Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

লাল গোলাপ পেলাম হোয়াইট হাউসে

প্রেসিডেন্ট তখন রোনাল্ড রেগন। ভিজিটর্স পাসে তাঁর সই। দেখানো হল ওভাল অফিস থেকে প্রেসিডেন্টের বেডরুম, সব কিছু। গাইড উপচে পড়লেন খুশিতে। জিজ্ঞাসা করলেন, গাঁধীর দেশ থেকে এসেছ?কো মরের বাঁ, ডান দু’দিকেই পিস্তল গোঁজা। লম্বাচওড়া চেহারা, গুরুগম্ভীর গলার স্বর। আমি লাইনে দাঁড়ানো ইস্তক কৃষ্ণকায় রক্ষীটি বেশ কিছু ক্ষণ ধরে আমাকে আপাদমস্তক জরিপ করছিলেন। বোধহয় ভাবছিলেন, টাকমাথা বেঁটে-কালো লোকটা হোয়াইট হাউসে কী করতে এসেছে! বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল।

চিরঞ্জীব
শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০৩
Share: Save:

কো মরের বাঁ, ডান দু’দিকেই পিস্তল গোঁজা। লম্বাচওড়া চেহারা, গুরুগম্ভীর গলার স্বর। আমি লাইনে দাঁড়ানো ইস্তক কৃষ্ণকায় রক্ষীটি বেশ কিছু ক্ষণ ধরে আমাকে আপাদমস্তক জরিপ করছিলেন। বোধহয় ভাবছিলেন, টাকমাথা বেঁটে-কালো লোকটা হোয়াইট হাউসে কী করতে এসেছে! বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এখানকার টিকিট পেলে কোত্থেকে? দেখি তো এক বার টিকিটটা!’

দুরুদুরু বুকে টিকিট দেখাতেই, ভুরু কুঁচকে ফের আনখশির নিরীক্ষণ। আমার টিকিট বা পাসে খোদ প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগনের স্বাক্ষর দেখার পর বললেন, ‘অ! ভিআইপি। তা, তুমি কিউয়ে দাঁড়িয়ে কেন? সোজা ঢুকে যাও।’ সঙ্গের এক মহিলা নিরাপত্তারক্ষীকে দেখিয়ে বললেন, ‘ও-ই তোমার গাইড। তোমাকে সব ঘুরিয়ে দেখাবে।’ আমি বিগলিত ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলতে হাসলেন। আমারও ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।

১৯৮৩। পরের বছর লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক্স। তার প্রস্তুতি এক বছর আগেই দেখার আমন্ত্রণ পেয়েছি স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে। জীবনে প্রথম বার আমেরিকা যাওয়া। মাসাধিক কালের সফরসূচিতে ওয়াশিংটনও ছিল। রোনাল্ড রেগন তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।

লস অ্যাঞ্জেলেসে পৌঁছতেই স্টেট ডিপার্টমেন্ট-এর হারবার্ট এম হাউ হোটেলে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওয়াশিংটনে আপনি কী কী দেখতে চাইছেন? খেলাধুলা সংক্রান্ত তেমন কিছু ওখানে পাবেন না কিন্তু।’ বলি, আর কিছু না হোক, হোয়াইট হাউস দেখতে পেলেই খুশি হব। হারবার্ট নিশ্চয়তা দিতে পারলেন না। জানালেন, কী এক কারণে হোয়াইট হাউসে তখন কয়েক সপ্তাহ সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। তবে একেবারে না করে দিলেন না। বললেন, ‘এক শতাংশ সুযোগ থাকলেও আপনাকে হোয়াইট হাউস দেখানোর চেষ্টা করব।’

লস অ্যাঞ্জেলেস, ডেনভার, শিকাগো ঘুরে ওয়াশিংটনের হোটেলে পৌঁছলাম ২০ সেপ্টেম্বর। তার আগেই আমার নামে ইউনাইটেড স্টেট ইনফর্মেশন এজেন্সির একটা প্যাকেট হোটেলে পৌঁছে গিয়েছে। তাতে ওয়াশিংটন সফরের সূচি, সঙ্গে একটি চিঠি। তাতে বলা হয়েছে, ২১ তারিখ, মানে পর দিনই আমি যেন সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে ১৬০০ পেনসিলভানিয়া অ্যাভিনিউয়ে হোয়াইট হাউসের সাউথ গেটে পৌঁছে যাই। প্যাকেটের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট রেগনের সই করা পাস। ওই পাস নিয়ে গেলেই হোয়াইট হাউসের কর্মীরা আমাকে সব ঘুরিয়ে দেখাবেন। আমার জন্য পাঁচ ঘণ্টা সময় বরাদ্দ, তার মধ্যেই যা দেখার দেখতে হবে।

পর দিন সকাল আটটারও আগে সেই পাস নিয়ে, ক্যামেরা কাঁধে পৌঁছে গেলাম হোয়াইট হাউসের সামনে। প্রথম দর্শনে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাড়ি দেখে আহামরি কিছু মনে হয়নি। উঁচু লোহার ফেন্সিংয়ের ভিতরে-বাইরে পাহারা আছে ঠিকই, তবে কড়া পাহারা বলতে যা বোঝায়, তা নয়। এর চেয়ে আমাদের রাজভবনের সব ক’টা গেট অনেক বেশি সুরক্ষিত! আর দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবন তো দুর্গ! অথচ হোয়াইট হাউসের সামনে, অনেকটা রকের মতো জায়গায় অনেকেই বসে গুলতানি করছেন। পুব দিকের গেটের ধার ঘেঁষে রাস্তার উপর কয়েক জন তরুণ বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। তবে কোনও স্লোগান নয়। কয়েকটা ফেস্টুনে লেখা— ‘পরমাণু বোমা ফাটানো চলবে না।’

সাউথ গেটে গিয়ে দেখলাম, ১০-১২ জনের লাইন। প্রত্যেকের হাতেই টিকিট (পরে জেনেছিলাম, ওঁদের পাস দেওয়া হয়েছে ঠিকই, তবে ভিআইপি পাস নয়, তাতে প্রেসিডেন্টের সই নেই)। ওখানেই প্রথম চোখে পড়ল কয়েক জন সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীকে। প্রত্যেকেই কৃষ্ণাঙ্গ। এক জন আমার পাসটা পরীক্ষা করে ভেতরে ঢুকতে দিলেন।

গেট পেরিয়ে হোয়াইট হাউস চত্বরে ঢোকার পর বুঝলাম, নিরাপত্তা কাকে বলে। সব স্যুটেড-বুটেড পিস্তলধারী। আমার দিকে যেন শ্যেনদৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট রেগনের সই করা টিকিট দেখার পরেও নজর নরম হচ্ছে না। তবে সন্দেহের নিরসন হওয়ার পর তাঁরাই খাতিরদারি করছেন। এগনোর পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন।

নুড়ি বিছানো পথ, আমাদের রাজভবনের মতোই। দ্রুত হাঁটা যায় না। ভবনে প্রবেশের মুখে ব্যাগ খুলে দেখাতে হল, কী কী আছে। তার পর মেটাল ডিটেক্টরের বাধা পার হওয়া। বলে দেওয়া হল, ছবি তোলার দরকার নেই। ওটা আসলে তখনকার মার্কিনি ভদ্রতা। পরিষ্কার মানেটা হচ্ছে, ছবি তোলা যাবে না। ৯/১১-র পর থেকে নিশ্চয়ই আর নিরাপত্তারক্ষীরা ভদ্রতার ধার ধারেন না।

সাংবাদিক বলে তিনটে বই পেলাম। তরুণী গাইড বললেন, ‘এতে হোয়াইট হাউসের সব তথ্য আর প্রচুর ছবি আছে। আপনি কাজে লাগাতে পারবেন।’ একটা ঘরে বসিয়ে হোয়াইট হাউসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস শোনালেন। জানালেন, পর্যায়ক্রমে নাম বদল হতে হতে আজ এটা হোয়াইট হাউস। শুরুতে ছিল প্রেসিডেন্ট’স প্যালেস, তার পর প্রেসিডেন্ট’স হাউস, এগজিকিউটিভ ম্যানসন। ১৯০৯-এ প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট ঘোষণা করলেন, ‘এখন থেকে এটা হোয়াইট হাউস।’

আমার গাইডের শুরুতেই প্রশ্ন, ও দেশে কেন এসেছি। ওঁকে বুঝিয়ে বলতে হল আমার পেশার কথা। আমি ক্রীড়া সাংবাদিক, জেনে ওঁর মুখে খুশির ঝলক। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ‘টি?’ কোন দুঃখে আপত্তি করতে যাব? চা এল, তবে তৈরি চা নয়। গরম জল, সঙ্গে টি-ব্যাগ, দুধ, চিনি। সঙ্গে হরেক রকম কুকি-ও। সাদামাটা, সংক্ষিপ্ত আয়োজন। কুকি খেতে খেতে চায়ে চুমুক দিচ্ছি। গাইডও আমার দেখাদেখি চা নিলেন।

হোয়াইট হাউসের অন্দরমহল খুঁটিয়ে দেখতে হলে পাঁচ ঘণ্টা মোটেই যথেষ্ট নয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যাবে। সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানার পর তাই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’ মনে রেখে দ্রুতপায়ে এগোচ্ছিলাম। যত দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি। সব চেয়ে আশ্চর্য হলাম প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডির বে়ডরুমে গিয়ে। আমাদের দেশে বহু সাধারণ পরিবারে গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীর বেডরুমে অদৃশ্য নো-এন্ট্রি বোর্ড ঝোলানো থাকে। সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বেডরুমে ঢুকে দেশটার প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ল। গাইড জানালেন, ন্যান্সি রেগন প্রথম যে দিন হোয়াইট হাউসে ঢোকেন, সে দিন ছেলের সাইকেলের পিছনে বসে গোটা লনটা ঘুরে দেখেছিলেন!

রোনাল্ড ও ন্যান্সি রেগনের আলাদা ডাইনিং রুম দেখলাম তিন তলায়। একটা ছোট টেবিলে টেলিফোন রাখা। ফোন বাজলে দুজনের কেউ রিসিভার তোলেন। সামনের দেওয়ালে ঝোলানো টিভি। খেতে খেতে গল্প আর সঙ্গে টিভি দেখা এবিসি-র প্রাক্তন অভিনেতা রেগনের চাই-ই চাই।

হোয়াইট হাউসের অন্দরের সাজ, আসবাব, প্রেসিডেন্টের ওভাল অফিস, ঝাড়বাতি, ফায়ারপ্লেস দেখানোর পর গাইড হাতঘড়ির দিকে তাকালেন। সময় ফুরিয়ে আসছে। তড়িঘড়ি যাওয়া হল বিশাল লনে। এমনিতেই ওয়াশিংটন শহরে সবুজ বেশি। আর হোয়াইট হাউস যেন সবুজে ভরা বনানী। গাছের সারিতেই তৈরি হয়েছে পাঁচিল। প্রেসিডেন্ট’স পার্কে গাছের মেলা দেখে আমি অবাক। বিশেষ করে ওক গাছ। সব গাছের নাড়িনক্ষত্র তরুণী গাইডের নখদর্পণে।

গার্ডেনের মধ্যে ছোট ছোট পরিসর, এক-একটা গাছ প্রাক্তন প্রেসিডেন্টদের নামে। লনের এক জায়গায় ছোট একটা টেবিল ও দুটো চেয়ার দেখিয়ে গাইড বললেন, ‘এখানে বসতেন প্রেসিডেন্ট কেনেডি ও ফার্স্ট লেডি জ্যাকলিন। জ্যাকলিনের বড় সাধের জায়গা ছিল এটা।’

পাঁচ ঘণ্টা শেষ হতে আর মাত্র কয়েক মিনিট। হোয়াইট হাউসের আনাচকানাচ ঘুরে দেখলাম, কিন্তু শুধু ছবি ছাড়া জর্জ ওয়াশিংটনের স্মৃতি-বিজড়িত আর কিছু নেই কেন? জিজ্ঞেস করতেই তরুণী আঙুল দিয়ে একটা সাদা মিনার দেখালেন। হোয়াইট হাউসের বাইরে, তবে লন থেকে দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। ‘ওটা ওয়াশিংটন মনুমেন্ট। শহরের শুধু নয়, সাড়ে পাঁচশো ফুটেরও বেশি উঁচু ওই মিনার গোটা আমেরিকার, গণতন্ত্রের গর্ব।’ তরুণী যোগ করলেন, ‘আমরা পুরনোদের কাউকে ভুলি না। আর গণতন্ত্রের দিশারীকে ভুলব কেমন করে?’ ওঁকে বললাম, ব্রুকলিনে জে এফ কেনেডি হাই স্কুলে রেক্টরের ঘরের সামনে তিনটে ব্রোঞ্জ মূর্তি দেখেছি। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, কেনেডি ও আমাদের মহাত্মা গাঁধীর। গাইডের মুখে আবার খুশির ঝলক, ‘ও! ইউ আর ফ্রম গ্যাঁধীজ ক্যান্ট্রি!’

হাত মিলিয়ে বললেন, ‘তোমার সময় শেষ। এ বার গেট বন্ধ হয়ে যাবে। এই নাও তোমার জন্য ছোট্ট উপহার। হোয়াইট হাউসের নিজস্ব জিনিস।’

হোয়াইট হাউসের ফুলবাগানের একটা লাল গোলাপ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

White House
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE