মৃত্যুর মতো জীবনে ভয়াবহ দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। পুত্রশোকে তাঁকে ভারতবাসী ভেঙে পড়তে দেখেনি, তিনি কালো চশমা পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে নিজের ভিতরের সত্তাটিকে লুকিয়েছেন। নেহরু যে রকম স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নিজের মনের কথা বলতেন, ইন্দিরা তা বলতেন না। যা বলতেন সুপরিকল্পিত ভাবে, রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে বলতেন।

এমনকী ১৯৬৯ সালে তিনি ‘স্ট্রে থটস্’ বলে যেটি লেখেন সেটিও কংগ্রেসের উপর নিয়ন্ত্রণ রক্ষার লড়াইয়ের প্রধান ইস্তাহারে পরিণত করেন। হতে পারে পিতা ও কন্যার তুলনা করলে ইন্দিরার মধ্যে অনেক বেশি ছিল ‘কৌশলী চতুরতা’। ’৬২ সালে বিমানবন্দরে তড়িঘড়ি ডাকা এক সাংবাদিক বৈঠকে নেহরু বলে দেন, চিনাদের ছুড়ে ফেলে দিতে হবে। থ্রো আউট দ্য চাইনিজ। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের আগেভাগে ইন্দিরা পাকিস্তান নিয়ে এমন কোনও সাংবাদিক বৈঠক করেননি।

তাঁর এই ‘প্র্যাগম্যাটিজম’ নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। হেনরি কিসিঙ্গার একদা বলেছিন, ‘‘ইন্দিরা হলেন কোল্ড-ব্লাডেড প্র্যাকটিশনার অব রিয়্যাল পলিটিক।’’ ১৯৭৫-এর জুন মাসে ইলাহাবাদ হাইকোর্ট ইন্দিরার ভোটকে অবৈধ ঘোষণা করে তাঁকে ইস্তফা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। ইন্দিরা সেই আদেশ না মেনে শেষ পর্যন্ত দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। প্রবীণ সাংবাদিক ইন্দর মলহোত্র সেই সময় মুম্বইতে গিয়ে এক আকস্মিক জনমত যাচাই করেন। প্রশ্ন ছিল, ‘‘ঠিক এই রকম পরিস্থিতিতে নেহরু যদি থাকতেন তবে তিনি কী করতেন বলে আপনি মনে করেন?’’ ইন্দর মলহোত্র বলেন, ‘‘প্রথম কিস্তিতে যে ৩৬ জনকে নিয়ে সমীক্ষা করেছিলাম, তারা সবাই বলেছিল, ইলাহাবাদ হাইকোর্ট এ রকম নির্দেশ দিলে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে নেহরু ইস্তফা দিয়ে দিতেন।’’

ভারতের রাজনীতি ইন্দিরা যুগ থেকে আজ মোদী যুগে এসে পৌঁছেছে। অনেক পরিবর্তন এসেছে সমাজে, রাজনীতিতেও। একটা ব্যাপার এর মধ্যে স্পষ্ট। আজকের নেতৃত্বে যতটা না স্বতঃস্ফূর্ততা তার চেয়ে অনেক বেশি কৌশল। আবেগহীন মিডিয়া-কালচার গড়ে তোলা। যেখানে নেতার ‘মিথ’-কে নানা কর্পোরেট কৌশলে নির্মাণ করা হয়। রেডিয়ো এবং টিভিতে নরেন্দ্র মোদীর ‘মন কি বাত’-ও আসলে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাভিত্তিক। প্রধানমন্ত্রী যা জানানোর তা মূলত টুইটার এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানান। সেখানে পারস্পরিক আলোচনার রাজনৈতিক পরিসরটুকুও মুছে যাচ্ছে। গত তিন বছরে মোদী একটি সাংবাদিক বৈঠকও করেননি, ফি বছর দিওয়ালি মঙ্গল মিলনে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে হাসিমুখে সেলফি তোলেন।

ইন্দিরা কিন্তু সাংবাদিকদের কাছেও নিজের উষ্মা গোপন করতে পারতেন না। প্রয়াত সাংবাদিক কেবল বর্মা লিখেছেন, এক সাংবাদিকের তীক্ষ্ণ প্রশ্ন শুনে ইন্দিরা নাকি বলে ফেলেন, ‘‘জানেন, আপনার মালিক আমার বন্ধু। চাইলে আমি আপনার চাকরি খেতে পারি।’’

এই উষ্মা প্রকাশে ইন্দিরার স্বতঃস্ফূর্ততা আছে। তিনি যদি সত্যি সত্যিই রোবট হতেন, কখনও এ ভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেন না। আবার, ইন্দিরা রেগে গিয়েই পরক্ষণেই ঠান্ডা হয়ে যেতেন। ওই সাংবাদিকের কাছে রাগ দেখালেও কিন্তু সংবাদপত্রের মালিকের কাছে সেই ক্ষোভ জানাননি।

বিদেশের রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে কথা বলার সময়ও ইন্দিরার স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল অনবদ্য। ১৯৭৭ থেকে ’৮৮, জেনারেল জিয়াউল হক ছিলেন পাক একনায়কতন্ত্রী। ’৮০ সালের এপ্রিল মাসে হারারেতে জিম্বাবোয়ের স্বাধীনতা উৎসবে জিয়ার সঙ্গে প্রথম দেখা হয় ইন্দিরার। যে দিন দু’জনের বৈঠক, ঠিক সে দিন সকালের কিছু সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, জিয়া অতীতে ইন্দিরার বিরুদ্ধে কবে কী কী কটু কথা বলেছেন। জিয়া এমনিতে বেশ ভদ্রলোক ছিলেন। খবরের কাগজে প্রকাশিত ওই সব খবর দেখে লজ্জিত ছিলেন তিনি। বৈঠকে কথার শুরুতেই জিয়া বলেন, ‘‘ম্যাডাম, খবরের কাগজে কে কী লিখল ও সব বিশ্বাস করবেন না।’’ ইন্দিরা সঙ্গে সঙ্গে হাসতে হাসতে বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই বিশ্বাস করব না। ওরা যে লিখছে তুমি এক জন গণতন্ত্রী আর আমি স্বৈরতন্ত্রী। সে কথা কখনও বিশ্বাস করব না আমি!’’ বিশিষ্ট পাকিস্তানি সাংবাদিক খালিদ হাসান একদা জুলফিকার আলি ভুট্টোর প্রেস সচিব ছিলেন। তিনি এক বার ইন্দিরাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘আপনি কী ভাবে এ হেন মর্যাদা সহকারে ক্ষমতায় ফিরে আসতে সফল হলেন?’’ ইন্দিরা বলেছিলেন, ‘‘কারণ, আমাকে ফাঁসি দেওয়া হয়নি।’’

আমরা বলতে পারি, এ হল প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। আবার ওঁর মধ্যে এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ততাও ছিল। নানা ভাবে সেই ইন্দিরাকে খুঁজে পাওয়া যেত। মন্ত্রীরা সেই ইন্দিরাকে দেখতে পেতেন; দলীয় নেতা, সাংসদ, আমলা, সাংবাদিক, রাষ্ট্রদূত— সকলেই তাঁকে দেখতে পেতেন।

১৯৮০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যখন আফগানিস্তানের বিতর্ক শুরু হয় তখন সোভিয়েত বিদেশমন্ত্রী আন্দ্রেই গ্রোমিকো দেখা করতে এলে ইন্দিরা তাঁকে মিষ্টি মিষ্টি করে কথা না বলে সাফ জানিয়ে দেন, ‘‘আফগানিস্তানের ব্যাপারে আপনারা ভারত থেকে কোনও সাহায্যই পাবেন না।’’ প্রবীণ সাংবাদিক ইন্দর মলহোত্র বলেন, ‘‘সোজা কথা সোজা ভাবে বলাই ভাল। সে জন্য গ্রোমিকো যখন পরে আত্মজীবনী লেখেন, ইন্দিরার প্রশংসা করেন। তিনি লেখেন, ‘ভারতের জন্য যা করা উচিত তিনি তো সেটাই বলেছিলেন। ঠিক কাজ করেছিলেন।’

সে দিন লালকৃষ্ণ আডবাণী বলেছিলেন, ‘‘এত বছর পর মনে হয়, ইন্দিরা গাঁধীর রাজনীতিতে আছে অনেক অনেক স্তর। কখনও তিনি প্রকাশিত, কখনও মেঘের আড়ালে।’’ ব্যক্তি ইন্দিরাকে বিরোধী নেতা আডবাণী কেন, দলের সতীর্থ নেতারাও দেখতে পেতেন না অনেক সময়। আডবাণী বলেন, ওঁদের পরিবারে গোপনীয়তা রক্ষার একটা ট্র্যাডিশনও আছে। হয়তো পাশ্চাত্যের প্রভাব ছিল অভিজাত নেহরু-গাঁধী পরিবারে।

মৃত্যুর আগে ইন্দিরা অনেক বেশি পুজো-অর্চনা করতে শুরু করেন। ’৭৯ সালে সঞ্জয় গাঁধীর জীবনের উপর আঘাত আসতে পারে বলে গোয়েন্দারা ইন্দিরাকে সতর্ক করেন। এর পর ১৯৮০ সালে তিনি মারা যান। এর পরই নাকি তিনি বেশ দুর্বল হয়ে যান। আগে তাঁর ঘরে কোনও দেবদেবী, কোনও গুরুর ছবি থাকত না। পরে দেখা যায়, জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তি থেকে আনন্দময়ী মা, ঘন ঘন ভরত মহারাজের কাছেও তিনি যাওয়া শুরু করেন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩, এই দীর্ঘ সময়ে ঝাঁসিতে এক কালীমন্দিরে তাঁর জন্য নিয়মিত চণ্ডীপাঠ হত ইন্দিরার সম্মতিতেই। সে কথা জানত না অনেকেই। ’৮৩ সালে সে যজ্ঞকাণ্ড শেষ হয়, আর তিনি বিদায় নিলেন ’৮৪ সালে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE