Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

আট দশক পরেও অটুট যুদ্ধবিরোধী মেজাজ

আগামী বুধবার গের্নিকা শহরে গণহত্যার ৮০ বছর। তারই প্রতিবাদে ছবি এঁকেছিলেন পিকাসো। ইরাক, সিরিয়ার এই যুগে আজও ফিরে ফিরে আসে সেই ছবি। সম্রাট মুখোপাধ্যায় আগামী বুধবার গের্নিকা শহরে গণহত্যার ৮০ বছর। তারই প্রতিবাদে ছবি এঁকেছিলেন পিকাসো। ইরাক, সিরিয়ার এই যুগে আজও ফিরে ফিরে আসে সেই ছবি। সম্রাট মুখোপাধ্যায়

গের্নিকা: শিল্পীর ক্যানভাসে প্রতিবাদের গর্জন। আজও সমান প্রাসঙ্গিক।

গের্নিকা: শিল্পীর ক্যানভাসে প্রতিবাদের গর্জন। আজও সমান প্রাসঙ্গিক।

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

শূ ন্য ক্যানভাসের সামনে নিষ্পলক দাঁড়িয়ে মধ্য পঞ্চাশের প্রৌঢ়। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সামনে শুকিয়ে যাওয়া প্যালেট। বর্ণহীন তুলি। হাত-পা কাঁপছে, গলার কাছে দলা পাকানো অচেনা অস্বস্তি। আজ বড্ড অস্থির, অসহায় লাগছে। বসন্তের সকালে আলোয় ভেসে যাচ্ছে প্যারিসের আকাশ। আর নীচে রাজপথ ভাসছে কূলপ্লাবী জনজোয়ারে। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছেন এক নির্বিচার গণহত্যার প্রতিবাদে।

গণহত্যা ঘটেছে শিল্পীর মাতৃভূমি স্পেনে। সেখানকার বাস্ক প্রদেশের এক ছোট্ট, ছবির মতো সুন্দর শহর গের্নিকা। ১৯৩৭ সালের ২৬ এপ্রিল সেখানে ছিল হাটবার। তাই গের্নিকায় সে দিন জনসমাগম বেশি। কোনও পূর্বলক্ষণ, হুঁশিয়ারি বা হুমকি ছিল না। হঠাৎ বিকেল চারটে নাগাদ আকাশে উড়ে এল একটা প্লেন।

পনেরো মিনিটের মধ্যে পর পর তিনটে বিমান। সব ক’টাই জার্মানি ও ইতালির বোমারু বিমান। হিটলার ও মুসোলিনির যৌথ অভিযানে আকাশ থেকে নেমে এল একের পর এক বোমা। শহর জ্বলছে, তারই মধ্যে যাঁরা পালাতে চেষ্টা করলেন, নাত্‌সি বাহিনী মেশিনগান দিয়ে তাঁদের ঝাঁঝরা করে দিল। উদ্দেশ্য সহজ। স্পেনে কোনও প্রতিবাদ বা গৃহযুদ্ধ চলবে না, হিটলার ও মুসোলিনির বন্ধু শাসক ফ্রাঙ্কোকে ক্ষমতার আসনে স্বীকার করে নিতেই হবে।

নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই ছিল বেশি। গের্নিকার অধিকাংশ পুরুষই তখন কাজের সূত্রে বাইরে। এখনকার মতো ইন্টারনেট নেই, বাইরের দুনিয়ায় খবর পৌঁছতে তিন-চার দিন লেগে গেল। দিকে দিকে তখন ধিক্কার আর প্রতিবাদ। ১৯৩৭-এর ১ মে পথে নামল প্যারিস। সেই প্যারিসেই ওই ধ্বংসলীলার খবর পান তিনি। পাবলো রুইজ পিকাসো।

প্রতিবাদী: পাবলো পিকাসো

গের্নিকার হত্যালীলা সম্পর্কে সাংবাদিক জর্জ স্টিয়ার-এর বিবরণ আর ভয়াবহ সব ছবি তখন প্যারিসেই প্রবল ধাক্কায় বেসামাল করে দিয়েছে তাঁকে। স্পেনের রিপাবলিকান সরকারের জন্য সদ্য একটি কাজে তখন হাত দিয়েছেন পিকাসো। প্যারিস বিশ্ব মেলায় স্পেনীয় গ্যালারির জন্য একটি ম্যুরাল আঁকবেন। কিন্তু বিষয় নির্বাচন নিয়ে একটু ধন্দে ছিলেন। গের্নিকা সেই ধন্দ লহমায় কাটিয়ে দিল। স্পেনের রিপাবলিকান সরকারের বিরুদ্ধে ফ্রাঙ্কো আর হিটলারের মিলিজুলি আক্রমণের জবাব নিজের অস্ত্রেই দেবেন বলে ঠিক করলেন পিকাসো।

ঠিক ৩৫ দিনে ম্যুরালের কাজ শেষ করলেন পিকাসো। নাম দিলেন ‘গের্নিকা’। ২৫.৬ বাই ১১.৫ ফুটের বিশাল ক্যানভাসে গর্জে উঠল সাদা-কালোর অতুলনীয় কিউবিজম। যুদ্ধের বিরুদ্ধে, নির্বিচার হত্যার বিরুদ্ধে এক ছবি আঁকিয়ের হুঙ্কার। খুব সচেতন ভাবেই পিকাসো এ ছবিতে রং ব্যবহার করলেন না। ছবিটির প্রথম প্রদর্শনীর পরে তার স্পষ্ট ব্যাখ্যাও দিলেন না। জানালেন, ক্রোধে উন্মত্ত ষাঁড়, যন্ত্রণাকাতর ঘোড়া, মৃত সন্তান কোলে মা বা মুমূর্ষু সৈনিকের হাতে ধরা তলোয়ারে ফোটা ফুল— এ সবের ব্যাখ্যা যে যাঁর মতো করে নিন। তিনি কোনও ধারণা চাপিয়ে দিতে চান না।

গের্নিকা বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রদর্শিত হলেও স্পেন তার কাছে ব্রাত্যই ছিল। পিকাসো চেয়েছিলেন, যত দিন না স্পেনে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, তত দিন গের্নিকা সেখানে যাবে না। তাই তাঁর ইচ্ছাতেই গের্নিকার সযত্ন ঠাঁই হয় নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট-এ। পরে অবশ্য ১৯৭৩-এ পিকাসো এবং ’৭৫-এ ফ্র্যাঙ্কোর মৃত্যুর পরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ১৯৮১ সালে স্পেন ছবিটিকে হাতে পায়। প্রদর্শনের সময়ে বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েক বার আক্রান্তও হয়েছিল গের্নিকা। স্পেনে নিয়ে আসার পরে তাই ছবিটিকে বোমা ও বুলেট-নিরোধক কাচের ভিতরে রাখা হয়।

পিকাসো চলে গিয়েছেন, তাঁর গের্নিকারও বয়স বেড়েছে। দিনে দিনে ধারও বেড়েছে তার যুদ্ধবিরোধী নির্ঘোষের। ষাটের দশকে ভিয়েতনামের মাই লাই গণহত্যা। মার্কিন বোমারু বিমান আকাশ থেকে বোমা ফেলে উজাড় করে দিয়েছে ভিয়েতনামের দুই গ্রামকে, প্রায় সাড়ে ৫০০ হতাহতের মধ্যে নারী, শিশুরাও রেহাই পায়নি। আমেরিকায় যুদ্ধবিরোধী মিছিলের পুরোভাগে সে বার তুলে আনা হল গের্নিকার পোস্টার।

একুশ শতকও পিছিয়ে নেই। ২০০৩ সাল। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ইরাক আক্রমণের ‘আশু প্রয়োজন’ সম্পর্কে বুঝিয়ে বলবেন তৎকালীন মার্কিন বিদেশসচিব কলিন পাওয়েল ও রাষ্ট্রপুঞ্জে স্থায়ী মার্কিন প্রতিনিধি জন নেগ্রোপন্ট। তাঁদের বসার জায়গার ঠিক পিছনেই দেওয়াল জুড়ে গের্নিকা। আসল নয়, ‘রেপ্লিকা’। কিন্তু মার্কিন সরকারের কানে সে খবর যেতেই তারা ভাবল, কী অলক্ষুণে কাণ্ড! যে ঘরে যুদ্ধের পক্ষে সওয়াল করা হবে, সে ঘরেই কিনা ওই ছবি! অনুরোধের ছদ্মবেশে বুশ প্রশাসনের জরুরি নির্দেশ গেল রাষ্ট্রপুঞ্জের কর্তাদের কাছে। দেওয়ালে টাঙানো ছবিটাকে ঢেকে দিতে হবে। যেমন বলা তেমন কাজ। নীল পরদায় ঢেকে দেওয়া হল গের্নিকা। পাওয়েলরা বক্তৃতা করে চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু পর দিন সংবাদমাধ্যম নীল পরদার রহস্য ভেদ করে হইহই ফেলে দিল বিশ্ব জুড়ে। আড়াল করেও গের্নিকার মুখ ঢাকা গেল না।

দ্বিতীয় ঘটনা গত বছরের। আলেপ্পো শহরের আল কুদ হাসপাতালে পর পর চার বার বিমান হানা, গুঁড়িয়ে গেল হাসপাতাল থেকে মসজিদ, অনেক কিছুই। আমেরিকার বক্তব্য, সিরিয়ার সরকারি সেনা হামলা চালিয়েছে। রাশিয়ার বক্তব্য, আমেরিকার মদতে সিরিয়ার কিছু বিদ্রোহী সে দিন রাসায়নিক অস্ত্রে আলেপ্পোর জনজীবন ধ্বস্ত করেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জে ফ্রান্সের দূত রোজারিও পেরো সে দিনও টেনে আমলেন পিকাসোর ছবিকে, ‘স্পেনের যুদ্ধে গের্নিকা যা ছিল, সিরিয়ার যুদ্ধে আজ আলেপ্পোও ঠিক তাই। মানুষের ট্রাজেডি, সভ্যতার কৃষ্ণগহ্বর।’ ছবিটা আজও যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।

পিকাসো নিজে সেটাই চেয়েছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় প্যারিসে তখন নাৎসিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জোর কদমে। শিল্পবেত্তা এক নাৎসি অফিসার ছবিটা দেখতে এসে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারই সৃষ্টি, না?’

এক মুহূর্তও থমকালেন না পাবলো পিকাসো, ‘না, আমার নয়। সত্যিটা অন্য। ওটা আপনাদেরই সৃষ্টি।’

আগামী বুধবার সেই গণহত্যার ৮০ বছর। হত্যার খুঁটিনাটি আজ ম্লান, কিন্তু চিত্রকলার প্রতিবাদ আজও সমান জীবন্ত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Guernica Pablo Picasso Anti-war Painting
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE