Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ধা রা বা হি ক র হ স্য উ প ন্যা স

স্বাধীনতা তুমি...

লো কটি কে, কোথা থেকে আসছিল, কিছুই বোঝা গেল না! সবচেয়ে আশ্চর্য, মানুষটার মৃত্যু। টিটি ভদ্রলোক পরে বললেন গুলি লেগেছিল। কিন্তু গুলিটা এল কোথা থেকে? কম্পার্টমেন্টের মধ্যে কেউ কোনও রকম গুলি চালায়নি, এ বিষয়ে নিশ্চিত অর্ণব।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

সঞ্জয় দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

• (গত সংখ্যার পর) •

লো কটি কে, কোথা থেকে আসছিল, কিছুই বোঝা গেল না! সবচেয়ে আশ্চর্য, মানুষটার মৃত্যু। টিটি ভদ্রলোক পরে বললেন গুলি লেগেছিল। কিন্তু গুলিটা এল কোথা থেকে? কম্পার্টমেন্টের মধ্যে কেউ কোনও রকম গুলি চালায়নি, এ বিষয়ে নিশ্চিত অর্ণব। কোনও আওয়াজ সে শোনেনি।

ঘটনাটা এতটাই নাড়া দিয়েছিল তাকে, যে কলকাতায় এসে নিজে উদ্যোগ নিয়ে সে মৃত ব্যক্তির খোঁজ করার চেষ্টা করেছিল। স্কুলে তার সহপাঠীদের মধ্যে অনিরুদ্ধ আইপিএস অফিসার হয়েছে, এটা সে জানত। তাদের ব্যাচের রিইউনিয়নে দেখা হয়েছে বেশ কয়েক বার। লন্ডনেও এক বার গিয়েছিল অনি।

এত দিন পরে হঠাৎ তার ফোন পেয়ে বেশ অবাকই হয়েছিল কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি কমিশনার অনিরুদ্ধ কর।

‘আরে অর্ণব? সিবিএস-এর অর্ণব? মানে দাদু?’

‘হ্যাঁ রে, সে-ই!

‘বলিস কী রে? সেই দু’বছর আগে রিইউনিয়নে দেখা হয়েছিল। তার পর তো তোর আর পাত্তাই নেই। এখনও কি লন্ডনে? কবে এলি?’

‘শোন, তোর সঙ্গে একটু দেখা করা যায়? একটা সামান্য দরকার ছিল। খুব জরুরি কিছু না অবশ্য, তুই ব্যস্ত থাকলে...’ একটু কিন্তু-কিন্তুই করছিল অর্ণব।

‘ব্যস্ত? কী যে বলিস? তুই এসেছিস, দেখা করব না? দাদু তুমি কী ভেবেছ, আমরা সব বদলে গেছি?’

সে দিনই দুপুরে ক্যালকাটা ক্লাবে লাঞ্চ খাওয়াতে অনিরুদ্ধ বদ্ধপরিকর। কিন্তু মধ্যাহ্নভোজে বসে অর্ণবের কথা শুনে একেবারে উড়িয়ে দিল অনিরুদ্ধ।

‘কী সব বলছিস, দাদু? একটা জলজ্যান্ত লোক ট্রেনে যেতে যেতে দুম করে মরে গেল! তাও আবার গুলি খেয়ে! কিন্তু কেউ গুলি করেনি! এ সব কী বলছিস রে?’

‘আরে তুই একটু খোঁজই নে না গুরু, গত পরশু, মানে আঠারোই জুলাই, চিত্তরঞ্জন স্টেশনে কেউ মারা গেছে কি না। মানে ট্রেন থেকে কোনও ব্রট ডেড কেস আছে কি না। থাকলে সে লোকটা কে?’

‘কে তুই জেনে কী করবি?’

‘নিছক কৌতূহলই বলতে পারিস। এত কাছ থেকে এ রকম মৃত্যু আগে তো কখনও দেখিনি!’

‘লোকটা মারা গেছে? তুই ঠিক জানিস?’

‘খোঁজ নে না একটু। কেউ মারা গেছে কি না?’

‘খোঁজ নেওয়া মানে জিআরপি তো আবার ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ, ক্যালকাটা পুলিশ নয়! তবে ইনফরমেশন বার করা অবশ্য কঠিন হবে না। ঠিক আছে দেখছি।’

কথা রেখেছিল অনি। দিন দুয়েক পরে ফোন করেছিল তাকে।

‘শোন, ওই দিন, আঠেরো তারিখ, চিত্তরঞ্জনে একটা ডেডবডি নেমেছিল ঠিকই। পূর্বা এক্সপ্রেস থেকে। তুই কি ওই ট্রেনেই ছিলি?’

‘হ্যাঁ।’

‘লোকটাকে দেখেছিলি ভাল করে?’

‘ভাল করে মানে?’

‘ভাল করে মানে, লোকটা হিজড়ে টের পাসনি? তোমার তো দাদু হিজড়ে দেখে না চিনতে পারার কথা নয়! এক যদি চোখের মাথা না খেয়ে থাকো! হেঃ হেঃ।’

‘কী?’

‘আরে যে মারা গেছে!’

‘হ্যাঁ, সে কে?’

‘কে এখনও কেউ জানে না দাদু, কিন্তু লোকটা হিজড়ে!’

‘বলিস কী!’

‘কেন হিজড়েরা ট্রেনে যাতায়াত করে না? যাক তোর কৌতূহল মেটাতে পারলাম তো? শোন, পরের বার এলে অবশ্যই যোগাযোগ করবি কিন্তু। ভাল করে গ্যাঁজাব!’

ব্যাপারটা ওখানেই ছেড়ে দিয়েছিল অর্ণব। আর কীই বা সে করতে পারে? কিন্তু ওই নিথর দৃষ্টিটা কিছুতেই তার পিছু ছাড়ছে না।

‘অ্যানাদার হুইস্কি, স্যর?’

আবার সেই সুন্দরী মেয়েটি। একটু ইতস্তত করছে অর্ণব। আর খাওয়া উচিত হবে না বোধহয়! মাথা ধরে যেতে পারে। পরমুহূর্তেই মনে হল, হুইস্কি পেটে পড়লে সেই মুখটা সরে যাবে হয়তো! সে দিন থেকে মুখটা ভুলতে পারেনি অর্ণব। অজস্র বলিরেখার মধ্যেও কেমন একটা পেলব কমনীয়তা! চোখের দৃষ্টিটা বিস্মিত, বেদনার্ত, তার পরেই এক লহমায় নিথর হয়ে গেল!

‘ইয়েস, হোয়াই নট?’ নিজেকে বলতে শুনছে অর্ণব।

‘দ্য সেম, স্যর? উইথ আইস?’ মেয়েটির হাসিটা এখনও টাল খায়নি একটুও।

‘ইয়েস প্লিজ। বাই দ্য ওয়ে, টয়লেটটা কি ফ্রি আছে?’

প্রশ্নটা করতে করতেই বাঁ দিকের হাতলের উপর ভর দিয়ে আসন ছেড়ে উঠতে গেল অর্ণব। আর তখনই আবার রন্ধ্রে রন্ধ্রে তীব্র আকস্মিকতায় ছড়িয়ে পড়ল বেদনা। বাঁ হাতের কবজি আর কনুইয়ের ঠিক মাঝামাঝি একটা জায়গা যেন দপদপ করে উঠল! বাঁ হাতের ওই অংশটা বেশ ক’দিন ধরেই একটু ফুলেছে। একটা জায়গায় কালশিটে পড়েছে। ব্যথায় কুঁকড়ে গেল সে।

‘কী হল স্যর?’

বিমানবালিকার উদ্বিগ্ন প্রশ্নে শুধু মাথা নেড়ে জানাল অর্ণব, সে ঠিক আছে। কথা বলার অবস্থায় তখন সে নেই।

একটু একটু করে ব্যথাটা সরে যাচ্ছে। নাঃ, ফিরেই ডক্টর গ্যাবির কাছে যেতে হবে। কী যে হল! এই যাত্রায় যেন কেমন সব গোলমাল হয়ে গেল! জিংক্সড। কাজের কাজ কিছু হল না। একটা অদ্ভুত রকমের ভয়াবহ মৃত্যু দেখতে হল চোখের সামনে।

আজ ফেরার পথেও কী বিপত্তি! কলকাতা বিমানবন্দরে সিকিয়োরিটি চেক সেরে আন্তর্জাতিক উড়ানের যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত মেটাল ডিটেক্টরের মধ্যে পা দেওয়ামাত্রই লাল বাতি জ্বলে উঠল। যত বারই সে মেটাল ডিটেক্টর বসানো দরজার মধ্যে দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করে, তত বারই একই বিপত্তি— লাল বাতি জ্বলে উঠছে, বাঁশি বেজে উঠছে। মানিব্যাগ, বেল্ট, কলম, ঘড়ি, সব কিছু খুলে রেখেছে সে। এমনকী জুতো, কাফলিঙ্কসও খুলে ফেলল। তাও বাতি নেভে না। বাঁশি থামে না।

চার বার চেষ্টা করার পর, তাকে আলাদা একটা ঘরে নিয়ে গেল পুলিশের দুজন কর্মী। সব কিছু খুলে ফেলে প্রায় স্ট্রিপ সার্চ করে তবে ছাড়া হল তাকে। ব্যবসার কাজে প্রতি মাসেই দু’-এক বার অন্তত বিমানযাত্রা করতে হয় অর্ণবকে, ইউরোপের এদিক-সেদিক। কখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা দুবাই। এ রকম কখনও হয়নি তার আগে। এ ধরনের অভিজ্ঞতার কথা অন্যদের কাছে শুনেছে অর্ণব, কিন্তু এটা যে ঠিক কতটা বিরক্তিকর হতে পারে, নিজে সে অবস্থার মুখোমুখি না হলে বোঝা যায় না।

হুইস্কি চলে এসেছে। বড় একটা চুমুক দিল অর্ণব। বাবার মুখটা মনে পড়ছে তার। বাবা কেন ওই লোকটির কথা জানতে চাইলেন? কলকাতা ফিরে সে বাবার ফোন পেয়েছিল, হরিদ্বার থেকে। কানেকশন ভাল নয়। যেটুকু কথা হয়েছিল, তার ফাঁকেই বাবাকে ওই অদ্ভুত মৃত্যুর কথাটা জানিয়েছিল অর্ণব। তখনও সে বেশ নাড়া খেয়ে আছে।

মৃত্যুচিন্তা বাবাকে ভাবাচ্ছে। বাবা নিজেই লিখেছেন এ কথা। বয়স তো হল। অবশ্য ছিয়াশি বছর বয়সেও বাবার স্বাস্থ্য নিটোল। তাতে কী? মৃত্যু কি স্বাস্থ্যের তোয়াক্কা করে? না কি জানান দিয়ে আসে? ওই লোকটিকে কি জানান দিয়েছিল, মৃত্যু? প্রস্তুত হওয়ার এতটুকু সময় দিয়েছিল?

মৃতদেহ নামানোর সময় সেখানে ছিল না অর্ণব। তার আগেই সে নিজের জায়গায় ফিরে এসেছিল। কিন্তু শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কামরার নীলচে কাচের জানলা দিয়ে সে দেখেছিল, কয়েক জন ধরাধরি করে মানুষটাকে নিয়ে যাচ্ছে স্ট্রেচারে করে। ধবধবে সাদা চাদরে সবটা ঢাকা। শুধু চাদরের তলা থেকে বেরিয়ে আছে দুটি পায়ের পাতা!

অনেক ক্ষণ তাকিয়ে ছিল অর্ণব!

অনি বলল, লোকটা নাকি হিজড়ে! কিন্তু হিজড়েরও তো নিশ্চয়ই একটা নাম আছে? পরিচয় আছে? না কি তার শেষ পরিচয়, শুধুই সাদা চাদরের তলা থেকে উঁকি মারা শীর্ণকায়, কালো কালো দুটি পায়ের পাতা?

বিষণ্ণতার রামধনু রং

‘হিজড়ে বলে কি আমরা মানুষ না? কী করত তোকে? তুই ভয় পেলি কেন?’

রেগে গেলে রত্নার মেজাজের পারদের সঙ্গে সঙ্গে গলার স্বরও চড়তে থাকে। সেই সময় তার সামনে কেউ দাঁড়াবার সাহস পায় না। সিলেট তো শিশু!

‘বুলাকিদা না থাকলে কোথায় থাকতিস তুই, বাঞ্চোত? ও-ই তো তোকে বর্ডার পার করে নিয়ে এসেছিল! বল শালা, চলে এলি কেন? বল! কথা না বললে তোর গাঁড় ফাটিয়ে দেব শালা।’

আজ সকাল থেকেই রত্নার মেজাজ সপ্তমে। আজ বৃহস্পতিবার, আজও তার পাসপোর্ট আসেনি। এ দিকে ছ’দিন পরেই তার ফ্লাইট। কলকাতা থেকে দুবাই, দুবাই থেকে ভিয়েনা, ভিয়েনা থেকে এলএ। এলএ শব্দটা নতুন শিখেছে সে। যারা আমেরিকায় থাকে তারা লস অ্যাঞ্জেলেস বলে না। বলে এলএ। আমেরিকায় আগে দু’বার গেছে রত্না। দু’বারই নিউইয়র্ক, শিকাগো হয়ে এলএ। তাই এ বার অন্য রুট। বারে বারে একই রুটে যাতায়াত করায় ঝুঁকি আছে, তাই এ লাইনে তাদের রুট বদল হয় মাঝে মাঝেই। কাজের ধরনটা অবশ্য বদলায় না।

প্রত্যেক জায়গায় রঘুনন্দনজির লোক ফিট করা থাকে। এয়ারপোর্টের নিরাপত্তাবেষ্টিত এলাকাটা থেকে বেরিয়ে এলেই দেখা যায়, রত্না পাল নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে কেউ না কেউ অপেক্ষা করছে। সেই লোক গাড়িতে করে তাকে হোটেলে ছেড়ে দেয়। গাড়িতেই তার হাতে মাল ডেলিভারি করে দেয় রত্না। প্রত্যেকটা হল্টে আলাদা আলাদা প্যাকেট। সব কিছু ভাল করে বুঝে নিতে হয় রঘুনন্দনজির অফিসে অঘোরনাথ রায় বলে যে ভদ্রলোক কাজ করেন তাঁর কাছ থেকে। কোনও ভাবে যদি মাল উলটোপালটা হয়ে যায় তা হলে রঘুনন্দনজির লক্ষ লক্ষ টাকা লোকসান হয়ে যেতে পারে। দুবাইয়ে যে মাল ডেলিভারি হওয়ার কথা, সেই মাল যদি ভুল করে নিউইয়র্কে নিয়ে চলে যায়, বা নিউইয়র্কের মাল শিকাগোতে, তা হলে শুধু যে টাকাপয়সার বিরাট ক্ষতি তা-ই নয়, বড় রকমের সিকিয়োরিটি রিস্ক ঘটে যেতে পারে। ‘সিকিয়োরিটি রিস্ক’ কথাটা অঘোরবাবু প্রায়ই বলেন। আগে কথাটার মানে বুঝত না রত্না। এখন বোঝে। এ লাইনে এটা খুব চালু কথা। সকলকেই মাথায় রাখতে হয় সিকিয়োরিটি রিস্ক-এর ব্যাপারটা। মাল বেহাত হলেই ‘সিকিয়োরিটি রিস্ক’।

মাল মানে ছোট ছোট মুখ বন্ধ করা প্লাস্টিকের প্যাকেট। ভিতরে সাদা সাদা গুঁড়ো। নানা জাতের মাদক। ক্র্যাক, হেরোইন বা এলএসডি। প্রতিটি প্যাকেটের আলাদা আলাদা হিসেব আছে। কোনটা কতটা পরিস্রুত মাদক, তার উপর তার দাম নির্ভর করে। এ সবই এ লাইনে এসে একটু একটু করে শিখেছে রত্না।

প্যাকেট জায়গা মতো পৌঁছে দিতে পারলেই হাতে হাতে মোটা অঙ্কের অর্থপ্রাপ্তি। ভারতীয় টাকা নয়, ডলার। এই ডলারও যে আবার নানা দেশের হয়, সেটাও এই লাইনে এসেই শিখেছে সে। তার পছন্দ ইউএস ডলার। যে কোনও দেশে চলে, যে কোনও এয়ারপোর্টে ভাঙানো যায়, কলকাতাতেও যারা হাওয়ালার ব্যবসা করে তারা ইউএস ডলারেই সবচেয়ে ভাল রেট দেয়। প্রথম যে বার মেলবোর্নে মাল নিয়ে গিয়েছিল রত্না, সে বারে না বুঝে অস্ট্রেলিয়ান ডলারে পারিশ্রমিক নিয়েছিল। এখন আর সে ভুল করে না। দুবাই, আবুধাবি, লেগোস, যেখানেই হোক, সে সব সময় দাবি করে ইউএস ডলার। কেউ যদি অন্য কোনও মুদ্রায় তাকে পারিশ্রমিক দিতে চায়, সে নেয় না। বলে, কলকাতায় গিয়ে রঘুনন্দনজির কাছ থেকে পেমেন্ট বুঝে নেবে। রঘুনন্দনলাল কেদিয়া এ লাইনের রাঘববোয়াল। সবাই নাম জানে। সবাই ভয় পায়। রঘুনন্দনজির নাম করলে মন্ত্রের মতো কাজ হয়। কেউ আর গাঁইগুঁই করে না। ডলারে পেমেন্ট মিটিয়ে দেয়।

তবে এর উলটো দিকটাও আছে। সিকিয়োরিটি রিস্ক। রত্না জানে, সারা দুনিয়া জুড়ে মাদক চোরাচালানের যে কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা, তার মধ্যে সে যে কাজটা করে সেটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। এই লাইনে তার মতো লোকেদের নাকি বলে ড্রাগ মিউল্‌স— মাদকবাহী খচ্চর! এ কথাটাও লাইনে এসেই শেখা। কথাটা প্রথম শুনে সে খুব রেগে গিয়েছিল। কিন্তু রাগ করে হবেটা কী? পৃথিবীর যে কোনও বিমানবন্দরে ড্রাগ হাতে ধরা পড়লে তার শাস্তি সাংঘাতিক। কোনও কোনও দেশে মৃত্যুদণ্ড অবধারিত। যেমন ইন্দোনেশিয়া, ইরান, আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে। যে সব দেশে মৃত্যুদণ্ড হবে না, সেখানেও অন্তত পঁচিশ-তিরিশ বছরের জেল। মানে বাকি জীবনটা কোনও বিদেশ-বিভুঁইয়ে কারাগারের অন্তরালে। যে ক’দিন সে বেঁচে থাকবে, সূর্য উঠতে দেখবে না আর কোনও দিন। কোথায় সে হাপিস হয়ে গেল, কেউ টেরও পাবে না! অঘোরবাবু বলেই দিয়েছেন, এ লাইনে ফেলো কড়ি মাখো তেল। মাল ঠিকমত পৌঁছে দিলে হাতে গরম টাকা। কিন্তু ধরা পড়িলে কোম্পানি দায়ী নহে। তখন তুমি একা!

মাঝে মাঝেই ভেবেছে রত্না, এ লাইন ছেড়ে দেবে। মুশকিল হল টাকার অঙ্কটা। মাসে দুটো ট্রিপ করতে পারলেও হেসেখেলে চার-পাঁচ হাজার ডলার! তিনটে বা চারটে ট্রিপ মেরে দিতে পারলে তো কথাই নেই! মাসে দশ হাজার ডলার পর্যন্তও আয় করেছে সে! তাই পাসপোর্ট না আসাটা ঝামেলা। কোনও ভাবে বুধবারের ফ্লাইট না ধরতে পারলে রঘুনন্দনজি ভীষণ অসন্তুষ্ট হবেন। ফলে তার কাজ পাওয়াও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। নতুন পাসপোর্টের কোনও দরকারই ছিল না রত্নার, তার পাসপোর্টের মেয়াদ আছে আরও পাঁচ বছর। কিন্তু গত তিন-চার বছর এত ঘুরেছে সে, যে পাসপোর্টে আর ভিসা স্ট্যাম্প বসানোর পাতা খালি ছিল না! তাই দেড় মাস আগে নতুন পাসপোর্টের আবেদনপত্র জমা দিয়েছিল রত্না, এক রকম বাধ্য হয়েই! কম দিন তো হল না তার এই কাজে! পাঁচ বছরেরও বেশি বোধহয়! তার জীবনের অন্য অনেক কিছুর মতোই এ পথের দিশা দিয়েছিল বুলাকিদা। বুলাকিলাল।

বুলাকিদার কথা মনে হতেই রত্নার মনে হল, একটা খাঁ-খাঁ করা শূন্যতা এখুনি যেন গ্রাস করে ফেলবে তাকে। এখুনি একটা কিছু করা দরকার! এদিক-ওদিক তাকাতে গিয়েই আবার চোখ পড়ল সিলেটের দিকে। দরজার কাছে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে! দেখেই দপ করে জ্বলে উঠল রত্না।

‘কী রে শুয়ার, মুখ দিয়ে শালা বাক্যি সরছে না তোর? বুলাকিদাকে কোথায় নিয়ে গেছে?’

‘জানি না, দিদি। রেলের লোকেরা নামিয়ে নিয়ে গেল।’

‘বুলাকিদা মারা গেছে, তুই ঠিক দেখেছিস?’

সিলেট চুপ। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। সিলেটের নাম দিয়েছিল বুলাকিদাই। বাংলাদেশ থেকে ফেরার সময় এক বার বর্ডার পার করে নিয়ে এসেছিল আট বছরের একটা বাচ্চাকে। ওর বাড়ি নাকি সিলেটে। হিজড়ে হয়ে জন্মেছে, এটা বুঝতে পারার পর মা-বাবা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। বুলাকিদা ওকে ঢাকার রমনা পার্কে খুঁজে পায়। সন্ধের অন্ধকারে পার্কের একটা গাছতলায় বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল। দু’দিন কিছু খেতে পায়নি। সেই থেকে সিলেট বুলাকিদার কাছে।

‘কোন স্টেশনে নামিয়েছে বুলাকিদাকে?’

‘চিত্তরঞ্জন।’

‘চিত্তরঞ্জনেই মারা গেছে?’

‘না, একটু আগে।’

‘একটু আগে? আগে মানে?’

‘চিত্তরঞ্জন আসার আগেই ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল অনেক ক্ষণ। সিগনাল ছিল না বোধহয়। তার পর যেই চলতে শুরু করল, বুলাকিদাও পড়ে গেল!’

‘পড়ে গেল? পড়ে গেল মানে? ট্রেন থেকে পড়ে গেল?’

‘না, ট্রেনের ভিতরে।’

‘ট্রেনের ভিতরে? ভিতরে কোথায়? বুলাকিদা কি দাঁড়িয়ে ছিল, অতটা রাস্তা?’

‘না, দরজার কাছে বসে ছিল। ট্রেন চলতে পড়ে গেল।’

‘তুই কোথায় ছিলি?’

‘আমি কামরার ভিতরে ছিলাম, সিটে। বুলাকিদা বলল গরম আছে। তাই দরজায় গিয়ে বসল।’

ছেলেবেলা থেকে এক দল বিহারি ছেলেমেয়ের সঙ্গে সিলেটও ছিল বুলাকিলালের আশ্রিত। তাদের সঙ্গে থেকে থেকে সিলেটের বাংলায় দেহাতি টান।

‘তার পর কী হল?’

‘তার পর শোর মচাল সবাই। চেন টানল। গার্ডবাবু এসে বলল, বুলাকিদা মরে গেছে।’

‘গার্ডবাবু জিজ্ঞেস করল না এর সঙ্গে কেউ আছে কি না?’

‘করল তো।’

‘তুই চুপ করে ছিলি! তাই তো?’

সিলেট নিরুত্তর। অধোবদন। মেঝের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

‘কী রে! তাই তো? চুপ করে ছিলি। এই বুলাকিদা তোকে মানুষ করেছে। খেতে দিয়েছে। পরতে দিয়েছে। এ বাড়িতে থাকতে দিয়েছে তোকে! তুই চুপ করে ছিলি?’

• (ক্রমশ) •

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mystery novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE