Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ছোটগল্প

প্রফুল্লময়ী চপ ভাণ্ডার

সবাইকে দিচ্ছি দেব বলে প্রবোধ দেয় গৌরহরি। কর্মচারীদের দ্রুত হাত চালাতে বলে। তখনও একই সঙ্গে খেয়াল রাখে, কোনও খদ্দের যেন পাঁচটার বেশি চপ-বেগুনি-ফুলুরি বা কুমড়ি নিয়ে চলে না যায়।

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছবি: রৌদ্র মিত্র

অনীককুমার সাহা
শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৭ ০৯:৪০
Share: Save:

বেনিয়াদিঘি গঞ্জের বাজার রবিবার আর শুক্রবার জমজমাট। শুধু আশেপাশের পাঁচ-ছয়টা গ্রাম থেকেই নয়, দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকেও এই গঞ্জে ব্যবসাদার খরিদ্দাররা আসে। দর-দাম হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকিতে কান পাতা দায়। বাজারের সর্বত্র খদ্দেরের ভিড়, তবে সবচেয়ে বেশি ভিড় সবজিপট্টির শেষের গুমটি দোকানে। এটা গৌরহরির তেলেভাজার দোকান। দোকানের সামনে খদ্দেরের ভিড় অন্যান্য দোকানদারদের ঈর্ষা জাগানোর পক্ষে যথেষ্ট। কোনও খদ্দের সওদাপাতি শেষ করে গৌরহরির তেলেভাজা-মুড়ি খেয়ে বাস ধরার তাড়ায়, আবার কোনও কোনও খদ্দের এইমাত্র বাজারে এসে আগেই গৌরহরির দোকানে খাবার পাট চুকিয়ে নিতে চায়। সবারই তাড়া। কেউ চিৎকার করে, ‘‘দু’টো বেগুনি আর চার টাকার মুড়ি দাও।’’ কেউ চায়, ‘‘দুটো চপ, দু’টাকার মুড়ি।’’ কেউ বা চায় শুধুই ফুলুরি।

সবাইকে দিচ্ছি দেব বলে প্রবোধ দেয় গৌরহরি। কর্মচারীদের দ্রুত হাত চালাতে বলে। তখনও একই সঙ্গে খেয়াল রাখে, কোনও খদ্দের যেন পাঁচটার বেশি চপ-বেগুনি-ফুলুরি বা কুমড়ি নিয়ে চলে না যায়। তার দোকানের এটাই দস্তুর। হাটে আসা আধ-চেনা খদ্দেররা গৌরহরিকে প্রলোভন দেখায়, কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, ‘‘না হয় ডবল দাম দেব, এক্সট্রা গোটা চারেক চপ বেগনি কি হবে না?’’ ক্ষণিকের জন্য গৌরহরির মনে উপরি লাভের ইচ্ছে জেগে ওঠে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই চপের মশলার ওস্তাদের সতর্কবাণী মনে পড়ে যায়, ‘‘লাভ করতে চাও তো কাউকে একসঙ্গে পাঁচটার বেশি মাল বেচবে না। লোভ করেছ কি তোমার ব্যবসা শেষ।’’ বাসস্ট্যান্ডের ঝাপসা আলোয় ওস্তাদের সেই কথা আজও বর্ণে বর্ণে অনুসরণ করে চলে গৌরহরি। কোনও খদ্দেরকেই গৌরহরি পাঁচটার বেশি তেলেভাজা দেয় না। সে যতই বেশি দাম দিক না কেন, কিংবা সে যতই পরিচিত হোক না কেন। তার এই সততা খদ্দেরকে মুগ্ধ করে। ফলে খদ্দেরের কাছে তার দোকানের কাটতি বাড়ে বই কমে না। মুড়ির বস্তা, আলুর চপের ঝুড়ি, বেগুনির গামলা, ফুলুরির থালা নিমেষে শেষ হয়ে যাচ্ছে, আর সিদুঁর-লেপা কালো ক্যাশবাক্সটা ভরে যাচ্ছে। দু’জন কর্মচারী আর সে নিজে, এই তিন জন মিলেও খদ্দেরদের ভিড় সামাল দিতে পারে না। মনে মনে ভাবে গৌরহরি, আরও দু’জন কর্মচারী রাখতেই হবে, নইলে আর পারা যাচ্ছে না।

গৌরহরির তেলেভাজার দোকানের চারটে দোকান পরেই বিপিনের চপ-মুড়ির দোকান, তারও দু’টো দোকান পরে কুমুদের চপের দোকান। হাটবারে তাদের দোকানেও খদ্দেরের ভিড়, তবে গৌরহরির মতো নয়। বিপিন বা কুমুদের দোকানে সেই সব ক্রেতারাই সাধারণত আসে, যাদের গৌরহরির দোকানের চপ-বেগুনি-ফুলুরি কেনার মতো সময় বা ধৈর্য নেই। ফলে বিপিন ও কুমুদের মনে গৌরহরির প্রতি ঈর্ষা জাগতে বেশি সময় নেয় না। দু’জনে মিলে শলাপরামর্শ করে গোটা চারেক লোক ঠিক করে। হাটবারে তাদের কাজ হবে গৌরহরির দোকানের ক্রেতাদের ভাঙানো এবং তাদের দোকানে নিয়ে আসা। মনে আছে, মাস দুয়েক আগে এক হাটবারে যখন গৌরহরির দোকানের সামনে মাছির মতো খদ্দেরদের ভিড়, ঠিক তখনই ‘‘আরে, আরে! কী করছেন? এই দোকানের চপ খেয়ে মরবেন না কি!’’

ক্রেতারা চমকে ওঠে, ‘‘মরব মানে?’’

‘‘আপনারা তো জানেন না, এই চপ খেলেই শরীর খারাপ হবে। চপ-বেগুনির স্বাদ বাড়াবার জন্য এতে বিষ মেশানো হয়।’’ গৌরহরির দোকানের ক্রেতারা দু’দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য গৌরহরির সমর্থকদেরই জয় হয়। প্রতিবাদীদের নিজের খরচেই ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠিয়েছিল গৌরহরি। তার পর থেকে তার দোকানের মাল নিয়ে কেউ সন্দেহ করবার কথাও ভাবে না। বিপিন আর কুমুদও তাদের মনের ঈর্ষা মনেই রেখে দেয়, প্রকাশ করবার সাহস পায় না।

অথচ বছর তিন আগেও গৌরহরির তেলেভাজার দোকানের ছবিটা এ রকম ছিল না। বিপিন আর কুমুদের দোকানের চেয়ে তার দোকানের অবস্থান ভাল বলে কিছু সুবিধা সে পেতই। তা বলে এমনটা হত না। গৌরহরির মনে আছে, যে সব দিন তার দোকানে চার-পাঁচ কিলো আলুর পুর করতে হত, সে সব দিনই ছিল তার সৌভাগ্যের দিন। আর এখন এমনি দিনেই চার-পাঁচ কিলো আলুর পুরে কুলিয়ে উঠতে পারে না, হাটবারের দিনগুলোয় তো কথাই নেই। পঁচিশ-তিরিশ কিলো আলু তো লাগেই। এখন গৌরহরিকে বাড়িতেই গুদামঘর তৈরি করে আলু, বেগুন, কুমড়ো, তেল, মশলা জমিয়ে রাখতে হয়।

অবসর সময়ে গৌরহরি নিজের অতীতের দিকে চায়। তার তেলেভাজার স্বাদ অন্য দোকানের চেয়ে ভাল করবার জন্য কী-ই না সে করেছে! মালমশলা সব নিজে কিনেছে। গোটামশলা কিনে বাড়িতে এনে ঝাড়াই-বাছাই করে চপের মশলা তৈরি করেছে। নিজের হাতে পুর তৈরি করে চপ গড়েছে। সত্যি বলতে, সে সময়ের চপ এখনকার চপের চাইতে অনেকটাই সুস্বাদু ছিল। অন্তত গৌরহরির তা-ই মনে হয়। ব্যতিক্রম তার ক্রেতারা। এখন গৌরহরি নিজের হাতে প্রায় কিছুই করে না, শুধু পুর তৈরির সময় নিজস্ব গোপন মশলা মিশিয়ে দেয়। এই সময়টায় রান্নাঘরে কারও থাকার অধিকার নেই, এমনকী গৌরহরির স্ত্রী সুধা বা পুত্র সৌগতরও। বাকি সব কাজ কর্মচারীরাই করে, তবু গৌরহরি কাজের চাপে হাঁপিয়ে ওঠে। গৌরহরি ভেবে পায় না, কোনটা সত্যি আর কোনটা স্বপ্ন। বছর তিন আগের জীবন না কি আজকের জীবন।

দোকানের সামনে একটা কোলাহলে গৌরহরির দিবাস্বপ্নের সমাপ্তি ঘটে। তাকিয়ে দেখে, তাদের গ্রামের কয়েকটা অকর্মণ্য ছেলে লাইনে দাঁড়ানো খদ্দেরদের ঠেলে সরিয়ে এগিয়ে আসতে চাইছে। ওদের মধ্যে কয়েক জন সৌগতর বন্ধু। খদ্দেররা অনেক ক্ষণ ধরে গৌরহরির তেলেভাজার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থেকে অধৈর্য হয়ে পড়েছে, তার উপর এই শেষ মুহূর্তে ছেলেগুলোর উপদ্রব। স্বাভাবিক ভাবেই খদ্দেররা তাদের বাধা দিতে চায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! অকর্মণ্য ছেলেগুলো গৌরহরির সামনে উপস্থিত হওয়াকেই তাদের আশুকর্তব্য বলে মনে করে খদ্দেরদের সঙ্গে ঝগড়া করে চলেছে। এ বার গৌরহরিকে হস্তক্ষেপ করতেই হয়। ছেলেদের জিজ্ঞেস করতে তারা জানায়, ‘‘শোনো কাকা, মহালয়ায় আমাদের ক্লাবে বিরাট এক বিচিত্রানুষ্ঠান, নানা রকম প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়েছে। বাইরে থেকে অনেক নেতা-মন্ত্রী আসবে। আমরা বলেছি আমাদের এখানকার স্পেশাল চপ খাওয়াব তাদের। তাই চপের অর্ডার দিতে এসেছি।’’

‘চপের অর্ডার!’ চমকে ওঠে গৌরহরি। চপের আবার অর্ডার! তার মানে সত্যিই তার দোকানের চপ অন্য দোকানের চপের চেয়ে খেতে ভাল হয়! গৌরহরির মন গর্বে ভরে যায়। কোনও রকমে নিজেকে সংবরণ করে বলে, ‘‘মহালয়ার তো এখনও দেরি আছে। সে কথা পরে হবে। আগে তো এই খদ্দেরদের ছাড়ি, তোমরা নাহয় দুপুরের দিকে এস।’’

ক্লাবের ছেলেরা যে ভাবে অতর্কিতে তার দোকানের সামনে আবির্ভূত হয়েছিল, অনেকটা সে ভাবেই অন্তর্হিত হয়। রেখে যায় গৌরহরির তেলেভাজার খদ্দেরদের মনে গভীর বিস্ময় এবং স্বয়ং গৌরহরির মনে গর্বের স্বর্গীয় সৌরভ। দুপুরে তার দোকান দেড়টা নাগাদ বন্ধ হয়। তার একটু আগেই ক্লাবের ছেলেরা এসে তিনশো চপের অর্ডার দিয়ে গিয়েছে এবং গৌরহরিকে ও তার সকল কর্মচারীদের অবাক করে দুশো টাকা অগ্রিমও দিয়ে গিয়েছে।

গৌরহরি ঠিক করে ফেলে, তার দোকানের একটা নাম থাকা উচিত। ছেলে সৌগতর মুখেভাতের সময় টাউনের মিষ্টির দোকানে রসগোল্লা আর কালাকাঁদের অর্ডার দিয়েছিল সে। সুন্দর একটা ছাপানো বিল গৌরহরির হাতে ধরিয়ে মিষ্টির দোকানের মালিক উদাসীনভাবে বলেছিল, ‘‘এই বিলটা দেখালেই মাল রেডি পাবেন।’’ এখন তার দোকানেও অর্ডার পড়ছে। কিন্তু তার তো ছাপানো বিলবই নেই!

সে দিন রাতেই সে ঠিক করে, টাউন থেকে একখানা বিলবই কিনে আনতে হবে। তাদের গঞ্জের কোনও দোকান ছাপানো বিল দেয় না, সে দেবে। বুঝিয়ে দেবে, তেলেভাজা বিক্রি করলেও সে আসলে ব্যবসায়ী। পুর তৈরির কাজ শেষ করেই গৌরহরি বেরিয়ে পড়ে টাউনে। টাউনের মুখচেনা ছাপাখানায় খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে, বইয়ের দোকানে নয়, খাতা-পেনের দোকানে ছাপানো বিলবই কিনতে পাওয়া যায়। সে রকমই একটা দোকানে পৌঁছেও যায়। ছাপানো বিলবই দেখতে চায়। একটা পছন্দও করে। কিন্তু গোল বাঁধে দোকানের নাম নিয়ে। ছাপানো বিলবইতে তো কোনও নাম থাকবে না, অথচ তার তো দোকানের নাম দেওয়া বিলবই চাই। অগত্যা আবার সেই ছাপাখানায়। ‘‘দোকানের নাম কী হবে?’’ ছাপাখানার কর্মীর এই প্রশ্নে গৌরহরি বিব্রত বোধ করে। দোকানের নামকরণ নিয়ে তো সে ভাবেইনি! প্রশ্নকর্তাই তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। এটা-ওটা, অমুক তমুক ভাবার পর গৌরহরির মায়ের কথা মনে পড়ে। ঠিক হয়, মায়ের নামেই হবে তার চপের দোকানের নামকরণ। ‘প্রফুল্লময়ী চপ ভাণ্ডার’। দু’বান্ডিল বিলবই ‘আর্জেন্ট’ অর্ডার দিয়ে গৌরহরি বেরিয়ে পড়ল তার দোকানের একটা সাইনবোর্ড লেখানোর জন্য। সাইনবোর্ডের দোকানে গিয়ে তার অবস্থা আরও সঙ্গিন। কত রকম ডিজাইন, আর কত রঙের লেখা। গুমটি দোকানের সঙ্গে কোনটা যে মানানসই হবে! অনভিজ্ঞ খদ্দেরের অবস্থা বুঝতে পারে দোকানি। সাদামাটা একটা ডিজাইনওয়ালা সাইনবোর্ড গৌরহরি পছন্দ করে। এখানেও তাকে আর্জেন্ট অর্ডারই দিতে হয়। তবে এখন আর টাকার কথা ভাবে না গৌরহরি। শহরে থাকলে চারচাকা গাড়িতে সে ঘুরত। নেহাত গ্রামে থাকে। গ্রামের পাঁচটা লোকের চোখ টাটাবে, তাই ছেলেকে দেড়লাখি বাইক কিনে দিলেও নিজে এখনও সাইকেলেই ঘোরে। সাইনবোর্ডের দোকানদারকে তার দোকানের ঠিকানা, সাইনবোর্ড লেখার মজুরি আর ডেলিভারির দাম চুকিয়ে নিশ্চিন্ত হয় গৌরহরি। যাক, মহালয়ায় তার দোকান নতুন কলেবর লাভ করবে। গুমটি ঘরটা কী ভাবে সুসজ্জিত দোকানে পরিণত করা যায়, সে কথা চিন্তা করতে করতে ফিরতি বাসে বাড়িতে ফেরে গৌরহরি।

একুশ বছর পুরনো স্ত্রী সুধার পাশে শুয়ে বহু রাত পরে আজ গৌরহরি একটু প্রগলভ হয়ে পড়ে। তার শহুরে অভিযান, শহরের অভিজ্ঞতা এবং তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করতে থাকে। বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে পারস্পরিক নৈকট্যও বৃদ্ধি পেতে থাকে। অনেক দিন পরে গৌরহরি সুধার সঙ্গে মিলিত হয়। অনভ্যাসে হাঁপিয়ে ওঠে। তবে শেষ পর্যন্ত সাফল্যের সঙ্গেই ক্রিয়াদি সম্পন্ন করে। এই কর্মকাণ্ডের সফলতা তার কাছে ‘প্রফুল্লময়ী চপ ভাণ্ডার’-এর উজ্জ্বল প্রতিভূ হয়ে দেখা দেয়। নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রব ঘুমে রাত কেটে যায় গৌরহরির।

আজ মহালয়া। গত কালই গৌরহরি তার দোকানের নাম ছাপানো বিলবই পেয়ে গিয়েছে। সাইনবোর্ডও এসে গিয়েছে। সাইনবোর্ড টাঙানোর মিস্ত্রিরা আসবে সকাল সকাল। সবে ছ’টা বাজে। এ বারে গৌরহরি চপের পুর তৈরির কাজে ঢুকে যাবে। আধ ঘণ্টা সময় তো তার লাগবেই। আজ সব কিছুতেই বাড়তি আয়োজনের ব্যবস্থা করে রেখেছ গৌরহরি। একে তো মহালয়া, তায় শুক্রবার। হাটবারের বাজার সরগরম। অন্যান্য হাটবারের চাইতে খরিদ্দারদের সংখ্যা যে প্রায় দ্বিগুণ বাড়বে, সে সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ গৌরহরির নেই। তাই চপের পুর অন্যান্য দিনের চাইতে একটু বেশি যত্ন নিয়েই বানায় সে। তার পর দোকানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে যায়। দোকানের কর্মচারীরা চপের পুর নিয়ে চলে যায় দোকানে, তারাই দোকান খোলে, প্রথম চপটা দেবতার নামে উৎসর্গ করে ফেলে দেয় অগ্নিদেবতার প্রতিনিধি জ্বলন্ত উনুনের মধ্যে। তার পর শুরু হয় বিক্রিবাটা।

ইচ্ছে করেই আজ গৌরহরি দেরিতে দোকানে আসে। কিন্তু এখনও তো সাইনবোর্ডের মিস্ত্রিরা এল না! গৌরহরি ভিতরে ভিতরে অধৈর্য হয়ে ওঠে, কিন্তু প্রকাশ করে না বাইরে। সাড়ে ন’টা বাজতে চলল, এখনও মিস্ত্রিরা এল না। দোকানের সামনে রীতিমত লম্বা লাইন। এতগুলো লোক তার দোকানের সাইনবোর্ড না দেখেই ফিরে যাবে! এতগুলো টাকা কী তবে জলে গেল!

হঠাৎই তার নজরে পড়ে, ক্লাবের ছেলেরা এসে দাঁড়িয়েছে। আজ আর কোনও হুজ্জুতি তারা করে না। দূর থেকেই ইশারায় গৌরহরিকে দুপুরের তিনশো চপের অর্ডারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। গৌরহরিও তাদের আশ্বস্ত করে ইশারায়। এরই ফাঁকে সাইনবোর্ডের মিস্ত্রিরা এসে যায়। শুরু হয় গৌরহরির চপ-গুমটির ভোলবদলের প্রক্রিয়া। ক্রেতাদের ভিড় আজ সাংঘাতিক রকমের বেশি, তা না হলে গৌরহরি তার চপ-গুমটির এই পরিবর্তন স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করত।

বেলা বয়ে যায়। আসে সেই শুভক্ষণ। ক্লাবের ছেলেরা গৌরহরির চপ নিতে আসে ঠিক সাড়ে তিনটের সময়। গৌরহরি তাদের পঞ্চাশটা চপের ছ’টা প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দেয়। প্রতিটি প্যাকেটে ‘প্রফুল্লময়ী চপ ভাণ্ডার’-এর একটা করে বিল লাগিয়ে দেয়। ব্যবসা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান শর্ত হল বিজ্ঞাপন।

সব গুছিয়ে বাড়ি যেতে যেতে তার প্রায় সাড়ে চারটে বাজে। অন্য দিনের চেয়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা দেরি। কিন্তু আজ গৌরহরির শরীরে-মনে কোনও ক্লান্তি নেই, বরং অদ্ভুত এক উদ্যম সে অনুভব করে। বাড়িতে চান-খাওয়া সারতে সারতে প্রায় ছ’টা বাজে। আজ আর ঘুম আসে না সারা দিনের পরিশ্রমের পরেও। দাওয়ায় এসে বসে, সুধাকেও কাছে টেনে নেয়। ঠিক করে, আর একটু রাত বাড়লে সুধাকে সাইনবোর্ডটা দেখাতে নিয়ে যাবে। দূর থেকে গাড়ির সাইরেন শুনতে পায়। কোনও মন্ত্রী-আমলা হবে হয়তো। তার চপ খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে ফিরে যাচ্ছে। সাইরেনের শব্দ মিলিয়ে যেতে না যেতেই আরও একটা কোলাহল তার কানে আসে। কয়েক জন মানুষের চিৎকারের মতো শোনায়। মানুষের চিৎকার ক্রমেই তীব্র হয়। কিন্তু সে দিকে মন দেওয়ার অবসর পায় না গৌরহরি। তার মন জুড়ে এখন শুধুই ঝকঝকে ছাপা বিলবই। চকচকে সাইনবোর্ড।

সুধার কথায় গৌরহরি স্বপ্নলোক থেকে বাস্তবে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। ‘‘শুনছ, বাইরে একটা চিৎকার-চেঁচামেচি হচ্ছে না! মনে হচ্ছে যেন আমাদের বাড়ির দিকেই আসছে!’’ তার বাড়ির দিকে! গৌরহরি সচকিত হয়। ঠিকই বলছে সুধা। কতকগুলো ছেলের সমবেত চিৎকার ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। হঠাৎই কানে আসে ‘সৌগত’ ‘গৌরহরি’ শব্দ দু’টো। গৌরহরি চমকে ওঠে এ বার। কী হল! তাদের নাম ধরে ছেলেরা চিৎকার করছে কেন? এগিয়ে যায় দরজার দিকে। এ বারে স্পষ্ট শোনা যায় ছেলেদের কথাবার্তা। দেখতেও পাওয়া যায় তাদের। দশ-বারোটা ছেলে, আর একটা ছেলেকে প্রায় কোলে করে নিয়ে আসছে। নিয়ে আসছে তাদের বাড়ির দিকেই। মুহূর্তে গৌরহরির মাথা ঘুরে যায়। তবে কী সৌগতর কোনও দুর্ঘটনা ঘটল! অত ভারী মোটরসাইকেল কিনে দেওয়াটাই ভুল হয়েছে। নিশ্চয়ই অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। হাত-পা ভেঙেছে হয়তো। পর ক্ষণেই মনে হয়, কাউকে ধাক্কা মারেনি তো? আজকাল যা শোনে, ভয় লাগে। ভুল যারই হোক, পথচলতি লোকেরা বাইক-আরোহীকেই দোষী মনে করে। সে রকম কিছু নয় তো?

জটলাটা তার বাড়ির সামনে চলে এসেছে। গৌরহরিও এগিয়ে যায়। সুধাও তার পিছন পিছন বেরিয়ে আসে। ঠিকই, ছেলেগুলো সৌগতকেই ধরে আনছে। সৌগতর জ্ঞান নেই। মুখটা কী রকম হয়ে গিয়েছে। ঠোঁটের পাশ দিয়ে গ্যাঁজলা গড়াচ্ছে। বিস্ফারিত চোখদু’টো যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ‘‘কী হয়েছে সৌগতর?’’ আর্তনাদটা গৌরহরির বুক ফেটে বেরিয়ে আসে। ছেলের দল একেবারে চুপ। সবাই এর ওর দিকে তাকাচ্ছে। শেষে বয়েসে বড় একটি ছেলে বলে, ‘‘কাকা, গেস্টদের দেওয়ার পরেও প্রায় চল্লিশটার মতো চপ বেঁচে গিয়েছিল। কে ক’টা চপ খেতে পারবে সেই নিয়ে বাজি ধরা হচ্ছিল। তখন সৌগত একাই কুড়ি-একুশটা চপ খেয়ে নেয়। তার একটু পরেই ওর চোখমুখ কেমন হয়ে যায়। খিঁচুনি হতে থাকে। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলাও বেরোতে থাকে। মাঠেই ভজন ডাক্তার ছিল, সে দেখে বলল, মনে হয় ওর মারাত্মক বিষক্রিয়া হয়ে গিয়েছে। আমরা তাড়াতড়ি করে তোমার কাছে নিয়ে আসছিলাম, কিন্তু পথেই...’’

এক জন কথা বলতে শুরু করায় এখন সবাই একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছে। ভাল করে কিছুই বুঝতে পারে না গৌরহরি। শুধু কানের মধ্যে বাজছে ‘একাই কুড়ি-একুশটা চপ খেয়েছে সৌগত।’ একই সঙ্গে বাজছে চপের পুর তৈরি করা শেখানোর ওস্তাদের সাবধান বাণী, ‘‘কাউকে একসঙ্গে পাঁচটার বেশি মাল বেচবে না। লোভ করেছ কি তোমার ব্যবসা শেষ।’’ ছেলেদের চিৎকারে আশেপাশের বাড়ির লোকজনও বেরিয়ে এসেছে। সবারই প্রশ্ন, সৌগতর কী হয়েছে? কী ভাবে হয়েছে এমন অবস্থা? কোনও শব্দ, কোনও কিছুই গৌরহরির মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে পারছে না। ছেলের এই মর্মান্তিক পরিণতি, স্ত্রীর অসহায় আর্তনাদ, কিছুই সে বুঝতে পারছে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু সৌগতর মৃতদেহের দিকে।

সবাই সৌগতর মৃতদেহ ও পুত্রশোকে অচেতন সুধাকে নিয়ে ব্যস্ত। গৌরহরি চপ-কারখানার ঘরে ঢোকে। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। তার পর ওস্তাদের দেওয়া সাদা গুঁড়োর প্যাকেটটা খুলে পুরোটাই ঢেলে দেয় মুখের মধ্যে। গিলতে কষ্ট হয়, তবু চিবিয়ে চিবিয়ে গিলে ফেলে প্রায় অর্ধেকটা। গৌরহরির হাত-পা অবশ হয়ে আসে, মাথাটা দুলতে থাকে। চোখের সামনে নেমে আসে অন্ধকারের একটা পরদা। আর বেনিয়াদিঘি গঞ্জের বাজারে প্রফুল্লময়ী চপ ভাণ্ডারের নতুন সাইনবোর্ডে আলো জ্বলে ওঠে ঠিক তখনই।

‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে ছোটগল্প পাঠান, অনধিক ১৫০০ শব্দে।
ইমেল: rabibasariya@abp.in সাবজেক্ট: rabibasariya galpa

ডাকে পাঠানোর ঠিকানা:

‘রবিবাসরীয় গল্প’,

আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,

কলকাতা ৭০০০০১

যে কোনও একটি মাধ্যমে গল্প পাঠান। একই গল্প ডাকে ও ইমেলে পাঠাবেন না।
পাণ্ডুলিপিতে ফোন নম্বর বা ইমেল আইডি জানাবেন। ইউনিকোড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE